Platform no. 13/@indrila/oimookh.com

Platform no. 13/@indrila/oimookh.com

পর্ব -১ _____________________________________________________

ঘুম ঘুম চোখে ঘড়িতে কটা বাজে ঠিক ঠাওর করতে পারা যাচ্ছিল না। জানলার বাইরেটা আজ বড়ো মেঘলা। আকাশটা কেমন যেন ঘন কালো হয়ে আছে। বাজে কটা? বিছানার পাশের সাইড টেবিল থেকে মোবাইল ফোনটা তুলে নিয়ে অনীশ দেখল ঘড়ি বলছে সাড়ে ছ’টা।
……ভীষণ রকম একটা আলসেমী কাজ করছে আজ অনীশের মধ্যে …জানলার পর্দাটা হাওয়ায় সরে গেছে একফালি…আর সেখান দিয়েই বাইরের আকাশটাকে একচিলতে দেখা যাচ্ছে । জানলার পাশের সুপারি গাছগুলো বেশ বৃষ্টিস্নাত। ঠান্ডা ঠান্ডা হাওয়া দিচ্ছে। অনীশ কিছুক্ষন একদৃষ্টে বাইরের দিকে চেয়ে রইল…তারপর গায়ের চাদরটা বেশ ভালো করে মুড়ি দিয়ে মুখ ঢেকে উল্টোদিকে ফিরে শুলো। পৃথার মাথার বালিশটা একটু একপেশে হয়ে আছে। গায়ের চাদরটা নিচের দিকে আলগোছে জট পাকিয়ে পড়ে আছে। …অনীশের পাশের জায়গাটা পৃথার । কিন্তু এখন সেটা ফাঁকা …পৃথা ঘুম থেকে উঠে পরেছে অনেক্ষন। অনীশ পৃথার বালিশটাকে দুহাতের মধ্যে আঁকড়ে ধরে চেপেচুপে শুয়ে রইল। গত রাতের তীব্র জৈবিক চাওয়াগুলোর আবেশ এখনও বুঝি তার শরীরে রয়ে গেছে সমমাত্রায়। তার খালি গায়ে আর চওড়া কাঁধে এখনও পৃথার কপালের সিঁদূরের লাল দাগ লেগে আছে কোথাও কোথাও। প্রতিটা মানুষেরই নির্দিষ্ট একটা গায়ের গন্ধ থাকে। পৃথার বালিশেও তেমনি গত রাতের আদুরে গন্ধটা মাখা হয়ে আছে। অনীশ পৃথার বালিশে নাক লাগিয়ে সেই আঘ্রানটাই পেতে চেষ্টা করছিল… হঠাৎ একটা ফুটবল এসে পড়ল অনীশের কোলের কাছে। চাদর থেকে মুখ বার করে সে তাকিয়ে দেখল …পেলে…তার চার বছরের ছেলে…ভাল নাম আলাপন।
-গুড মর্নিং বাবাই।
-মর্নিং বেটা। তুমি স্কুলে যাবে না ?
-না …বাইরে জল জমে গেছে…মা বলেছে আজ রেনি ডে। তাই দাদাই বলেছে আজ খিচুড়ি ইলিশমাছ ভাজা।
-বাব্বা সকাল হতে না হতেই দুপুরের খাওয়ার প্ল্যানিং রেডি…হি ইস গ্রেট।
কিন্তু তার আগে আরেকটু ঘুমবি আয় দেখি…
পেলে গুটি গুটি খাটে উঠছিল বলটা নেবে বলে … কিন্তু অনীশ পেলেকে জাপটে ধরে কাছে টেনে জড়ামড়ি করে চাদরে ঢুকিয়ে নিতে চেষ্টা করল। আর পেলে যেন ছাড়া পেতে পারলে বাঁচে ।
“উফফ উফফ” … হাঁসফাঁস করে উঠল পেলে…
এমন সময় পৃথার ডাক পাওয়া গেল, ঘরের বাইরে থেকে… “পেলে টুথব্রাশটা আবার কোথায় রাখলি?”
-চুপ চুপ…বাবাই …মামমাম আসছে।
-তবে আয়, চাদরের ভেতরে লুকোবি আয়।
…কয়েক মুহুর্ত শুধুই গরম শ্বাস-প্রশ্বাসের আদানপ্রদান চাদরের ভেতর , পেলে আর অনীশের। পৃথা ঘরে এসে একবার দরজার পিছনে , একবার আলমারীর পাশে , একবার খাটের নিচে খুঁজে বলল …
-ওমা কোথায় গেল ?এইতো দেখলাম এই ঘরে ঢুকল ফুটবল নিয়ে!
তারপর বিছানায় চাদরের মধ্যে একটা নড়াচড়া দেখে আর ফিসফাস শব্দ শুনে , পৃথা একটু মুখ টিপে হেসে মজা করে বলল …
-ওহো কোথায় গেল দুষ্টুটা ?…আমি তো খুঁজেই পাচ্ছিনা!…তাহলে নিশ্চয়ই ঘুমিয়ে পড়েছে…আর আমি তো জানি ঘুমলে পেলের পা নড়ে……কই দেখি পাটা কি নড়ছে চাদরের ভেতর?…এই বলে যেই না পৃথা চাদরটা তুলে দিয়েছে অমনি একটা খিল খিল হাসি। আর পেলে লাফিয়ে উঠে তার কচি কচি হাত দুটো দিয়ে পৃথার গলাটা জড়িয়ে ধরল। তারপর মা ছেলের সে এক খুনসুটি। অবশেষে পেলে তার মায়ের হাত থেকে ছাড়া পেয়ে ফুটবল নিয়ে লাফঝাঁপ করে ঘর থেকে পালিয়ে গেল।
…অনীশের বেশ লাগে পৃথা আর পেলের এই ছোট্ট ছোট্ট খেলাগুলো।অনীশ বলল…
-দিলে তো …মা ছেলে মিলে আমার ঘুমটার বারোটা বাজিয়ে!
-আর কত ঘুমবে ? ওঠো এবার। সাতটা বাজে।
-কি হয়েছে? আজ তো রেনি ডে ।
-সেকি তোমারও রেনি ডে?
-ওঠো ওঠো…আমি বিছানা গুছোব তো?
-বাহ রে, শুধু ছোটো ছেলেটার সাথেই যত খুনসুটি …বড়ো ছেলেটা যে কখন থেকে দেখছে এসব …তাকে চোখেই পড়ছে না তোমার।
-যাহ …একবারে যা-তা…কি হয়েছে তোমার? ওঠো বলছি …একটু বাজারে যাও না …ইলিশ মাছ পেলে নিয়ে এস …বাবা বলছিলেন আজ খিচুড়ি আর ইলিশমাছ ভাজা করতে দুপুরে।
-হেড অফিসের অর্ডার যখন…কিছু করার নেই, উঠতেই হবে। কিন্তু এমনি এমনিই উঠব? কিছু দেবে না তাহলে?
আপাত রাগে পৃথা তার মাথার বালিশটা ছুঁড়ে বলল… “না দেব না কিছু…। তুমি উঠবে নাকি? মাকে ডাকব এবার?”
-উঠছি বাবা…উঠছি…
অনীশ জানে মা আসলেই আরেক বিপদ…একথা সেকথা …তারপরই জুড়ে দেবে ছোটোবেলার কথা…। অগত্যা বিছানা ছেড়ে উঠতেই হল অনীশকে। গায়ের চাদরটা সরাতেই সিঁদুরের লাল দাগগুলো দেখে পৃথা বলে উঠল ,
“ এই … তুমি এখনও খালি গায়ে আছো ?…মা দেখলে কি ভাববেন …নাও এটা পর”… বিছানার নিচে রাখা গোল গলা সাদা টিশার্টটা পৃথা ছুঁড়ে দিল অনীশের দিকে। জামাটা লুফে নিয়ে একটু ঝেড়ে, অনীশ অবলীলায় সোজা জামাটাকে আবার উল্টো করে পরে ফেলে বলল … “দেখলে আবার সেই উল্টো হয়ে গেল।”…পৃথা হেসে বলল “সাধে কি বলি তুমি এখনো বড়ই হও নি!!!”

………………………………………………………………………………….ক্রমশ

  

 

পর্ব-২


     এক একদিন রাতে লেখার ভুত চাপে অনীশের। তখন সারাদিনের সমস্ত ক্লান্তি অবসাদ…চাওয়া পাওয়া সবকিছু সরিয়ে রেখে তার ভেতরে চলে এক ভাঙ্গাগড়া… শব্দ নির্মানের প্রবল দায়…সে যেন এক প্রসব যন্ত্রণা …কিছু ভালো লাগে না তখন অনীশের…স্টাডি রুমের আলো জ্বলতে থাকে কত রাত পর্যন্ত ……শব্দ সৃষ্টির তাড়নায় সে তার অলীক ভাবনাগুলোকে ভেঙ্গে চুড়ে নিংড়ে বীর্যপাত ঘটায় তার কলমের ডগায়। তারপর গভীর রাতে যখন আবেগ প্রশমন হয় তার খাতার পাতায়, নেমে আসে এক পরম শান্তি।
……সেদিনও এমনি অনেকটা রাত জেগে লেখালেখির পর অনীশের আর ঘুম আসতে চায় নি। স্টাডি ছেড়ে ঘরে এল অনীশ। বিছানায় বসে পাশের টেবিল ল্যাম্পটা জ্বালিয়ে সিগারেট ধরালো সে। রাত তখন পৌনে তিনটে হবে। পাশে অকাতরে ঘুমিয়ে আছে পৃথা। কপালের ওপর খোলা চুলগুলো ফ্যানের হাওয়ায় মাঝে মাঝে মুখে এসে পড়ছে, রাত পোশাকে শরীরের সমস্ত বাঁধন তখন হালকা…ঘরের সেই আলো আঁধারির মধ্যে কেমন যেন অনন্য সাধারন হয়ে উঠেছে পৃথা । তার সেই স্নিগ্ধ মায়াময়ী মুখের দিকে অপলকে তাকিয়ে রইল অনীশ বেশ কিছুক্ষণ। সকালে পেলেকে নিজের হাতে রেডি করে স্কুলে পাঠানো থেকে রাতে সবার খাওয়া দাওয়ার পর বাবার পান সেজে দেওয়া পর্যন্ত চলে তার কর্মকান্ড। এক কথায় বেশ গুছিয়ে নিয়েছে পৃথা তাদের সংসারটাকে । সত্যি বলতে সে সংসার করতেই ভালোবাসে। আর সব মেয়েদের মনের ভেতর যেমন ঘর বরের, সুখী গৃহকোণের একটা নিটোল ভাবনা থাকে, পৃথারও তেমনই কিছুটা আছে মনে হয়। না হলে অনীশের মত এমন ভাবুক ছেলের সাথে ঘর করা মুখের কথা নয়…। ছোটোবেলা থেকেই অনীশের যেন কেমন স্বপ্ন স্বপ্ন মন। তার মনোজগতের ভালোলাগা না লাগা, ভাঙ্গাগড়ার হদিশ বোধ করি সে ছাড়া আর কেউই জানে না । তার এই খামখেয়ালিপনা কোনোদিন তাকে কেরিয়ার সচেতন হতেও দেই নি… ইঁদুরদৌড়ে নাম লেখাতে যেভাবে ছুটে চলেছে নতুন প্রজন্ম অনীশ তার আওতার মধ্যে পড়েই না। তার মধ্যে সেই ইচ্ছেটার সিকি ভাগও দেখতে পাওয়া যায় না। তাই তার বাবা অম্বরীশ মিত্র তাদের পারিবারিক ল্যাবরেটরি ইন্সট্রুমেন্টের ব্যবসার কাজে ব্যাস্ত রাখতে চেষ্টা করেছেন তার একমাত্র সন্তান অনীশকে, তা প্রায় তার বিয়ের পর থেকেই । যদিও এখন সে ব্যবসার কাজকর্ম বেশ দায়িত্ব নিয়েই দেখাশনা করে তবুও তার ভালো লাগে না এই দিনগত পাপক্ষয়ের ব্যাপারটা… রোজকার এত হিসেব নিকেশ লাভ ক্ষতি। মাঝে মাঝে কেমন যেন জীবন-যন্ত্রনা হয়ে দাঁড়ায় তার কাছে এই সমস্ত ফ্যাক্টরির কাজ, ওয়ার্কশপের কাজের দেখভাল করাটা। তার বেরিয়ে পড়তে ইচ্ছে করে সব কিছু ছেড়েছুড়ে সেই আগের মতন…একা একা…উদ্দেশ্যহীন ভাবে।
……………ছেলের এইসব বাউন্ডুলে ভাবগতিক দেখেই অম্বরীশ নিজে থেকেই খোঁজখবর করে অনীশের সাথে পৃথার বিয়ের সম্বন্ধটা করেছিলেন একটু আগেভাগেই…তার ধারণা ছিল …‘কাচায় না নোয়ালে বাঁশ …পাকলে পরে ঠাস ঠাস’… । হাজারো ওজোর আপত্তি থাকলেও বাবার মুখের ওপর না বলে ওঠার সাহস করে উঠতে পারে নি অনীশ। শেষমেশ অনীশ আর পৃথার বিয়েটা হয়েই যায়। যদিও কিন্তু বিয়ের প্রথম প্রথম তার পৃথাকে মানতে বেশ অসুবিধে হয়েছিল… কারন ইতিমধ্যেই সে প্রেমে আঘাত পেয়ে খানিকটা বিধ্বস্ত হয়েই পড়েছিল ……তারপর ধীরে ধীরে পৃথার মমতায় আর বন্ধুতায় অনেকটা ঝড় ঝাপটা কাটিয়ে , তাদের সমান্তরাল সম্পর্কটা পেলের হাত ধরে একটা সামতলিক রূপরেখা ফিরে পেয়েছে একসময় । দেখতে দেখতে আজ তাদের বিবাহিত জীবন প্রায় বছর ছয়েকের হতে চলল। আর কেমনভাবে অনীশও যেন এই ক’বছরে বেশ নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে পৃথার ওপর। সেদিনের সেই অনীশ আজ অনেক বেশি গৃহি ।
…এইসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে অনেক সাধ্যি সাধনার পর যখন ঘুম এল অনীশের দুচোখ জুড়ে , তখন প্রায় ভোর হয়ে এসেছে। …ঘুমের মধ্যে ধোঁয়া ধোঁয়া এক গভীর অন্ধকারের মাঝে, থেকে থেকে ভেসে উঠতে লাগলো সারি সারি অচেনা মুখ…… কুলি হাঁকাহাঁকি …চা ওয়ালার ডাক “চায়ে গরম …চায়ে গরম” …… ট্রেনের ঘষটানির শব্দ… চারিদিকে শুধু যাত্রীদের ঢল , কালিঝুলি মাখা ভিখারি পথশিশুর মুখ… ইতস্তত বিক্ষিপ্ত মানুষের জটলা ।… ব্যাস্ততার এক সুনিপুন চিত্র …কানে আসতে থাকলো কিছু টুকরো টুকরো কথা। সুদীর্ঘ এক প্ল্যাটফর্ম…বেঞ্চে বেঞ্চে রাখা বাক্স প্যাঁটরা… কিন্তু সবাই যেন স্থির চিত্রের মত উন্মুখ হয়ে আছে কিসের অপেক্ষায়… ঘন ঘন মাইকে টিং টং শব্দ …এরই মাঝে শোনা গেল একটা ঘোষণা …“ টু থ্রী নাইন আপ পাঁশকুড়া লোকাল সকাল ছটা পনেরো, প্ল্যাটফর্ম নম্বর চোদ্দোর পরিবর্তে প্ল্যাটফর্ম নম্বর তেরো থেকে ছাড়বে ।” …চারিদিকের চিত্রটা যেন মুহূর্তের মধ্যে বদলে যেতে লাগলো… কেমন সরব হয়ে উঠল আশপাশটা …ছোটাছুটি ….. ডাকাডাকি …হৈ হৈ…গম গম করে উঠল…কিসের যেন একটা চরম ব্যাস্ততা …দমচাপা অপেক্ষা…হঠাৎ সব যেন কেমন নড়ে চড়ে উঠল… সরে সরে যেতে লাগলো প্ল্যাটফর্মটা… জানলা দিয়ে যতদূর চোখ যায় শুধু এক নিমেষহীন দৃষ্টি … একবুক অতৃপ্তি …চারিদিকের ভীড় ঠেলে ট্রেনটা স্টার্ট নিয়েও ঝাঁকুনি দিয়ে থেমে গেল আর সেই সঙ্গে তীব্র এক হুইসেলের শব্দে চমকে উঠে পা দুটো খাটের ধারে ঠুকে গেল অনীশের… ঘুমটা ভেঙ্গে গেল তার…ঘন ঘন শ্বাস প্রশ্বাসের ওঠাপড়ায় ততক্ষণে পলকে গায়েব হয়ে গেছে প্ল্যাটফর্মের সেই দৃশ্যপট, এখন চারিদিকে শুধু এক সীমাহীন নীরবতা… চোখ মেলে ঠায় তাকিয়ে রইল অনীশ সিলিং-এর দিকে… কেমন যেন বোকা হয়ে গেছে সে…। সারা শরীর ঘামে ভিজে গেছে …গলায় আকন্ঠ এক তৃষ্ণা… বাইরে তখন ভোরের মৃদু আলোর হাতছানি আর পাখির কিচিরমিচির শব্দ। …স্বপ্ন কেন এমন হয়? আর কেনই বা এমনভাবে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায় মানুষকে তা আজও অনীশ বুঝে উঠতে পারে নি …। কেন যে দেখে এই স্বপ্নটা সে বারে বারে…?কে জানে!
-কিগো এতো ঘামছো কেন? জল খাবে? দাঁড়াও আমি দিচ্ছি।
-না না ঠিক আছে। আমি নিয়ে নিচ্ছি । তুমি শুয়ে থাকো।
বিছানায় উঠে বসে, সাইড টেবিলে রাখা জলের জগ থেকে এক নিঃশ্বাসে অনেকটা জল খেয়ে নিল অনীশ।পৃথাও তখন উঠে পড়েছে… আলগোছে হাত খোঁপা বানাচ্ছে তার চুলে। বিছানা ছেড়ে উঠে দক্ষিনের বারান্দায় এসে দাঁড়ালো অনীশ। নিচে তাকিয়ে দেখলো বসুধা তখন সবেমাত্র স্নান সেরে তামার ঘটি থেকে সদর দরজায় জল ছিটচ্ছেন…পরনে লাল পেড়ে শাড়ি… কপালে সিঁদুরের বড় টিপ… হাতে ফুলের সাজি। মায়ের এই চেহারাটার মধ্যে কেমন একটা স্বস্তির আশ্রয় খুঁজে পায় অনীশ…। বাগানে আজ অনেক ফুলের সমারোহ …জবা , টগর , গন্ধরাজ , গাঁদা …। বেশ একটা হালকা হাওয়ায় তার গায়ের ঘামটা শুকিয়ে আসছে…আর ধীরে ধীরে ঝাপসা হয়ে আসছে তার ভোরের দেখা স্বপ্নের রেশটা…।

……………………..……………………..……………………..………………..ক্রমশ

  

 

 

পর্ব-৩


   পৃথার সাথে অনীশের সম্পর্কটা যতটা স্বামী স্ত্রীর, ততটাই মিথোজীবিতার …ঠিক তেমনি পেলের সাথেও অনীশের বেশ একটা বন্ধু বন্ধু ভাব। বাবা ছেলে এই ব্যাপারটা মনে হয় না…। কোথায় যেন দুজনেই অনেকটা একইরকম …দুজনেই ছেলেমানুষ ।সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত অনীশ ফ্যাক্টারীতে থাকে, তারপর দুপুরে বাড়ি এসে লাঞ্চ করে…সেরকম কাজ না থাকলে একটু বিকেল করে অফিসে যায় ,…ছুটিছাটায় পৃথাকে আর পেলেকে নিয়ে বেরোয় কখনও সখনও … আর মাঝে মাঝে বিকেলে পেলেকে নিয়ে পার্কে আসে। পেলে একটু ছোটাছুটি করে, বল নিয়ে খেলে…আর অনীশ ঘাসের ওপর শুয়ে শুয়ে খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে…আর কি যেন ভাবে।

-বাবাই , এস না একটু খেলি…
-ওই বিচ্ছু, তোর অতগুলো বন্ধু তো খেলছে, যা না ওদের সাথে গিয়ে খেল না…
-ওরা খেলায় নিচ্ছে না আমায়।
-কেন?
-বলছে ‘আমি তো ছোট’।
-সেকি ওরা খুব বড়ো নাকি?
-তুমি তো বড়ো …তুমি বল না ওদের।
-নারে, আমার বড়ো হতে ভাল লাগে না।
-কিন্তু আমি কবে বড়ো হব বাবাই?
-দাঁড়া আগে আমি বড়ো হই , তারপর আমি যখন বুড়ো হব তখন তুই বড়ো হবি।
-তুমি কি করছ বাবাই আকাশের দিকে তাকিয়ে? এখন তো তারা নেই!!
-মানে?
-আমার যখন ঘুম আসে না ঠাম্মাম বলে জানলা দিয়ে আকাশের তারা গুনতে। কিন্তু এখন তো বিকেল ,কত আলো…তুমি কি দেখছ আকাশে?
-আরে বাবা , শুধু তারা কেন রে আকাশে কত কি দেখার আছে জানিস? কত খেলা হয় মেঘেদের… আয় আমার পাশে শুয়ে পর আমি দেখাচ্ছি তোকে?
……পেলে বাবার পাশে ডিগবাজি খেয়ে হাত মেলে শুয়ে পরে ঘাসের ওপর । অনীশ বলে, রোজ রোজ বল নিয়ে কেন খেলব …আজ আমরা অন্য কিছু খেলব। বল তো ওই যে আকাশের ওই কোণে লাল আলো টা যে মেঘটার ফাঁকে দেখা যাচ্ছে , সেই মেঘটাকে কেমন দেখতে লাগছে?
-কই কোথায় ? গোটা আকাশটাই তো লাল!!
-ওই তো দেখ না তোর ডানদিকে দেখ…ও—ই-ই যে
-ওই সাদা কালো মেঘটা?
– হুম…ঠিক পান্ডার মত না?…সেই চিড়িয়াখানায় দেখা?
-হি হি হি…না না ভাল্লুকের মত।
-আচ্ছা তাই…বেশ এবার দেখ দূরে গাছের ফাঁকে দুটো প্রজাপতি কেমন উড়ছে …।
-আমি ধরব ওদের ?
…এই বলেই অনীশের পাশ থেকে পেলে লাফিয়ে উঠে ছুট লাগায়। অনীশ দেখে কি অবলীলায় পেলে সাদা প্রজাপতি আর হলুদ প্রজাপতির পিছনে দৌড়ে বেড়াচ্ছে। অদ্ভুত একটা ভালো লাগায় অনীশের চোখটা চিক চিক করে… পকেটে ফোনটা ভাইব্রেট করছে…অনীশ দেখে মায়ের ফোন । বসুধা চেনেন তার ছেলেকে ভালমতো । ছেলের হাতে নাতিকে ছেড়েও তার শান্তি নেই…
-কিরে পেলে কি করছে? ওকে দে তো একবার ফোনটা ।
-ওমা …ও তো এখন প্রজাপতি ধরছে।
-মানে? কোথায় কোথায় দৌড়োচ্ছে …দেখ দেখ …পড়ে যাবে তো রে।
-আমি আছি তো ? কি আর হবে ? তুমি অত ভাবলে তুমিই নিয়ে এস এবার থেকে।
-ওকে দে না একবার ফোনটা ।
-দাঁড়াও …পেলে এদিকে আয়…ঠাম্মামের ফোন …কথা বল।
……বাবার হাঁক পেয়ে পেলে হাঁফাতে হাঁফাতে এসে ফোনটা হাতে নিয়ে বলল…
-দেখলে তো তোমার জন্য পালিয়ে গেল প্রজাপতি দুটো।
-থাক অনেক হয়েছে এবার বাবার সাথে বাড়ি এস…
-না না আমি এখন পাখির বাসা দেখব…বাবা বলেছে আমায় দেখাবে।
-না আর বাসা দেখে কাজ নেই …তুমি বাবাকে নিয়ে বাড়ি এস…কি করছে বাবা?
-বাবাই তো আকাশে মেঘেদের খেলা দেখছে।
-কি???…আচ্ছা ফোনটা বাবাকে দাও…
-বাবাই ঠাম্মাম ডাকছে।
-হ্যালো …কি বলছ বল?
-তুই বাড়ি আয় ওকে নিয়ে… সন্ধ্যেবেলা বেরোবি তো?
-হুম …যাচ্ছি।
ফোনটা কেটে দিয়ে আবার যেন ভাবনায় ডুবে যায় অনীশ …পেলে তখন একটা কাঠি দিয়ে মাটি খুঁড়তে থাকে মাঠের একপাশে…
……অনীশের জগৎটা সত্যিই তেমন ডাইন্যামিক নয়…ব্যবসার কাজের ফাঁকে ফাঁকে একটা লেখালিখির জগৎ …তেমন চাপেরও নয়…তবু তার মাঝে মাঝে কেমন যেন অসহিষ্ণু লাগে… শুধু তার বাবা মাঝে মাঝে তার এমন ভাবলেশহীন অবস্থাটায় ভীষণ বিরক্ত হন…রাগ করেন…বলেন “তুমি আর কবে বড়ো হবে অনীশ? বয়স তো হল…এখন থেকে সব দায়দায়িত্ব বুঝে না নিলে আমি চোখ বুজলে কি করবে তখন??…এইভাবে আর কতদিন গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরবে?”……অনীশ চুপচাপ মাথা নামিয়ে শোনে…একটা অপরাধবোধ কাজ করে তার…ভাবে সত্যিই আজও সে অম্বরীশ মিত্রের ছেলে হয়েই রইল…জীবনে কিছুই আর করা হয়ে উঠল না…মনটা কেমন যেন অস্বস্তিতে ভরে যায় …তবে বেশিক্ষণ নয় বাবার রাগী চোখ দুটোর বাইরে চলে এলেই মনটায় ধীরে ধীরে ফুরফুরে হাওয়া লেগে যায়…বেশ হালকা লাগে । …পৃথা আশে পাশে থাকলে একটু আরক্ত মুখে শাসন করে…তারপর অনীশের মাথার চুলে হাত বুলিয়ে বলে …
-তোমাকে গম্ভীর হয়ে থাকতে দেখলে আমার মোটে ভাল লাগে না… কিন্তু বাবা কি কিছু ভুল বলেন ? ভেবে বল দেখি?
-না ঠিক ই তো বলেন …কিন্তু আমি যে মন বসাতে পারি না…
-তা বললে হবে?
-জানি হবে না…ঠিকই বলছ সবাই …আচ্ছা দেখি এবার চেষ্টা করে দেখি একবার।
……তার ভাবনায় ছেদরেখা টেনে পেলে বলে,
-বাবা দেখ কি বানালাম!
-কিরে?
-এই যে একটা ছোট্ট গর্ত … এটা আমার ব্যাঙ্ক
-ব্যাঙ্ক ? এর মধ্যে কি রাখবি?
-এই দেখ একটা পয়সা পেয়েছি কুড়িয়ে …এটা পুঁতে রাখব…দাদু বলেছে পয়সা ব্যাঙ্কে জমা রাখলে পরে অনেক অনেক হয়ে যায়।
……পেলের ভাবনায় হেসে ফেলে অনীশ …বলে “ঠিক আছে, এখন চল সন্ধ্যে হয়ে আসছে আমরা বাড়ি যাই। …পরে এসে বাকি কাজটা করব…আর গর্তটা আরেকটু বাড়াতে হবে তো …আজ ছেড়ে দে…।”
……………………..……………………..……………………..…………………….ক্রমশঃ


  

 

 

 

 

 পর্ব-৪


    সন্ধ্যের মুখে অফিসে এসে অনীশ জানতে পারলো একটা বড়ো অর্ডার এসেছে মুম্বাই থেকে…অম্বরীশ অফিসেই ছিলেন …ছেলেকে দেখে বললেন,

-নতুন ওয়ার্কশপের জন্যে একটা জায়গা দেখতে যাওয়ার ব্যাপার আছে কদিনের মধ্যে। তোমাকে নিয়েই যাবো। নিজেকে ফ্রী রেখো এই সপ্তাহটা…
-ঠিক আছে…কবে যাবে বোলো…
……কয়েকটা কোটেশান ফাইনাল করার ছিল…অনীশ কিছু পুরোনো ফাইল নিজের কেবিনে নিয়ে আসলো… অনীশের কেবিনটা বেশ ওয়েল ডেকোরেট …একটা ওভাল শেপড টেবিল উইথ রিভল্ভিং চেয়ার ……সামনে আরও তিনটে সিটিং অ্যারেঞ্জমেন্ট… ব্যাকসাইড ওয়ালে একটা এল সি ডি স্ক্রীন… একটা কর্নারে সোফাসেট, সেন্টার টেবিল……সাইডে শেলফ …ফাইল ক্যাবিনেট ……এক পাশে গোটা দেওয়াল জুড়ে ফ্লোর থেকে একটু উঁচুতে অ্যালুমিনিয়াম উইন্ডো উইথ গ্লাস পেন …কাচের ওপর লুভার্স… তার ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে রাসবিহারী মেট্রো স্টেশানটা । অনীশ বুদ্ধদাকে চা দিতে বলে ল্যাপটপে নতুন এস্টিমেটের খসরাটায় চোখ বোলাতে লাগলো …মেটেরিয়ালের নিউ প্রাইজ লিস্টটাকে মাঝে মাঝে আপডেট করে নিতে হয়… এমনসময় ইন্টারকামে অম্বরীশ বললেন
-পিসিমা এসেছে বেলেঘড়িয়া থেকে…বাড়িতে যেতে বলছে …
-ওহো …আমি তো এই এলাম…আচ্ছা চলো…
-না , আমার একটা মিটিং আছে আটটায় …তুমি বেরিয়ে যাও …আমি মিটিং সেরে যাচ্ছি। যাওয়ার সময় শ্রী হরির মালাই চমচম নিয়ে যেও …
-ঠিক আছে। আমি বেরিয়ে যাচ্ছি তাহলে…
……চা খেয়েই অনীশ বাধ্য ছেলের মত ল্যাপটপ আর ফাইল ক’খানা নিয়ে বেরিয়ে পড়লো…যাবার পথে ভাবলো ‘ পিসিমণি যে শ্রীহরির চমচম খেতে ভালবাসেন , বাবার সেটাও খেয়াল আছে!!’ …..গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়ে শ্রী হরিতে পৌঁছলো অনীশ… পাশের রাস্তাটায় গাড়ি থামিয়ে মিষ্টি কিনতে গিয়ে দেখা হল …বারীন বাবুর সাথে…অনীশের অঙ্কের স্যার…পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করল অনীশ…
-ভালো আছেন স্যার…চিনতে পারছেন ?
-কে বলো তো?
-অনীশ …স্যার…অনীশ মিত্র …মিত্র ইনস্টিটিউশন।
-হুম… খুব মনে পড়ছে… পাবলো ,মিতুল, কুরচিদের সাথে ছিলে তো?
-হ্যাঁ স্যার…এখনও পড়ান?
-না বাবা…এখন আর টিউশন করি না …শরীরও তেমন ভালো নেই…তা তুমি কি করছো এখন?
-আমি তো বাবার ব্যবসাই দেখাশনা করি …আর কিছু করতে পারলাম কই!!!
-সে কি কথা…এমন সাজানো বাগান থাকলে কে আর কি করতে চায়?
-জয়ি কেমন আছে স্যার ?
-ভালো আছে…ওর তো ব্যাঙ্গালোরে বিয়ে হয়েছে …একটা মেয়ে হয়েছে গতবছর…
-বাহ … অনেক দিন কোনও যোগাযোগ নেই তো …কারও সাথে দেখাও হয় নি তেমন…
-হ্যাঁ এখন তো সবাই ব্যস্ত… বড়ো ব্যস্ত …তুমি দুটো কথা বললে ভালো লাগলো…..চলি , সবাই ভালো থেকো কেমন !……বারীন বাবু এগিয়ে গেলেন… কেমন যেন মনটা খারাপ হয়ে গেল অনীশের…মিষ্টি নিয়ে গাড়িতে উঠল অনীশ …..পথে যেতে যেতে মনে পড়ে গেল কত পুরোনো কথা….সেই অঙ্কের ক্লাস…সেই বারীন বাবুর কোচিং…। পাবলো …তার স্কুলের জুটি … বারীনবাবুর মেয়ে জয়িতা আর সুমৌলীর জুটি।
…এই কোচিং-এই তার প্রথম দেখা সুমৌলীর সাথে… ডাক নাম কুরচি…
-কোন স্কুল?
-মিত্র ইনস্টিটিউশন।
-কোন ক্লাস?
-নাইন…
-আমারও ক্লাস নাইন …কমলা গার্লস।
বারীনবাবুর প্রথম অঙ্ক ক্লাসে পাশাপাশি বসে অঙ্ক কষতে কষতে পরিচয় পর্ব সারা হয়ে গেল দুজনের…
-তোর বাড়ি কোথায় কুরচি?
-কালীঘাটে … তোর?
-টালিগঞ্জ চারু মার্কেটে …।
ব্যাস…এরপর থেকেই দুজনের বেশ ভাব হয়ে গেল…. কোচিংএ যাওয়া আসার সময়ে বিশেষত………অনীশের তো পড়ায় মনটা কম …চিরকালই খালি স্বপ্ন আর স্বপ্ন। কিন্তু কুরচি ছিল বেশ চালাকচতুর …বুদ্ধিমতী…আর দায়িত্ববোধটাও বেশ ভালোরকমের।
বেশ কদিন হল অনীশের হোমওয়ার্ক করতে ভালো লাগছে না …বারীন বাবু বলেছেন “এরপর হোমওয়ার্ক না করলে ক্লাসে আসবি না”…..ফলে অনীশ পড়েছে মহা মুশকিলে …শেষ পর্যন্ত কুরচিই ভরসা… দেশপ্রিয় পার্কের ভিতরে বসে কুরচি অনীশের খাতায় অঙ্ক কষছে …আর অনীশ ঘাসের ওপর গঙ্গা ফড়িং-এর ওড়া দেখছে…
-কি করিস বলতো অনি? কিচ্ছু পড়াশোনা করছিস না…এইভাবে কি করে চলবে?
-কেন? তুই আছিস তো!
-দ্যুর… আমি কি সব সময় থাকব নাকি তোর সঙ্গে?
-কেন? থাকলে দোষ কি?
-মানে?
-মানে …আমি তো ভাবি তুই আছিস সবসময় আমার সাথে সাথে…আর পরেও থাকবি । …কিরে থাকবি না??
-পরে মানে?
-মানে সারাজীবন।
-তাহলেই হয়েছে…তোর মত খামখেয়ালি ছেলের সাথে সারাজীবন? …তুই আমার কোন সুরাহাটা করেছিস আজ পর্যন্ত …যে পরেও করবি?
-আচ্ছা কুরচি …একটা কথা বল …প্রেম বিয়ে দায়-দায়িত্ব এগুলো ছাড়া দুজনে একসাথে থাকা যায় না ,না??
-মানে? লিভ টুগেদার?
-না না, অত সব ভারি ভারি কথা আমি বুঝি না…অঙ্ক না পারলে যেমন তুই করে দিস…তেমন যদি জীবনের সব অঙ্ক মেলাতে না পারি…তুই মিলিয়ে দিতে পারবি না?
-ভগবান!!!!! এ কার পাল্লায় পড়েছি…না পারি ধরতে না পারি ছাড়তে…। শোন এসব ভুলভাল বকে কিছু লাভ নেই অনি…।ভালো করে পড় । জীবনে কিছু করতে হবে তো?…যতই তোর বাবার ব্যাকগ্রাউন্ড থাকুক …তোর পরিচয় তোকে নিজেকেই তৈরি করতে হবে…।……কত বড়ো কথা!!!……অথচ কত ছোট বয়সে কুরচি বলতো…সত্যি আজও সে পারে নি তার নিজের পরিচয় গড়ে তুলতে…কতদিন হয়ে গেল কুরচিকে দেখা হয় নি তার…সত্যি বলতে সে তেমন করে আর আঁকড়েও থাকে না কুরচির স্মৃতিগুলোকে এখন… এমনকি কুরচির সাথে পৃথাকে আর মেলায়ও না। প্রথম প্রথম পৃথাকে মেলাতো অনি, কুরচির সাথে…কারন তখন মনে হত কুরচি ছিল ঠিক তার মনের মত…কিন্তু এই ক’বছরে অনীশ বেশ বুঝেছে মনের মত বলে কিছু হয় না…কেউ হয় না…আসলে প্রতিটা মানুষের মাঝেই নারী পুরুষ দুটো সত্ত্বা থাকে । তাই তার কল্পনার নারী মানে একেবারে তার নিজের নারী সত্ত্বা…তা কেমন করে মিলবে কোনো জাগতিক নারীর সাথে। তাই পৃথা যতটা তার সেই কল্পলোকের নারীর থেকে অন্যরকম, ঠিক ততটাই অসম্পুর্ণ মনে হয়েছিল কুরচিকেও একসময় । তাই এখন আর পৃথার মধ্যেও সে কুরচিকে খোঁজে না … শুধু জানতে ইচ্ছে করে কেমন আছে কুরচি ?…ভালো আছে তো? হতে পারে সময় আজ তাদের আলাদা করে দিয়েছে…তাই বলে কি সব অনুভুতিগুলো মিথ্যে হয়ে গেছে?…স্মৃতিগুলো কি সব ঝাপসা হয়ে গেছে?…সত্যি কি সব ভুলে যাওয়া যায়…?…নাকি শুধু ইমপালসটা কমে যায়…রিফ্লেকশনটা ফিকে হয়ে যায় মাত্র…!!!
……গাড়ির হর্ন বেজে উঠলো বাড়ির গেটের মুখে এসে…পেলে রুদ্ধশ্বাসে ছুটে বারান্দায় এসে চেঁচাচ্ছে “বাবাই এসে গেছে, মামামাম…।বাবাই এসে গেছে…”।
……………………..……………………..…………………..ক্রমশ।


  

 

 

পর্ব – ৫


 

অনীশ বেশ থাকতে পারে নিজের মত। একা একা সময়ও কাটাতে পারে… কখনও সিনেমা থিয়েটারে, কখনও গাড়িতে লঙ-ড্রাইভে, আবার কখনো গড়ের মাঠে। তাই কখনো ব্যবসার কাজে বাইরে গেলে তার খারাপ লাগে না… সে নিজেকে দিব্যি রাস্তাঘাট, দোকানপাট, লোকজন, ধানক্ষেত, খানা-খন্দ, পুকুর-ডোবা, এই সবকিছুর মাঝেই হারিয়ে ফেলতে পারে…শুধু দিনের শেষে সবাই যখন ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে থাকে তখন এক-একদিন তার ভীষণ চোখ জ্বালা করে , মনে পড়ে কুরচির কথা …তাদের সেই ছেলেবেলার ভালোবাসার খুনসুটির কথা।
কুরচির কথা ভাবতে ভাবতে অনীশ তার বারান্দার রকিং চেয়ারে শরীরটা এলিয়ে দেয় …বেশ কয়েক বছর আগের কথা তখন কুরচির সামনে গোটা পৃথিবীটা বড়ো ফ্যাকাসে …জীবনটা বড়ো দুর্বিষহ তার বাবার হঠাৎ মারা যাওয়ায়…কুরচি আর তার মা যেন দিনকে দিন তার কাকার পরিবারে গলগ্রহ হয়ে উঠছে……নিত্যদিন উঠতে বসতে তার মেয়ে হয়ে জন্মানোটা তার নিজের চোখেই অপরাধ বলে অনুভূত হচ্ছে…… অথচ কুরচি তখনও কলেজের গণ্ডী পেরোয় নি। ওদিকে অনীশ তখন পড়াশোনার সাথে সাথে একটু আধটু লেখালিখি করছে…একটা দুটো লেখা ম্যাগাজিনে বেরতেও শুরু করেছে… কুরচির সেই অত্যন্ত স্ট্রাগলের দিনগুলোতে অনীশ কুরচির পাশে থাকতে চেয়ে বলেছিল ,
-চল না কুরচি …কোথাও চলে যাই…তুই আর আমি। পারবি না একটু সাহস
করতে… ।
-একটু সবুর কর অনি । বাড়ির পরিবেশটা একটু শান্ত হয়ে যাক…তারপর সব ছেড়ে ছুড়ে শুধু তুই আর আমি।
-দেখিস, আমি ঠিক চালিয়ে নেবো।
-হুম জানি…তুই এর মধ্যে একটা কাজ খুঁজে ফেল… আর আমিও বাড়িটাকে একটু গুছিয়ে নি… আচ্ছা অনি তোর বাবা মানবেন না, না আমাদের এই সম্পর্কটা?
-বাবা নাই বা মানলো … আমি আছি তো, তুই আমায় ভরসা করিস না?
-করি তো…কিন্তু?
-তাহলে আর কোনও কিন্তু নয়। আমি জানি মা আপত্তি করবে না।
ইতিমধ্যেই অম্বরীশ তার ছেলের ব্যাপারটা জানতে পেরেছিলেন কানাঘুষোয়…..বার কয়েক চোখেও পড়েছিল ঈষৎ শ্যামলা কুরচিকে অনীশের রাজপুত্রের মতো চেহারাটার পাশে …অনীশকে শুনিয়ে বসুধাকে বলেছিলেন, ‘অনীশ যদি তাঁর কথা না শুনে চলে তাহলে যেন নিজের রাস্তা নিজেই দেখে নেয়… স্বেচ্ছাচারিতা করলে এ বাড়িতে তার কোনও জায়গা হবে না । ‘ আসলে অম্বরীশ অনীশের পাশে কুরচিকে ঠিক মানতে পারেন নি, হয়ত তার পারিবারিক পরিকাঠামোর জন্যই। একবার একা কুরচিকে বাজার করতে দেখে গাড়ি দাঁড় করিয়ে অম্বরীশ কটমটে চোখে তাকিয়ে অপমান করেছিলেন তাকে দম্ভের বশে… অনীশের আজও মনে পড়ে কুরচি অপমানে আহত হয়ে অনীশের বুকে মাথা রেখে কেঁদে ফেলেছিল…আর অনীশ তার মাথায় হাত রেখে খোলা চুলে হাত বুলিয়ে বলেছিল…

-ক্ষমা করে দে কুরচি …ওনার মিথ্যে অহংকারে তোকে ছোটো করতে চেয়ে উনি নিজেই ছোটো হয়ে গেছেন অজান্তে… যখন উনি বুঝবেন তখন নিজেই লজ্জা পাবেন…ওনার চোখ রাঙ্গানিতে কি আমি তোর হাত ছেড়ে দেব?…কুরচি অনীশকে আঁকড়ে ধরে বলেছিল…
-কথা দে অনি , কোনওদিন আমাকে একা ছেড়ে দিবি না তো?
-কথা তো আগেই দিয়েছি কুরচি…আমি যে তোকে ছাড়া অসম্পূর্ণ ।
…সেই প্রথম অনীশ অবাধে ঠোঁট ছুঁয়েছিল কুরচির …ভাবতে ভাবতে অর্ধেক রাত কেটে যায় অনীশের…অপরিসীম ভালবাসার স্মৃতিতে চোখ বুজে আসে তার ।মাঝরাতে ঘুম ভেঙ্গে গেলে পাশটা খালি খালি ঠেকে পৃথার, উঠে পড়ে বিছানা থেকে, বাইরের বারান্দায় এসে ঘুমন্ত অনিকে রকিং চেয়ারে শুয়ে থাকতে দেখে তার চোখের চশমাটা খুলে পরম মমতায় গায়ে একটা চাদর চাপা দিয়ে দেয় । পৃথা জানে অনীশের মাঝে মাঝে একটু একা থাকার দরকার হয় । তাই তার নিজের ভালো না লাগলেও একটু সরে থেকে অনীশকে সেই জায়গাটুকু দেয় পৃথা।
………ঘুমের মধ্যে অনির কানে বাজতে থাকে খাপছাড়া কিছু কথা…এলোমেলো কিছু শব্দ…চারদিকে কেমন যেন সবুজের আঘ্রান…এক রাশ খোলা হাওয়া …কিন্তু হঠাৎ যেন পরিবেশটা গুমোট হয়ে যায়… মনে আসে কিসের একটা উদ্বেগ …কেমন একটা চাঞ্চল্য …এত ভিড় কেন চারিদিকে…কেমন যেন চাপাচাপি…অনীশ চেষ্টা করতে থাকে ভিড় ঠেলে সামনে এগোতে কিন্তু অসম্ভব ধস্তাধস্তি হতে থাকে… কানে আসে কিছু অশালীন মন্তব্য…তার পায়ের নিচের মাটিটা দুলতে থাকে…সে যেন এতক্ষণ একটা ট্রেনের ভিতর ছিল… প্লাটফর্মের একটা তীব্র ঝাঁঝালো গন্ধ নাকে আসছে… ট্রেনটা কি ছেড়ে দিল?… প্ল্যাটফর্মটা সরে সরে যাচ্ছে……কিন্তু তাকে তো নামতেই হবে!!!যে ভাবেই হোক তাকে ঐ চলন্ত ট্রেন থেকে নামতেই হবে…ভয়ানক একটা উত্তেজনা আর দমচাপা কষ্ট… কিছু চোরা চোখের চাউনি…বিশ্রী হাসি আর প্রবল উপেক্ষা নিয়ে অনীশ রাগে লজ্জায় অভিমানে বুকের বাঁদিকটা খামচে ধরে… আর সঙ্গে সঙ্গে একটা চেন টানার কর্কশ আওয়াজে অস্ফুটে তার গলা দিয়ে বেরিয়ে আসে একটা স্বর…
-আঃ
চোখ মেলে অনীশ দেখে পৃথা গাছে জল দিচ্ছে…অনীশের দিকে না ফিরেই পৃথা বলে উঠল…
-আবার নিশ্চয়ই স্বপ্ন দেখছিলে? এই যে মশাই…কাল রাতে কি আমাকে এতটাই অসহ্য লাগছিল যে ব্যালকনিতে এসে ঘুমোতে হল?
-ইসসস্ ঘুমিয়ে গেছিলাম এখানেই ? ডাকোনি কেন?
-কি জানি বাবা…লেখালেখি করে কত রাতে শুয়েছ কে জানে !
চোখমুখ দুহাতে ডলে রকিং চেয়ার থেকে উঠতে গিয়ে গায়ের চাদরটা মাটিতে পরে যেতে দেখে অনীশ একটু আদুরে গলায় বলে…
-আবার গায়ে চাপা দিয়ে দিয়েছিলে? আমার চশমা কই?
-ঘুমোচ্ছ দেখে আর ডাকি নি গো …শুধু শীতে কুঁকড়ে শুয়েছিলে তাই গায়ে চাদরটা দিয়ে দিয়েছি আর চশমাটা খুলে ঘরে রেখেছি … পিসিমনি আছেন খেয়াল আছে কি ? যাও ফ্রেশ হয়ে ডাইনিং-এ যাও। বাবা আজ বেরোবেন না বলেছেন …হয়ত তোমাকেই অফিসে যেতে হবে…কোথায় যেন একটা যাওয়ার কথা বলছিলেন।……ডাইনিং এ এসে অনীশ দেখে বেশ জমাটি আড্ডা চলছে…চা পর্ব প্রায় শেষ। অনীশকে দেখে পিসিমনি বলেন “কিরে ঘুম ভাঙল? তোর ছেলের কি মিষ্টি মিষ্টি কথা রে!”….. পিসিমনির কথায় অনীশ জানতে পারে পেলে বলেছে যে , দাদাই নাকি ওর থেকেও বেশি ব’কে বাবাইকে আর বাড়িতে সবাই বলে, পেলের বাবা পেলের চেয়েও ছোটো ।অনীশ একটু অপ্রস্তুত হাসে পিসিমনির কথায়…অম্বরীশ খবরের কাগজে চোখ বোলাচ্ছিলেন অনীশকে দেখে বলে ওঠেন,
-ভালোই হয়েছে উঠে পড়েছ…তৈরি হয়ে নাও…তোমাকে একবার দাশনগরের দিকে যেতে হবে আজ…ঐ ওয়ার্কশপের জমিটার ব্যাপারে। আজ আমি যেতে পারব না…ঋত্বিক যাবে তোমার সাথে।
-আজই? কিন্তু আমি একা দেখে কি বুঝবো?
-কেন? বুঝবে নাই বা কেন?…আগে তো প্লটটা দেখে এসো… ওদের কাগজপত্রের কপি নিয়ে এসো… আমি অ্যাডভোকেট অরুনাংশুকে দেখাই তারপর তো ফাইনাল করার সময় আমি যাবই…জমি-জায়গা তো একবার দেখায় কেনাকাটি হয় না!!
-ঠিক আছে কখন বেরোতে হবে বলো…আমি অফিসে গিয়ে ঋত্বিকের সাথে কথা বলে তোমায় জানাচ্ছি।
……অফিসে ঢুকে অনীশ ম্যানেজার বাবুকে সব বুঝিয়ে অম্বরীশের টেকনিক্যাল অ্যাডভাইজার ঋত্বিকবাবুকে নিয়ে বেড়িয়ে পড়লো… অফিসে চুপচাপ বসে থাকার চাইতে অনীশের গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়তে ভালোই লাগে। ব্যস্ত কলকাতার যানজট পেরিয়ে …গাড়ির ক্র্যাকাফনি ছাড়িয়ে কোনা এক্সপ্রেস ওয়ে দিয়ে গাড়ি ছুটে চলল… গাড়ির ভেতর সুমনের গান চলছে ‘কতটা পথ পেরোলে তবে পথিক বলা যায়…কতটা পথ পেরোলে পাখি জিরোবে তার দায়…কতটা অপচয়ের পর মানুষ চেনা যায় …প্রশ্নগুলো সহজ আর উত্তরও জানা’
…অনীশ যেন কেমন নস্টালজিক হয়ে পড়ছে… সত্যি কত কত সময়ের অপচয় হয়ে গেছে জীবনে, আজও অনীশ নিজের পরিচয় গড়ে তুলতে পারে নি। কুরচির দেখা অনীশ আর পৃথার দেখা অনীশের মধ্যে কতটুকুই বা পার্থক্য হয়েছে? কিই বা দিতে পেরেছে তার পরিবারকে সে… অথচ তার বাবা নয় নয় করে তাদের এই ব্যবসাকে আজ এমন জায়গায় দাঁড় করিয়েছেন যে মোটামুটি এই ল্যাব ইন্সট্রুমেন্টের ব্যবসায় তারা অনেক বছর বেশ একাধিপত্য বিস্তার করে আছে… চারটে ওয়ার্কশপ তো আছেই ,আর যদি এই দাশনগরের জায়গাটা ফাইনাল হয় তবে এটা পাঁচ নম্বর ওয়ার্কশপ হবে । দাশনগরে সাড়ে এগারো কাটা একটা জমির ন’কাটা বিক্রি আছে …আর এই ব্যাপারে কথা বলতেই সে আর ঋত্বিক বাবু চলেছে জমির মালিকের সাথে কথা বলতে। এইসব দিকে অনীশ আগে কখনও আসেনি… চারপাশের রাস্তাঘাট দোকানপাট সব যেন জলছবির মত সরে সরে যাচ্ছে। দৃশ্যপট বদলে যাচ্ছে পলকে…শহর ছেড়ে শহরতলী…মাঠঘাট পুকুর জলা জঙ্গল পেরিয়ে তাদের গাড়ি ছুটে চলেছে … অতঃপর বেশ কিছু সময় পরে বাসস্ট্যান্ড থেকে কিছুটা ভেতরের দিকে নির্দিষ্টস্থানে এসে পৌঁছালো অনীশ আর ঋত্বিক …চারদিক উঁচু পাঁচিলে ঘেরা বেশ বড়ো একটা কারখানার শেড চোখে পড়ল তাদের বাইরে থেকে … লোহার গেটের মুখে এসে হর্ন দিতেই অনীশ দেখল ভেতর থেকে গেট খুলে দিল এক মাঝবয়সী ভদ্রলোক আর ততক্ষণে তাদের গাড়ির আওয়াজ শুনে গেটের কাছে এগিয়ে আসছেন আরেকজন বেশ বয়স্ক ভদ্রলোক।
……………………..……………………..……………………..…………….ক্রমশঃ


  

 পর্ব – ৬


     গেটের মুখেই অনীশকে সাদরে অভ্যর্থনা জানালেন জমির মালিক প্রবীণ সুকুমার দাস । ভদ্রলোক স্বভাবে বেশ অমায়িক । ঋত্বিকবাবুও নিজেদের পরিচয় দিলেন সুকুমার বাবুকে।ভদ্রলোকের উৎসাহ দেখে মনে হল, অম্বরীশ মিত্রের ফোন পেয়ে আগে থেকেই উনি সচেতন ছিলেন । সুকুমারবাবু অনীশকে বাড়ির ভিতর যাওয়ার জন্য অনুরোধ জানালেন । কিন্তু ঋত্বিকবাবু বললেন ,
-আগে জমিটা একটু ঘুরে দেখতে চাই।
-দেখবেন ক্ষণি , এতটা পথ আসলেন আগে একটু জিরিয়ে নিলে হত না?
-না না , ঠিক আছে এতটা পথ আর কোথায়!!
অগত্যা সুকুমারবাবু সম্মতিসূচক ঘাড় নেড়ে তার সঙ্গের মাঝবয়সী মানুষটির সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন…
-ও আমার ভাইপো সুশান্ত , ঠিক আছে যান তাহলে ওর সাথেই ঘুরে আসুন চারপাশটা …আমি আজকাল কোমরের ব্যথায় একটু কাবু হয়ে গেছি।
এতক্ষণ পর অনীশ কিছু বলল,
-সেকি? তাহলে তো আপনার কষ্টই হচ্ছে দাঁড়িয়ে থাকতে…
-না তেমন নয় …তবে বেশিক্ষণ দাঁড়াতে একটু অসুবিধে হয় ।
-ঠিক আছে, আপনি ভেতরে থাকুন আমরা একটু জায়গাটা দেখে নি, তারপর কথা বলছি।
-হ্যাঁ হ্যাঁ, অবশ্যই।
……সুশান্তবাবু অনীশ আর ঋত্বিকবাবুকে পুরো জমিটাই ঘুরে ঘুরে দেখাতে লাগলেন। সাড়ে এগারো কাঠা জমির মধ্যে সাত কাঠা জমিতে কারখানার শেড, গেট, স্টোর ,এমন কি একটা বড়ো মেশিন রুম পর্যন্তও করা আছে। সুকুমার বাবুর মাতামহের আমলে ওখানে একটি লেদ কারখানা ছিল। যা সুকুমার বাবু ধরে রাখতে পারেন নি ঠিকমতো , লিজে দিয়ে দিয়েছিলেন । বছর খানেক হল সেও উঠে গেছে। অনীশ চুপটি করে দেখে যাচ্ছিল সব, আর ঋত্বিকবাবুর সাথে সুশান্তবাবুর কথা হচ্ছিল মাঝে সাঝে । সুশান্ত বাবু বলে চললেন,
-এখন এই পুরো জায়গাটাই ফাঁকা পড়ে আছে। ভিতরের দিকে বাকি সাড়ে চার কাঠা জমিতে কাকার নিজস্ব বাড়ি আর একটি বাঁধানো পুকুর আছে, পুকুরের ধারে অল্প একটু বাগান।
-তাহলে তো আপনাদের এ সব দেখাশোনা করার জন্য প্রচুর লোক আছে?
-হ্যাঁ তা ছিল এককালে …চাকর বাকরে বাড়ি গমগম করতো। এখন অবশ্য কেউই নেই সেরকম , তাই এসব আমিই একটু দেখভাল করি। এইসব জমিজমা ছোট কাকার মাতৃকূলের সম্পত্তি । আমাদের আসল বাড়ি তারকেশ্বর লাইনে …..আমার বাবা আর ছোট কাকার বাবা ছিলেন ভাই ভাই। কাকা বিয়ে থা করেন নি…শৌখীন মানুষ ছিলেন …একা দেখাশোনা করে উঠতে পারতেন না…তাই আমাকে ডেকে নিয়েছিলেন । তা বেশ কয়েক বছর আগের কথা।
-আচ্ছা জমি বিক্রি মানে তো কারখানাটা সমেতই বিক্রি করতে হবে…আর তাহলে আপনারা কি ঐ বাকি অংশটুকুতেই থাকবেন?
-দেখি কাকা কি বলেন? আসলে ব্যবসাটা বন্ধ হয়ে যেতে এখন একটু অবস্থাটা পড়ে গেছে তো…তাই কাকা এখানে আর থাকতেও চাইছেন না , বলছেন তারকেশ্বর চলে যাবেন । কিন্তু বাড়িটার ওপর তো একটা মায়া পড়ে গেছে …দেখি কি বলেন…উনি যা বলবেন।

……জায়গা দেখা শেষে সুশান্তবাবু বাড়ির ভেতর ওনাদেরকে নিয়ে আসলেন……সামনের বারান্দা পেরিয়ে বৈঠকখানায় নিয়ে এসে বসালেন। বাড়িটা বেশ পুরোনো আমলেরই… আসবাবপত্রও বেশ পুরোনো দিনের , সেই সাদা নাইলন তারে বোনা কাঠের সোফা …একটা কাঠের গোল টেবিল …উল্টোদিকে একটা আরাম কেদারায় সুকুমারবাবু বসে ছিলেন। অনীশকে দেখে বললেন,
-আসুন আসুন …কি দেখা হল জমি ?…
-হ্যাঁ …
-কেমন দেখলেন বলুন?
-ভালোই…
-সুশান্ত একটু চায়ের কথা বলে এস তো দেখি ভেতরে।
অনীশ বলে উঠল,
-না না চায়ের তেমন প্রয়োজন নেই একটু জল খাব ।
-আরে তা বললে হবে নাকি? জলও খাবেন, চাও খাবেন।
…কথার ফাঁকে ঋত্বিকবাবু কাগজপত্রগুলো দেখতে চাইলেন ।অনীশ খুব অস্বস্তিতে পরে গেল এদের আপ্যায়নে । সুকুমারবাবু সত্যি বেশ অসুস্থ, তাই সুশান্তবাবুই দেরাজের চাবি খুলে জমির দলিলপত্র বার করতে উদ্যোগী হলেন। জমির দাম কাগজপত্র এসব নিয়ে যতক্ষণ কথা হতে লাগল ততক্ষণে সুশান্তবাবু অনীশ আর ঋত্বিকের জন্য একটু জল মিষ্টির তৎপরতা করতে বাড়ির ভেতরে গেলেন । রান্নাঘর থেকে ঘুরে এসেই আবার সুশান্তবাবু তার কাকার নির্দেশের জন্য দাঁড়িয়ে রইলেন ঘরের এক কোণায় । একটু পরেই অনীশের কানে একটা হালকা নূপুরের শব্দ এলো……হাজার চেষ্টা করেও নিজেকে সংযত করতে পারল না অনীশ, তার চোখ সেই শব্দ অনুসরণ করে চলে গেল ঘরের দরজার দিকে, দেখল পর্দার আড়ালে একজোড়া আলতা পড়া পা।…অনীশের অন্যমনস্কতা দেখে সুশান্তবাবুও সেই দৃষ্টি অনুসরণ করে এগিয়ে গেলেন দরজার মুখে, পর্দাটা ঈষৎ তুলে খাবারের ট্রে টা হাতে করে নিয়ে এসে অনীশের সামনে কাঠের টেবিলে রাখলেন। একপলকে যতটুকু চোখে পড়ে অনীশ দেখল ঘোমটা দেওয়া একজন মহিলার শাঁখা পলা পড়া হাত, যার পরনে হলুদ রঙের জমি , আর বেগুনী পাড়ের তাঁতের শাড়ী । সুশান্তবাবু খাবারের ট্রে থেকে দুটি কাচের ডিশ ওনাদের সামনে সাজিয়ে রাখলেন। গরম লুচি, ছোলার ডাল, আলুরদম, দু তিন রকম মিষ্টি …এতসব দেখে দুজনেই কেমন লজ্জা পেয়ে গেল । ঋত্বিকবাবু বললেন,
-বাবা এত আয়োজন ?
অনীশ একটু হেসে বলল,
-এত খেতে পারা যাবে না।
সেই শুনে সুকুমার বাবু হাসলেন ,
-আরে মশাই খেয়ে নিন, খুবই সামান্য কিছু , তাজা বয়স আপনাদের , আর এই তো খাওয়ার সময়…আপনাদের বয়সে আমরা কত খেতাম জানেন!! সত্যি আজ ভাবি সে একটা দিন ছিল বটে !!!
…নিজের মনেই কেমন যেন হেসে উঠলেন সুকুমার বাবু….তারপর সুশান্তবাবুকে বললেন ,
-ওনারা ততক্ষণ খান তুমি বরং জমির দলিল আর পরচার কাগজগুলোকে জেরক্স করে নিয়ে এস সুশান্ত ।
সুশান্তবাবু বেরিয়ে গেলেন কাকার হুকুমে। একটু পরে অনীশের চোখে পড়ল পর্দার বাইরে একটা ছায়ার নড়ে চড়ে ওঠা …আর একগোছা চুড়ির রিনরিন মৃদুশব্দ …দরজায় ঈষৎ টোকা পড়ায় সুকুমার বাবু বললেন,
-চা এনেছ তো ? ভেতরে এস বউমা। ওনারা কলকাতা থেকে এসেছেন।
ভদ্রমহিলা পর্দা সরিয়ে ভেতরে আসলেন। মাথার ওপর ঘোমটা টানা , কাপড়ের কোনাটা দাঁত দিয়ে কামড়ে রাখা… সুকুমার বাবু বললেন , ও সুশান্তর স্ত্রী, বউমার বাপের বাড়িও কোলকাতায় …কালিঘাটে…। কালিঘাট নামটা শুনেই অনীশ নিজের অজান্তেই চোখ তুলে চাইল… চায়ের ট্রে টা টেবিলে নামিয়ে রেখে, ভদ্রমহিলা দাঁতে চেপে রাখা ঘোমটার কোনাটা ছেড়ে , হাতে করে মাথায় কাপড়টা টেনে নিল। তারপর ঘোমটার ফাঁক দিয়ে ডাগর চোখে এক পলক অনীশের চোখে চোখ রেখে বলল,
-কিছুই তো খাওয়া হয় নি দেখছি । কথাটা কানে শিহরণ তুলল অনীশের , অবাক চোখে তাকিয়ে দেখল কপালের লাল সিঁদুরের বড়ো টিপ আর নাকছাবির ঝিকিমিকিতে এক অপরূপ লাবণ্য। অনীশ যেন হাসতে ভুলে গেল। তার পৃথিবীটা কোনদিনই তেমন রঙীন ছিল না তবু যেটুকু রঙ তার মনের অগোচরে লুকিয়ে ছিল সব যেন কেমন এই কারখানা সংলগ্ন বাড়ির পরিবেশে ধূসর হয়ে উঠল সুশান্তবাবুর স্ত্রীকে এক ঝলক দেখে…ছ’বছর পড়ে এমন মলিন পরিবেশে দেখেও , অনীশের চিন্তে একটুও অসুবিধে হল না, সুশান্তবাবুর স্ত্রী আসলে কুরচি ছাড়া আর কেউ নয়।… অনীশ কেমন হারিয়ে গেল তার পুরোনো দিনগুলোয়… সেই সরস্বতী পুজোয় বাসন্তী শাড়িতে দেখা কুরচির ছেলেবেলার ছটফটে রূপে…যদিও আজকের দেখা কুরচি অনেক সুন্দর অনেক পরিণত, তবুও কোথাও যেন তারমধ্যে একটা ছেলেমানুষি অস্থিরতা আজও অমলিন রয়েছে……যেন তাই অনীশকে জানান দেওয়ার জন্যই তার এমন আগমন । অনীশের মুখে কোনও কথা সরছিল না। …চা নামিয়ে রেখে কুরচি চলে গেল অনীশের সামনে দিয়ে …..কুরচি চলে যাবার সাথে সাথে এক অদ্ভুত আকুলতা অনীশকে ঘিরে ধরল!! তার খুব জানতে ইচ্ছে করছিল কেমন আছে কুরচি ? খুশি আছে তো? সুশান্তবাবুর সাথে বয়সের ফারাক অনেকটা হওয়া সত্ত্বেও বিবাহিত জীবনে সে সুখী তো? অনীশকে কি আজও মনে পড়ে তার, নাকি ভুলেই গেছে সে?….কিন্তু এসব জানার আর অবকাশ কই?? ?..একরাশ খারাপ লাগা আর দমচাপা অস্বস্তি নিয়ে অনীশের আর ভালো লাগছিল না এখানে থাকতে …কেমন যেন অধৈর্য লাগছিল…ঋত্বিকবাবু সব খেয়ে নিলেও …অনীশের প্লেটে সবই পড়ে রইল…চা টাও কেমন যেন নামতে চাইছিল না গলা দিয়ে। কি কথা হচ্ছিল কানে যাচ্ছিল না তার । ওদিকে সুকুমার বাবু বলে যাচ্ছিলেন…
-আমি তো অকৃতদার….. সুশান্ত আমার সাথে এখানে আছে অনেকগুলো বছর……বিয়ে করবে না ,করবে না করে…শেষমেশ একটু বয়সেই বিয়ে করল…এখন একটি বছর তিনেকের ছেলে হয়েছে …বউমা বেশ চালাক চতুর গোছানো , আমার যা কিছু সব ওদেরই থাকবে … ঐ আমার সব জমিজমা কারখানা দেখাশোনা করত এতদিন …সত্যি বলতে আগের কোম্পানির সাথে লিজটা আর চালাতে চাইনি ….জমিটা তো ফাঁকাই পড়েছিল…বিজ্ঞাপন দিলাম , আপনারা কাগজ দেখে যোগাযোগ করলেন …যা হোক দেখে শুনে যাচ্ছেন …অম্বরীশ বাবুর সাথে কথা বলুন, দেখুন কি বলেন? ঋত্বিক তার ফাঁকা প্লেটেই হাতটা ধুয়ে নিল…কিন্তু অনীশ একটু ইতস্তত করে বলল ,
-হাত টা একটু…
-হাত ধোবেন? কিন্তু আপনি তো কিচ্ছুই খেলেন না? বউমা?
গলাটা তুলে একটু ডাক দিতেই কুরচি পর্দার আড়ালে এসে দাঁড়ালো…তার নূপুরের আওয়াজে সুকুমার বাবু বললেন ,
– ওনাকে একটু ভেতরে নিয়ে যাও তো , উনি হাত ধোবেন।
কুরচি বলল,
-ভেতরে আসুন…
বৈঠকখানা থেকে বেড়িয়ে দোতলায় ওঠার সিঁড়ির একপাশে একটা বেসিনে গিয়ে হাত ধুলো অনীশ… দেখল কুরচি কেমন পরিপূর্ণ রূপে দাঁড়িয়ে আছে, হয়ত কিছু বলার জন্য …কিন্তু দুজনের মাঝে কিছু শব্দ বিনিময় হওয়ার আগেই সুশান্তবাবুকে আসতে দেখেই কুরচি সরে গেল সিঁড়ির নিচে ।সুশান্তবাবু বেসিনের পাশে রাখা তোয়ালেটা হাত মোছার জন্য এগিয়ে দিয়ে বললেন,
-এই নিন, আপনি তো কিছুই খেলেন না ।
অনীশ ঈষৎ হাসল , দেখল দূরে বারান্দায় একটি মেয়ে একটি বাচ্চা ছেলেকে কোলে নিয়ে খাঁচায় রাখা পাখির সাথে খেলছে…বাচ্ছাটার আদুরে মুখ…বড়োবড়ো চোখ…কপালে কাজলের টিপ, তার মন বলছিল, ‘এই কুরচির সন্তান ।’

……অনীশ বৈঠকখানায় ফিরে আসার পর কাগজপত্রের জেরক্স নিয়ে উঠে পড়ল ঋত্বিকবাবু…সবাই বৈঠক খানা ছাড়িয়ে এগিয়ে গেল বারান্দার দিকে… তারপর সুকুমারবাবু আর সুশান্তবাবুর সাথে কথা বলতে বলতে গেটের কাছে পৌঁছে …ফিরে দেখবে না ভেবেও একবার ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকালো অনীশ…, অনীশের চোখজোড়া কেমন যেন তন্ন তন্ন করে খুঁজতে লাগল কুরচিকে… নাহ, কেউ নেই বারান্দায় … মুখটা সামনের দিকে ফেরাতে গিয়ে হঠাৎ মনে হল দোতলার একটা জানলায় হলুদ শাড়িতে কেউ দাঁড়িয়ে আছে …আর একবার ফিরে তাকাতেই সরে গেল অবয়বটা ।…সুকুমার বাবু পুরো পথটা না আসলেও সুশান্তবাবু শেষ পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন। অনীশ আরও একবার ভালো করে চেয়ে দেখল সুশান্ত বাবুর দিকে…।না কোনও অসহিষ্ণুতা বা হিংসে নিয়ে নয় বরং উনি যে কুরচির স্বামী …এই অনুভবটায় কেমন যেন একটা আত্মিক টান অনুভব করল সে তার মনের মধ্যে …তাই নিজে থেকেই তার সাথে হাত মিলিয়ে বলল,
-চলি তাহলে…আজকের মত। বাবা ফোন করবেন পড়ে।
-আচ্ছা ।
-ভাল থাকবেন।
-আপনিও ।

দুজনের মধ্যে হালকা একটু হাসি বিনিময়ের পর……অনীশ গাড়িতে এসে বসল ঋত্বিক বাবুর পাশে। গাড়ি স্টার্ট নিয়ে এগিয়ে চলল সামনের দিকে…আর অনীশ গাড়ির আয়নার মধ্যে দিয়ে অপলকে তাকিয়ে রইল কারখানার শেডের ওপর থেকে দূরে মাথা উঁচিয়ে থাকা কুরচির বাড়ির ছাদের পাঁচিলটুকুর দিকে…।ক্রমশ তা যেন অদৃশ্য হয়ে যেতে লাগল গাড়ির গতি বাড়ার সাথে সাথে । আর একটু এগিয়েই রাস্তা বাঁক নিল মোড়ের মাথায়……॥

……………………………………………………… ক্রমশ


  

 

 

 পর্ব – ৭


 

অনীশের গাড়িটা বেড়িয়ে যাওয়ার সাথে সাথে ভারী লোহার গেটটা বন্ধ হওয়ার আওয়াজ কানে এলো কুরচির । দোতলার কোণের ঘরে জানালার পাশ থেকে সরে এসে খাটের একধারে ঝিম মেরে বসে পড়ল সে । অপলকে চেয়ে রইল উল্টোদিকে রাখা আলমারির আয়নাটায়। আয়নার ওইপারে এ কোন কুরচি? আজকের এই কুরচিকে কেন এত ভীষণ অচেনা লাগছে তার ! যেন তার বর্তমান আর তার অতীত মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে একে অন্যের মুখ চেয়ে …চোখের সামনে ভেসে উঠল মাথার দুপাশে বেণী দোলানো ঈষৎ ছটফটে কুরচির সেই ছ’ বছর আগেকার লাজুক মুখটা। কাকীমার গঞ্জনায় যার প্রতিদিনের বিস্বাদ সকালটা অনীশের ভালোবাসার মায়াঞ্জনে রাতের অন্ধকারে হয়ে উঠত স্বপ্নিল। গেল বছর অনীশ কুরচির জন্মদিনে একটা মোবাইল ফোন কিনে দিয়েছিল কুরচিকে, তার সাথে যোগাযোগের সহজ মাধ্যম হিসাবে , আর সেই ফোনটা ছিল কুরচির একমাত্র অক্সিজেন। সেই ফোন মারফত তার সারাদিনের সমস্ত মনখারাপ রাতের আঁধারে গলে গলে পড়ত অনীশের বুকে আর কুরচির কথার আবেশে অনীশের কান দিয়ে যেন সারা শরীরে বয়ে যেত এক সুরেলা ঝরনার রিণরিণে শীতল জলধারা । যদিও কুরচির কাকা তখন হন্যে হয়ে উঠেছেন তার দায় থেকে নিজেকে মুক্ত করার জন্য…জগৎ সংসারে যাকে পাচ্ছেন তাকেই ধরে আনছেন কুরচির সাথে বিয়ে দিয়ে দেবেন বলে…দিনের পর দিন কুরচি যেন কেমন আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে উঠছে, এই বুঝি বাড়ি ফিরে শুনবে, আজকেই বোধহয় তার কাকার হোটেলের শেষ ভাত, মায়ের সাথে কাটানো শেষ রাত, কালই বুঝি কাকা তাকে ঠেলে দেবেন অন্য এক জীবনে । এমনি একদিন, কলেজ থেকে বাড়ি ফিরে কুরচি দেখেছিল সুশান্ত বাবু , কাকাবাবু আর আরও একজন অপরিচিত ভদ্রলোক তাদের ঘরে বসে আছেন । তার বেশ মনে পড়ে সেই দিনকার কথা… সেদিন কাকিমার আতিথেয়তার ঘনঘটা কিছু কম ছিল না …অতিথিদের সামনে থালা ভরতি সিঙ্গারা মিষ্টি , কাপে কাপে চা…… মা দাঁড়িয়ে ছিল পর্দার আড়ালে… নিস্তব্ধ। ঘরে পা রাখতেই কাকা যেন হাতে চাঁদ পেয়ে গেলেন… কুরচিকে দেখে আদিখ্যেতাই চুড় চুড় হয়ে বললেন,
-এই আমার ভাইঝি সুমৌলী।
কুরচি ঈষৎ তীক্ষ্ণ চোখে তাকাতেই কাকা বলে উঠলেন,
-যা যা প্রণাম কর। আর কদিন পরই ওনারা আমাদের সম্বন্ধী হবেন…।
কুরচিকে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে, কেউ যেন বলেছিলেন,
-থাক থাক , লজ্জা পাচ্ছে , তুমি এখন ভেতরে যাও মা…
কুরচি এক ছুটে ভেতরে চলে গিয়েছিল …তার যে তখন মাথায় বাজ ভেঙ্গে পড়েছে। সন্ধ্যেবেলা সবাই চলে যেতে মায়ের সাথে কথা বলল কুরচি । মা বললেন ,
-শোন কুরচি ছেলের পরিবারটা কিন্তু বেশ ভালো । হ্যাঁ, মানছি ছেলের বয়সটা একটু বেশি কিন্তু অবস্থাটা ভালো…কিচ্ছু নেবে না ওরা , শাঁখা সিঁদুরে তোকে নিয়ে যাবে বলেছে। তুই আর অমত করিস না মা।… মাথা থেকে অনীশের চিন্তাটা ছাড় ।
-কি বলছ তুমি মা?
-হ্যাঁ ঠিকই বলছি, ও ছেলে কোনওদিনই বাবার ইচ্ছের বাইরে যেতে পারবে না , আর কি দরকার আছে কুরচি …ওরা অনেক বড়ো মানুষ , আমাদের সামর্থ কই যে ওদের সাথে আত্মীয়তা করব!… আর ওর বাবা কক্ষনও তোকে মেনে নেবেন না…মাঝখান থেকে ওর মায়ের চোখের জল কোনোদিন তোদের সুখী হতে দেবে না। … তোর অনেক ভাগ্য কুরচি তাই এমন একটা যোগাযোগ এসেছে। …ঠাকুরপো যা ব্যবস্থা করেছে তা তোর ভালোরই জন্য…তুই আজই অনীশকে ফোন করে না করে দিস।
… পলকে কুরচির চোখের সামনেটা কেমন ঝাপ্সা হয়ে গেল …চোখ জলে ভরে গেল…গুম হয়ে বসে রইল। …রাতে কিচ্ছু খেল না সে। তারপর ঘরের দরজা বন্ধ করে চুপি চুপি ফোন করলে অনীশকে,
-হ্যালো অনি …
-বল…কিরে চুপ কেন?
-কথা ছিল রে ?
-তোর গলাটা অমন লাগছে কেন রে?
-কাল কলেজ থেকে ফেরার পথে হাজরা বাসস্ট্যান্ডে থাকিস, বিকেল চারটেই, কথা আছে।
-আরে কি হয়েছে ? এখনই বল না।
-না , এখন বলা যাবে না কাল আসিস বলব ।
-ঠিক আছে যাব …কিন্তু একটু কিছু তো বল।
-ভালো লাগছে না অনি। কিছু ভালো লাগছে না।
-কি হয়েছে বল না …প্লিজ বল।
-কাকা আমার বিয়ে ঠিক করে ফেলেছে ।
-সেকি কোথায়? কার সাথে?
-জানি না…
-মানে?
-মানে বেশি কিছুই জানি না শুধু জানি ,ছেলের বয়স বছর চল্লিশ.. আর তার কাকার লোহার কারখানা।
-সেকি আয়রন ম্যান!!
-মজা ভাল্লাগছে না অনি। প্লিজ কিছু একটা কর । আমি এই বিয়েটা করতে পারব না , মরে যাব অনি।
-দুর , পাগলী মরার কথা উঠছে কেন?…আমাকে একটু ভাবতে দে।
-তুই আর কি ভাববি? এতকাল তো তোর সব ভাবনা আমিই ভেবে এলাম। তোর ভাবতে ভাবতে ঐ আয়রন ম্যানের সাথে আমার বিয়েটাই হয়ে যাবে , দেখিস।
-আমি মজা করছি না কুরচি । তোর মায়ের সাথে কথা বলেছিস?
-বলেছি, মা বলেছেন কাকার সিদ্ধান্তই শেষ কথা…। প্লিজ অনি এবার কিছু একটা কর। ভাবছি ভাবছি বলে সময় কাটানোর মত সত্যি সময় নেই।
-শোন আমি একটা কথা বলি, তোকে বিয়ে করে বাড়ি নিয়ে এলে বাবা মানবেন না ঠিকই কিন্তু আমার মা তো আর ফেলে দেবে না আর সময়ের সাথে সাথে তুই পারবি না কুরচি আমার বাবাকে মানিয়ে নিতে।…তার মনটা জয় করে নিতে…তুই তো সব অঙ্কের সমাধান জানিস।
-সব বিষয়টা এত সোজা নয় অনি ।আমি তোর বাবার চোখে আমার প্রতি যে ঘৃণা দেখেছি উনি হয়ত আমাদের একসাথে হতেই দেবেন না।
-তাহলে কি করতে বলছিস আমায়?
-চল না অনি আমরা কোথাও পালিয়ে যাই …তুই তো বলতিস দূরে কোথাও চলে যাবি আমায় নিয়ে …সবার আড়ালে…সেখানে শুধু তুই আর আমি।
-বলতাম তো , কিন্তু যাব কোথায়?
-আমি জানি না অনি…প্লিজ কিছু একটা কর…আমি আর থাকতে পারব না এখানে।
কুরচির গলাটা কান্নায় বুজে এলো…-
-প্লিজ সোনা, কাঁদিস না…দেখছি আমি কি করতে পারি আমাকে দুটো দিন সময় দে ,এর মাঝে তুই আর বাড়িতে কোনও ঝামেলা করিস না…একটু চুপচাপ থাক …আমি কিছু একটা ব্যবস্থা করে তোকে জানাব…জাস্ট আমার ফোনের অপেক্ষায় থাক আর প্লিজ স্বাভাবিক থাক। কাল কোনও দেখা-সাক্ষাতের দরকার নেই । আমি একটু গুছিয়ে নিয়ে তোকে জানাব কোথায় দেখা করতে হবে।কেমন?
-যা করবি একটু তাড়াতাড়ি কর অনি । মা বলছিল ছেলেদের কোনও ডিমান্ড নেই, ওরা এক কাপড়ে আমাকে নিয়ে যেতে চায়। তাই কাকা হয়ত কালীঘাটেই আমাদের বিয়েটা দিয়ে দিতে চাইবেন।
-তুই অত ঘাবড়াচ্ছিস কেন? আমি আছি তো …
-ঠিক আছে । এখন রাখছি তাহলে।
-আজ কিছু দিবি না আমায়…!!!
-আহ অনি …তুই একটা যাচ্ছেতাই …আমি মরছি চিন্তায়…আর… তোর খালি ধান্দা। এখন কিছু পাবি না আগে আমাকে নিয়ে যা তোর কাছে , তারপর সব হবে।
-আচ্ছা ?? …দাঁড়া তোকে কাছে পাই একবার…কড়ায় গণ্ডায় সব সুদ মিটিয়ে নেবো আমি।
-দেখা যাবে…রাখছি…এখন বাই ।
-হুম রাখ, বাই গুড নাইট।
……ফোনটা ছেড়ে দিয়ে অনীশ ভাবল, কি ব্যবস্থাই বা করবে সে এত চট জলদি…এখান থেকে পালিয়ে যাবেটা কোথায়? থাকবেই বা কোথায়? একটা কাজও তো খোঁজ করতে হবে। মনে পড়ল পাবলোর কথা। তার এককালের স্কুলের বন্ধু…এখন সে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে শিবপুরে। ছোটবেলায় একবার পাবলোর পিসির বাড়ি গিয়েছিল মেচেদায় ,তখন অনীশ নাইনে পড়তো…পিসিমশাই আগেই মারা গেছিলেন ।পাবলোর কাছে পড়ে শুনেছিলো, পিসি মারা যাওয়ার পর তার পিসতুতো দাদা অভয়দা একাই থাকত মেচেদায়, অভয়দার একটা প্রেস ছিল, অভয়দা অনির লেখালিখির জন্য তাকে বেশ পছন্দও করতো… কিন্তু বেশ কয়েক বছর তো কোনও যোগাযোগই নেই ।পাবলোকে একটা ফোন করতে হবে, জানতে হবে ওখানে কিছু সময়ের জন্য থাকা যাবে কিনা…কাজটাও যদি পাওয়া যায়…তাহলে কুরচিকে নিয়ে একেবারে শহর ছেড়ে শহরতলী।
……সত্যিই তো এইরকম সময় সে একা তো সব গুছিয়ে উঠতে পারবে না…বন্ধুরা কেউ পাশে থাকলে সুবিধেই হয় …ভাবা মাত্রই অনি ফোন লাগালো পাবলোকে । বেশ অনেকক্ষণ কথা হল পাবলোর সাথে……একটা আশ্বাসের সুরও পেল পাবলোর কাছ থেকে। ঠিক হল অভয়দার সাথে কথা বলে, পাবলো ফোন করে অনীশকে জানাবে।
……রাতে খেতে বসে কিছু খেতে পারল না অনি , মনটা খারাপ হয়ে রইল কুরচির জন্য। একটা লেখা নিয়ে বসবে ভেবেছিল তাও হল না……পড়াশোনা তো এমনিতেই তথইবচ…ক্লাস করতে ভালোও লাগে না…দেখতে দেখতে ফাইনাল ইয়ার শেষ হতে চলল…কোনওক্রমে পাসটা তো করতে হত…কিন্তু আর কি হবে?…জীবন বুঝি এবার অন্য খাতে বইবে কুরচিকে নিয়ে। আর নয় অনেক হয়েছে ছেলেমানুষি… এবার তাকে দায়িত্ববান হয়ে উঠতে হবে কুরচির জন্য। …আর কদিন পরে তাদের একটা ছোট্ট সংসার গড়ে উঠবে…যেখানে শুধু সে, কুরচি আর তাদের বুক ভরা একরাশ স্বপ্ন। তার বাবার অহংকার আর কুরচির কাকার অত্যাচার সব কিছুকে অগ্রাহ্য করে তাদের স্বপ্নের উড়ান শুরু হয়ে যাবে আর কদিনের মধ্যেই। ……এইসব ভাবতে ভাবতে অদ্ভুত একটা প্রশান্তিতে তার দুচোখ জুড়ে নেমে এল গভীর ঘুমের ঝাঁপি।
…পড়ন্ত বিকেলের ফিকে হয়ে আসা আলোতে কুরচির আজও মনে পড়ে পরদিন বিকালে অনীশ তাকে ফোন করে সাঙ্গুভিলা রেস্টোরেন্টে দেখা করতে বলেছিল…।একটা দমচাপা উত্তেজনায় বসুশ্রী সিনেমা হলের সামনে বাস থেকে নামতেই চোখে পড়েছিল অনিকে ,পরনে তার সাদা পাঞ্জাবি আর নীল জিনস ,একমাথা উষ্কখুষ্ক চুল , চোখে কালো ফ্রেমের চশমা, গাল ভরতি দাড়িতে কেমন যেন উদ্বিঘ্ন , দুজনে মিলে রেস্টোরেন্টের একদম শেষ কেবিনটায় বসে তাদের পরবর্তী পদক্ষেপের কথা আলোচনা করেছিল বেশ কিছুক্ষণ। তারপর লোকচক্ষুর আড়ালে দুজনে দুজনকে পরম বিশ্বস্ততায় আঁকড়ে ধরে অজানা ভবিষ্যতের স্বপ্নের বীজ বুনেছিল । সেদিন কি এক পরম মমতায় অনি যেন আগলে রেখেছিল তার কুরচিকে… কিন্তু কুরচির মধ্যে তখন কাজ করছিল এক অদ্ভুত অস্থিরতা। তার অমন ছটফটানি না থাকলে হয়ত আরও কিছুক্ষণ অনি নিজের করে কাছে টেনে রাখত কুরচিকে। কিন্তু পরদিন ভোরে যে তাদের নতুন গন্তব্যের উদ্দেশ্যে পাড়ি দিতে হবে…আর তাই সেই শপথেই দুজনে হাতে হাত রেখে বেরিয়ে পড়েছিল সাঙ্গুভিলা থেকে। আলগোছে হেঁটে চলেছিল পাশাপাশি ,নীরবে …কারন সময় তাদের মধ্যে এনে দিয়েছিল এক অজানা আশঙ্কা আর দায়িত্ব বোধের যুগপথ দ্বন্দ্বের আস্বাদ। কালীঘাট পর্যন্ত হেঁটে কুরচিকে বাড়ির পথে এগিয়ে দিয়ে, অনীশ নাকতলার মিনি বাসে উঠে বসেছিল।
… দেখতে দেখতে কতদিন হয়ে গেল কুরচি তার নিজের স্বামী পুত্র নিয়ে বেশ গুছিয়ে ঘর সংসার করছে , ঘুণাক্ষরেও সে ভাবতে চায়না তার সেই ফেলে আসা অতীতের কথা। তবে বিধাতার কোন সে অঙ্গুলি হেলনে আজ কুরচি এতদিন পর অনিকে দেখতে পেল আর একলাফে পিছিয়ে গেল ছ’ছটা বছর , ফিরে চাইল কালো কফিনে ঢাকা তার স্মৃতির চোরকুঠুরিতে …তা বোধকরি সে নিজেও বুঝে উঠতে পারছিল না। সে জানে না আর জানতে চায়ও না এখানে সত্যি কোনও প্রোজেক্ট অম্বরীশ মিত্র করবেন কিনা, কিন্তু সত্যি বলতে মনের মাঝে অনিকে একবার চোখের দেখা দেখবার যে সাধ তার অপূর্ণ ছিল তা বোধহয় এই জমি দেখতে আশার সূত্র ধরে সার্থক হয়ে উঠল।
……………………………………………………… ক্রমশ

  

 

পর্ব -৮

________________________________________________________________________________________________________________________________

দাশনগর থেকে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে ফিরতে ফিরতে অনীশ ভাবছিল যদি এখানে প্রোজেক্টটা হয় , তাহলে তো আবার তার কুরচির সঙ্গে দেখা হবে । একথা ভাবামাত্রই তার মনে অজানা একটা শিহরণ যেমন হল, সাথে সাথে মনটা কেমন ফ্যাকাস হয়ে গেল। তার এতদিনের এত ভাবনা , যাকে ঘিরে তার স্বপ্নের জগৎ , সব যেন আজ নামহীন গোত্রহীন টুকরো অবকাশের মত পড়ে রইল। কুরচি কেমন আছে এই কথা ভাবতে ভাবতে তার কত ঘুমহীন রাত পার হয়ে গেছে কত অবহেলায় ,অথচ আজ সেই ভাবনা থেকে সে ছুটি পেয়ে একেবারে বেকার হয়ে গেল। কুরচির জন্য তার রোজের যে খোঁজ , যে বন্ধন, আজ বোধকরি তা মুক্তি পেল কুরচিকে সামনাসামনি দেখায় ।অনীশ ভাবল, পৃথিবী যে গোল ,এই বিজ্ঞানটাকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে এমন করে বোঝানোর খুব দরকার ছিল কি? …এখন তো শুধুই এক অন্তহীন ভাবনাহীন নিঃশব্দ ছুটে চলা । সত্যি বলতে কুরচি আর সুশান্তবাবুকে দেখে বেশ সুন্দর গোছানো একটা সংসারের ছবিই প্রতিফলিত হয়েছে তার মনে। তাই কুরচি ভালো আছে এই ভাবনাটা যতটা তৃপ্তি এনে দিয়েছে, ঠিক ততটাই মনের গভীরে একটা শূন্যতার অনুভুতি ,অনীশকে কেমন হিমশীতল করে তুলছে। অনীশের ভাবনার সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে গাড়ি চলতে লাগলো …সবুজ গাছপালা মেঠো পথঘাট ছাড়িয়ে আর তার মনের অতলে একটাই গানের কলি গুনগুনিয়ে উঠতে থাকল… ‘ ময়নামতির পথের ধারে দেখা হয়েছিল/তেপান্তরের মাঠের ধারে দেখা হয়েছিল/দেখা হয়েছিল তবু না দেখাই ছিল ভাল/ দেখা হয়েছিল…’ ঠিকই তো কত মানুষের জীবনেই তো কত বন্ধু হারিয়ে যায়, সবার কি দেখা হয় …নাই বা হত অনির সাথে কুরচির দেখা, ক্ষতি কি ছিল! থাকতো সে অনির ভাবনায় না হয় একজন নীলপরী হয়ে!!! কিন্তু আজকের এই দেখাটা যে তার মনের অতি সঙ্গোপনে রাখা ভাবনাগুলোকে কেমন এলোমেলো করে দিল। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে অনীশ জানলার বাইরে চোখ রাখল… গাড়ি দাঁড়িয়ে গেছে লেভেল ক্রসিং-এ……সামনে দাশনগর রেলওয়ে স্টেশন । লেভেল ক্রসিং-এর ওপারে , এক স্থবির জনজীবন…ঝাঁকা মুটে, ফিরিওয়ালা , সাইকেল, রিক্সা……আর মাঝখান দিয়ে প্রচন্ড জোরে ঝমঝম শব্দে চারপাশ কাঁপিয়ে ট্রেন ছুটে আসছে……হারিয়ে যাচ্ছে অনীশ অতীতে , যে ঘটনাটা অনীশ পারতপক্ষে তার স্বপ্নের গভীরেও এড়িয়ে চলতে চায়, আজ কিন্তু নিজে থেকেই সেই ভাবনার অতলে ডুব দিতে চাইল সে। ট্রেনের ঝমঝম শব্দের অবসরে ফিরে দেখতে চাইল সেই দিনটাকে । তার চোখের সামনে ফুটে উঠল ব্যস্ত হাওড়া স্টেশন। যেখানে ব্যাগ হাতে দাঁড়িয়ে আছে পাবলো আর দুরন্ত আগ্রহে ঘন ঘন প্ল্যাটফর্মের এ মাথা ও মাথা করছে অনীশের ব্যস্ত চাহনি । হাজার ভিড়ের মাঝে তার চোখ দুটো হন্যে হয়ে অপেক্ষা করছে কুরচির জন্যে । হঠাৎ মাইকে ঘোষণা শোনা গেল, ‘ সকাল ছটা পনেরোর টু থ্রি নাইন আপ পাঁশকুড়া লোকাল প্ল্যাটফর্ম নম্বর পনেরোর পরিবর্তে প্ল্যাটফর্ম নম্বর তেরো থেকে ছাড়বে ’। ঘোষণা শোনামাত্রই পাবলো বলে উঠল…

-এই রে আবার আগেরটায় যেতে হবে চল, চল, ওদিকে চল অনি।
-দাঁড়া , কুরচি আসবে তো এখানেই…
– আরে হ্যাঁ রে বাবা ট্রেন তো দিয়ে দিয়েছে তেরো নম্বরে …সকালের দিকে ফাঁকাও থাকবে…তুই ওদিকে গিয়ে দাঁড়া আমি প্ল্যাটফর্মের মুখটায় থাকছি।
-কিন্তু ও আস্তে এত দেরি করছে কেন বলতো?
-কোনও গন্ডগোল হল নাতো রে ,অনি? দেখ আবার আসবে তো? তুই একেবারে নিয়ে আসলি না কেন?
-যাহ। তা কেন? আমি তো বলেছিলাম। ওই বারন করল , কেউ দেখলে বিপদে পড়ে যাবে বলল। তাই আর…
-বললেই বা তুই শুনবি কেন? এত ভোরে ওর যদি একা আসতে কোনও অসুবিধে হয়?
-আরে বাবা ভয় দেখাচ্ছিস কেন? ওর ইচ্ছেতেই তো …

অনীশের কথা শেষ হওয়ার আগেই পাবলো বলল…ব্যস ব্যস আর ভাবতে হবে না…ওই-ই দেখ…
পাবলোর চোখ অনুসরণ করে অনি দেখল দূরে একটা হলুদ সালোয়ার কামিজ পরে দুটো বেনী দুলিয়ে কাঁধে ব্যাগ নিয়ে ছুটে ছুটে আসছে কুরচি। অনি তাড়াতাড়ি এগিয়ে গিয়ে কুরচির হাত থেকে ব্যাগ নিয়ে বলল …

-ওদিকে চল , ট্রেন তেরো নম্বরে দিয়ে দিয়েছে।

-তুই যে বলেছিলি চোদ্দ-পনেরো তে দেবে…

-হুম পাবলো তো তাই বলেছিল…চল…চল…এখুনি ছেড়ে দেবে..

তেরো নম্বর প্ল্যাটফর্মে এসে কুরচি আর অনি ট্রেনে উঠে পড়ল …জানলার পাশে একটা সিট দেখে দুজনে মুখোমুখি বসলো। জানলার বাইরে তখন পাবলো। ট্রেনের বাঁশি বেজে উঠল …পাবলো দুজনকেই শুভকামনা জানিয়ে বলল …

-পৌঁছে একটা খবর দিস । যদিও অভয়দাকে সব বলা আছে তাও…অসুবিধে হলে জানাবি…আর হ্যাঁ মোবাইলে ফোন করিস না …আমি আজই জেঠুর বাড়ি চলে যাব কদিনের জন্য…ওখানেই ফোন করিস , ল্যান্ডলাইনে …এই নে নম্বরটা মোবাইলে সেভ কর।

-হুম দে… ঠিক। আমার খোঁজ শুরু হলে তোর ওপর আঁচ সবার আগে পড়বে।

নম্বর নেওয়া হল…ট্রেনও নড়ে চরে উঠল…অনীশ ভাবাবেগে আপ্লুত হয়ে গেল…মনে মনে ভাবলো…সত্যি পাবলোর মত বন্ধু হয় না। ধীরে ধীরে প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে গাড়ি এগিয়ে চলল । সাথে সাথে কুলি হাঁকাহাঁকি…মাইকের ঘোষনা…টিং টং আওয়াজ…সব শব্দ কেমন যেন ফিকে থেকে ফিকেতর হয়ে উঠল…কানে বেজে উঠল…ট্রেনের হুইসেল । সকালের গাড়ি… বেশ ফাঁকা ফাঁকা…কয়েকজন যাত্রী এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছে কামরায় । কুরচির হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে সিটের নিচে রাখতে রাখতে অনীশ একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল…তারপর কুরচির পাশে এসে একদম গায়ের কাছে বসলো…আজ যেন সে একটু বেশিই প্রগলভ হয়ে উঠল…কুরচিকে বেড় দিয়ে মাথার পিছনে হাতা রেখে বলল… “কিরে কেউ বুঝতে পারেনি তো?”

কুরছি ঘাড় নেড়ে বলল নাহ। আজ যেন সে একটু বেশিরকমই চুপচাপ। অনি বলল …

-কিরে চুপ কেন? মন খারাপ? নাকি ভয় করছে? এত গুম মেরে আছিস কেন?

-না …এমনি। ভাবছি।

-কি ভাবছিস?

-মায়ের কি হবে অনি? কাকা তো বাক্যবানে মাকে …

-কিচ্ছু হবে না…কটা দিনের ব্যাপার …দাঁড়া না বিয়েটা হয়ে যাক।কাজ তো একটা হয়েই গেছে…. এরপর একটা নিজের আস্তানা হলেই তোর মাকে আমাদের কাছে নিয়ে চলে আসব। তোর আর চিন্তা থাকবে না তখন…মা’কে নিজের কাছে পাবি সবসময়…তবে হ্যাঁ ,তখন কিন্তু মাকে পেয়ে আমাকে দূরে দূরে রাখা চলবে না …এই আমি বলে রাখলাম।

এই বলে , অনি কুরচিকে যেন আরও একটু নিজের কাছে টেনে নিল…অনির দুচোখ জুড়ে তখন কেবল স্বপ্নই স্বপ্ন…মনের খুশিতে কত কি বলে যেতে লাগল সে, দুটো মানুষের মনের মিল থাকলে এই জগত সংসারে আর কতটুকুই বা চাওয়া!!!…কিন্তু কুরচি আজ যেন কেমন এলোমেলো হয়ে আছে…অনির সাথে এই পাশাপাশি বসে থাকার মুহুর্তগুলোকে সে কিছুতেই উপভোগ করতে পারছে না…মনের মধ্যে একরাশ অনিশ্চয়তা তাকে ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছে! কি হতে চলেছে? …কোথায় থাকা হবে ?…কি করবে?…মায়ের কি হবে? কাকা কি বলবে?…এই প্রশ্নগুলোর সাথে জড়ো হয়েছে কিছু ভাবনা…এখনও কি সবাই টের পেয়ে গেছে যে সে বাড়ি নেই? জানলে হয়ত আশপাশের লোকজন ছিঃ ছিঃ করবে…হয়ত সেই আয়রন ম্যান শুনে ভাববে … ‘সত্যি কি বাঁচাটাই না বেঁচেছে…কি মেয়েকে বিয়ে করতে যাচ্ছিল’!!!

একদিকে অনীশের স্বপ্ন আর একদিকে কুরচির ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার ভাবনা দুজনকে দুভাবে ব্যস্ত রেখেছিল …আর ট্রেন চলছিল তার আপন গতিতে। হঠাৎ ট্রেনের হুইসিলের শব্দের সাথে সাথে ট্রেনের গতিটা কমে কমে ট্রেনটা থেমে গেল ……দুজনের চিন্তাতেই পড়ল ছেদরেখা…অনি জানলার বাইরে তাকিয়ে দেখল কোনো স্টেশন ছাড়াই গাড়িটা থেমে গেছে….. আশপাশ থেকে দু একজন যাত্রীদের কন্ঠস্বর কানে আসছে …অনি ঘাড় ঘুরিয়ে একজনকে জিগ্যেস করল

-এটা কোথায় এলাম?

অপরিচিত এক ভদ্রলোক বললেন…বাগনানের কাছে…সিগন্যাল না পেয়ে গাড়ি থেমে গেল বোধহয়…

কুরচির তখন মনের মধ্যে এক অজানা আশঙ্কা ক্রমশ তাকে চিন্তান্বিত করে তুলেছে …কিছুটা কঠিন ভাবেই বলল অনিকে…

-আচ্ছা তুই যে কাজের কথা বললি, তা তুই কি কাজ খুঁজলি শুনি।

-প্রেসের কাজ।

-কোথায়?

-যেখানে যাচ্ছি সেখানেই…কাছাকাছি।

-কার প্রেস?

-আরে পাবলোর মামাতো দাদা যেখানে কাজ করে…সেখানেই।

-কথা ফাইনাল হয়ে গেছে তো?…কত মাইনে পাবি শুরু শুরুতে?

-আরে দাঁড়া …আমি গেছি নাকি! আগে তো যাই , ওখানে গিয়ে কথা বলি…অভয়দা পাবলোকে বলেছেন তো …ওখানে লোক নেবে…আর উনি বললে হয়েই যাবে।

-মানে তুই অভয়দার সাথে নিজে কথা বলেছিস তো …

-আমি বলাও যা পাবলো বলাও তা …বেশি ভাবিস নাত। ওটা আমার ওপর ছেড়ে দে না।

-বাহ…কি কথা…বেশি ভাবিস নাতো…তা আমরা যে যাচ্ছি …থাকবটা কোথায় এখন?…সেটাও কি ঠিক করেছিস নাকি…পৌঁছে ভাববি?

-আমায় কি ভাবিস বলত? না সেটা ঠিক করেছি তো।…এখন আপাতত পাবলোর মামারবাড়ি …তারপর কাজটা হলে কদিন পর একটা বাড়ি ভাড়া নিতে হবে।

-বাঃ বাঃ … বেশ ব্যবস্থা…সবই পাবলোর বন্দোবস্ত…তুই তাহলে নিজে কি করলি অনি?

…কুরচির কথাগুলো থেকে কেমন যেন একটা শ্লেষ ঝরে পড়ছিল…সেই দেখে অনি কেমন একটা থতমত খেয়ে গেল…এমন সময় একজন চা- ওয়ালা ‘চায়ে চায়ে’ করে ডেকে উঠতেই অনি বলল… “দাঁড়া দাঁড়া, এক কাপ চা খাই …মাথাটা কেমন যেন কাজ করছেনা”।…অনি হাঁক পারল চা -ওলাকে। কুরচি বলল… “ দূর বাবা ট্রেনটার আবার হল কি? মাঝ রাস্তায় দাঁড়িয়ে পড়ল!… কখন ছাড়বে কে জানে?” অনীশ দু ভাঁড় চা নিয়ে কুরচির দিকে একটা এগিয়ে দিল…কুরচির কথার উত্তরে চা-ওলা বলল… ‘ট্রেন ছাড়তে দেরি হবে দিদি…একটা ছেলে আর একটা মেয়ে লাইনে কাটা পড়েছে…সব ট্রেন আটকে দিয়েছ…চারিদিকে কত লোকজন পুলিশ …কখন ছাড়ে দেখুন।’ কথাটা শুনেই কুরচি যেন কেমন স্থির হয়ে গেল …অনি বলে উঠল “ও বাব্বা একি গেরো… এইজন্যই লোকে বলে আনলাকি থারটিন !যখনই পনেরোর বদলে তেরো বলেছে আমার মনটা কেমন যেন খচ খচ করছিল…নাও বোঝো এখন!” আশপাশ থেকে বিভিন্ন মন্তব্য ভেসে আসতে লাগল … কেউ বলল, ‘ এ নির্ঘাত ভাব ভালবাসার গপ্প’… কেউবা বলল… ‘আমি বুঝি না ওভারব্রিজ দিয়ে না গিয়ে কেন ট্রেন লাইন দিয়ে মানুষ পারাপার করে’…সকালের গাড়ি ডেলি প্যাসেঞ্জারের সঙ্খ্যাই বেশি …কেউ কেউ অসহিষ্ণু হয়ে হয়ে বলে উঠল … ‘দূর বাবা অফিসের আজ বারোটা বেজে গেল…একদিনের ছুটি গেল…আরে বাবা পেটে টান পড়লে ওসব ভালোবাসা জানলা গলিয়ে ফুড়ুৎ’। পিছনের ভদ্রলোক বললেন ‘আরে দেখ আবার, সুইসাইড কেস কিনা!…দারিদ্র মানুষকে কতটাই না অসহায় করে দেয় !!’…বিভিন্ন মানুষের মন্তব্যে কুরচি যেন কেমন শিঁটিয়ে জেতে লাগলো অজানা এক ভয়ে। চুপ করে এক জায়গায় বসে রইল…আর মনে মনে ভাবতে থাকল… ‘তারা কি এভাবে বাড়ি থেকে পালিয়ে ঠিক করছে? এও তো এক অচেনা অজানা অনিশ্চিত জগৎ …যেখানে কোনও কিছুই ঠিক ঠাক নেই… তবে দারিদ্র কি অনি জানে না…কিন্তু সে তো দেখেছে…বাবা মারা যাবার পর কেমন করে তারা অসহায় অবস্থায় কাকার কাছে সব মুখ বুজে ছিল, আর কেউ না জানুক সে জানে।…দৈবাৎ এই সুশান্ত বাবুর খোঁজ পাওয়া গেছিল…সেটা হয়ত তার পক্ষে নিশ্চিত ভবিষ্যৎই ছিল…আর হয়ত সেটাই তার একমাত্র সুস্থির গন্তব্য হতে পারত যদি না তারা এভাবে নিরুদ্দেশের পথে পা বাড়াত…… কিন্তু এখন আর সে ভেবে লাভ কি? তবে কে বলতে পারে তাদের অমোঘ ভবিষ্যৎও তাদের সাথে এমন মর্মান্তিক রসিকতা করবে না… যার পরিণতি আজকের ওই হতভাগ্য নাম না জানা ছেলেটা আর মেয়েটার মত হতে পারে!!! …মনে মনে শিউরে উঠল কুরচি…আর বলল, ‘ সত্যি বলতে এই দুঃসাহসিক পালানোয় , তার সাথে সাথে অনিরও কম বড়ো ক্ষতি হচ্ছে না…তার বাবা অম্বরীশ মিত্রের হাত তো কম লম্বা নয়…তিনি হয়ত ঠিকই একদিন না একদিন ওদের খুঁজে বার করবেন…তখন কি তিনি কুরচিকে ছেড়ে দেবেন? মাঝখান থেকে দুজনের জীবনটাই হয়ত তাদের হটকারিতায় নষ্ট হয়ে যাবে ……ধীরে ধীরে কুরচির মধ্যে ভাবাবেগটা কমতে কমতে কেমন যেন থিতিয়ে যেতে লাগল…সময় যত পেরিয়ে যাচ্ছিল কুরচি তত কঠিন হয়ে উঠছিল … শেষমেশ কেমন একটা অধৈর্য হয়ে গেল …পুরো ব্যাপারটার সাথে সাথে তার অনিকেও অসহ্য লাগতে শুরু করল …যে অনির একটু সান্নিধ্যের জন্য সে ছটফট করতে সেই অনি তার এত কাছে বসে আছে অথচ কুরচির তাকে কেমন অর্বাচীন ঠেকল । সত্যি বলতে অনির ওপর তার ভরসার জায়গাটা কেমন টলমল করছিল…এত স্বপ্নিল হয়ে কিভাবে বসে থাকতে পারে ছেলেটা …কোনও ভাব লেশ নেই…গুনগুন করে গান করছে অনি আর কুরচিকে বলছে… “নো টেনশন কুরচি , ট্রেন যখন ছাড়বে তখনই পৌঁছব বল…তাড়ার কি আছে? এখান থেকে তো আর কেউ নামিয়ে দিতে পারবে না…।” ইতিমধ্যে বেশ কয়েজন যাত্রী নেমে গেছেন …বেশ অনেকক্ষন পর বাগনানের লেভেল ক্রসিঙে ‘ঢ্যাং ঢ্যাং’করে ঘন্টা বাজছে…কানাঘুষোয় শোনা যাচ্ছে, কাজ হয়ে এসেছে, ট্রেন এবার ছাড়বে হয়ত ….. দু চারটে ছেলে হৈ হৈ করে অনি আর কুরচির সামনের সিটে এসে বসল …নিজেদের মধ্যে একটা খোসগল্প শুরু করেছে …মাঝে মাঝেই কুরচির পাশের জানলা দিয়ে হাত বাড়িয়ে চায়ের ভাঁড় ফেলছে …সিগারেটের টুকরো ফেলছে, পানের পিকও ফেলছে… এক আধবার মাথাটা এগিয়ে দিয়ে কাকে যেন দেখছে… কুরচি এমনিতেই দুর্ভাবনায় ডুবে আছে…কেমন একটা দোলাচল… তার ওপর ছেলেগুলোর ছটফটানি তার মোটে ভালো লাগছিল না…গলা নামিয়ে আস্তে করে অনিকে বলল…

-পাশের কামরাটা ফাঁকা আছে কিনা দেখ না …তাহলে ওটায় গিয়ে বসি…

-আবার ওঠাউঠির কি আছে ? বস না…এই তো এবার ট্রেন ছাড়বে মনে হচ্ছে…সময় তো বেশ গড়িয়ে গেল… আর ফাঁকা ফাঁকা থাকবে না ট্রেন …দেখছিস না কেমন ভিড় হতে শুরু করেছে। সত্যিই ট্রেনটা নড়ে উঠল… একটা ভোঁ ভোঁ করে হুইসেলের আওয়াজও হল…অবশেষে ঝিক্ ঝিক্ ঝিক্ করে ট্রেন এগোতে শুরু করল…একঝলক ঠান্ডা হাওয়া জানলা দিয়ে উড়ে এসে কুরচির অশান্ত চোখেমুখে লাগল…উল্টোদিকের সিটের একটি ছেলে আরাম করে পা ছড়িয়ে বসল…বলল ‘ যাক ছেড়েছে’।আরেকটি ছেলে দুটি জানলার মাঝে রাখা ব্যাগের মধ্যে থেকে তাসের প্যাকেট বার করে ব্যাগটা রাখতে গেল…হঠাৎ জানলার হাওয়ায় কুরচির ওড়নাটা উড়ে গিয়ে ব্যাগের হ্যান্ডেলে গেল জড়িয়ে … দুজনেই অপ্রস্তুত হয়ে উঠে সামনাসামনি দাঁড়াল , পাশ থেকে অনি চেষ্টা করতে লাগল ওড়নাটাকে ব্যাগের হ্যান্ডেলের কোণের রিংটা থেকে ছাড়াতে …সামনের ছেলেটা একটা হ্যাঁচকা টান দিতেই কুরচির ওড়না গেল ফেঁসে …কুরচি হঠাৎ কেমন রেগে গিয়ে ছেলেটার গালে এক চড় বসিয়ে দিল । সঙ্গে সঙ্গে বাকি তিনটে ছেলের মধ্যে একজন সিট ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে কুরচির হাত চেপে ধরল…বলল,

–কি হচ্ছেটা কি? এসব কি? গায়ে হাত দিচ্ছেন কেন?

কুরচি বলল… “আমি তখন থেকে দেখছি উনি বিরক্ত করে যাচ্ছেন …জানলা দিয়ে পিক ফেলছেন …চায়ের ভাঁড় ফেলছেন…বার বার গায়ে হাত লেগে যাচ্ছে…

অনি বলল , “ওনার হাতটা ছেড়ে কথা বলুন…”

-তো? জানলা দিয়ে ফেলা বারণ নাকি…সিটটাকি আপনার একার সম্পত্তি ?

কুরচি বলে উঠল, “তা হবে কেন ? কিন্তু ইচ্ছে করে বিরক্ত করার জন্য এগুলো করছিলেন আপনারা …”

ব্যস আর যায় কোথায় চেঁচামেচি , তর্কাতর্কি …

অনি সমানে পাশ থেকে বলে , “চুপ করে যা কুরচি … ঝামেলা বাড়াস না…”

-কেন চুপ করব? আমি কি মিথ্যে বলছি?

আশপাশের লোকজন মজা দেখছে…তারমধ্যে একজন বলে উঠলেন ‘ … না ম্যাডাম হয়ত মিথ্যে বলছেন না তবে , নিত্যদিন ভিড়ের মধ্যে এরকম কত গায়ে গা ঠেকে যায়…। এ নিয়ে এত কেউ ভাবে না…এগুলো সবাই ইচ্ছে করে, করে না …এগুলোকেও সহ্য করতে জানতে হয়…সেটাও ভদ্রতা…’ উল্টোদিকে ছেলেগুলো বলে, ‘এত অপমান বোধ হলে প্যাসেঞ্জার ট্রেনে উঠেছেন কেন ?’ …পিছন থেকে এক বয়স্ক ব্যাক্তি বলতে থাকেন… ‘সবসময় কি ছেলেদের দোষ হয়…আজকালকার মেয়েরাও বাপু বড্ড উদ্ধত…যা হয়েছে, হয়েছে … ক্ষমা চেয়ে নিলেই হয়’ … অমনি উল্টোদিকের ছেলেগুলো বলতে থাকে – ‘হ্যাঁ হ্যাঁ ওনাকে ক্ষমা চাইতেই হবে…বলা নেই ,কওয়া নেই গায়ে হাত দেবেন কেন?’ কুরচির পাশে পাশে অনিও অনেক চিৎকার করল কিন্তু কেউ শুনলে তো?

কুরচি ক্রমশ রাগে অন্ধ হয়ে উঠছিল…তার সব রাগ গিয়ে পড়ছিল অনির ওপর…আর অনি গলা নামিয়ে বলছিল … ‘তুই গায়ে হাত তুলতে গেলি কেন? …আমি তো আছি নাকি? …যা হয়েছে, হয়েছে তুই সরি বলে দে ওরা ফ্লোটিং লোকজন …সব নেমে যাবে একটু পর …তুই আর ঝামেলা করিস না।’

কুরচি একগুঁয়ের মত দাঁতে দাঁত চেপে দাঁড়িয়ে রইল শেষে অনিই ‘সরি’ বলে দুঃখপ্রকাশ করে , কুরচিকে নিয়ে সামনের দিকের কামরায় এগিয়ে গেল…। ততক্ষনে অন্য কামরাগুলোতেও বেশ ভিড় । পাশাপাশি কোনও সিট নেই…ইতস্তত এক আধটা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে…। তার মধ্যে একটা জায়গা একটু ফাঁকা দেখে কুরচিকে ব্যাগ নিয়ে সিটে বসতে বলে অনি জলের বোতল বার করে জল খেল…কুরচি তখন নিজের মনের সাথে যুদ্ধ করছে…তারপর অনি যেই বলল… ‘এত মাথা গরম করলে চলবে?…অত উত্তেজিত হস না…সব ঠিক হয়ে যাবে…একটু ভরসা করতে পারছিস না আমাকে?’ হঠাৎ আগুনে যেন ঘৃতাহুতি হল…এতক্ষণ গুম মেরে থাকা কুরচি চেঁচিয়ে উঠল….

-ভরসা??? আর তোকে? কোথায় যাবি ঠিক নেই…কি করবি ঠিক নেই…সামান্য কটা ছেলের অপমানের মোকাবিলা পর্যন্ত করতে পারিস না…ঝামেলার ভয় পাস…খালি স্বপ্ন স্বপ্ন স্বপ্ন…শুধু স্বপ্ন দেখলেও কিছু হয় না অনি ? আমারই ভুল… আমি ভাবলাম কি করে তুই সব ব্যবস্থা করতে পারবি? না না আর নয়… তোর মতো ছেলের সাথে আমার গাঁটছড়া বাঁধার আর কোনও সাধ নেই…

ইতিমধ্যে ট্রেনের গতি ধীরে ধীরে থেমে গেল বাগনান স্টেশনের কাছে এসে…। আর কুরচি সিট ছেড়ে উঠে পড়ল…তারপর তার ব্যাগ নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে লাগল ভিড় ঠেলে । ঘটনার আকস্মিকতায় অনীশ প্রথমে কিছুটা স্তম্ভিত হয়ে গেলেও …কুরচিকে এগিয়ে যেতে দেখে তার পিছু পিছু তাকে থামাতে গেল, বলল …

-এটা কি পাগলামি করছিস বলত? এই কুরচি…কথা শোন…

আশপাশের লোকজনের অবাক চাউনি…আর এলোমেলো কথার মধ্যে দিয়ে কুরচি অনির কথায় কোনও আমল না দিয়ে দরজার মুখে এসে দাঁড়াতেই, অনি কুরচির হাতটা চেপে ধরে বলল,

– প্লিজ কুরচি শোন। কি করছিস তুই?

-না শুনব না আমি …আমি যা করছি একদম ঠিক করছি অনি। আমার সব ঘোর কেটে গেছে …এভাবে পালিয়ে , তোকে বিয়ে করে একটা অনির্দিষ্ট ভবিষ্যতের দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ার কোনও মানেই হয় না…আর তাছাড়া তুই জীবনে দেখেছিসটাই বা কি? তোর কোনো বাস্তব জ্ঞান পর্যন্ত নেই অনি…ক্ষমা কর আমায়…আমি তোর সাথে এভাবে যেতে পারব না…আর তাছাড়া সত্যি বলতে আমি মাকে ছেড়ে এমন করে চোরের মত পালাতেও পারব না…যদি কোনদিন সসম্মানে ঐ বাড়ি থেকে আমাকে নিয়ে যেতে পারিস তবেই আমাদের বিয়ে হবে নয়ত হবে না…। ট্রেনটা একটু দুলে উঠল…বুঝি বা অনির মনটাও। কুরচি নেমে পড়ল ট্রেন থেকে…… দু একজন যাত্রী ছুটে এসে গাড়িতে উঠল…এতক্ষণে অনির শ্বাসপ্রশ্বাসটা কেমন স্তব্ধ হয়ে গেছিল… চোখটাও কেমন একটা ঝাপসা ঠেকছিল …বুঝতে পারছিল কুরচিকে আর আটকানো যাবে না…ক্রমশ প্ল্যাটফর্মটা অনির থেকে একটু একটু করে দূরে সরে যাচ্ছিল , আর তার জীবন থেকে মিলিয়ে যাচ্ছিল কুরচিও …চলন্ত ট্রেন থেকে যতদুর চোখ যায় অনি দেখতে থাকল কুরচিকে …হলুদ সালোয়ার কামিজে একবারও পিছনে না তাকিয়ে ভিড়ের মধ্যে মিশে গেল কুরচি… অভিমানে আর অপমানে অনির বুকের ভিতরটা জ্বলে যাচ্ছিল । সেকি এতটাই অবুঝ ছিল…ভরসা না করার মতো ছিল…যে কুরচি ওর হাত ছাড়িয়ে ঐভাবে ওকে একা ছেড়ে ট্রেন থেকে নেমে পড়ল…আর যেন পালিয়ে বাঁচল? কি জানি?
…সেদিন কুরচি অনীশকে ভরসা করতে পারেনি…আর সত্যি বলতে আজও অনীশ নিজেকে ভরসা করতে পারেনা…সেদিনের সেই ক্ষোভ আজ আর নেই, এমনকি কোনও কিছুর তাড়নায় তাকে আর তাড়িয়ে বেড়ায় না …শুধু কুরচি কেমন আছে এই ভাবনাটাই হয়ত তাকে ঘিরে রেখেছিল এতদিন । …নাহ আর ভাববে না সে কুরচির কথা …আর নতুন করে কোনও পিছুটান তৈরিও করবে না…কারন সময় তাকে বুঝিয়ে দিয়েছে কুরচি , পৃথা এরা কেউ-ই তার কল্পলোকের নারীর মত হতে পারবে না…। আর সত্যি বলতে কুরচি তার জীবনে আজ অতীতই …কিন্তু পৃথা তো বর্তমান …আর সে-ই তো এখন তার জীবনের সত্যি … ঠিক যতটা মনের মিল হওয়া সত্তেও কুরচি অধরা থেকে গেছে ঠিক ততটাই মনের অমিল পৃথাকে তার কাছাকাছি এনে দিয়েছে..
গাড়ির কাঁচের মধ্যে দিয়ে অনি দেখল গাড়ি কখন যেন শহরতলী ছেড়ে তার নিজের শহরে ঢুকে পড়েছে….নিজের শহরের বেশ একটা চেনা চেনা গন্ধ আছে যাতে অনেক দুঃখ জারিয়ে যায়! ক্রমশ কলকাতার এই ব্যস্ত পরিবেশটায় অনীশের নিজেকে বেশ আশ্বস্ত লাগছিল… তার মন বলছিল স্বপ্নের প্ল্যাটফর্মের যাত্রাটা বুঝি আজ এখানেই শেষ হল…। আজ এত বছর যে স্বপ্ন তাকে ভোর রাতে প্রায়ই তাড়া করে বেড়াত অজানা এক গন্তব্যের দিকে ,আজ বোধহয় সেই স্বপ্নের রেশই তাকে মনে মনে অদ্ভুত একটা দৃঢ়তা এনে দিল , যার জোরে অনি ভাবলো …সে বাবাকে জানিয়েই দেবে , ‘ দাশনগরে কোনদিন কোনও প্রোজেক্ট হবে না , এটা তার সিদ্ধান্ত। ’ কেন জানি না এই না বলতে পারার দৃঢ়তাটা আজ তাকে বেশ খানিকটা তৃপ্তি দিল …যে অনীশ কোনদিন তার বাবার মুখের ওপর না বলতে পারে নি ,কুরচির ওপর জোর খাটাতে পারেনি….এমন কি নিজের ইচ্ছেগুলো অকপটে প্রকাশ পর্যন্ত করতে পারে নি …আজ কিন্তু নিজের প্রতি এক অটুট বিশ্বাসে নিজেকে তার আগের চেয়ে অনেক বেশি নির্ভরযোগ্য মনে হতে লাগল….এমনি করে চাওয়া পাওয়ার বিশ্লেষণে গাড়ি এসে দাঁড়াল বাড়ির গেটে , বারান্দার দিকে তাকিয়ে দেখল পেলে আর পৃথা ……পেলে চিৎকার করছে যথারীতি ‘বাবা এসেছে ,বাবা এসেছে’ …..গাড়ি থেকে নেমে একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে নতুন একটা জীবনের আগ্রহে আর নিজেকে নতুন রূপে খুঁজে পাওয়ার এক অমোঘ টানে ঘরের পথে পা বাড়াল অনি।

__________________________________________________________________শেষ।

  
PAGE TOP
HTML Snippets Powered By : XYZScripts.com
Copy Protected by Chetans WP-Copyprotect.
Skip to toolbar