প্রথম পর্বঃ
আভেনের আঁচটা কমিয়ে দিয়ে জল হাতটা মুছতে মুছতে কিচেন থেকে বেড়িয়ে এল বিভা। ল্যান্ডলাইনটা বাজছিল। বিভা ধরল ফোনটা।
-হ্যালো।
-তোমার মোবাইলটা অফ কেন? ব্যাস্ত আছো?
-হ্যাঁ …কিন্তু তুমি কেন আবার আমায় ফোন করেছো বলতো?
-বেশ করেছি। সব তোমার ইচ্ছে মতই হবে নাকি?
-উফ …নীল। প্লিজ একটু বোঝার চেষ্টা করো।
-কি বুঝব বলতে পারো?
-জানি না…কিন্তু তুমি আর ল্যান্ডলাইনে ফোন করো না।
-তুমি মোবাইলটা খোলো। আমার কথা আছে। এটা কি হচ্ছে তোমার তিন দিন ধরে মোবাইল বন্ধ করে রেখে ?
-প্লিজ দোহাই তোমার…অতীন বাড়ি আছে এখন।পরে কথা হবে।
……ফোনটা কেটে দিয়ে বিভা এসে ডাইনিং এর একটা চেয়ারে বসল। কিচেনের জানলা দিয়ে দূরে দেখা যায় গায়ে গায়ে লেগে থাকা কয়েকটা বাড়ি। আর জানলার চৌখুপড়ি দিয়ে দেখা যাচ্ছে এক চিলতে আকাশ । বিভার এই চারতলার ফ্ল্যাট থেকে আশপাশের বাড়িগুলোকে বেশ নিচু দেখায়। একটা তিনতলা বাড়ির ছাদের অ্যান্টেনায় বসে আছে দুটো কাক। একে অন্যের ঘাড়ের কাছে বসে মাঝে মাঝে মুখ গুঁজে কি যেন করছে … দূরে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ক্রমশ আনমনা হয়ে যায় বিভা।মনে পড়ে যায় সেদিনের কথা…যেদিন প্রথম কথা হয়েছিল নীলের সাথে। দুপুরবেলা, খাওয়া সেরে একটু ভাত ঘুম দিয়েছিল বিভা…হঠাৎ মোবাইলে দিদিভাই-এর ফোন… ঘুমটা ভেঙ্গে যায় বিভার…একটু কথা হয়, আভার সাথে। তারপর ঘুম চোখে অতীনকে একটা ফোন করতে গিয়ে বিভা দেখল মোবাইলের ব্যালান্স নেই…অগত্যা খাটের পাশে রাখা ল্যান্ডলাইন থেকে দশটা ডিজিট ডায়াল করতে গিয়ে শেষ তিনটে নম্বর কেমনভাবে যেন ভুল হয়ে গিয়েছিল বিভার …ভুল মানে একটু আগে পরে। কিন্তু সেটা বুঝতে পারার আগেই ফোনের অপর প্রান্তে রিং বন্ধ হতেই বিভা কথা বলতে শুরু করে দিয়েছিল… ‘শোনো আজ ফেরার সময় একটু বাজার করো দেখি… মোচা এনো, বড়ি আর নারকেলও এনো …অনেকদিন মোচার ঘন্ট করিনি… পরশুদিন দিদিভাই আসবে বলেছে, দিদিভাই মোচা খেতে খুব ভালোবাসে…আর শোনো না , আমার এ মাসের পিল নিয়ে এসো…কাল পরশু দুদিন খেলেই কিন্তু শেষ !’
এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে ফেলার পর পাল্টা কোনও উত্তর না পেয়ে বিভা ভাবল লাইনটা বুঝি সিগন্যালের অভাবে কেটেই গেছে…সন্দেহ প্রকাশ করে বিভা বলল, যা বাব্বা কেটে গেল নাকি… শুনতে পাচ্ছ ? হ্যালো…
-হুম পাচ্ছি তো… কিন্তু ভাবছি এইসব জিনিসগুলো কোথায় নিয়ে যেতে হবে!
অপরিচিত কন্ঠস্বরে চমকে ওঠে বিভা… ফোনের এলসিডি স্ক্রীনে তখনও জ্বলজ্বল করছে নম্বরটা, যার শেষ নম্বর কটা… ৫৪৫৫ না হয়ে …৫৫৪৫ হয়ে আছে । …ইশশশ, ছিঃ কি ভুলটাই না করেছে বিভা। এইজন্যই ল্যান্ডলাইনে ফোন করতে চায় না সে… লজ্জায় মরে যাচ্ছিল বিভা। একটু চুপ করে থেকে ফোনটা কেটে হাঁফ ছেড়ে বাঁচল যেন সে। তারপর একটু ধাতস্থ হয়ে ধীরে ধীরে আবার অতীনের নম্বরটা ডায়াল করতে যেতেই , ল্যান্ডলাইন্টা বেজে উঠল …
-হ্যালো…
-হ্যালো…প্লিজ প্লিজ প্লিজ ফোনটা কেটো না মেমসাহেব। আমি নীল…মানে স্বপ্ননীল…বাড়ি ঢাকুরিয়ায় , কর্মক্ষেত্র হরিশ মুখার্জী রোড। আমি কি জানতে পারি , আমি কার সাথে কথা বলছি মেমসাহেব?
বিভা একটু বিরক্ত হয়ে বলল, ‘ফোন তো আপনি করেছেন আপনিই বলুন কার সাথে কথা বলতে চাইছেন?’
-এইমাত্র যিনি আমায় বাজার করে নিয়ে যেতে বললেন…
-সরি, রঙ নাম্বার হয়ে গেছিল…
-তো কি হয়েছে? হলই না হয় নম্বর ভুল…দুটো কথা বলতে আর আপত্তির কি আছে? হাউ নাইস ইওর ভয়েস ম্যাম…
-আপত্তি আছে বই কি… প্লিজ ডোন্ট মাইন্ড। আমি অপরিচিত কারোর সাথে কথা বলি না।
-কোথায় অপরিচিত? বললাম যে আমি নীল…বাড়ি ঢাকুরিয়ায়…
-তো এগুলো আমায় বলছেনই বা কেন? আমি তো জানতে চাই নি।
-ওমা কেন মানেটা কি? কি হয়েছে বললে? আমি তো নিজের পরিচয় দিয়েই দিলাম…আর কি অপরিচিত রইলাম? আর ফোনে কথা বললেই কি আমায় বাজে ভাবতে হবে !
-না আমি এসব কিছুই ভাবিনি …বেশ জানা রইল আপনার নাম …এখন কাটুন আমায় দরকারি ফোন করতে হবে?
-খুব দরকারী?
-হ্যাঁ… আরে বাবা যাকে সত্যি বাজার করার কথা বলতে চেয়েছি আগে তাকে তো ফোনটা করি…আপনার সাথে পরে কথা বলব কিনা ভেবে দেখব।
-ওকে…আমার নম্বর তো জেনেই গেছ মেমসাহেব…সময় করে যদি পারো তো কথা বোলো। আমি অপেক্ষায় থাকব কিন্তু।
…আর কোনও কথা বলে নি বিভা । ফোনটা কেটে দিয়েছিল…তবে মনে মনে হেসেছিল এই নীলের কথায়। কিন্তু নীলের কথার মাঝে কিছু একটা ছিল যা বিভাকে ভাবিয়েছিল। আজও সে কথা মনে পড়লে মনে মনে একটা ভালোলাগা ছেয়ে যায় ।
কাক দুটো হঠাৎ তারস্বরে চেঁচিয়ে উঠতেই ভাবনার রেশটা কেটে গেল বিভার।…পাশের ঘর থেকে অতীন বলে উঠল, ‘কিগো তোমার চা হল?’
হ্যাঁ এই দিচ্ছি।
তড়িঘড়ি আভেনের কাছে গিয়ে দেখল চায়ের জল ফুটে ফুটে একেবারে তলানিতে এসে ঠেকেছে, …নিজের মনেই জিভ কেটে আবার নতুন করে চায়ের জল বসালো বিভা।
……………………..