পর্ব -৭
লাঞ্চ আওয়ারে ক্যান্টিনে চাঁদ আর বৃন্দা । কফি আর স্যান্ডউইচ নিয়ে সবেমাত্র বসেছে, বৃন্দার মোবাইলটা বেজে উঠল ।
বৃন্দা বলল: জাস্ট আ মিনিট…চন্দ্রিমা….সুরম্যর ফোন…
চাঁদ: ..ইটস ও কে….ক্যারি অন….টেক ইওর টাইম….
চাঁদ আশপাশটা লক্ষ্য করছিল….সব পড়ুয়ারা নিজেদের মধ্যে হৈ হৈ করছে …..তার মাঝে মাঝে সুরম্য আর বৃন্দার প্রেমালাপের টুকরো টুকরো কথা । চাঁদ চলে যাচ্ছে তার অতীতে । মনে পড়ে যাচ্ছে কলেজ ক্যান্টিনের কথা ।……জন্মদিনের খাওয়াটা সোহম আসার পরই হয়েছিল , তবে ওরা কেউ বেদুইনে রোল খেতে যায়নি…..ক্যান্টিনে চিকেন মোমো খেয়েছিল । সেদিন বেশ হৈ হৈ করেছিল বন্ধুরা । সোহম বলল “আচ্ছা তোকে আমরা কি উপহার দি বলতো, চাঁদ ?”
চাঁদ : উপহারের প্রয়োজনটা কি আছে? আমি তোদের কাছে এই যে হাসি মজা ভালোলাগাটুকু পেলাম…..তাই তো আমার সেরা উপহার ।
সোহম: দেখ, সত্যি বলতে আমি টিউশানে যা হাত খরচা পাই ….তার সবটাই প্রায় ফোনের এক্সট্রা বিল পেমেন্ট করতে চলে যায়….মা বলে দিয়েছে, মাসে নর্মালই যা ওঠে তাই দেবে….এর বেশিটা আমায় দিতে হবে, যেহেতু ফোন ছাড়া আমার চলে না….তাই হাত আমার সবসময় খালি ।
সৈকত: হাত খরচে আমারও কুলিয়ে ওঠে না….. কিন্তু না…….. তাও তোকে আমাদের কিছু দেওয়াই উচিত ।
…..এতসব আলোচনার মাঝে দীপা আর রঞ্জা চাঁদকে একটা মনিপুরি ওয়ালম্যাট দিল উপহারে ।
রুদ্র : দেখেছিস মেয়েরা কতটা গোছানো হয়….বাঁচালি বটে আমাদের ।
সবাই খুব হাসল । চাঁদ খুব খুশি হয়েছিল ওদের অকপট সারল্যে।
মনে মনে ভেবেছিল সোহমের উপস্থিতিটাই তো তার সবচেয়ে বড়ো পাওয়া । যদিও চাঁদ এখন সোহমকে কিছুটা এড়িয়েই চলে । ফোনে কথা হয় না…একসাথে ফেরার জায়গাটাই রাখতে চায় না ….আগে আসে আর আগে আগেই কলেজ থেকে বেরিয়ে যায় …..সোহম বুঝতে পারে সবই কিন্তু কিছুই প্রশ্ন করে নি কখনও । এরই মাঝে ওদের ক্যাম্পাস ইন্টারভিউ হয়েছে …..রুদ্র আর সোহম এল. এন. টি তে চান্স পেয়েছে…আর সৈকত গ্রুপ থেকে ছিটকে গেল ই.আই.এল এ।
এইভাবে কেটে গেল বেশ কিছু সময় । হঠাৎ একদিন বাসে মুখোমুখি সোহম আর চাঁদ ।….চাঁদ গড়িয়াহাট গিয়েছিল দীপার সাথে টিফিনের সময় ….আর ভালো লাগছিল না ক্লাস করতে….দীপাকে অটোতে তুলে , ধর্মতলার বাসে উঠেই দেখে সোহম ….ব্যস আর যায় কোথায় ?
সোহম: কিরে আমার পাশের সিটটা তো ফাঁকা ….তাও পরেরটায় বসলি?
চাঁদ: না….গরম লাগছে …তাই জানলার ধারটা খুঁজছিলাম….বাস তো ফাঁকা !
সোহম উঠে গিয়ে পিছনে চাঁদের পাশে বসল ।
সোহম: আমায় এড়িয়ে চলছিস চাঁদ !!!
চাঁদ: (একটু ইতস্তত করে ) না, সেরকম কিছু না….তবে….
সোহম: কি তবে?
চাঁদ: তুই তো চেয়েছিলি যাতায়াতটা বন্ধ হোক ।
সোহম: হুম ….মুখে অবশ্যই বলেছিলাম কিন্তু মন থেকে চাই নি ।
চাঁদ : ও ….(চুপ করে রইল বেশ কিছুক্ষণ )
সোহমকে চুপ থাকতে দেখে চাঁদ বলল…” যা হোক , সব ঠিকঠাক আছে তো ? “
সোহম: হুম….তবে রঞ্জার সাথে একটু সমস্যা হয়েছে ।
চাঁদ: রঞ্জাদিকে নিয়ে আবার কি হল?
সোহম: তুই ওর সাথে একটু কথা বলবি?
চাঁদ: কি হয়েছেটা কি?
সোহম: রঞ্জার পুজোর ছুটিতে বাড়ি যাবার কথা…কিন্তু এর মাঝে শুনলাম ইন্দ্রদা ওর সাথে যোগাযোগ করেছিল ।
চাঁদ: তো!!
সোহম: না….আমার ধারণা ছিল ও ইন্দ্রদাকে এন্টারটেইন করবে না….কিন্তু এখন মনে হচ্ছে আমি ভুল….ও এখনও মনে মনে ওই জায়গাটায় বেশ দুর্বল ।
চাঁদ: এমন মনে হল কেন তোর? রঞ্জাদি কিছু বলেছে? কারণ আমি ওকে যতটুকু বুঝেছি তোর প্রতি ও যথেষ্ট দায়বদ্ধ….
সোহম: না আমি এ ব্যাপারে কিছুই বলি নি ….কিন্তু ও কেমন যেন ধীরে ধীরে শীতল হয়ে যাচ্ছে চাঁদ ….একটু যেন উদাসীনও ….আমি ঠিক বুঝতে পারছি না কি করব….ও যা চাইবে তাই হবে….কিন্তু ও কি চায় সেটা বলুক তো নিজের মুখে…. ।
চাঁদ: ঠিক আছে আমি কথা বলব রঞ্জাদির সাথে ।
সোহমকে চুপ করে থাকতে দেখে চাঁদ একটু সহজ হওয়ার চেষ্টা করে বলে….” ইন্টারভিউ তো হল, ট্রেনিং কোথায় পড়বে ?
সোহম: জানি না…ফার্স্ট লিস্টে নাম আছে…ওরা একশো পঁচিশ জনের মধ্যে দশ জনকে একেবারে কনফার্মেশন লেটার দেবে…দেখি কোথায় হয়…দূরে হলে মাকে নিয়ে চিন্তা !
চাঁদ বুঝতে পারছিল , যে কঠিন বর্মটা সে তৈরি করে রেখেছিল সেটা ধীরে ধীরে ভেঙে যাচ্ছে ….তার খুব ইচ্ছে করছিল তার নিজের ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞেস করুক সোহম। সোহমের আনত মুখের দিকে তাকিয়ে তার মনে হচ্ছিল ,সোহম যেন একটু ক্লান্ত ….একটু অসহায় ….চাঁদের মন চাইছিল তার মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দিতে ….একদৃষ্টে চাঁদ চেয়েছিল সোহমের দিকে…দেখছিল তার চওড়া কপাল , টিকালো নাক, চশমার ফাঁকে আনত চোখ, বলিষ্ঠ চোয়াল….পাতলা ঠোঁট ….জলে ভরে যাচ্ছিল চাঁদের চোখদুটো….জোড় করে চাঁদ মুখটা ফিরিয়ে জানলার দিকে চাইল চোখের জল লুকোতে…..কিছুটা সময় চুপচাপ….কলকাতার বুকে যানজট এড়িয়ে বাস ছুটে চলেছে….সেই চলন্ত পথের দিকে চেয়ে রইল চাঁদ….হঠাৎ সোহম বলল, “আমি যাতায়াতটা বন্ধ করতে বলেছিলাম ….তার একটাই কারণ ছিল…আমার প্রথম আকর্ষণ আমার মা….দ্বিতীয় আকর্ষণ সিগারেট …তৃতীয় আকর্ষণ রঞ্জা…আমি আর কোনো আকর্ষণে নিজেকে বাঁধতে চাইনি ।
চাঁদ: মানে….?
সোহম: মানে, ধীরে ধীরে তুইও আমার নেশা হয়ে যাচ্ছিস….রোজকার যাতায়াতে …কথায় ,লেখায়, হাসি ঠাট্টায় তুই আমাকে আকর্ষণ করছিলি….আমি রঞ্জাকে মনে করতে চাইলেও তুই আমার ভাবনায় চলে আসছিস…আমার অদ্ভুত একটা যণ্ত্রণা হচ্ছে চাঁদ …তাই তোকে ফোন করাটা কমিয়েছি…চোখের বাইরে তবু ঠিক আছে কিন্তু রোজ চোখের সামনে হলে….আমি নিজের কাছে নিজে অপরাধী হয়ে যাচ্ছি।
চাঁদ চুপ করে রইল অপরাধীর মত….কিন্তু তার মনে হতে লাগল একবার সোহমকে আঁকড়ে ধরে সে যদি বলতে পারত…তারও এখন আর কিছুই ভালো লাগেনা…জীবনের সব আনন্দ কেমন যেন হারিয়ে গেছে…সব কিছু বেরঙিন হয়ে গেছে….কিন্তু এসব কিছুই সে বলতে পারল না! শুধু মুখ নিচু করে রইল ।
সোহম : কিছু বলবি না?
চাঁদ: নাহ! আমার কিছুই বলার নেই । তোর চাওয়াটাকে সম্মান করি । তুই চেয়েছিস ফোন কমাতে…যাতায়াত বন্ধ করতে …করেছি তো ।আর এখন বলেছিস রঞ্জাদির সাথে কথা বলতে…বলব ।
সোহম: তোর নিজের কোনো চাওয়া নেই?
চাঁদ: না…
সোহম: কেন ?
চাঁদ ক্ষয়ে যাচ্ছিল ভেতরে ভেতরে ….তবুও অসম্ভব কাঠিন্য বজায় রেখে বলল…” আমি আগেও বলেছি এখনও বলছি ,আমি তোর প্রেমে পড়িনি…তাই তোর আমার ব্যাপারে কি কি হল তাই নিয়ে আমার আর কি বলার থাকতে পারে ।এসব সিলি ইমোশনের কোনো মূল্য নেই ।তুই রঞ্জাদিকে নিয়ে ছেলেখেলা করতে পারিস না ।”
সোহম: তুই নিজেকে আড়াল করতে চাইছিস কেন চাঁদ ? আজ যদি সত্যিটাকে অস্বীকার করিস তাহলে সারাজীবন পালাতে হবে জেনে রাখ!!
চাঁদ: এত সত্যি মিথ্যে বুঝিনা ওম….আমার জন্যে তোদের সম্পর্কে চিড় ধরুক আমি চাই না…এটা হতে দেব না…আমি বলেছি তো আমি রঞ্জাদির সাথে কথা বলব….আপাতত আমার আর কিছু বলার নেই ।
….চাঁদের এই আপাত কঠিন চেহারাটার পিছনে যে আবেগ …যে যন্ত্রণা লুকিয়ে ছিল তা বোধকরি সোহম বুঝে উঠতে পারল না ।
সোহম: তোকে আমার আজ বড়ো অচেনা লাগছে । আমি তো ভেবেছিলাম যদি রঞ্জা চায় ইন্দ্রদার কথা ভাবতে আমি সরে আসব….বাধা দেব না…কিন্তু তখন তুই আমার পাশে থাকবি তো চাঁদ?
চাঁদ: ইউ জাস্ট স্টপ অল দিজ ননসেন্স….আমি আমার মত..আমি কারও বিকল্প হতে চাই না । আমার অ্যাটাচমেন্টে বড় ভয় ওম…সম্পর্কের বোঝাপড়ায় যে কষ্ট , আমি তার একধাপ আগেই কষ্টটা বইতে পারি তাতে কষ্টের বোঝাটা একটু কম হয় । আর তাছাড়া আজ রঞ্জাদির পরিবর্তে আমি…কাল আমার পরিবর্তে যদি অন্য কেউ …….
সোহম চাঁদকে কথা শেষ করতে না দিয়েই অদ্ভুত একটা রাগে চাঁদকে থামিয়ে দিয়ে বলল “ব্যস অনেক বলেছিস…আর নয়…আর একটা কথা বলি, তুই ভুলেও আর রঞ্জার সাথে কথা বলবি না….ওটা অ্যাবসলিউটলি আমাদের ব্যাপার ….আমাদের মাঝে তোর তো কোনো জায়গাই নেই…..আমার ই ভুল ….রাস্তার সম্পর্ক রাস্তায় রাখাই ভাল….তাকে বেশি প্রাধান্য দেওয়া বোকামি…. ।
চাঁদ: রাস্তার সম্পর্ক ? হোয়াট ডু ইউ মিন ?
সোহম: ইয়েস আই মিন ইট । তুই ভুলেও আমাকে আর ফোন করবি না…ভুলেও আমার সামনে এসে দাঁড়াবি না…কলেজে দেখা হলে আর পাঁচটা জুনিয়ারের সাথে যতটুকু কথা হয় তোর সাথেও তাই হবে….দ্যাটস এনাফ ফর ইউ।
…..এই কথা বলে সিট ছেড়ে উঠে পড়ল ওম….বাসটা থামতেই রাসবিহারীতে নেমে পড়ল সোহম । অপমানে চাঁদের চোখ জলে ভরে গেল । তবু স্হির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল ….সোহম ভিড়ে মিশে গেল….বাস ছেড়ে দেওয়ার মুখে চাঁদ ভাবল , একবার কি নেমে যাবে সে? ছুটে গিয়ে ওমের হাতটা ধরে বলবে কিভাবে রাতের পর রাত সে নির্ঘুম কাটায়….তারপর ভাবল ভালোই হয়েছে যা হয়েছে….কি অবলীলায় সোহম বলল….রঞ্জা না হলে চাঁদ…স্বার্থপরের মত শুধু নিজের কথাই ভাবল ওম…রঞ্জাদির সাথে সব মিটে গেলে তখন ভুলেও চাঁদকে মনে পড়বে না হয়ত তার….চাঁদ যে একা সেই একাই থাকবে…..। ভীষণ অস্হির লাগছিল চাঁদের ….রাগ হচ্ছিল নিজের ওপর ।
বাড়ি এসে তার কিছুই ভালো লাগলো না ।…মা কিছু বলার আগে নিজেই বলল ….”আমার শরীরটা ভালো লাগছে না মা ..আমি একটু রেস্ট নিয়ে নি …পরে খাব …””
……ওপরে উঠে নিজের ঘরে চুপচাপ শুয়ে রইল চাঁদ…..তা প্রায় অনেক্ষণ….তারপর সন্ধ্যেবেলা কিছুটা ইতস্তত করে সোহমকে একটা ফোন করল….
বেশ কয়েকবার রিং হওয়ার পর ফোনটা ধরল সোহম….গম্ভীর ভাবে বলল…” হ্যালো ফোন করেছিস কেন ?”
চাঁদ চুপ করে রইল ।
সোহম: কি বলবি বল….
চাঁদের ইচ্ছে করছিল নিজেকে একটু ভাঙতে তবু কেন যে ভাঙতে পারল না কে জানে ! বলল…” না ….আসলে তুই হঠাৎ নেমে গিয়েছিলি তো….তাই….আর হ্যাঁ আজকের পর তোকে ফোন না করতেই চেষ্টা করব….বিশাল থেকে তো একধাপে শূন্যে আসা যায় না…একটু সময় লাগে…সেই টুকুর অপেক্ষা মাত্র …তারপর সব ঠিক হয়ে যাবে…ভালো থাকিস ।”
সোহমও বেশ কঠিন ভাবে বলল…” হ্যাঁ আমি ভালোই থাকব….কারণ ভালো থাকতে জানাটাও শেখার আছে জীবনে….তুইও ভালো থাকিস ।”
এই বলে সোহম ফোনটা কেটে দিল । চাঁদের গলার কাছে কিছু একটা উঠে আসছিল যেটা বেরোনোর পথ পাচ্ছিল না….একটা দম বন্ধ করা পরিবেশ ….চাঁদ চেষ্টা করেও নিজেকে সংবরণ করতে পারল না…..বালিশে মুখ লুকোলো ।
…………………………………….(ক্রমশঃ)