পর্ব -৮
________________________________________________________________________________________________________________________________
দাশনগর থেকে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে ফিরতে ফিরতে অনীশ ভাবছিল যদি এখানে প্রোজেক্টটা হয় , তাহলে তো আবার তার কুরচির সঙ্গে দেখা হবে । একথা ভাবামাত্রই তার মনে অজানা একটা শিহরণ যেমন হল, সাথে সাথে মনটা কেমন ফ্যাকাস হয়ে গেল। তার এতদিনের এত ভাবনা , যাকে ঘিরে তার স্বপ্নের জগৎ , সব যেন আজ নামহীন গোত্রহীন টুকরো অবকাশের মত পড়ে রইল। কুরচি কেমন আছে এই কথা ভাবতে ভাবতে তার কত ঘুমহীন রাত পার হয়ে গেছে কত অবহেলায় ,অথচ আজ সেই ভাবনা থেকে সে ছুটি পেয়ে একেবারে বেকার হয়ে গেল। কুরচির জন্য তার রোজের যে খোঁজ , যে বন্ধন, আজ বোধকরি তা মুক্তি পেল কুরচিকে সামনাসামনি দেখায় ।অনীশ ভাবল, পৃথিবী যে গোল ,এই বিজ্ঞানটাকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে এমন করে বোঝানোর খুব দরকার ছিল কি? …এখন তো শুধুই এক অন্তহীন ভাবনাহীন নিঃশব্দ ছুটে চলা । সত্যি বলতে কুরচি আর সুশান্তবাবুকে দেখে বেশ সুন্দর গোছানো একটা সংসারের ছবিই প্রতিফলিত হয়েছে তার মনে। তাই কুরচি ভালো আছে এই ভাবনাটা যতটা তৃপ্তি এনে দিয়েছে, ঠিক ততটাই মনের গভীরে একটা শূন্যতার অনুভুতি ,অনীশকে কেমন হিমশীতল করে তুলছে। অনীশের ভাবনার সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে গাড়ি চলতে লাগলো …সবুজ গাছপালা মেঠো পথঘাট ছাড়িয়ে আর তার মনের অতলে একটাই গানের কলি গুনগুনিয়ে উঠতে থাকল… ‘ ময়নামতির পথের ধারে দেখা হয়েছিল/তেপান্তরের মাঠের ধারে দেখা হয়েছিল/দেখা হয়েছিল তবু না দেখাই ছিল ভাল/ দেখা হয়েছিল…’ ঠিকই তো কত মানুষের জীবনেই তো কত বন্ধু হারিয়ে যায়, সবার কি দেখা হয় …নাই বা হত অনির সাথে কুরচির দেখা, ক্ষতি কি ছিল! থাকতো সে অনির ভাবনায় না হয় একজন নীলপরী হয়ে!!! কিন্তু আজকের এই দেখাটা যে তার মনের অতি সঙ্গোপনে রাখা ভাবনাগুলোকে কেমন এলোমেলো করে দিল। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে অনীশ জানলার বাইরে চোখ রাখল… গাড়ি দাঁড়িয়ে গেছে লেভেল ক্রসিং-এ……সামনে দাশনগর রেলওয়ে স্টেশন । লেভেল ক্রসিং-এর ওপারে , এক স্থবির জনজীবন…ঝাঁকা মুটে, ফিরিওয়ালা , সাইকেল, রিক্সা……আর মাঝখান দিয়ে প্রচন্ড জোরে ঝমঝম শব্দে চারপাশ কাঁপিয়ে ট্রেন ছুটে আসছে……হারিয়ে যাচ্ছে অনীশ অতীতে , যে ঘটনাটা অনীশ পারতপক্ষে তার স্বপ্নের গভীরেও এড়িয়ে চলতে চায়, আজ কিন্তু নিজে থেকেই সেই ভাবনার অতলে ডুব দিতে চাইল সে। ট্রেনের ঝমঝম শব্দের অবসরে ফিরে দেখতে চাইল সেই দিনটাকে । তার চোখের সামনে ফুটে উঠল ব্যস্ত হাওড়া স্টেশন। যেখানে ব্যাগ হাতে দাঁড়িয়ে আছে পাবলো আর দুরন্ত আগ্রহে ঘন ঘন প্ল্যাটফর্মের এ মাথা ও মাথা করছে অনীশের ব্যস্ত চাহনি । হাজার ভিড়ের মাঝে তার চোখ দুটো হন্যে হয়ে অপেক্ষা করছে কুরচির জন্যে । হঠাৎ মাইকে ঘোষণা শোনা গেল, ‘ সকাল ছটা পনেরোর টু থ্রি নাইন আপ পাঁশকুড়া লোকাল প্ল্যাটফর্ম নম্বর পনেরোর পরিবর্তে প্ল্যাটফর্ম নম্বর তেরো থেকে ছাড়বে ’। ঘোষণা শোনামাত্রই পাবলো বলে উঠল…
-এই রে আবার আগেরটায় যেতে হবে চল, চল, ওদিকে চল অনি।
-দাঁড়া , কুরচি আসবে তো এখানেই…
– আরে হ্যাঁ রে বাবা ট্রেন তো দিয়ে দিয়েছে তেরো নম্বরে …সকালের দিকে ফাঁকাও থাকবে…তুই ওদিকে গিয়ে দাঁড়া আমি প্ল্যাটফর্মের মুখটায় থাকছি।
-কিন্তু ও আস্তে এত দেরি করছে কেন বলতো?
-কোনও গন্ডগোল হল নাতো রে ,অনি? দেখ আবার আসবে তো? তুই একেবারে নিয়ে আসলি না কেন?
-যাহ। তা কেন? আমি তো বলেছিলাম। ওই বারন করল , কেউ দেখলে বিপদে পড়ে যাবে বলল। তাই আর…
-বললেই বা তুই শুনবি কেন? এত ভোরে ওর যদি একা আসতে কোনও অসুবিধে হয়?
-আরে বাবা ভয় দেখাচ্ছিস কেন? ওর ইচ্ছেতেই তো …
অনীশের কথা শেষ হওয়ার আগেই পাবলো বলল…ব্যস ব্যস আর ভাবতে হবে না…ওই-ই দেখ…
পাবলোর চোখ অনুসরণ করে অনি দেখল দূরে একটা হলুদ সালোয়ার কামিজ পরে দুটো বেনী দুলিয়ে কাঁধে ব্যাগ নিয়ে ছুটে ছুটে আসছে কুরচি। অনি তাড়াতাড়ি এগিয়ে গিয়ে কুরচির হাত থেকে ব্যাগ নিয়ে বলল …
-ওদিকে চল , ট্রেন তেরো নম্বরে দিয়ে দিয়েছে।
-তুই যে বলেছিলি চোদ্দ-পনেরো তে দেবে…
-হুম পাবলো তো তাই বলেছিল…চল…চল…এখুনি ছেড়ে দেবে..
তেরো নম্বর প্ল্যাটফর্মে এসে কুরচি আর অনি ট্রেনে উঠে পড়ল …জানলার পাশে একটা সিট দেখে দুজনে মুখোমুখি বসলো। জানলার বাইরে তখন পাবলো। ট্রেনের বাঁশি বেজে উঠল …পাবলো দুজনকেই শুভকামনা জানিয়ে বলল …
-পৌঁছে একটা খবর দিস । যদিও অভয়দাকে সব বলা আছে তাও…অসুবিধে হলে জানাবি…আর হ্যাঁ মোবাইলে ফোন করিস না …আমি আজই জেঠুর বাড়ি চলে যাব কদিনের জন্য…ওখানেই ফোন করিস , ল্যান্ডলাইনে …এই নে নম্বরটা মোবাইলে সেভ কর।
-হুম দে… ঠিক। আমার খোঁজ শুরু হলে তোর ওপর আঁচ সবার আগে পড়বে।
নম্বর নেওয়া হল…ট্রেনও নড়ে চরে উঠল…অনীশ ভাবাবেগে আপ্লুত হয়ে গেল…মনে মনে ভাবলো…সত্যি পাবলোর মত বন্ধু হয় না। ধীরে ধীরে প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে গাড়ি এগিয়ে চলল । সাথে সাথে কুলি হাঁকাহাঁকি…মাইকের ঘোষনা…টিং টং আওয়াজ…সব শব্দ কেমন যেন ফিকে থেকে ফিকেতর হয়ে উঠল…কানে বেজে উঠল…ট্রেনের হুইসেল । সকালের গাড়ি… বেশ ফাঁকা ফাঁকা…কয়েকজন যাত্রী এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছে কামরায় । কুরচির হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে সিটের নিচে রাখতে রাখতে অনীশ একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল…তারপর কুরচির পাশে এসে একদম গায়ের কাছে বসলো…আজ যেন সে একটু বেশিই প্রগলভ হয়ে উঠল…কুরচিকে বেড় দিয়ে মাথার পিছনে হাতা রেখে বলল… “কিরে কেউ বুঝতে পারেনি তো?”
কুরছি ঘাড় নেড়ে বলল নাহ। আজ যেন সে একটু বেশিরকমই চুপচাপ। অনি বলল …
-কিরে চুপ কেন? মন খারাপ? নাকি ভয় করছে? এত গুম মেরে আছিস কেন?
-না …এমনি। ভাবছি।
-কি ভাবছিস?
-মায়ের কি হবে অনি? কাকা তো বাক্যবানে মাকে …
-কিচ্ছু হবে না…কটা দিনের ব্যাপার …দাঁড়া না বিয়েটা হয়ে যাক।কাজ তো একটা হয়েই গেছে…. এরপর একটা নিজের আস্তানা হলেই তোর মাকে আমাদের কাছে নিয়ে চলে আসব। তোর আর চিন্তা থাকবে না তখন…মা’কে নিজের কাছে পাবি সবসময়…তবে হ্যাঁ ,তখন কিন্তু মাকে পেয়ে আমাকে দূরে দূরে রাখা চলবে না …এই আমি বলে রাখলাম।
এই বলে , অনি কুরচিকে যেন আরও একটু নিজের কাছে টেনে নিল…অনির দুচোখ জুড়ে তখন কেবল স্বপ্নই স্বপ্ন…মনের খুশিতে কত কি বলে যেতে লাগল সে, দুটো মানুষের মনের মিল থাকলে এই জগত সংসারে আর কতটুকুই বা চাওয়া!!!…কিন্তু কুরচি আজ যেন কেমন এলোমেলো হয়ে আছে…অনির সাথে এই পাশাপাশি বসে থাকার মুহুর্তগুলোকে সে কিছুতেই উপভোগ করতে পারছে না…মনের মধ্যে একরাশ অনিশ্চয়তা তাকে ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছে! কি হতে চলেছে? …কোথায় থাকা হবে ?…কি করবে?…মায়ের কি হবে? কাকা কি বলবে?…এই প্রশ্নগুলোর সাথে জড়ো হয়েছে কিছু ভাবনা…এখনও কি সবাই টের পেয়ে গেছে যে সে বাড়ি নেই? জানলে হয়ত আশপাশের লোকজন ছিঃ ছিঃ করবে…হয়ত সেই আয়রন ম্যান শুনে ভাববে … ‘সত্যি কি বাঁচাটাই না বেঁচেছে…কি মেয়েকে বিয়ে করতে যাচ্ছিল’!!!
একদিকে অনীশের স্বপ্ন আর একদিকে কুরচির ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার ভাবনা দুজনকে দুভাবে ব্যস্ত রেখেছিল …আর ট্রেন চলছিল তার আপন গতিতে। হঠাৎ ট্রেনের হুইসিলের শব্দের সাথে সাথে ট্রেনের গতিটা কমে কমে ট্রেনটা থেমে গেল ……দুজনের চিন্তাতেই পড়ল ছেদরেখা…অনি জানলার বাইরে তাকিয়ে দেখল কোনো স্টেশন ছাড়াই গাড়িটা থেমে গেছে….. আশপাশ থেকে দু একজন যাত্রীদের কন্ঠস্বর কানে আসছে …অনি ঘাড় ঘুরিয়ে একজনকে জিগ্যেস করল
-এটা কোথায় এলাম?
অপরিচিত এক ভদ্রলোক বললেন…বাগনানের কাছে…সিগন্যাল না পেয়ে গাড়ি থেমে গেল বোধহয়…
কুরচির তখন মনের মধ্যে এক অজানা আশঙ্কা ক্রমশ তাকে চিন্তান্বিত করে তুলেছে …কিছুটা কঠিন ভাবেই বলল অনিকে…
-আচ্ছা তুই যে কাজের কথা বললি, তা তুই কি কাজ খুঁজলি শুনি।
-প্রেসের কাজ।
-কোথায়?
-যেখানে যাচ্ছি সেখানেই…কাছাকাছি।
-কার প্রেস?
-আরে পাবলোর মামাতো দাদা যেখানে কাজ করে…সেখানেই।
-কথা ফাইনাল হয়ে গেছে তো?…কত মাইনে পাবি শুরু শুরুতে?
-আরে দাঁড়া …আমি গেছি নাকি! আগে তো যাই , ওখানে গিয়ে কথা বলি…অভয়দা পাবলোকে বলেছেন তো …ওখানে লোক নেবে…আর উনি বললে হয়েই যাবে।
-মানে তুই অভয়দার সাথে নিজে কথা বলেছিস তো …
-আমি বলাও যা পাবলো বলাও তা …বেশি ভাবিস নাত। ওটা আমার ওপর ছেড়ে দে না।
-বাহ…কি কথা…বেশি ভাবিস নাতো…তা আমরা যে যাচ্ছি …থাকবটা কোথায় এখন?…সেটাও কি ঠিক করেছিস নাকি…পৌঁছে ভাববি?
-আমায় কি ভাবিস বলত? না সেটা ঠিক করেছি তো।…এখন আপাতত পাবলোর মামারবাড়ি …তারপর কাজটা হলে কদিন পর একটা বাড়ি ভাড়া নিতে হবে।
-বাঃ বাঃ … বেশ ব্যবস্থা…সবই পাবলোর বন্দোবস্ত…তুই তাহলে নিজে কি করলি অনি?
…কুরচির কথাগুলো থেকে কেমন যেন একটা শ্লেষ ঝরে পড়ছিল…সেই দেখে অনি কেমন একটা থতমত খেয়ে গেল…এমন সময় একজন চা- ওয়ালা ‘চায়ে চায়ে’ করে ডেকে উঠতেই অনি বলল… “দাঁড়া দাঁড়া, এক কাপ চা খাই …মাথাটা কেমন যেন কাজ করছেনা”।…অনি হাঁক পারল চা -ওলাকে। কুরচি বলল… “ দূর বাবা ট্রেনটার আবার হল কি? মাঝ রাস্তায় দাঁড়িয়ে পড়ল!… কখন ছাড়বে কে জানে?” অনীশ দু ভাঁড় চা নিয়ে কুরচির দিকে একটা এগিয়ে দিল…কুরচির কথার উত্তরে চা-ওলা বলল… ‘ট্রেন ছাড়তে দেরি হবে দিদি…একটা ছেলে আর একটা মেয়ে লাইনে কাটা পড়েছে…সব ট্রেন আটকে দিয়েছ…চারিদিকে কত লোকজন পুলিশ …কখন ছাড়ে দেখুন।’ কথাটা শুনেই কুরচি যেন কেমন স্থির হয়ে গেল …অনি বলে উঠল “ও বাব্বা একি গেরো… এইজন্যই লোকে বলে আনলাকি থারটিন !যখনই পনেরোর বদলে তেরো বলেছে আমার মনটা কেমন যেন খচ খচ করছিল…নাও বোঝো এখন!” আশপাশ থেকে বিভিন্ন মন্তব্য ভেসে আসতে লাগল … কেউ বলল, ‘ এ নির্ঘাত ভাব ভালবাসার গপ্প’… কেউবা বলল… ‘আমি বুঝি না ওভারব্রিজ দিয়ে না গিয়ে কেন ট্রেন লাইন দিয়ে মানুষ পারাপার করে’…সকালের গাড়ি ডেলি প্যাসেঞ্জারের সঙ্খ্যাই বেশি …কেউ কেউ অসহিষ্ণু হয়ে হয়ে বলে উঠল … ‘দূর বাবা অফিসের আজ বারোটা বেজে গেল…একদিনের ছুটি গেল…আরে বাবা পেটে টান পড়লে ওসব ভালোবাসা জানলা গলিয়ে ফুড়ুৎ’। পিছনের ভদ্রলোক বললেন ‘আরে দেখ আবার, সুইসাইড কেস কিনা!…দারিদ্র মানুষকে কতটাই না অসহায় করে দেয় !!’…বিভিন্ন মানুষের মন্তব্যে কুরচি যেন কেমন শিঁটিয়ে জেতে লাগলো অজানা এক ভয়ে। চুপ করে এক জায়গায় বসে রইল…আর মনে মনে ভাবতে থাকল… ‘তারা কি এভাবে বাড়ি থেকে পালিয়ে ঠিক করছে? এও তো এক অচেনা অজানা অনিশ্চিত জগৎ …যেখানে কোনও কিছুই ঠিক ঠাক নেই… তবে দারিদ্র কি অনি জানে না…কিন্তু সে তো দেখেছে…বাবা মারা যাবার পর কেমন করে তারা অসহায় অবস্থায় কাকার কাছে সব মুখ বুজে ছিল, আর কেউ না জানুক সে জানে।…দৈবাৎ এই সুশান্ত বাবুর খোঁজ পাওয়া গেছিল…সেটা হয়ত তার পক্ষে নিশ্চিত ভবিষ্যৎই ছিল…আর হয়ত সেটাই তার একমাত্র সুস্থির গন্তব্য হতে পারত যদি না তারা এভাবে নিরুদ্দেশের পথে পা বাড়াত…… কিন্তু এখন আর সে ভেবে লাভ কি? তবে কে বলতে পারে তাদের অমোঘ ভবিষ্যৎও তাদের সাথে এমন মর্মান্তিক রসিকতা করবে না… যার পরিণতি আজকের ওই হতভাগ্য নাম না জানা ছেলেটা আর মেয়েটার মত হতে পারে!!! …মনে মনে শিউরে উঠল কুরচি…আর বলল, ‘ সত্যি বলতে এই দুঃসাহসিক পালানোয় , তার সাথে সাথে অনিরও কম বড়ো ক্ষতি হচ্ছে না…তার বাবা অম্বরীশ মিত্রের হাত তো কম লম্বা নয়…তিনি হয়ত ঠিকই একদিন না একদিন ওদের খুঁজে বার করবেন…তখন কি তিনি কুরচিকে ছেড়ে দেবেন? মাঝখান থেকে দুজনের জীবনটাই হয়ত তাদের হটকারিতায় নষ্ট হয়ে যাবে ……ধীরে ধীরে কুরচির মধ্যে ভাবাবেগটা কমতে কমতে কেমন যেন থিতিয়ে যেতে লাগল…সময় যত পেরিয়ে যাচ্ছিল কুরচি তত কঠিন হয়ে উঠছিল … শেষমেশ কেমন একটা অধৈর্য হয়ে গেল …পুরো ব্যাপারটার সাথে সাথে তার অনিকেও অসহ্য লাগতে শুরু করল …যে অনির একটু সান্নিধ্যের জন্য সে ছটফট করতে সেই অনি তার এত কাছে বসে আছে অথচ কুরচির তাকে কেমন অর্বাচীন ঠেকল । সত্যি বলতে অনির ওপর তার ভরসার জায়গাটা কেমন টলমল করছিল…এত স্বপ্নিল হয়ে কিভাবে বসে থাকতে পারে ছেলেটা …কোনও ভাব লেশ নেই…গুনগুন করে গান করছে অনি আর কুরচিকে বলছে… “নো টেনশন কুরচি , ট্রেন যখন ছাড়বে তখনই পৌঁছব বল…তাড়ার কি আছে? এখান থেকে তো আর কেউ নামিয়ে দিতে পারবে না…।” ইতিমধ্যে বেশ কয়েজন যাত্রী নেমে গেছেন …বেশ অনেকক্ষন পর বাগনানের লেভেল ক্রসিঙে ‘ঢ্যাং ঢ্যাং’করে ঘন্টা বাজছে…কানাঘুষোয় শোনা যাচ্ছে, কাজ হয়ে এসেছে, ট্রেন এবার ছাড়বে হয়ত ….. দু চারটে ছেলে হৈ হৈ করে অনি আর কুরচির সামনের সিটে এসে বসল …নিজেদের মধ্যে একটা খোসগল্প শুরু করেছে …মাঝে মাঝেই কুরচির পাশের জানলা দিয়ে হাত বাড়িয়ে চায়ের ভাঁড় ফেলছে …সিগারেটের টুকরো ফেলছে, পানের পিকও ফেলছে… এক আধবার মাথাটা এগিয়ে দিয়ে কাকে যেন দেখছে… কুরচি এমনিতেই দুর্ভাবনায় ডুবে আছে…কেমন একটা দোলাচল… তার ওপর ছেলেগুলোর ছটফটানি তার মোটে ভালো লাগছিল না…গলা নামিয়ে আস্তে করে অনিকে বলল…
-পাশের কামরাটা ফাঁকা আছে কিনা দেখ না …তাহলে ওটায় গিয়ে বসি…
-আবার ওঠাউঠির কি আছে ? বস না…এই তো এবার ট্রেন ছাড়বে মনে হচ্ছে…সময় তো বেশ গড়িয়ে গেল… আর ফাঁকা ফাঁকা থাকবে না ট্রেন …দেখছিস না কেমন ভিড় হতে শুরু করেছে। সত্যিই ট্রেনটা নড়ে উঠল… একটা ভোঁ ভোঁ করে হুইসেলের আওয়াজও হল…অবশেষে ঝিক্ ঝিক্ ঝিক্ করে ট্রেন এগোতে শুরু করল…একঝলক ঠান্ডা হাওয়া জানলা দিয়ে উড়ে এসে কুরচির অশান্ত চোখেমুখে লাগল…উল্টোদিকের সিটের একটি ছেলে আরাম করে পা ছড়িয়ে বসল…বলল ‘ যাক ছেড়েছে’।আরেকটি ছেলে দুটি জানলার মাঝে রাখা ব্যাগের মধ্যে থেকে তাসের প্যাকেট বার করে ব্যাগটা রাখতে গেল…হঠাৎ জানলার হাওয়ায় কুরচির ওড়নাটা উড়ে গিয়ে ব্যাগের হ্যান্ডেলে গেল জড়িয়ে … দুজনেই অপ্রস্তুত হয়ে উঠে সামনাসামনি দাঁড়াল , পাশ থেকে অনি চেষ্টা করতে লাগল ওড়নাটাকে ব্যাগের হ্যান্ডেলের কোণের রিংটা থেকে ছাড়াতে …সামনের ছেলেটা একটা হ্যাঁচকা টান দিতেই কুরচির ওড়না গেল ফেঁসে …কুরচি হঠাৎ কেমন রেগে গিয়ে ছেলেটার গালে এক চড় বসিয়ে দিল । সঙ্গে সঙ্গে বাকি তিনটে ছেলের মধ্যে একজন সিট ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে কুরচির হাত চেপে ধরল…বলল,
–কি হচ্ছেটা কি? এসব কি? গায়ে হাত দিচ্ছেন কেন?
কুরচি বলল… “আমি তখন থেকে দেখছি উনি বিরক্ত করে যাচ্ছেন …জানলা দিয়ে পিক ফেলছেন …চায়ের ভাঁড় ফেলছেন…বার বার গায়ে হাত লেগে যাচ্ছে…
অনি বলল , “ওনার হাতটা ছেড়ে কথা বলুন…”
-তো? জানলা দিয়ে ফেলা বারণ নাকি…সিটটাকি আপনার একার সম্পত্তি ?
কুরচি বলে উঠল, “তা হবে কেন ? কিন্তু ইচ্ছে করে বিরক্ত করার জন্য এগুলো করছিলেন আপনারা …”
ব্যস আর যায় কোথায় চেঁচামেচি , তর্কাতর্কি …
অনি সমানে পাশ থেকে বলে , “চুপ করে যা কুরচি … ঝামেলা বাড়াস না…”
-কেন চুপ করব? আমি কি মিথ্যে বলছি?
আশপাশের লোকজন মজা দেখছে…তারমধ্যে একজন বলে উঠলেন ‘ … না ম্যাডাম হয়ত মিথ্যে বলছেন না তবে , নিত্যদিন ভিড়ের মধ্যে এরকম কত গায়ে গা ঠেকে যায়…। এ নিয়ে এত কেউ ভাবে না…এগুলো সবাই ইচ্ছে করে, করে না …এগুলোকেও সহ্য করতে জানতে হয়…সেটাও ভদ্রতা…’ উল্টোদিকে ছেলেগুলো বলে, ‘এত অপমান বোধ হলে প্যাসেঞ্জার ট্রেনে উঠেছেন কেন ?’ …পিছন থেকে এক বয়স্ক ব্যাক্তি বলতে থাকেন… ‘সবসময় কি ছেলেদের দোষ হয়…আজকালকার মেয়েরাও বাপু বড্ড উদ্ধত…যা হয়েছে, হয়েছে … ক্ষমা চেয়ে নিলেই হয়’ … অমনি উল্টোদিকের ছেলেগুলো বলতে থাকে – ‘হ্যাঁ হ্যাঁ ওনাকে ক্ষমা চাইতেই হবে…বলা নেই ,কওয়া নেই গায়ে হাত দেবেন কেন?’ কুরচির পাশে পাশে অনিও অনেক চিৎকার করল কিন্তু কেউ শুনলে তো?
কুরচি ক্রমশ রাগে অন্ধ হয়ে উঠছিল…তার সব রাগ গিয়ে পড়ছিল অনির ওপর…আর অনি গলা নামিয়ে বলছিল … ‘তুই গায়ে হাত তুলতে গেলি কেন? …আমি তো আছি নাকি? …যা হয়েছে, হয়েছে তুই সরি বলে দে ওরা ফ্লোটিং লোকজন …সব নেমে যাবে একটু পর …তুই আর ঝামেলা করিস না।’
কুরচি একগুঁয়ের মত দাঁতে দাঁত চেপে দাঁড়িয়ে রইল শেষে অনিই ‘সরি’ বলে দুঃখপ্রকাশ করে , কুরচিকে নিয়ে সামনের দিকের কামরায় এগিয়ে গেল…। ততক্ষনে অন্য কামরাগুলোতেও বেশ ভিড় । পাশাপাশি কোনও সিট নেই…ইতস্তত এক আধটা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে…। তার মধ্যে একটা জায়গা একটু ফাঁকা দেখে কুরচিকে ব্যাগ নিয়ে সিটে বসতে বলে অনি জলের বোতল বার করে জল খেল…কুরচি তখন নিজের মনের সাথে যুদ্ধ করছে…তারপর অনি যেই বলল… ‘এত মাথা গরম করলে চলবে?…অত উত্তেজিত হস না…সব ঠিক হয়ে যাবে…একটু ভরসা করতে পারছিস না আমাকে?’ হঠাৎ আগুনে যেন ঘৃতাহুতি হল…এতক্ষণ গুম মেরে থাকা কুরচি চেঁচিয়ে উঠল….
-ভরসা??? আর তোকে? কোথায় যাবি ঠিক নেই…কি করবি ঠিক নেই…সামান্য কটা ছেলের অপমানের মোকাবিলা পর্যন্ত করতে পারিস না…ঝামেলার ভয় পাস…খালি স্বপ্ন স্বপ্ন স্বপ্ন…শুধু স্বপ্ন দেখলেও কিছু হয় না অনি ? আমারই ভুল… আমি ভাবলাম কি করে তুই সব ব্যবস্থা করতে পারবি? না না আর নয়… তোর মতো ছেলের সাথে আমার গাঁটছড়া বাঁধার আর কোনও সাধ নেই…
ইতিমধ্যে ট্রেনের গতি ধীরে ধীরে থেমে গেল বাগনান স্টেশনের কাছে এসে…। আর কুরচি সিট ছেড়ে উঠে পড়ল…তারপর তার ব্যাগ নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে লাগল ভিড় ঠেলে । ঘটনার আকস্মিকতায় অনীশ প্রথমে কিছুটা স্তম্ভিত হয়ে গেলেও …কুরচিকে এগিয়ে যেতে দেখে তার পিছু পিছু তাকে থামাতে গেল, বলল …
-এটা কি পাগলামি করছিস বলত? এই কুরচি…কথা শোন…
আশপাশের লোকজনের অবাক চাউনি…আর এলোমেলো কথার মধ্যে দিয়ে কুরচি অনির কথায় কোনও আমল না দিয়ে দরজার মুখে এসে দাঁড়াতেই, অনি কুরচির হাতটা চেপে ধরে বলল,
– প্লিজ কুরচি শোন। কি করছিস তুই?
-না শুনব না আমি …আমি যা করছি একদম ঠিক করছি অনি। আমার সব ঘোর কেটে গেছে …এভাবে পালিয়ে , তোকে বিয়ে করে একটা অনির্দিষ্ট ভবিষ্যতের দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ার কোনও মানেই হয় না…আর তাছাড়া তুই জীবনে দেখেছিসটাই বা কি? তোর কোনো বাস্তব জ্ঞান পর্যন্ত নেই অনি…ক্ষমা কর আমায়…আমি তোর সাথে এভাবে যেতে পারব না…আর তাছাড়া সত্যি বলতে আমি মাকে ছেড়ে এমন করে চোরের মত পালাতেও পারব না…যদি কোনদিন সসম্মানে ঐ বাড়ি থেকে আমাকে নিয়ে যেতে পারিস তবেই আমাদের বিয়ে হবে নয়ত হবে না…। ট্রেনটা একটু দুলে উঠল…বুঝি বা অনির মনটাও। কুরচি নেমে পড়ল ট্রেন থেকে…… দু একজন যাত্রী ছুটে এসে গাড়িতে উঠল…এতক্ষণে অনির শ্বাসপ্রশ্বাসটা কেমন স্তব্ধ হয়ে গেছিল… চোখটাও কেমন একটা ঝাপসা ঠেকছিল …বুঝতে পারছিল কুরচিকে আর আটকানো যাবে না…ক্রমশ প্ল্যাটফর্মটা অনির থেকে একটু একটু করে দূরে সরে যাচ্ছিল , আর তার জীবন থেকে মিলিয়ে যাচ্ছিল কুরচিও …চলন্ত ট্রেন থেকে যতদুর চোখ যায় অনি দেখতে থাকল কুরচিকে …হলুদ সালোয়ার কামিজে একবারও পিছনে না তাকিয়ে ভিড়ের মধ্যে মিশে গেল কুরচি… অভিমানে আর অপমানে অনির বুকের ভিতরটা জ্বলে যাচ্ছিল । সেকি এতটাই অবুঝ ছিল…ভরসা না করার মতো ছিল…যে কুরচি ওর হাত ছাড়িয়ে ঐভাবে ওকে একা ছেড়ে ট্রেন থেকে নেমে পড়ল…আর যেন পালিয়ে বাঁচল? কি জানি?
…সেদিন কুরচি অনীশকে ভরসা করতে পারেনি…আর সত্যি বলতে আজও অনীশ নিজেকে ভরসা করতে পারেনা…সেদিনের সেই ক্ষোভ আজ আর নেই, এমনকি কোনও কিছুর তাড়নায় তাকে আর তাড়িয়ে বেড়ায় না …শুধু কুরচি কেমন আছে এই ভাবনাটাই হয়ত তাকে ঘিরে রেখেছিল এতদিন । …নাহ আর ভাববে না সে কুরচির কথা …আর নতুন করে কোনও পিছুটান তৈরিও করবে না…কারন সময় তাকে বুঝিয়ে দিয়েছে কুরচি , পৃথা এরা কেউ-ই তার কল্পলোকের নারীর মত হতে পারবে না…। আর সত্যি বলতে কুরচি তার জীবনে আজ অতীতই …কিন্তু পৃথা তো বর্তমান …আর সে-ই তো এখন তার জীবনের সত্যি … ঠিক যতটা মনের মিল হওয়া সত্তেও কুরচি অধরা থেকে গেছে ঠিক ততটাই মনের অমিল পৃথাকে তার কাছাকাছি এনে দিয়েছে..
গাড়ির কাঁচের মধ্যে দিয়ে অনি দেখল গাড়ি কখন যেন শহরতলী ছেড়ে তার নিজের শহরে ঢুকে পড়েছে….নিজের শহরের বেশ একটা চেনা চেনা গন্ধ আছে যাতে অনেক দুঃখ জারিয়ে যায়! ক্রমশ কলকাতার এই ব্যস্ত পরিবেশটায় অনীশের নিজেকে বেশ আশ্বস্ত লাগছিল… তার মন বলছিল স্বপ্নের প্ল্যাটফর্মের যাত্রাটা বুঝি আজ এখানেই শেষ হল…। আজ এত বছর যে স্বপ্ন তাকে ভোর রাতে প্রায়ই তাড়া করে বেড়াত অজানা এক গন্তব্যের দিকে ,আজ বোধহয় সেই স্বপ্নের রেশই তাকে মনে মনে অদ্ভুত একটা দৃঢ়তা এনে দিল , যার জোরে অনি ভাবলো …সে বাবাকে জানিয়েই দেবে , ‘ দাশনগরে কোনদিন কোনও প্রোজেক্ট হবে না , এটা তার সিদ্ধান্ত। ’ কেন জানি না এই না বলতে পারার দৃঢ়তাটা আজ তাকে বেশ খানিকটা তৃপ্তি দিল …যে অনীশ কোনদিন তার বাবার মুখের ওপর না বলতে পারে নি ,কুরচির ওপর জোর খাটাতে পারেনি….এমন কি নিজের ইচ্ছেগুলো অকপটে প্রকাশ পর্যন্ত করতে পারে নি …আজ কিন্তু নিজের প্রতি এক অটুট বিশ্বাসে নিজেকে তার আগের চেয়ে অনেক বেশি নির্ভরযোগ্য মনে হতে লাগল….এমনি করে চাওয়া পাওয়ার বিশ্লেষণে গাড়ি এসে দাঁড়াল বাড়ির গেটে , বারান্দার দিকে তাকিয়ে দেখল পেলে আর পৃথা ……পেলে চিৎকার করছে যথারীতি ‘বাবা এসেছে ,বাবা এসেছে’ …..গাড়ি থেকে নেমে একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে নতুন একটা জীবনের আগ্রহে আর নিজেকে নতুন রূপে খুঁজে পাওয়ার এক অমোঘ টানে ঘরের পথে পা বাড়াল অনি।
__________________________________________________________________শেষ।