
চাঁদের পরিক্রমণ@Oindrila
সে ছিল এক রাঙা ভাঙা চাঁদ …..
যাকে ছুঁয়ে আমি বুঝতে চেয়েছিলাম কলঙ্কের পরিভাষাটা কি ?….জানি না কথায় কথায় চাঁদকে কতটা ছুঁতে পারব…. কিন্তু এই কাহিনীর তাগিদ এক অন্য কাহিনি যার শিরোনাম জীবন !!!!
মুখবন্ধঃ
আজ অনেক বছর পর মনের তাড়নায় লিখতে বসেছি আমার এক দোসরকে নিয়ে…..আজ পর্যন্ত যখনই লিখতে শুরু করি আমার সব ভাবনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে যায় সে…..তাকে এড়িয়ে আমার লেখা অসম্পূর্ণ । তাই ভেবেছি এবার না হয় তাকে নিয়েই কিছু লিখি…… । ধরা যাক তার নাম চন্দ্রিমা…..যদিও তাকে আমরা চাঁদ বলেই জানব….। চন্দ্রিমার একটা কালো মলাটের আখাম্বা ডায়রী ছিল…..আমি তার প্রত্যেকটা অক্ষর পড়ে ফেলেছি। ডায়রীর পাতায় তার প্রত্যেকটা শব্দনির্মাণ আমাকে বুঝিয়েছে সে চিরকাল ই একটু অন্যরকম ….প্রবল জলোচছ্বাসের মধ্যে সে আজন্ম নির্জন দ্বীপ …..আবার দিগন্ত বিস্তৃত রুক্ষ মরুভূমির মাঝে সে অবধারিত শীর্ণ জলধারা……। চাঁদের জোছোনায় আমি সত্যিই চন্দ্রাহত…..। চাঁদের জীবন তিরিশ বছর বয়সে এসে শ্লথ হয়ে গেছে । চাঁদকে দেখলে সুস্থই মনে হয় কিন্তু চাঁদ মানসিক ভাবে বড় অস্থির…..সে অনেক মানুষের মন নিয়ে নাড়াচাড়া করে তবু নিজের মনটাই বুঝে উঠতে পারে না….সবাই যখন হাসে কথা বলে গল্প করে কখনও সে ঐ আনন্দের অনুভূতিতে প্রগলভ হয়ে ওঠে আবার কখনও আনমনা হয়ে যায়……সে হাসে , সাজে, নিত্যনতুন জিনিস কেনে কিন্তু কোনো কিছুতেই যেন পূর্ণতা আসে না ।সম্পৃক্ততার আশায় কি যে খোঁজে তাও জানে না…..সবার মাঝে থেকেও সে একা …….আবার একা থেকেও সে একা নয়……তার দুটো সত্ত্বা….সে মনে মনে কথা বলে বুঝেছে…..তার একটা মন যতটা বাধ্য আরেকটা মন ততটাই বেপরোয়া ।এহেন চাঁদ ছোটোবেলা থেকেই বাবার ক্ষুদে হেল্পার ।বাবা গাছের পাতা ছাঁটছেন, চাঁদ বাবার পিছুপিছু ঘুরছে…..আর টালমাটাল পায়ে গাছের ফুল ছিঁড়ছে…..বলছে…”বাব্বা ফুঃ” বাবাও তেমনি আপাত রাগে বলছেন…..”ছিঃ চাঁদ , ছোটো ছোটো ফুল তুলছ কেন?….তাহলে বড়বড় ফুল গুলো কে তুলবে?” চাঁদ খুশি খুশি গাছের ফোটা ফুলের দিকে তাকিয়ে বলে, “আয়েত্তা তুব্ব”….? একটু এগিয়ে গিয়ে আরেকটা ফুল তুলে , ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে ফেলে দেয় ….এইভাবে ফুল দেখলেই তাকে ছিঁড়তে চাওয়ার বাসনাটা তার মন থেকে অপসারিত হয় চির দিনের জন্যে । ………এটাইবোধহয় ছিল , তার সম্পৃক্ততার উপলব্ধি…..যা তাকে তার সজ্ঞানে, এরপর আর কোনও প্রাপ্তিই এনেদিতে পারে নি । চাঁদ বিশ্বাস করতে চায় পজিটিভিটিতে…যে কোনো ‘না বাচক ‘শব্দ ,যা মনের মধ্যে কৌতূহলের সৃষ্টি করে তাকেই চাঁদ ভেঙে দেখতে চায়…..জানতে চায় কি এমন হিস্ট্রি-মিস্ট্রি-কেমিস্ট্রি আছে তার মধ্যে।
পর্ব ১/
চাঁদের রোজকার পাঁচালীটা যেন একটু বেশি রকম স্বশাসিত…..সে নিয়মের বেড়াজালে আবদ্ধ থাকতে একটুও ভালোবাসে না…..তবুও আবর্তনে তো থাকতেই হয়…. চাঁদ এখন একটি বেসরকারী ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে অধ্যাপনা করে…..সারাদিন ই তার নানান বয়সের মানুষের সাথে ওঠাবসা….শুধু তাই নয় এখনকার এই ছাত্রজীবনটাকে সে ভীষণ কাছ থেকে দেখে বলেই বোধহয় সবসময় একটা তুলনামূলক দৃষ্টিভঙ্গী তার অতীত আর বর্তমানের মধ্যে দ্বন্দ্ব তৈরী করে দেয়….নচেৎ সে তার কলেজ-বাড়ি- পরিবার সবের মধ্যেই একটা তারতম্য বজায় রেখেই চলতে চায়…..শুধু তার মনের হদিস পাওয়া যায় না…..সে এগিয়ে চলতে চায়….কিন্তু অতীত তাকে কেন জানি না আজও বড়ো পিছু টানে……অতীতের কোন সে অসম্পৃক্ততা আজও তাকে কথার নেশায় ভাসিয়ে নিয়ে যায়….তা সে বোধ করি নিজেও বোঝে না…..। আজ চাঁদের সকালটা একটু অন্যরকম…কাকভোরে ঘুম ভেঙে যায় তার । শোবার ঘরের দখিনের জানলাটা তার কাছে মুক্তির স্বাদ ।ভোরবেলায় জানলার ভারী পর্দা সরিয়ে অন্ধকারের মাঝে যে আলো ফুটে উঠছিল ,তার আঘ্রাণ নিল চাঁদ । জানলার গ্রিলে মাথা হলিয়ে উদাস চোখে দূরের নারকেল গাছটার দিকে তাকালো ।চাঁদ ঠিক বুঝে উঠতে পারেনা তার মনে কখন ঝড় ওঠে,কখন মেঘ করে আর কখন বৃষ্টি আসে । চাঁদের জীবনে প্রথম বন্ধু তার বাবা ….তারপর বহু বন্ধু এসেছে….চাঁদ খোঁজে একটা অস্তিত্ব ,যার পাশে থাকায় এক নির্ণিমেষ স্বস্তি……সে সম্পর্কের জটিলতা এড়িয়ে ছোটো ছোটো অনুভুতির পরিবর্তনগুলো বিশ্লেষণ করতে চায় ।সে জানে সম্পর্কের সহজিয়া সুর তো একটাই…..’তুমি খুশী থাকলেই আমি খুশী…এর বাইরে আর কোনো চাওয়া হয় কি ???? …..সকালের রুটিন তার যাই থাকুক খবরের কাগজে একটু চোখ না বোলালে চাঁদের হয় না….আকাশটা আজ বড়ো মেঘলা….বৃষ্টি নামল বলে….আজ তার বেরোতে ভালো লাগছে না…..কিন্ত আজ তাকে ক্লাস নিতে হবে স্ট্রাকচারের…..থার্ড ইয়ারের স্টুডেন্টসদের প্রোজেক্ট সাবমিশান আজ….ভাইভা নিতে হবে..সুতরাং যেতে তাকে হবেই….চাঁদ চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে ব্যালকনিতে এসে দাঁড়াল…..ইচ্ছে অনিচ্ছে মেঘলা আকাশ সব মিলিয়েই সে যেন অতীতের সেই দিনটাকে আরও একবার ফিরে দেখতে চাইল…………….. বেশ কয়েক বছর আগের কথা । চাঁদ তখন উনিশে পা রেখেছে । যাদবপুর ইউনিভার্সিটির সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং-এর ফার্ষ্ট ইয়ারের ছাত্রী………… সেদিন কি হল কে জানে……সকাল থেকে তার একটুও ইচ্ছা নেই কলেজে বেরোনোর, অথচ ড্রয়িং শীট সাবমিশন আছে সেকেন্ড হাফে ।বেশ একটা আলসেমী জড়িয়ে ধরেছে তাকে। গোটা রাতই প্রায় জাগা ড্রয়িং শীটের জন্য। সাঁতরাগাছি থেকে যাদবপুর যেতে দুটো বাস তখন পাল্টাতে হত। দুপুরবেলা চাঁদ খুব অনিচ্ছা সত্ত্বেও বাসে উঠল।বাসের জানলায় মুখ রেখে দেখল রোদ্দুরে ভেসে যাওয়া আকাশটা কেমন যেন থমথম করছে। কোথা থেকে একফালি কালো মেঘ ঝড়ের আভাস দিচ্ছে……একটু পরে বাসটা ছাড়ল …..সঙ্গে দমকা হাওয়া, এলোমেলো বৃষ্টি….বৃষ্টির সাথে সাথে বাসের বন্ধ কাচের জানলায় ছোটো ছোটো শিলের টোকা পড়তে লাগল। চাঁদ ভাবল “ইস্ এখন কি হবে? ছাতাটাও নিই নি….বাস থেকে নেমে কোথায় দাঁড়াব? ভিজে যাব তো…..” ধীরে ধীরে বাস বিদ্যাসাগর সেতুর ওপর দিয়ে ,রবীন্দ্রসদন পেড়িয়ে ,বিড়লা প্ল্যানাটোরিয়ামের বিপরীতে এসে দাঁড়াল । চাঁদকে নামতেই হবে…..এখান থেকে সে যাদবপুরের বাস ধরবে…..ঝিরঝির বৃষ্টির মধ্যে আরও কয়েকজন যাত্রীর সঙ্গে চাঁদও নেমে দাঁড়ালো একটা গাছের নীচে। দূরের দিকে তাকিয়ে ভাবতে থাকল কখন বাস পাবে…..এমন সময় তার খেয়াল হল ‘কই , আমি ভিজছি নাতো?’ ঘাড় ঘুড়িয়ে দেখল…..হ্যাঁ তা প্রায় ফুট ছয়েকের একটা ছেলে তার মাথার ওপর একটা ছাতা হেলিয়ে রেখে তাকে ভিজে যাওয়া থেকে অনেকটাই বাঁচিয়েছে….চোখে হাই পাওয়ারের চশমা , একমুখ খোঁচা খোঁচা দাড়ি,এলোমেলো চুল……এক গাল হেসে প্রশ্ন করল ” ফার্ষ্ট ইয়ার তো ? কোন ব্রাঞ্চ তোর ? ” চাঁদ একটু অপ্রস্তুত হয়ে বলল ” সিভিল “। মনে মনে ভাবল প্রথমেই তুইতোকারী করাটা একটু কেমন যেন লাগে ।পিছনে দাঁড়ানো ছেলেটা বলল ” আমি থার্ড ইয়ার মেকানিক্যাল…” এতক্ষণে চাঁদ বুঝে গেছে এই ছেলেটা তার আজকের সহযাত্রী….এতটুকুও কুন্ঠাবোধ না করে চাঁদ পাল্টা বলে উঠলো “আমি চন্দ্রিমা ব্যানার্জী…..তোর নাম কি? “আমি সোহম গাঙ্গুলী….তোর সিনিয়র….তুই বলাটা কি খুব জরুরি ?”চন্দ্রিমার মুখে একটা দুষ্টুমির হাসি …..বলল “অপরিচিত একটা মেয়েকে তুই যদি তুই বলতে পারিস , আমি কেন নয়?” দুজনের কথার মাঝখানে হুড়মুড় করে যাদবপুর মিনিবাস এসে দাঁড়ালো । সোহম ছাতাটা বন্ধ করে বাসের গায়ে দুটো চাপড মেরে বলল….” আস্তে লেডিস”….চাঁদ ওঠার পর সোহম বাসে উঠেই তার দুজন বন্ধুকে দেখে তাদের মাঝে গিয়ে বসলো….আর যেন চাঁদকে ভুলেই গেল । চাঁদ একদম লাস্ট সিটে গিয়ে বসলো….. অপলক দৃষ্টিতে সোহমের দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ…..তারপর গোটা রাস্তায় আর একটাও কথা হয়নি দুজনের । চাঁদ কেবল জানলা দিয়ে বৃষ্টি দেখেছে আর ভেবেছে….সে যেন ভুলেও আর সোহমের ছাতার মুখাপেক্ষী না হয় । ধীরে ধীরে বাস গড়িয়াহাটের কাছে আসতেই বৃষ্টিটা থেমে যায় বেশ…..চাঁদ দেখে সোহম উঠে পড়েছে আর ওর দুই বন্ধু সৈকত আর দীপান্বিতাকে উদ্দেশ্য করে গলাটা বেশ তুলেই বল….কাজ আছে কয়েকটা….কম্পিউটার ক্লাসে দেখা হবে…..একদম বাসের দরজার মুখে গিয়ে চেঁচিয়ে বলে.”দীপু আমায় রাতে পারলে ফোন করিস একটা….নাম্বারটা মনে আছে তো…..03326608645….করিস কিন্তু….” দীপান্বিতা বলে,”নাম্বার বলার কি আছে? জানি তো ….করে নেব” চাঁদ একটু ফিরে চাইলেও সোহম পিছনে না দেখেই নেমে যায় বাস থেকে……চাঁদের চোখজোড়া কেমন যেন সোহমের চলার পথটা অনুসরণ করতে থাকে আর এমনই মুহুর্তে ফোন নাম্বারটা মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকে…… !!!!
………………………………………………………………………ক্রমশ