পর্ব- ৭
সারা রাত অপমানের জ্বালায় পুড়ে পুড়ে ভোরের দিকে অদ্ভুত এক ক্লান্তিতে ঘুম এসে গেছিল, বিভার। ঘুম যখন ভাঙল … তখন ঘড়ি বলছে প্রায় এগারোটা… বিছানায় উঠে বসলো বিভা । গায়ে হাতে অসহ্য একটা ব্যাথাও টের পেল। বিধ্বস্তভাবে পর্দার ফাঁক দিয়ে বাইরের আকাশটার দিকে চেয়ে রইল, …গত রাতের কথাগুলো মনে হতেই এক অফুরান বিস্বাদে ভরে গেল মনটা … ভাবল ইশশশশ্ কেন যে ভাঙল ঘুমটা। ঘুমটা যদি না ভাঙত কত ভালো হত… মুক্তি ই মুক্তি… চরম তৃপ্তি । কিন্তু পরক্ষণেই বিভার মনে হল, এত সহজে সে ছেড়ে দেবে অতীনকে? নাহ কিছুতেই না। অতীন তার ইচ্ছমত যা খুশি তাই করবে বিভার সাথে আর সে মেনে নেবে ? না… যে লুকোচুরি খেলা অতীন শুরু করেছে , সেই খেলার শেষ বিভাই করবে । বিছানা ছেড়ে উঠে ঘরের দরজা খুলে বাইরে গেল বিভা, পাশের ঘরের দরজা খোলা, ঘরটাও মোটামুটি গুছোনো… কিচেন ফাঁকা , লিভিং ফাঁকা … ব্যালকনির দরজা লাগানো … দরজার কাচের মধ্যে দিয়ে যতদূর চোখ গেল, খোলা এক বুক আকাশ যেন উপুর হয়ে আছে বিভার ব্যালকনির ছাদে। বেশ একটা মেঘলা মেঘলা ভাব… শীতের শুরুতে ঠান্ডা ফেলার জন্য একটা নিম্নচাপ হতে পারে, আকাশটা যেন তেমনি নির্দেশ দিচ্ছে , কেমন একটা থমথমে ভাব । লিভিং থেকে ফিরে এসে বিভা দেখল, বাথরুমের দরজা খোলা। নিজের ঘরে এল বিভা… কাল এই খাটটায় অতীন শুয়েছিল একা , তাকে ঢুকতে দেয়নি ঘরের দরজা বন্ধ রেখে। বিভা খাটের কোণায় বসল …উদাস হয়ে চেয়ে রইল খাটের পিছনের দেওয়ালে রাখা একদল ছুটন্ত ঘোড়ার ছবির দিকে, মনে মনে ভাবল, আচ্ছা সে কি এমন অন্যায়টা করেছিল? অতীন কি চাইলে পারত না একবার তার দরজায় এসে দাঁড়াতে ? আজ পর্যন্ত বিভা ঝগড়া কখনো বাসি করে নি, নিজের দোষ না থাকলেও , গোঁ ধরে না থেকে মিটিয়ে নিয়েছে নিজে থেকেই। এই প্রথম সে নিজে থেকে এগোতে পারল না, কিন্তু কই অতীনও তো এগিয়ে আসলো না , কিন্তু সত্যিই কি অতীন নিরপরাধ, তার কি উচিত ছিল না বিভার সাথে খোলাখুলি কথা বলা? … এক মুহূর্ত আরো কি যেন ভাবল বিভা ? তারপর তার মনে হল অতীন গেল কোথায়? তবে কি…চলে গেল …তাকে ফেলে? আচ্ছা অতীনের অফিসের ব্যাগটা কই ? স্টাডি টেবিলে চোখ পড়তেই… বিভা দেখল ব্যাগ নেই …আলমারি খুলে হলুদ ফাইলটাও চোখে পড়ল না বিভার। তারপর মনে হল …ওহো আজ তো অতীনের অফিসে স্মল স্কেল ইন্ডাস্ট্রি গ্লোবালাইজেশানের জন্যে ফরেন ডেলিগেটসদের সেমিনার… আর এই মিটিংএর জন্যই তো কাল বাড়ি বসে সে ফাইনাল রিপোর্ট তৈরি করছিল, সন্ধ্যেবেলা ব্রজেশ্বরদার ফোন এসেছিল… অতএব অতীন অফিসেই গেছে । তাছাড়া ছেলেরা খুব আরাম প্রিয়, তাদের সাজানো বাগান ছেড়ে তারা অন্য বাগানে ঘুরতে যেতে পারে কিন্তু সন্ন্যাস নিয়ে সহজে পাহাড়ে যেতে পারে না। তার জন্য সমস্ত ইন্দ্রিয় সুখ ছাড়তে হয়। অতএব অতীন বাবু আর যাই হোক বিবাগী হতে পারে না… । তবু একবার সুনিশ্চিত করনের জন্য অফিসের নম্বরে ফোন করল বিভা ল্যান্ডলাইন থেকে,
-হ্যালো
-হ্যা-লো, কি চাই?
-আচ্ছা সেলস ডিপার্টমেন্টের অতীনবাবু কি আজ এসেছেন?
-হ্যাঁ , এসেছেন , কিন্তু এখন সিটে নেই … আপনি কে বলছেন ম্যাডাম? হ্যালো হ্যালো …
কিছু না বলেই ফোনটা কেটে দিল, বিভা ।তারপর মনে মনে হাসল …. যা ভেবেছিল , ঠিক তাই। মোল্লার দৌড় ওই মসজিদ পর্যন্তই । নাহ, তাহলে অতো চিন্তার কোনো কারণ নেই, অতীনবাবু এখন অফিসে নিজের ভাবমূর্তি বজায় রেখে হেসে হেসে কাজ করে যাচ্ছে … আগের দিন রাত্রিতে সে যে মিথ্যে সন্দেহে তার বউয়ের গায়ে হাত তুললো, কেউ জানলই না। বিভা মফস্বলের একটা সাধারণ মেয়ে… যার জগতটাও খুব খুব ছোট … তবুও মুখোশের আড়ালে থাকা এই মানুষগুলোকে সে কোনদিনই সহ্য করতে পারত না… আজও পারে না। তাই নরম স্বভাবের মেয়েটা হঠাৎই কেমন প্রতিবাদী হয়ে উঠল নিজের অজান্তেই।
ওদিকে অতীনের মাঝরাতে সেই যে ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছিল, সত্যি বলতে আর সে ভাবে ঘুমটা আসেই নি, একটা অপরাধবোধ তাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছিল। বিভাকে তার বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয়, কিন্তু এক এক সময় নিজের অক্ষমতার কারণে হারিয়ে ফেলার ভয়ও হয়, তখন কেমন একটা অধিকারবোধ, আধিপত্য, প্রকারন্তরে গোঁয়ারতুমি পেয়ে বসে। মনে হয় এই নীল বোধহয় তার এমন সাজানো সংসারটাকে চোখের পলকে ওলোটপালোট করে দিল। রাগ হয়… কিন্তু তারপর ভাবে না বিভা ওরকম নয়… কিন্তু বিভা নীলকে নিয়ে বেশি উৎসাহ দেখালে একটা হিংসেও হয়। … কিন্তু এর মানেটা তো এইটাই যে সে বিভার প্রতি যথেষ্ট সচেতন, সেটা কি ভালোবাসা নয়…!!! কিন্তু বিভা কি তা বোঝে না ..বিভার বাচ্চাদের প্রতি এতো ভালবাসা আর তার নিজের অপারগতা… এই দুয়ের দ্বন্দ্বে সে কিভাবে বিভাকে যে আসল সত্য বলবে বুঝে উঠতে পারছিল না, যার ফলে দিনকে দিন অতীন যেন কেমন অসহায় হয়ে উঠছিল। একটা অদ্ভুত আশঙ্কা নীল কে নিয়ে তার মাথায় চেপে বসছিল , হয়ত অহেতুক কিন্তু ভাবনাটা যে নামছিল না মাথা থেকে।…এইসব নানা কথা ভাবতে ভাবতে তার সারারাত আর ঘুমই হল না, সকাল বেলা উঠে বিভার ঘরের সামনে গিয়ে বিভাকে ডাকতেও কেমন একটা কুন্ঠাবোধ হল তার, শেষ পর্যন্ত বিভা উঠছে না দেখে নিজেই নিজের কাজ গুছিয়ে, স্নান করে কিছু মুখে না দিয়েই অফিসে বেরিয়ে গেল। ভাবল, অফিস ক্যান্টিনে কিছু খেয়ে নেবে ক্ষণ …আর পরে সময়মত বিভাকে ফোন করে নেবে।
একদিনের একটা ঘটনা পরিবারের দুটো মানুষের মধ্যে কতটা দেওয়াল তুলে দিয়েছে এই কথা ভাবতে ভাবতে বেশ কিছুটা সময় আলগোছে বয়ে গেল বিভার । সাতপাঁচ অনেক ভেবেও বিভা কোনো কূলকিনারা পেল না… অগত্যা, সে ওয়াশ রুমে গেল… গিজার অন করল, বেসিনের সামনের আয়নায় চোখ পড়তেই দেখল ঠোঁটের কোনে কালশিটে একটা দাগ। … হাতের দু একটা জায়গাতেও একইরকম দাগ… চোখেমুখে জলের ঝাপটা দিল। কালকে অতীনের খামচে ধরা জায়গাগুলো নখের আঁচড়ে ক্ষতবিক্ষত হয়েছিল , সেখানে জলের ছিটে লাগতেই কেমন একটা চিড়বিড় করে উঠল … হয়ত বা মনটাও জ্বালা করে উঠল।…কিন্তু এত কিছু দেখেও তার একটু কাঁদতে ইচ্ছে করল না…চোখের সব জল কি শুকিয়ে গেল তার? মনে মনে ভাবল বিভা … একটা রাতে সে কি এতটাই বদলে গেল?… কই আজ তো তার অতীনের জন্য একটুও অনুকম্পা হচ্ছে না… তিন বছর যে লোকটার সাথে ঘর করল তার প্রতি এতটুকুও কৃতজ্ঞতা আসছে না বিভার ! বরং নীলের কথা তার মনে পড়ে যাচ্ছে অতীনকে ছাড়িয়ে। সে ভাবতে চেষ্টা করল নীলের জন্য কি অনুভুতি হচ্ছে তার? … এই কথাটা ভাবতেই মনে হল… ‘ ওহো নীলকে একটা ফোন করতে হবে? ‘যাক স্নানটা তো সেরে নি আগে ’…
অনেক্ষন ধরে ঠান্ডাগরম জলে স্নান করল বিভা … স্নান সেরে বাইরে এসে একটা ঘন জাম রঙের তাঁতের শাড়ি পরল … ইচ্ছে করল না কপালে সিঁদুরটা ছোঁয়াতে , ভিজে চুলটা আঁচড়ে, একটু সাজল নিজের জন্যে , …এতকাল তো সে অনেক সেজেছে অতীনের জন্যে ,… আজ মনে হল একটু নিজের জন্য বাঁচতে , কিচেনে এসে এক কাপ কফি বানাল বিভা , তারপর মোবাইলটা খুলে সবার প্রথম নীলকেই ফোনটা করল
-হ্যালো… নীল
-উফফফফ… মেমসাহেব… বলো ফোন করলে তবে?
-হুম…
-বিশ্বাস কর , এই কদিন মনে হয়েছে কি এক নির্বাসন দিয়েছ যেন তুমি আমাকে, বুকের মধ্যে একটা ভারি পাথরের চাপ… এখন তোমার কণ্ঠস্বরে বেশ হাল্কা লাগছে… কি হয়েছিল তোমার। আমায় বলবে না?
-বলব , তাই তো তোমায় ডাকছি নীল… আজ এক্ষুনি আমার বাড়ি আসতে পারবে কি ?
-মজা করছ?
-না সত্যি… পারলে এখনি এসো… অনেক কথা বলার আছে।
-এখনি? কি হয়েছে বল তো? অতীনদা আছে তো ?
-না ও অফিসে। তুমি যদি এখনি আসো… তবে কথা হবে , না হলে, আমাকে আর তুমি ফোন কর না নীল।
-এরকমভাবে বলছ কেন? আচ্ছা তুমিই বলো… অতীনদা নেই আমার যাওয়াটা কি ভালো দেখাবে?
-আমি আজ খুব বেপরোয়া নীল… হয়ত বা মন থেকে স্বৈরিণীও । আসবে তো এস না হলে ফোন রেখে দিচ্ছি।
-কি বাজে বকছ … আচ্ছা দেখছি …
-না দেখছি না…
-আচ্ছা এইভাবে যাওয়া যায় নাকি?
-খুব যায়… চাইলেই যায়। তুমি চাও না তাই বলো।
-না ঠিক তা নয়… আচ্ছা যাচ্ছি… কিন্তু এখন তো পৌনে বারোটা , আমাকে কিন্তু দুটো আড়াইটের মধ্যে ফিরে আসতে হবে …ভালো করে ভেবে দেখ তোমার অসুবিধে হবে না তো?
-না …বললাম তো… তাহলে এস… আমি তোমার অপেক্ষায় রইলাম।
বিভা ফোন কেটে দিল ।
নীল একটু দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে গেল।তারপর ঘড়ি দেখে ভাবল, সময় কম। নিজের কাজগুলো একজন সহকর্মীকে একটু দেখে দিতে বলে, নীল হসপিটাল থেকে বেরিয়ে পড়ল… একটা ট্যাক্সি ধরল… বিভার বাড়ি তার কর্মক্ষেত্র থেকে খুব দূরে নয়…মনে মনে ভাবতে থাকল কি হয়েছে বিভার। এই কদিনে সে যতটা চিনেছে তাকে ,সহজ বলেই তো মনে হয়েছে । সত্যি বলতে তার ইমলির সাথে সম্পর্কটা এখন দুই বাড়ির কথা রাখতে গিয়ে একপ্রকার দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে , কিন্তু মনের খিদেটা সে বিভার সাথে কিছুটা হলেও ভাগ করে নিয়েছিল… কিন্তু আজ এমন কি হল যে বিভা তাকে ডেকে পাঠালও। ভাবল অতীনদাকে কি একবার ফোন করবে? পরক্ষনেই মনে হল, ‘না ,আগে দেখি তো কি হয়েছে, হয়ত দুজনের মধ্যে ঝগড়াঝাটি কিছু হয়ে থাকবে,…তাই হবে… সে যেমন ইমলির জন্য বিভাকে বলে, হয়ত বিভাও তেমনি অতীনদার জন্যে তাকে কিছু বলবে… ঠিক আছে নো প্রবলেম, দেখাই যাক না কি বলে?’