This entry is part 1 of 8 in the series এখানেই গল্পের শেষ নয়

 

প্রথম পর্বঃ
আভেনের আঁচটা কমিয়ে দিয়ে জল হাতটা মুছতে মুছতে কিচেন থেকে বেড়িয়ে এল বিভা। ল্যান্ডলাইনটা বাজছিল। বিভা ধরল ফোনটা।
-হ্যালো।
-তোমার মোবাইলটা অফ কেন? ব্যাস্ত আছো?
-হ্যাঁ …কিন্তু তুমি কেন আবার আমায় ফোন করেছো বলতো?
-বেশ করেছি। সব তোমার ইচ্ছে মতই হবে নাকি?
-উফ …নীল। প্লিজ একটু বোঝার চেষ্টা করো।
-কি বুঝব বলতে পারো?
-জানি না…কিন্তু তুমি আর ল্যান্ডলাইনে ফোন করো না।
-তুমি মোবাইলটা খোলো। আমার কথা আছে। এটা কি হচ্ছে তোমার তিন দিন ধরে মোবাইল বন্ধ করে রেখে ?
-প্লিজ দোহাই তোমার…অতীন বাড়ি আছে এখন।পরে কথা হবে।
……ফোনটা কেটে দিয়ে বিভা এসে ডাইনিং এর একটা চেয়ারে বসল। কিচেনের জানলা দিয়ে দূরে দেখা যায় গায়ে গায়ে লেগে থাকা কয়েকটা বাড়ি। আর জানলার চৌখুপড়ি দিয়ে দেখা যাচ্ছে এক চিলতে আকাশ । বিভার এই চারতলার ফ্ল্যাট থেকে আশপাশের বাড়িগুলোকে বেশ নিচু দেখায়। একটা তিনতলা বাড়ির ছাদের অ্যান্টেনায় বসে আছে দুটো কাক। একে অন্যের ঘাড়ের কাছে বসে মাঝে মাঝে মুখ গুঁজে কি যেন করছে … দূরে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ক্রমশ আনমনা হয়ে যায় বিভা।মনে পড়ে যায় সেদিনের কথা…যেদিন প্রথম কথা হয়েছিল নীলের সাথে। দুপুরবেলা, খাওয়া সেরে একটু ভাত ঘুম দিয়েছিল বিভা…হঠাৎ মোবাইলে দিদিভাই-এর ফোন… ঘুমটা ভেঙ্গে যায় বিভার…একটু কথা হয়, আভার সাথে। তারপর ঘুম চোখে অতীনকে একটা ফোন করতে গিয়ে বিভা দেখল মোবাইলের ব্যালান্স নেই…অগত্যা খাটের পাশে রাখা ল্যান্ডলাইন থেকে দশটা ডিজিট ডায়াল করতে গিয়ে শেষ তিনটে নম্বর কেমনভাবে যেন ভুল হয়ে গিয়েছিল বিভার …ভুল মানে একটু আগে পরে। কিন্তু সেটা বুঝতে পারার আগেই ফোনের অপর প্রান্তে রিং বন্ধ হতেই বিভা কথা বলতে শুরু করে দিয়েছিল… ‘শোনো আজ ফেরার সময় একটু বাজার করো দেখি… মোচা এনো, বড়ি আর নারকেলও এনো …অনেকদিন মোচার ঘন্ট করিনি… পরশুদিন দিদিভাই আসবে বলেছে, দিদিভাই মোচা খেতে খুব ভালোবাসে…আর শোনো না , আমার এ মাসের পিল নিয়ে এসো…কাল পরশু দুদিন খেলেই কিন্তু শেষ !’
এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে ফেলার পর পাল্টা কোনও উত্তর না পেয়ে বিভা ভাবল লাইনটা বুঝি সিগন্যালের অভাবে কেটেই গেছে…সন্দেহ প্রকাশ করে বিভা বলল, যা বাব্বা কেটে গেল নাকি… শুনতে পাচ্ছ ? হ্যালো…
-হুম পাচ্ছি তো… কিন্তু ভাবছি এইসব জিনিসগুলো কোথায় নিয়ে যেতে হবে!
অপরিচিত কন্ঠস্বরে চমকে ওঠে বিভা… ফোনের এলসিডি স্ক্রীনে তখনও জ্বলজ্বল করছে নম্বরটা, যার শেষ নম্বর কটা… ৫৪৫৫ না হয়ে …৫৫৪৫ হয়ে আছে । …ইশশশ, ছিঃ কি ভুলটাই না করেছে বিভা। এইজন্যই ল্যান্ডলাইনে ফোন করতে চায় না সে… লজ্জায় মরে যাচ্ছিল বিভা। একটু চুপ করে থেকে ফোনটা কেটে হাঁফ ছেড়ে বাঁচল যেন সে। তারপর একটু ধাতস্থ হয়ে ধীরে ধীরে আবার অতীনের নম্বরটা ডায়াল করতে যেতেই , ল্যান্ডলাইন্টা বেজে উঠল …
-হ্যালো…
-হ্যালো…প্লিজ প্লিজ প্লিজ ফোনটা কেটো না মেমসাহেব। আমি নীল…মানে স্বপ্ননীল…বাড়ি ঢাকুরিয়ায় , কর্মক্ষেত্র হরিশ মুখার্জী রোড। আমি কি জানতে পারি , আমি কার সাথে কথা বলছি মেমসাহেব?
বিভা একটু বিরক্ত হয়ে বলল, ‘ফোন তো আপনি করেছেন আপনিই বলুন কার সাথে কথা বলতে চাইছেন?’
-এইমাত্র যিনি আমায় বাজার করে নিয়ে যেতে বললেন…
-সরি, রঙ নাম্বার হয়ে গেছিল…
-তো কি হয়েছে? হলই না হয় নম্বর ভুল…দুটো কথা বলতে আর আপত্তির কি আছে? হাউ নাইস ইওর ভয়েস ম্যাম…
-আপত্তি আছে বই কি… প্লিজ ডোন্ট মাইন্ড। আমি অপরিচিত কারোর সাথে কথা বলি না।
-কোথায় অপরিচিত? বললাম যে আমি নীল…বাড়ি ঢাকুরিয়ায়…
-তো এগুলো আমায় বলছেনই বা কেন? আমি তো জানতে চাই নি।
-ওমা কেন মানেটা কি? কি হয়েছে বললে? আমি তো নিজের পরিচয় দিয়েই দিলাম…আর কি অপরিচিত রইলাম? আর ফোনে কথা বললেই কি আমায় বাজে ভাবতে হবে !
-না আমি এসব কিছুই ভাবিনি …বেশ জানা রইল আপনার নাম …এখন কাটুন আমায় দরকারি ফোন করতে হবে?
-খুব দরকারী?
-হ্যাঁ… আরে বাবা যাকে সত্যি বাজার করার কথা বলতে চেয়েছি আগে তাকে তো ফোনটা করি…আপনার সাথে পরে কথা বলব কিনা ভেবে দেখব।
-ওকে…আমার নম্বর তো জেনেই গেছ মেমসাহেব…সময় করে যদি পারো তো কথা বোলো। আমি অপেক্ষায় থাকব কিন্তু।
…আর কোনও কথা বলে নি বিভা । ফোনটা কেটে দিয়েছিল…তবে মনে মনে হেসেছিল এই নীলের কথায়। কিন্তু নীলের কথার মাঝে কিছু একটা ছিল যা বিভাকে ভাবিয়েছিল। আজও সে কথা মনে পড়লে মনে মনে একটা ভালোলাগা ছেয়ে যায় ।
কাক দুটো হঠাৎ তারস্বরে চেঁচিয়ে উঠতেই ভাবনার রেশটা কেটে গেল বিভার।…পাশের ঘর থেকে অতীন বলে উঠল, ‘কিগো তোমার চা হল?’
হ্যাঁ এই দিচ্ছি।
তড়িঘড়ি আভেনের কাছে গিয়ে দেখল চায়ের জল ফুটে ফুটে একেবারে তলানিতে এসে ঠেকেছে, …নিজের মনেই জিভ কেটে আবার নতুন করে চায়ের জল বসালো বিভা।
……………………..……………………..………………… ক্রমশ

  
This entry is part 2 of 8 in the series এখানেই গল্পের শেষ নয়

পর্ব – ২

‘এক কাপ চা করতে কত সময় লাগে বিভা’? …খবরের কাগজ হাতে অতীন এসে দাঁড়ালো কিচেনে। ঘড়ি বলছে বেলা এগারোটা সাতচল্লিশ ।অতীন দেখল বিভা একটা ছোটো ট্রেতে দুটো চায়ের কাপ সাজাচ্ছে।
অতীন বলল , থাক অত গুছিয়ে গাছিয়ে দিতে হবে না … হাতেই দাও।
বিভা একটু ইতস্তত করে অতীনের হাতে চায়ের কাপটা তুলে দিয়ে বলল, …না চা টা একটু ভিজতে দিয়েছিলাম। …এই নাও ধরো।
অতীনের হাতে একটা কাপ ধরিয়ে দিয়ে, নিজের চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে, অতীনের পাশ কাটিয়ে বিভা কিচেন থেকে ডাইনিং এ এসে বসল। তারপর পিছনে ঘুরে অতীনকে একটু অন্যমনস্কভাবে চায়ের কাপ হাতে কিচেনের জানলার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে বলল ,
– কি গো তুমি আবার কি ভাবছো , ওখানে দাঁড়িয়ে রইলে যে, এদিকে এসো না?
চায়ে এক চুমুক দিয়ে, অতীন বলল ,
– ভাবতে তো চাইছি না বিভা …কিন্তু ভাবাচ্ছে!
-কে?
-তোমার আচরণ ।
-মানে?
-দিন কে দিন তুমি কেমন যেন বদলে যাচ্ছ বিভা!!! সারাদিন কেমন একটা আনমনা হয়ে থাকো। কি যে ভাবো তুমিই জানো…একটা ঘোরের মধ্যে থাকো …কোনও কিছুতেই খেয়াল নেই। …কি ভাবো বলতো ?
-দুররর… কি আবার ভাববো।
-আরে ভাবো , ভাবো…আমি বলছি। আর কি ভাবো আমি বোধহয় একটু হলেও বুঝতে পারছি, ইদানীং।
-না আমি কিছুই ভাবি না…আর তাছাড়া ভাবার মত আছেটাই বা কি?
দুজনের কথার মাঝে ল্যান্ডলাইনটা বেজে উঠলো।বিভা চেয়ার ছেড়ে উঠে লিভিং স্পেসের সাইড টেবিলে রাখা কর্ডলেসটা ধরল…
-হ্যালো।
-তুমি মোবাইলটা খুলবে নাকি আমি এখানেই কথা বলব?
নীলের ফোন বুঝতে পেরেও অশান্তির ভয়ে ,বিভা চুপ করে রইল। অতীন বলল,
-কে ফোন করেছে?
বিভা ফোনটা নামিয়ে রেখে বলল, ‘জানি না কিছু শোনা গেল না …কেটে গেল লাইনটা’।
অতীন একটু ঠান্ডা চোখে জরীপ করল বিভাকে।
বিভা তার অস্বস্তি ভাবটা কাটিয়ে ফাঁকা কাপ দুটো হাতে নিয়ে কিচেনে যেতে না যেতেই আবার বেজে উঠল ফোন। এবার অতীন নিজেই ফোনটা ধরল। বিভা মনে মনে প্রমাদ গুনল… আগাম ঝড়ের পূর্বাভাস শুনতে পেল তার মনের অতলে…
-হ্যালো কে বলছেন?
-হ্যালো কে অতীন দা? আমি নীল বলছিলাম দাদা । কেমন আছেন?
-ও হো নীল … আমি ওই আছি একপ্রকার …তুমি কেমন আছ বলো …সব ঠিকঠাক চলছে তো?
-হ্যাঁ দাদা… সবই চলছে গড়িয়ে গড়িয়ে…মেমসাহেবের সাথে একটু কথা ছিল দাদা…দেখলাম মোবাইলটা বন্ধ…তাই এখানে ফোন করলাম। কথা বলা যাবে এখন।
-হ্যাঁ হ্যাঁ ধরো দিচ্ছি…অনেকদিন আসোও নি তো? সময় করে এসো একদিন। কথা হবে । …দাঁড়াও ডাকছি বিভাকে।
বিভা ততক্ষণে অপরাধীর মতো মুখে অতীনের পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে । অতীন একটু কঠিন চোয়ালে ফোনটা বিভার দিকে এগিয়ে দিল…বিনা বাক্য ব্যয় করে।
ফোনটা ধরেই বিভা একটু গম্ভীর সুরে বলল,
-হ্যালো …কি ব্যাপার ঝটপট বলো …সময় কম …রান্না করছি।
-আমার ফোনটা ধরে বার বার কেটে দিচ্ছ কেন মেমসাহেব…একটু কথা ছিল ইমলির ব্যাপারে।
-শোনো না নীল এখন তো আমি ব্যস্ত আছি… তুমি সন্ধ্যেবেলা ফোন করো, তখন ফ্রী থাকব। কথা বলতে পারব।
-সন্ধ্যেবেলা ? আচ্ছা বেশ্‌… ফোন ধরবে তো তখন। আমার নাম শুনে কেটে দিও না প্লিজ …আমি কথা দিচ্ছি আর ডিস্টার্ব করব না… বাট মোবাইলটা খুলে রেখ প্লিজ । আমি সত্যি ফোন করব না সময়ের আগে ,কিন্তু ফোনটা খোলা না থাকলে দমটা কেমন বন্ধ লাগছে মেমসাহেব…প্লিজ ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড ।
-আচ্ছা ঠিক আছে…এখন রাখছি পরে কথা হবে। বাই।
ভালো করে কোনো কথা বলা বা শোনার মত মানসিকতা তখন বিভার ছিল না । ফোনটা ছাড়া মাত্রই অতীন বলে উঠল…
-আচ্ছা আমাকে একটা সোজা বাংলা বোঝাবে বিভা ?
-কি ?
-নীল তোমাকে সব ব্যাপারে এতো কেন ফোন করে? তুমি কে হও ওর? দিনের পর দিন ফোনে এত কিসের দহরম মহরম? আজকাল তোমার ভাবগতিক আমার মোটেই ভালো ঠেকছে না বিভা।একটা অপরিচিত ছেলের সাথে হঠাৎ ফোনে আলাপ …আর ব্যাস তারপর থেকেই…

অতীন কে কথা শেষ করতে না দিয়েই বিভা বলে উঠল, …
– ‘আর কতদিন অপরিচিত থাকবে? এতই যদি তোমার আপত্তি ছিল …তবে বাড়িতে ঘটা করে নিমন্ত্রন কে করতে বলেছিল?’
-বাহ…আমার বউ অচেনা একটি ছেলের সাথে দিনের পর দিন ফোনে গল্প করবে..তারপর যখন সেই ছেলেটি দেখা করতে বলবে , তখন বাড়ির বাইরে গিয়ে দুজনে দেখা করবে…কেউ দেখলে কি ভাববে বিভা?
-বাজে কথা কেন বলছ? নীল আমাকে কোথাও দেখা করতে বলে নি…ইনফ্যাক্ট আমাদের কোনদিন দেখা হবে ভাবিও নি … দুষ্টুর অ্যাক্সিডেন্ট টা না ঘটলে হয়ত আমাদের দেখা হতই না…আর তাছাড়া আমি তো দেখলাম নীল কে বাড়িতে আনায় তুমিই বেশি উৎসাহী ছিলে।
-সেটা ভদ্রতা বিভা… না হলে কোথাকার কে একটা ছেলে তাকে বাড়ি ডেকে এনে গল্প মারার কোনও ইচ্ছাই আমার ছিল না।
-কেন আমি তো বলেছিলাম বাইরে কোথাও খাইয়ে দাও…তুমিই তো বেশি বাড়াবাড়ি করে বাড়িতে ডেকেছিলে।
-আমি না ডাকলে তোমরা বাইরে দেখা করতে … করেছিলে তো।
-মোটেই না। ওটা একটা অ্যাক্সিডেন্ট।
-তুমি সিওর !!! ওটা ডেটিং নয়???
-ভদ্রভাবে কথা বলো অতীন।
-আচ্ছা তুমি কি ভদ্র কাজটা করছ?
-প্লিজ চুপ কর। আমার ভালো লাগছে না…
-হ্যাঁ তা লাগবে কেন? এখন আমার সাথে কথা বলতেই তোমার ভালো লাগে না… আমি জানি বিভা।
-প্লিজ অতীন এভাবে বলোনা…আচ্ছা কেন বলতো, বাইরের একটা ছেলে কে নিয়ে আমরা নিজেদের মধ্যে এমন একটা ঝগড়া করছি।
-তুমি সেটা বোঝো কি?
-হ্যাঁ বুঝি তো, তাই তো আমি ওকে এড়িয়ে চলি আজকাল…ফোন ধরি না , কথা বলি না…বিশ্বাস করো নীলের কোনো অস্তিত্ত্ব নেই আমার কাছে …… আমার তো শুধু তুমি আছো ।…এই নতুন শহরে আমার আর কে আছে বলো ? সত্যি বলতে তুমি না থাকলে আমার বড়ো একা একা লাগে… দুষ্টুটা থাকলে তবুও কিছুটা সময় কাটে কিন্তু তুমি তো আবার দিদিকে বারণ করেছ দুষ্টুকে আমার জিম্মায় রাখতে…
-না না বিভা, দুষ্টু তোমার দিদিভাইয়ের একমাত্র অবলম্বন । তোমার জাম্বো মারা যাওয়ার পর দিদির ওই ছেলে ছাড়া আর কেউ নেই। আর অন্যের সন্তানের দায়িত্ব নিয়ে পালন না করতে পারলে …নেওয়া উচিত নয় বিভা। দুষ্টুর আরো বড়ো ক্ষতি হতে পারত!!!
-মানছি কিন্তু আমি ওর কোনও অবহেলা করি নি অতীন । আচ্ছা আমরা কি পারি না অতীন আমাদের নিজেদের সন্তানের কথা ভাবতে? এখনও কি সময় হয় নি বলতে চাও…নয় নয় করে আমাদের বিয়ের তিন বছর তো হল… কি বলো তুমি?
-না এখনো সময় হয়নি বিভা … আমাকে একটু গুছিয়ে নিতে দাও। আমি তো বলেছি… সময় আসলে তোমাকে বলতে হবে না…আমিই বলব তোমায়।
আমার রোজ রোজ ওই ওষুধগুলো খেতে ভালো লাগে না অতীন, এবার তুমি আমাকে কনসিভ করতে দাও। আমার ভীষণ একা একা লাগে ।
…কথাগুলো বলতে বলতে কান্নায় বুজে আসে বিভার কণ্ঠস্বর …অতীন পরম মমতায় বিভার মাথায় হাত রাখে…আর এইভাবেই ধীরে ধীরে অতীন আর বিভার সম্পর্কের মাঝের মেঘটা কেটে যেতে থাকে…কিন্তু বিভার মনের মধ্যে তখনো অদ্ভুত এক মিশ্র অনুভুতির যুগপৎ ভাবনার মেঘের সমাবেশ ,যা তাকে প্রবলভাবে অস্থির করে তুলতে থাকে শরীরে মনে ।

……………………..……………………..……………………..…………ক্রমশ

  
This entry is part 3 of 8 in the series এখানেই গল্পের শেষ নয়

পর্ব – ৩

বিভার সব আপনজনেরা বহরমপুরে থাকে । শ্বশুরবাড়ির বাপেরবাড়ির সবাই সেখানে । বিয়ের পর একটা বছর বিভা অতীনও বহরমপুরেই ছিল। হঠাৎ করে অতীনের বদলির চিঠি । ব্যস , তারপরেই অতীনের কর্মসূত্রে বিভার বহরমপুরের স্বজন পরিজন ছেড়ে কলকাতায় আসা, আর চেতলার কাছাকাছি একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে থাকা । যদিও প্রথম কিছুদিন অতীন কলকাতায় একাই অফিসের গেস্টহাউসে থেকে অফিস করেছিল , তারপর একটা মাথা গোঁজার উপযুক্ত ঠাঁই ঠিক করে বিভাকে নিয়ে এসেছিল কলকাতায়। সত্যি বলতে কলকাতার এই জটিল জীবনযাত্রায়, মাপা কথা মাপা হাসি, বিভা যেন ভেতর থেকে নিজেকে গুটিয়ে ফেলেছিল। সর্বোপরি এই শহরে তাদের নিজের কেউ না থাকা …আর তার ওপর অতীনের সকাল থেকে বেড়িয়ে যাওয়ায় বিভা ক্রমশই একা হয়ে পড়েছিল।
বিয়ের পর থেকেই বিভা দেখেছে অতীন একটু গোঁয়ার স্বভাবের। ভালো তো ভালো… কিন্তু রাগলে মাত্রাজ্ঞান থাকে না। একটু যেন চোখেও হারায় বিভাকে। যে কারনে বিভা বহরমপুরে শ্বশুর ভাসুর সবাইকে নিয়ে থাকতে রাজি থাকলেও অতীন প্রায় একপ্রকার জেদ করেই বিভাকে কলকাতায় এনে তুলল । না হলে অতীনের মা বাবা দাদা বউদি সবাই চেয়েছিল বিভা ওখানেই থাক , অতীন না হয় সপ্তাহে সপ্তাহে আসবে। কিন্তু না অতীন বিভাকে একা ছাড়বেই না। প্রথম প্রথম বিভার এই চোখে হারানোটা বেশ লাগত কিন্তু দিনে দিনে কেমন পাহারাদারীর মতো ঠেকছিল। অথচ অতীন মানুষটা বেশ সোজা সাপটা , বিভার আক্ষরিক অভিভাবকও বটে। কিন্তু কেন জানি না বন্ধুত্বটা কম , শাসনটা একটু বেশি লাগে বিভার। সাথে সাথে ফ্যামিলি এক্সপ্যানসনের কথা শুনলেই অতীনের এড়িয়ে যাওয়াটাও ভালো লাগে না বিভার। তাই মাঝে মাঝে বিভার দমবন্ধ হয়ে আসত কলকাতার এই অজানা পরিবেশে। একমাত্র অক্সিজেন বলতে তার দিদিভাই আভা আর দুষ্টুর মাঝে মধ্যে চন্দননগর থেকে আসা যাওয়াটা । আভার স্বামী সুকান্ত মারা যাওয়ার পর এখনও আভা তার শ্বশুরবাড়ি চন্দননগরেই থাকে । এখন তার বাড়িতে অসুস্থ শাশুড়ি ছাড়া আর সেরকম কেউ নেই । বছর তিনেক আগে বারুইপুর মিউনিসিপ্যালিটিতে সুকান্তর চাকরীটা কমপ্যাশনেট গ্রাউন্ডে পেয়েছিল আভা। সেই কারনে বিভা কলকাতায় আসার পর ছুটিছাটায় মাঝে মধ্যে দুষ্টুকে বিভার কাছে রেখে যায় আভা। বিভা আর দুষ্টু মিলে তখন খুব হৈ-হৈ হয় । কিন্তু অতীন সেটাতেও মাঝে মাঝে আপত্তি করত। তাই নিয়ে আভা যদিও কিছু মনে করে নি কখনো, শুধু বিভাকে বোঝাত অতীনের সাথে এ ব্যাপারে যেন ঝগড়াঝাটি না করে। কিন্তু তা বললে কি হবে… বিভার একমাত্র ভালোলাগার জায়গা তো ওই দুষ্টুই …তাই অতীন দুষ্টুকে রাখার ব্যাপারে বিরক্তি দেখালেই বিভার সাথে অতীনের এক চোট ঝামেলা হয়েই যেত । বিভার বেশ মনে আছে, এমনি একদিন , দুষ্টুকে নিয়ে দুজনের তর্কাতর্কির পর অতীন অফিসে বেড়িয়ে গিয়েছিল কিছু না খেয়েই । বেশ অনেকক্ষণ একা একা বাচ্ছা মেয়ের মত বালিশে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেছিল বিভা , কোনও কাজ করে নি, তারপর দুপুরের দিকে ফ্ল্যাটের পশ্চিমের একচিলতে বারান্দাটায় এসে দাঁড়িয়েছিল বিভা। শীতকাল , দুপুরের ঝলমলে রোদে চারিদিক বেশ ঝকঝক করছিল , কিন্তু তার ছটফটে চড়াই চড়াই মনটায় সেদিন কেমন যেন পড়ন্ত রোদের আঁচ। দুপুরে সে কিছু খায়ও নি, মনে মনে ভেবেছিল অতীন বোধহয় ফোন করবে, তাড়াতাড়ি চলে আসবে …তারপর দুজনে মিলে একসাথে খাবে । কিন্তু কোথায় কি? অতীন তো ফোন করেই নি উপরন্তু বিভা মোবাইলে রিং করলেও সে সমানে ফোন কেটে দিচ্ছিল। বিভা কেমন যেন অস্থির হয়ে উঠছিল ।… আসলে বিভা অতীনের সাথে পারতপক্ষে ঝামেলা করেই না…কিন্তু ঝামেলা হলে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে থাকে । বিভার এই দুর্বলতাটা আর কেউ বুঝুক না বুঝুক অতীন কিন্তু ভালোই বুঝত। তাই বিভার ফোনটা না ধরায় অতীন যতটা স্বস্তি বোধ করছিল… বিভা ততটাই অধৈর্য হয়ে উঠছিল। বিভার একটুও ভাল লাগছিল না। মনটা হালকা করার জন্য সে দিদিভাইকে ফোন করল…কিন্তু ফোন নট রিচেবেল । ‘দূররর’… রাগ করে বিভা ফোনটা সুইচ অফ করে বিছানায় ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে চুপ করে বসে রইল কিছুক্ষন …এমন সময় হঠাৎ ল্যান্ডলাইনটা বেজে উঠতেই বিভা ছুটে গেল …অতীনের ফোন ভেবে…কিন্তু ফোনটা ধরতেই অপরপ্রান্তের মানুষটি বলল…
– কি ব্যাপার মেমসাহেব… আজ দুপুরে ঘুমোওনি মনে হচ্ছে?
বিভা চুপ …
-হ্যালো …হ্যালো, তোমার এত রাগ কিসের মেমসাহেব? জানো তো বেশি রাগ করলে শরীর খারাপ হয়… মনও খারাপ হয়।

নীলের ফোনটা তার কাছে তখন অসহ্য মনে হচ্ছিল। সেই প্রথম দিনের পর দুপুরের দিকে নীল এর আগেও বেশ কয়েকবার বিভাকে ফোন করেছিল। প্রতিবার না হলেও এক আধবার নীলের সাথে বিভার কথা হয়েছিল। বিভা প্রথম দিকে একটু আধটু কথা বললেও পরের দিকে এড়িয়েই চলত.. । যদিও বিভার ছেলেটাকে খারাপ মনে হয়নি …তবে কেমন যেন পাগলাটে লেগেছিল। বেশি কথা বলে । বিভার বিষয়ে বেশি কিছু না জানতে চাইলেও , নিজের ভালোলাগা মন্দলাগার খবর বিভাকে কিছুটা দিয়েছিল। কথায় কথায় বিভা জেনেছিল, নীল তার চেয়ে নয় নয় করে তিন চার বছরের ছোটোই হবে । সে যাই হোক অচেনা কারোর বিষয় তার অত জেনেই বা লাভ কি ? অকারন গল্প করে কিই বা হবে, এই সব ভেবে ইদানীং আর কথা বলতে ভালো লাগত না বিভার । ঠিক এই কারনে প্রথমে কোনো কথা বলেনি বিভা , ফোনটা কেটেই দিয়েছিল। তারপর চুপ করে কিছুক্ষন খাটে শুয়ে রইল সে … ভাবল আচ্ছা সে যে রাগ করেছে , ঘুমোয়নি একথা ওই নীল জানলো কি করে ???? ব্যস ভাবামাত্রই মোবাইলটা তুলে নিয়ে সুইচ অন করে একটু মনে করে করে নম্বরটা ডায়াল করল বিভা। ওপ্রান্তে হ্যালো বলার সাথে সাথেই বিভা বলে উঠল ,
-আচ্ছা আপনি হঠাৎ বললেন কেন, আমার রাগ হয়েছে … আমি আজ ঘুমোই নি ?
-আরেব্বাস এটা তোমার মোবাইল নম্বর মেমসাহেব ?
-হুম… তো? আগে বলুন আপনি একথা বললেন কেন?
-হুম বলব তো…বলতে তো হবেই। কারন শুধু এই প্রশ্নটা জানতেই তুমি আমাকে আজ নিজে থেকে ফোন করলে মেমসাহেব …কিন্তু মাঝের এই আপনি আপনি ডাকটা কি বদলে তুমি করা যায় না?
-সেটা যায়, কিন্তু আগে বলুন…
-বলব… প্লিজ আপনি ডাকাটা বন্ধ করো মেমসাহেব।
-আচ্ছা বেশ… এবার বলো দেখি।
– এটা তো ভারী সোজা। অন্যদিন আমি ফোন করলে তুমি অনেকক্ষন পর ফোন ধরো আর ঘুম জড়ানো গলায় হ্যালো বলো। কিন্তু আজ তোমার গলায় সেই আলসেমীটা ছিল না।
-আচ্ছা তাই থেকেই তুমি বুঝলে আমি ঘুমোই নি? কিন্তু রেগে গেছি সেটা বুঝলে কি করে…
-এটা তো আরো সোজা …তুমি তো কথাই বলো নি…মানে হ্যালো টুকুও না…তার মানে আমার ফোনটা একেবারেই তোমার কাছে এক্সপেক্টেড নয়…
-বাব্বা তুমি এত স্টাডি করো নাকি মানুষকে ?
-নাহ , সবাইকে না… ।
-তাহলে কি আমাকে? কিন্তু কেন?
-ঠিক তোমাকেও না… তোমার ভয়েসটাকে ।
– আচ্ছা তাই বুঝি…? কিন্তু সবাই যদি এমন করে বুঝত, তাহলে তো…
-কি ব্যাপার মেমসাহেব আজ এমন মনমরা হয়ে আছো কেন?
-আমার কণ্ঠস্বরে এটাও বুঝি বোঝা যাচ্ছে ?
-হুম যাচ্ছে তো? আসলে কি জানো তোমার অস্তিত্বটা আমার কাছে শুধু কন্ঠস্বরে তো তাই বোধহয় …
– বুঝলাম…তা কি করা হচ্ছে এখন অফিসে?
– সেরকম কিছুই না… আচ্ছা তোমার মন খারাপ কেন ?
-নাহ মন খারাপ নয় তো? আচ্ছা তুমি যে এতো বোঝো , তোমার বাড়ীর লোকেদের সবাইকে বুঝতে পারো…
-বাড়ির লোক মানে কার কথা বলছো… বউ ?..তাহলে জানিয়ে রাখি… আমার বিয়ে হয় নি এখনো। এখনও আমি স্বাধীন…বশ্যতা স্বীকার করি নি।
– বিয়ে মানেই পরাধীন নাকি ?
-হ্যাঁ তো …সবার ক্ষেত্রেই, তবে মেয়েদের ক্ষেত্রে বেশি…
-আচ্ছা তোমার কোনো বান্ধবী নেই?
-বান্ধবী মানে গার্ল ফ্রেন্ড বলছো কি? …তাহলে বলি, ছিল…হয়ত আছেও!
-এ আবার কিরকম উত্তর!!!!
-না মানে তার যখন আমাকে দরকার তখন আছে …যখন দরকার পড়ে না তখন ডাকলেও সাড়া পাই না।
-কেন?
-কি কেন? অনেকদিনের সম্পর্ক মেমসাহেব । আছি ওই পর্যন্ত । একসময় এত কথা বলেছি …এখন কথা ফুরিয়ে গেছে …সারাদিনে একবার শুধু থাকাটা জেনে নেওয়া।
-এমন কেন? এখনো তো বিয়ে করনি।
-কেন তোমাদের বিবাহিত জীবনে সম্পর্কগুলো বুঝি ফুরিয়ে যায় না?
-না… বুড়িয়ে যেতে পারে … ফুরিয়ে যাবে কেন?
-যায় মেমসাহেব যায়… কিন্তু বিয়ে হয়ে গেছে বলে সহজে কেটে বেরোনো যায় না।
-কি জানি …ভাবিনি কোনোদিন এমনভাবে।
– তোমার গার্ল ফ্রেন্ডের নাম কি?
– ইমলি…
– ওমা কি মিষ্টি নাম!!!!
– মিষ্টি ??? তেঁতুল আবার মিষ্টি হয় নাকি?
– খাট্টা মিঠা তো হয় …
– তাতে কি বোঝা গেল শুনি?
– অনেক কিছু ।
– কি আবার বুঝলে?
– বুঝলাম এই যে, তুমি যেমন বুনো ওল সেও তেমন বাঘা তেঁতুল । কি তাই তো????
– তোমার এই হাসিটা আমার বেশ লাগে মেমসাহেব …
-তোমার এই মেমসাহেব ডাকটাও আমার বেশ লাগে । যাক অনেক হয়েছে…এখন রাখি …কাজ আছে অনেক …বাই।
– এবার ফোন করলে বিরক্ত হবে নাতো …মে-ম সাহেব?
– তা বলতে পারছি না… সব আমার মুডের ওপর নির্ভর করছে…এখন রাখছি। বাই
– হুম রাখ। আই উইল ওয়েট ।

অতীনের কড়া কড়া কথা আর উপেক্ষায় বিভার মনটা এতটাই বিপর্যস্ত ছিল , যে নীলের সাথে সামান্য কটা কথা সেদিন তার বেশ লেগেছিল। মনটা বেশ হালকা হয়ে গিয়েছিল। তার যে মনটা তাকে ইদানীং কোন কিছুতেই সঙ্গ দিচ্ছিল না, সেই মনটা কিন্তু নীলের সাথে কথা বলার ছাড়পত্র দিয়েছিল খুব সহজেই।

……………………..……………………..…………………(ক্রমশ)

  
This entry is part 4 of 8 in the series এখানেই গল্পের শেষ নয়

পর্ব- ৪

নীলের সাথে ইমলির সম্পর্কটা কেন এমন ছাড়া ছাড়া বিভা ঠিক বোঝে না। যতবারই কথা হয়েছে নীলের সাথে বিভার মনে হয়েছে নীল কেমন যেন জোর করে বয়ে বেড়াচ্ছে সম্পর্কটা । নীলের পেড়াপেড়িতে বেশ কয়েকবার ইমলির সাথে কথাও হয়েছিল বিভার , কিন্তু ইমলি সেটা ভালো চোখে নেয় নি বোধহয়। যদিও ইমলির বয়সটা বেশ কম তাও , ইমলিকে বড়ো হিসেবি ঠেকেছিল বিভার। তবুও যখনই ইমলি নীলের ফোন ধরত না , নীল বিভাকে ইমলির সাথে কথা বলতে জোর করত। প্রথম প্রথম বিভার বেশ অস্বস্তি হত , কি বলবে ভেবে পেত না । তার ওপর ইমলি যখন জিগ্যেস করত ‘আচ্ছা বিভাদি বলোতো, তোমার সাথে ওর কি এত কথা হয় …আমি তো ওর সাথে বলার মতো কথাই খুঁজে পাই না’। … বিভা হাসত , মুখে কিছু না বললেও মনে মনে কেমন একটা মায়া লাগত নীলের ওপর। আসলে সেও জানে না নীলের সাথে সে কি এত কথা বলে। সত্যি বলতে নীলের সাথে তার বেশ কয়েক মাস টুকটাক ফোনেই যা কথা হত। কিন্তু যে বার অতীন অফিসের কাজে শিলিগুড়ি গিয়েছিল, সেই বার বিভা একা থাকতে পারবে না বলে আভাকে থাকতে বলেছিল… কিন্তু অসুস্থ শাশুরিকে ছেড়ে আভা কেমন করেই বা থাকে? … অগত্যা দুষ্টুকে রেখেছিল বিভার কাছে কদিনের জন্য। অতীন বার বার বিভাকে বলেছিল, ‘একা একটা বাচ্চাকে নিয়ে থাকতে পারবে না ’ বিভা কথা কানেই তোলে নি। দুষ্টুকে নিয়ে তার বেশ কাটছিল।সকালে ঘুম থেকে উঠে দুষ্টুকে নিয়ে কাছাকাছি একটু বাজার করা, দুপুরে ভাত খাওয়ানো , ঘুম পাড়ানো , তারপর বিকেলবেলা দুস্টুকে নিয়ে পার্কে যাওয়া । সেখানে আর পাঁচটা বাচ্চার সাথে দুষ্টুর খেলা দেখতে বিভার বেশ লাগত। সন্ধ্যেবেলা দুজনে মিলে গল্পের বই পড়ত, টিভি দেখত, তারপর অল্প কিছু রান্না করে খেয়ে খাইয়ে , অতীনের সাথে ফোনে সব কিছুর বিস্তারিত গল্প করে , তারপর শুতে যাওয়া । এক সপ্তাহের মধ্যে এইভাবে বেশ কটা দিন তো কেটেই গেছিল । কিন্তু একদিন বিকেলে দুষ্টুকে নিয়ে খেলতে গিয়ে হঠাৎ মাঠে কি একটা কামড়াতে দুষ্টুর পায়ে রক্ত জমাট হয়ে নীল হয়ে গেছিল…কি বিচ্ছিরিভাবে ফুলে উঠেছিল পা টা, … সে কি কান্না দুষ্টুর, কাঁদতে কাঁদতে ছেলেও যেন কেমন ঝিমিয়ে পড়েছিল। বিভা ভয় পেয়ে অতীনকে ফোন করল , অতীন তখন মিটিং-এ । ফোন সাইলেন্ট… । দিদিকে ফোন করল বিভা , দিদির ফোনও বেজে বেজে কেটে গেল। শেষমেষ বিভা একটা ট্যাক্সিতে উঠে পড়ল দেশপ্রিয় পার্কের দিকে এক ডাক্তারের কাছে যাবে বলে । এমন সময় হঠাৎই নীলের ফোন , বেশ কয়েবার ফোনটা বাজার পর , বিভা ফোন ধরেই খুব বিরক্তি নিয়ে বলেছিল… পরে কথা বলব, আমি এখন খুব বিপদে আছি।
-বিপদ …আরে কি হয়েছে বলোই না?
-একটু ইতস্ততঃ করে বিভা পুরো ঘটনাটা বলতেই, নীল বলেছিল, ‘কোথাও না , তুমি সোজা হরিশ মুখার্জ্জী রোডে, শম্ভুনাথ পন্ডিত হসপিটালে এসো। আমি ওখানে এমারজেন্সিতে আছি, তুমি কাউন্টারে এসো, ভয়ের কিছু নেই , সব ঠিক হয়ে যাবে’।
বিভার আজো মনে পড়ে সে কিভাবে দুষ্টুকে নিয়ে গিয়েছিল, দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে। কাউন্টারের বাইরে দুষ্টুকে কোলে নিয়ে এগিয়ে আসতে দেখেই , সুঠাম চেহেরার বেশ লম্বা একটি ছেলে কাউন্টার ছেড়ে বেরিয়ে এসে জিগ্যেস করেছিল,
-তুমি বিভা???
-হ্যাঁ…
-আমি নীল , এসো আমার সাথে এসো…ডাক্তার আছেন ভেতরে।
শম্ভুনাথ পন্ডিত হস্পিটালের আউট ডোরে ডাক্তার দেখেছিলেন দুষ্টুকে , বলেছিলেন ‘হয়ত কোনও বিষাক্ত কীটের দংশন’। …তারপর দুষ্টুর পায়ের ওই জায়গাটা একটু চিড়ে জমে থাকা রক্ত বের করে দেওয়ার পর, ওষুধ লাগিয়ে ব্যান্ডেজ করে, ইঞ্জেকশান দিয়ে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে বলছিলেন। প্রায় ঘন্টাখানেক বাদে দুষ্টু একটু স্বাভাবিক হওয়ার পর বিভার খেয়াল হয়েছিল নীলের কথা, কাউন্টারের দিকে তাকাতেই চোখাচোখি হয়েছিল নীলের সাথে। ইতিমধ্যে সে বেশ কয়েকবার এসে দেখে গেছে বিভাকে, নীলের প্রতি অসীম কৃতজ্ঞতায় বিভার মনটা ভরে গেছিল। সেদিন অল্প কিছু কথার পর, ফাইনাল চেক আপ করিয়ে, নীল ট্যাক্সিতে পৌঁছে দিয়েছিল বিভা আর দুষ্টুকে । কিন্তু বাড়ি আসে নি । কারণ ট্যাক্সিতে ওঠার পরই অতীনের ফোন … সব শুনে খুব বকেছিল বিভাকে দুষ্টুর প্রতি অবহেলার জন্য। চুপচাপ সব বকুনি শুনে বিভার তখন কাঁদো কাঁদো অবস্থা । তাও কিছুটা স্বাভাবিক হতে চেয়ে বিভা বলেছিল, ‘তুমি কি নীলের সাথে কথা বলবে, ও পাশেই আছে’ । কথা হয়েছিল অতীন আর নীলের। নীলের প্রতি কৃতজ্ঞতা দেখিয়ে অতীন তাকে বলেছিল, ‘অনেক অনেক ধন্যবাদ নীল, আমি কলকাতা ফিরলে একদিন আসুন আমার বাড়ি , তখন কথা হবে, খাওয়া-দাওয়া হবে।’ নীল বোধহয় এক মুহূর্ত কিছু ভেবেছিল। তারপর বলেছিল, …সে হবে ক্ষন, আগে আপনি ফিরুন তো দাদা।’
……এই ঘটনার পর থেকেই নীলের সাথে বিভার একটা সুন্দর বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। কলকাতায় ফিরে আসার পর অতীন একটা রবিবার নিমন্ত্রণও করেছিল, নীলকে । সেদিন খুব সুন্দর করে সেজেছিল বিভা। অনেক রাত পর্যন্ত গল্প হয়েছিল… খাওয়া দাওয়া…একটু আধটু লাল জলও চলেছিল অতীন আর নীলের । তারপর নীল বেড়িয়ে পড়েছিল বাড়ির উদ্দেশ্যে, বিভার খুব ভালো লেগেছিল, অনেকদিন পর কলকাতায় চেনা পরিচিত কাউকে পেয়ে…। বেশ আনন্দের সাথে অতীনকে জিগ্যেস করেছিল,
-কেমন লাগলো তোমার নীলকে? …
অতীন গম্ভীর হয়ে জড়ানো শব্দে বলেছিল,
-ঠিকই আছে …কিন্তু তোমার নজরটা ঠিক ছিল না , হাভ ভাব বদলে গেছিল?
-মানে?
-লড়বে নাকি আমার সাথে এই টপিকে, ..লেটস স্টার্ট বেবি …আমি রেডি।
-এ আবার কি কথা… রাত দুপুরে যত্তসব উল্টোপাল্টা ।
-তোমার তাই মনে হচ্ছে বুঝি ? কিন্তু একটা কথা বলো তুমি সেদিন ওর সাথে দেখাই করতে গিয়েছিলে, কি তাই তো?
-তুমি কি পাগল হয়ে গেছ?
– তুমি আগে তো কোনওদিন এমন করে সাজোনি বিভা, আজ কেন সেজেছিলে? ওকে ইম্প্রেসড করার জন্য? কি এমন দেখতে ছেলেটাকে?
…এরকমই কিছু কথার জ্বালায় বিভাকে এফোঁড় ওফোঁড় করে, সেই রাতে অতীন বিভার অঙ্গরাজ্যের ওপর আধিপত্য বিস্তার করেছিল। সেদিন অতীনের সোহাগের পরিভাষাটা এতটাই অন্যরকম ছিল যে, বিভা গোটারাত দুচোখের পাতা এক করতে পারে নি। অতীন যখন বেঘোরে ঘুমোচ্ছিল, বিভা তখন জলভরা চোখে ভেবেছে, একবার নীলকে ফোন করে বলবে নাকি, যে সে যেন আর তার সাথে যোগাযোগ না রাখে… । আর কোনোদিন যেন ফোন না করে, অতীন পছন্দ করছে না ব্যাপারটা…। নাকি আর ফোন ধরবেই না নীলের। বুঝিয়ে দেবে ব্যস অনেক হয়েছে আর নয়। অবশেষে ভোর রাতে মনের সাথে বেশ যুদ্ধ করে মোবাইলটা হাতে নিয়ে অন করতেই , একটা এসএমএস … !!! একরাশ মন খারাপ নিয়ে চোখের জল মুছে বিভা একদৃষ্টে চেয়েছিল স্ক্রীনের দিকে…। ভেবেছিল, এ হেঁয়ালীর মানে কি??? এসএমএস টা নীলের। গত রাতে বাড়ি পৌঁছে নীল কেন জানিনা নেশার ঘোরে বিভাকে লিখেছিল,
‘তোমাকে আজ না দেখলে বুঝতেই পারতাম না মেমসাহেব তোমার মধ্যে ,এত মেঘ… এত জল আছে, … মেম…, তুমি সবসময় খুব হাসি খুশি থেকো, হাসলে তোমায় ভারি সুন্দর দেখায়…
শুভ রাত্রি। নীল।
……………………..……………………..…………………(ক্রমশ)

  
This entry is part 5 of 8 in the series এখানেই গল্পের শেষ নয়

পর্ব- ৫

নীলের সাথে বিভার বন্ধুত্বটা হবে না হবে না করেও কেমন যেন দিনকে দিন বেড়ে যেতে থাকে। সারাদিনের কাজের মাঝে টুকটাক এসএমএস … কখনো ধাঁধাঁ , কখনো জোকস , কখনও বা ছোটো ছোটো হাসি ঠাট্টা অভিমান … ফোনের টিং টিং আওয়াজ সব মিলিয়ে বেশ লাগতে থাকে বিভার । কেমন যেন একটা ভরে থাকার অনুভব …সেই একাকিত্বটা এখন আর তাকে তাড়া করে বেড়ায় না। … মাঝে মাঝে নীলের ভুলভাল কথায় তর্ক হয়, রাগ হয় …তখন কিছুদিন কথা বার্তা বন্ধ থাকে , তারপর আবার বিভাই নীলের রাগ ভাঙ্গিয়ে নিজে থেকে ফোন করে। গম্ভীর গলায় নীল বলে,
– ফোন করেছ কেন?
বিভা বলে ,
-রাগ কমেনি দেখছি। আচ্ছা বাবা সরি, ঘাট হয়েছে আমার ,কথা বলতে হবে না …কিন্তু বড়ো বলে একটা সম্মান তো করতে পারো…
তখন নীল বলে,
-তুমি বড়ো বলেই যে সবসময় ঠিক হবে এমন কিন্তু নয় মেমেসাহেব … তুমি বড় হতে পারো কিন্তু আমার অভিজ্ঞতা তোমার থেকে অনেক বেশি।
নীল যখন রেগে থাকে বিভার কেমন যেন একা একা লাগে… মাঝে মাঝে ভাবে নীলকে জিগ্যেস করবে কেন সেদিন রাতে সে অমন মেঘ জলের এসএমএস করেছিল … কি বলতে চেয়েছিল সে? কিন্তু যখনই বিভা জিগ্যেস করতে যায় কেমন একটা অস্বস্তি তাকে ঘিরে ধরে।
বিভা আর নীলের বন্ধুত্বটা যতটা গভীর হয়ে উঠছিল, অতীন যেন কেমন একা হয়ে যাচ্ছিল। সত্যি বলতে দুটো মানুষের মাঝের সম্পর্কের সুতোটা যখন আলগা হতে থাকে তখন একজন আরেকজনকে কি সত্যি বুঝতে চায়? চায় না বোধহয়… পরিবর্তে আধিপত্য দেখাতে চায়, নিজেকে বোঝাতে চায় … একে অন্যকে দোষারোপ করতে থাকে… যার ফলে দুরত্বটা বাড়তে বাড়তে একজন অপরজনের কাছে দিনে দিনে অপরিচিত হয়ে ওঠে। এক্ষেত্রেও তার অন্যথা হয় নি। বিভার প্রতি অতীনের আচরণটা ধীরে ধীরে কেমন কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে উঠতে থাকে অনাবশ্যক ভাবেই। একটা সন্দেহের জালে বিভার জীবনটা জড়িয়ে পড়তে থাকে… মাঝে মাঝেই অতীন বিভার ফোন নিয়ে কললিস্ট চেক করে , এসএমএস দেখে , … কিছু দেখতে না পেলে বলে , ‘ আগে আগেই সব ডিলিট করে রেখেছ, তাই না?’ অপমানে বিভার মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে যায়। আর অতীনের চোয়ালটা কঠিন । বিভা সহজ করার জন্যে অতীনের গায়ে হাত ছোঁয়ালে এক ঝটকায় অতীন হাত সরিয়ে দেয় বিভার । বিভা ভেতরে ভেতরে ক্ষয়ে যায়। মুখে কিচ্ছুটি বলে না। মনে মনে অতীনের জন্যে তার মায়াও হয়… ভাবে ,
ধ্যুত আর ফোন করবে না নীলকে । সত্যিই তো কে এই নীল …একটা উড়ো অশান্তি…যার জন্যে অহেতুক অতীন তার থেকে দূরে সরে থাকছে… সন্দেহ করছে…নিজেদের সম্পর্কটা শুধু শুধু নষ্ট হয়ে যাচ্ছে …কি লাভ আছে তার নিজের সংসারে এমন ঝামেলা করে। অতীনের সাথে জেদাজেদিতে নীলের সাথে কথা বলাটা একটা নেশার মত হয়ে যাচ্ছে তার কাছে অথচ , একটু সহানুভুতির আদান প্রদান ছাড়া আর কিই বা আছে ??? হতে পারে নীল অবিবাহিত বলে তাদের হাসি ঠাট্টা নিয়ে অতীন খারাপ ভাবে কিন্তু বিভা তো জানে তার সীমাবদ্ধতার কথা। তাই গত কদিন ধরে বিভা নিজের সাথে বোঝাপড়া করে , সকাল থেকে ফোনটা বন্ধ করেই রেখেছে। অতীন যা যা পছন্দ করে তাই করবার চেষ্টাও করছে, কিন্তু এতেও কি সামান্য স্বস্তিটুকু পাওয়ার উপায় আছে! একে তো ফোনটা বন্ধ করতে হবে কেন সেই প্রশ্নে অতীন জর্জরিত করে তুলছে উপরন্তু মোবাইল বন্ধ থাকায় নীল এমন ভুলভাল কাজ করছে , যে যা সত্যি নয় তাকেও অতীন সত্যি মনে করতে শুরু করছে।
সন্ধ্যেবেলা আজ অনেকদিন পর অতীন আর বিভা টিভিতে সিনেমা দেখছে একসাথে । আজ অতীন সকাল থেকে অফিসও বেরোয় নি। যদিও বেলায় চা খেতে গিয়ে নীলের ব্যাপারে একটু কড়া কড়া কথা হয়েছে… কিন্তু দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর পরিবেশ একদম ঠান্ডা। অনেকদিন পর আজ একটা ডাকাতিয়া দুপুরের আবেশ এখনও বিভাকে কেমন আদুরে করে রেখেছে। অতীনের গায়ে হেলান দিয়ে দুজনে মিলে একটা কোয়ালিটি টাইম এনজয় করছিল। আঙ্গুলে আঙ্গুল জড়িয়ে সোফায় বসেছিল দুজনে, এমন সময় অতীনের ফোনে তার অফিস থেকে ব্রজেশ্বরদার ফোন এল…স্মল স্কেল ইন্ডাস্ট্রীর লাস্ট সেলস্ ফিগারটা কত? শেষ দুবছরের মার্জিনাল ডিফারেন্স কত ?এইসব জানতেই অফিসের ফোন…। কাল যে অতীনের অফিসে একটা বড়ো সেমিনার আছে । অতীন বিভাকে বলল,
-একটু ফাইলটা এনে দেবে বিভা …
-যাচ্ছি, কোথায় আছে বলো ।
-আমার আলমারির একদম ওপরের তাকে, হলুদ রঙের ফাইল।
-আনছি…
বিভা ফাইলটা আনতে গেল …বিভার আস্তে দেরী দেখে ব্রজেশ্বরদার সাথে একটু কালকের প্ল্যানিং নিয়ে অতীনের কথাও হল। কথা বলতে বলতে অতীন হাঁক পাড়ে,
– কি গো পেলে ?
-হ্যাঁ , দিচ্ছি।
একটু দেরী হলেও বিভা কিন্তু ফাইলটা খুঁজে এনে দিল অতীনকে। তারপর বলে ,
-তুমি কথা বলো, আমি আলমারিটা বন্ধ করে আসছি। পায়ে পায়ে ফিরে যায় বিভা । আলমারির পাল্লার পাশে দাঁড়িয়ে চুপ করে একটা বন্ধ খামে রাখা কিছু কাগজ বার করে পড়তে থাকে বিভা… পড়তে পড়তে বিভার চোখ দুটো জলে ভরে উঠতে থাকে… খামটা একটা ডায়গনেস্টিক সেন্টারের আর কাগজগুলো সাধারণ কাগজও নয়, মায়ো ক্লিনিক্যাল রিপোর্ট – মেল ফার্টিলিটি টেস্ট। যা বলছে, অতীনের স্পার্ম কাউন্ট নরমালের থেকে অনেক অনেক নিচে… এটা পড়ে বিভার একটুও বুঝতে অসুবিধে হল না, তার কনসিভ করতে চাওয়ায় অতীনের বাধাটা আসলে কোথায় ! … এক মুহুর্তের জন্যে বিভার জীবনখাতার আগাম পাতাগুলো সাদা হয়ে গেল… অতীনের অক্ষমতার কথায় যতটা না অনুকম্পা হল , রাগ হল অনেক বেশি । … কারণ সব জেনেও নিজের অসুবিধে গোপন রাখতে সে বিভাকে কামপিলগুলো খেয়ে যেতে বাধ্য করেছে। দিনের পর দিন ওই অসুধ খেয়ে বিভার হরমোনাল ডিসব্যালান্স হত, পাশাপাশি মাথা ঘোরা , গা বমি তো ছিলই। এমনকি তার দিদির কথা শুনে বিভা যখন ,’বলত এই পিলগুলো বেশি খাওয়া ঠিক নয় , পরে কনসিভ করতে প্রবলেম হতে পারে সেটা শুনে অতীন গা করত না।’ তার মানে ও সব বুঝত কিন্তু …. ! এরপর ধীরে ধীরে তার মনে হয় ,এও তো এক মিথ্যের আশ্রয়… এক রকমের প্রতারণা ! যা অতীন দীর্ঘ একবছর ধরে করে আসছে তার সাথে। বিভার মাথায় সব তালগোল পাকিয়ে যায়।মনের মধ্যে একটা উদ্দাম ঝড়ের আভাস টের পায় বিভা। ততক্ষণে অতীন লিভিং থেকে ডাকাডাকি শুরু করে দিয়েছে , ‘ শুনছ … কি করছ… এস না। …কিগো?… বিভা?’ নিজের মনের সাথে যুদ্ধ করতে থাকে বিভা… তার এই কদিনের সুসম্পর্ক গড়ে তোলার সুচেষ্টাটা ফালতু মনে হতে থাকে… খামটা সযত্নে আলমারির যথাস্থানে রেখে চোখ মুছে ঘরের আলো নিভিয়ে ধীর পায়ে অতীনের কাছে যায় বিভা। তার খুব ইচ্ছে করছিল অতীনকে একবার জিগ্যেস করতে , ‘সত্যি কথাটা এমনভাবে কেন গোপন করলে তুমি? তুমি সহজ কথাটা একবার সহজ ভাবে বলেই দেখতে আমি মেনে নিতে পারি না… চাইলে দুজনে মিলে ডাক্তার কনসাল্ট করতাম,… নিজের অক্ষমতার কথা বলতে পৌরুষে খুব লাগত বুঝি, তাই বোধহয় দুষ্টুকেও আজকাল তোমার আর পছন্দ হয় না… এরকম আরো অনেক কিছুই ভাবলো বিভা, কিন্তু কেন জানি না অতীনকে হাসতে দেখে নিজের কষ্টটাকে ভুলে থাকতে চাইল বিভা। অতীন হঠাৎ বিভার হাত ধরে টেনে বলল,
-বসো না যেমন বসেছিলে… উঠে পড়লে কেন? তারপর বিভার থমথমে মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ কি হয়েছে তোমার?’ বিভা চুপ করে থেকে বলল, ‘ কিছু না… তুমি চা খাবে?’ অতীন বলল, ‘ নাহ … চলো আজ আমি কড়া কফি করে তোমাকে খাওয়াই। অন্যসময় হলে বিভার হয়ত খুব আনন্দ হত, কিন্তু বিভা শূন্য চোখে তাকিয়ে রইল টিভি স্ক্রীনের দিকে … কফি বানাবে বলে অতীন সোফা ছেড়ে উঠে পড়ল।

  
This entry is part 6 of 8 in the series এখানেই গল্পের শেষ নয়

পর্ব- ৬

সন্ধ্যের দিকে নীলের মনটা কেমন যেন একটু করছিল। বাইরে বেরোল কিন্তু ভালো লাগল না… ফিরে এসে ইমলিকে ফোন করল একবার …কিন্তু ফোনটা বেজেই গেল । পরিবর্তে এসএমএস এল , ‘এখন স্যারের কাছে ….ফোন কর না , ফেরার সময় আমি মিসড কল করব। কথা হবে ।’ ইমলি এ বছর উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে, এডুকেশনে অনার্স নিয়ে কলেজে ভরতি হয়েছে। ওর দিদির বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত বাড়িতে ওর বিয়ের কথা কেউ ভাববেই না… অথচ নীলের সাথে ইমলির সম্পর্কটা বেশ কয়েক বছরের…বলা ভালো সেই স্কুলে পড়া কালীন। ইমলি , নীলের বাবার বন্ধুর মেয়ে। ছোটবেলার ভালোলাগা পরে দুই পরিবারের মধ্যে অলিখিত এক সম্পর্কের জন্ম দিয়ে দিয়েছে, যেখান থেকে নীল আর বেরোনোর কথা ভাবতেও পারে না। তখন দিনের পর দিন এত কথা বলেছে এখন আর কথাই খুঁজে পায় না …আসলে শুধু কথায় এখন আর মন ভরে না, তার বাইরেও আরো কিছু পেতে ইচ্ছে করে …কিন্তু সুযোগ কই? নীল তো ঢাকুরিয়ায় পেয়িং গেস্ট থাকে এক বৃদ্ধা মাসিমার বাড়ি, আর ইমলি তো নদীয়ায় । নীলের আসল বাড়ি শান্তিপুরে । চাকরী সূত্রে তার কলকাতায় আসা… থাকা। সম্পর্কটা কেমন যেন খুব কাছের হয়েও দূরের হয়ে যাচ্ছে …ইচ্ছে করলেও ছোঁয়া যায় না। মাঝে মাঝে একঘেয়ে লাগে নীলের, বড্ড এলোমেলো লাগে , সারাদিনে ওই এক আধটা ফোন … মিসড্‌কল… এসএমএস। দুজনের মাঝে একটা কমিটমেন্ট আছে কিন্তু মনের দূরত্ব হয়ে গেছে যোজন কয়েক। আজ দুতিনদিন ধরে বিভাও ফোনটা কেন জানি না ধরছে না। বয়সে বড়ো বলেই বোধহয় বিভা অনেকটা বুঝতে পারে নীলকে … কেমন একটা দিদির মত হাবভাব …কিন্তু কি একটা মায়া… কি একটা আকর্ষণ, কন্ঠস্বরে কি একটা নেশা, ভাল লাগা, গোটা শরীরটা মাঝে মাঝে উত্তাল হয়ে ওঠে নীলের, কান দিয়ে একটা শিরশিরানি বয়ে যায়। কিন্তু হঠাৎ কি এমন হল বিভার, যে এড়িয়ে যাচ্ছে নীলকে… কেমন একটা অস্বস্তি হচ্ছিল নীলের। চোখ বন্ধ করলে বিভার সেদিনের ওই মায়াবি মুখটা ভেসে উঠছিল… মনে হচ্ছিল অতীনদার থেকে সে অনেক বেশি বিভাকে বোঝে … বিভার মনে একাকিত্বের একটা মেঘ আছে, হয়ত কোনও লুকোনো কষ্ট , তার মিষ্টি কন্ঠস্বরে উচ্ছ্বলতার সাথে সাথে একটা বিষন্নতাও ঝরে পড়ে ঝরনার জলের মত… বিভার মুডের ভ্যারিয়েশনের ভাইব্‌সগুলো নীলকে কেমন যেন টানে। আর কথার ফাঁকে ফাঁকে ‘উঁহু’ বলে এক ঝলক হাসি নীলের শুকনো বুকটা কেমন জলে ভরিয়ে দেয়। দিনে দিনে নীলের কেমন যেন অভ্যেস হয়ে দাঁড়াচ্ছিল বিভাকে ফোন করাটা। তাই বোধহয় এমন সিগারেট খেতে না পাওয়ার মত ছটফট করতে থাকে নীল। ভাবে সকালে দু তিনবার ফোন করেছিল কিন্তু একবারও কথা হয় নি তেমনভাবে… বিভার সাথে খুব কথা বলতে ইচ্ছে করে নীলের। কিন্তু মোবাইলটা তো এখন ও বন্ধ। ল্যান্ডলাইনেও পাওয়া যাচ্ছে না। নীল ভাবে অতীনদা নিশ্চয় বাড়ি আছে তাহলে অতীনদার মোবাইলেই একবার ফোন করে দেখবে নাকি? ভাবা মাত্রই কাজ … ফোনটা রিং হতে থাকে । অতীন তখন কফি বানাচ্ছিল বিভার জন্য…ফোনের শব্দে কিচেন থেকে মাথাটা বের করে বিভাকে বলল, ‘ দেখ তো কে ? বিভা দেখল নীলের ফোন … কেমন যেন মনটা থই থই জলে ভরে গেল… কথা বলতে ইচ্ছে করল নীলের সাথে। একটু ইতস্তত করে ধরল অতীনের ফোনটা,
– হ্যাঁ বল
– যাক … , এতক্ষন পরে অতীনদার ফোনে তোমায় পেলাম । তোমার ল্যান্ডলাইন মোবাইল সব বন্ধ কেন গো? কি হয়েছে ?আমি কি কিছু ভুল করেছি?
– নাহ, এমনি। তুমি কেন ফোন করলে তাই বল।
– না সেরকম কিছু না আসলে ইমলির ব্যাপারে একটু কথা ছিল … তুমি একদিন ওর সাথে কথা বলবে। আমাকে নিয়ে ও কি ভাবছে, একটু যদি … আমি একদিন নিয়ে যাব ওকে তোমার কাছে।
– ঠিক আছে পরে কথা হবে ক্ষণ এ বিষয়ে … আজ নয়… অন্য কোনওদিন…
– তোমার কি হয়েছে মেমসাহেব ? মনটা খারাপ মনে হচ্ছে… আমায় বলা যাবে কি?
– হুমমম, বলব …পরে… এখন না
– বলবে তো ঠিক
– হুম এখন রাখছি …ব্যাস্ত আছি ।
– ফোনটা ছেড়ে দেবে এখনি? ওকে বাই।কিন্তু প্লিজ মোবাইলটা খুলে রাখ মেমসাহেব … ওটা বন্ধ থাকলে খুব একা লাগছে।
– আচ্ছা। বাই ।
ফোনটা কেটে সাইড টেবিলে রাখতে গিয়ে বিভা দেখল অতীন পিছনে দুহাতে দুটো কাপ নিয়ে দাঁড়িয়ে … কেমন যেন জেরা করার মত বলল, কে ফোন করেছিল?
-নীল
-আমার মোবাইলে?
-হ্যাঁ ল্যান্ডলাইনে পায় নি … আমার মোবাইল সুইচড্‌ অফ তাই…
-তো কি বলছে?
-কথা হয়নি।
-হুম সেটা তো দেখলাম কি যেন পরে বলবে বললে। এখন বললে না কেন বিভা?
-ভাল্লাগছে না ।
-তাই নাকি আমি আছি বলে?
বিভা অন্যসময় হলে ভয়ে ভয়ে উত্তর করত, কিন্তু অতীনের মেডিক্যাল রিপোর্ট টা দেখার পর তার মনের মধ্যে যে ঝড় উঠেছে, শুধু সেটাকে দাবিয়ে রাখার চেষ্টায় নিজেকে শান্ত রেখেছে বিভা। তাই হয়ত আগের চেয়ে কিছুটা ঔদাসীন্য দেখিয়ে চুপ করে রইল।
-অতীন আবারও বলল, কি হল উত্তর দিলে না যে?
বিভা স্থির চোখে তাকালো অতীনের দিকে…
বিভার চোখের এই স্থির ভাষাটা অতীনের বড় অচেনা … সে তো এতকাল বিভাকে ভয় পেতেই দেখেছে …আজ হঠাৎ কি এমন হল সে বুঝে উঠতেই পারছিল না… কিছুক্ষন চুপ করে থেকে কফির কাপ দুটো সেন্টার টেবিলে নামিয়ে রেখে বিভার খুব কাছে এসে তাকে এক ঝটকায় সোফা থেকে টেনে তুলে বলল,
– কি এমন কথা বিভা যা আমার সামনে বলতে পারলে না। বল না, কি কথা যা নীলকে বলা যায় আমায় না।
বিভা সোজাসুজি অতীনের চোখে চোখ রেখে বলল ,
– এমন কিছু নয় … তাছাড়া আমার আর নীলের মাঝে তেমন কোন কথা হয়ও না…কিন্তু সত্যি বল , তুমি কি আমায় সব কথা বল? তোমার মেডিক্যাল রিপোর্টটার কথা কি আমাকে বলেছিলে ?
আচমকা এমন একটা প্রশ্নে হতচকিত হয়ে উঠল অতীন , তারপর রাগে অন্ধ হয়ে , বলল,…

-ও বুঝেছি .. তুমি আমার আলমারিতে হাত রেখেই গোয়েন্দাগিরি শুরু করেছ? নিজের দোষ ঢাকতে, এখন নতুন ইস্যু খুঁজছো ঝামেলা করার জন্যে। তা তোমার বারোয়ারি বন্ধুর সাথে দুঃখের কথাগুলো শেয়ার করতে চাইছিলি বুঝি, আমি এসে পড়ায় ব্যাঘাত ঘটল? আমার পিঠ পিছে তোমরা কি কর আমার বুঝতে একটুও বাকি নেই? বিভা তুমি একেবারে যা-তা হয়ে গেছ। তোমার মত মেয়ে আর যাই হোক ঘরের বউ হতে পারে না …
-আচ্ছা তাই বুঝি? আর এটা বলবে না আমার মত মেয়ে , চাইলেও মা হতে পারে না । তার এমন দুর্গতি তার স্বামীর অক্ষমতার দায় তাকে সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হয়।

এই বলে বিভা অতীনের শক্ত করে ধরে রাখা হাতদুটো নিজের হাতে একে একে সরিয়ে দিয়ে বলে,
-অযথা চিৎকার করো না, চিৎকার আমিও করতে পারি …তাতে তোমার মান সম্মান কি খুব বাড়বে ? আর নীলকে নিয়ে তুমি যা ভাবছ সেগুলো সত্যি নয়।ভুল …ভাবনাগুলো তোমার সম্পূর্ণ মনগড়া… আসলে ওটা তোমার কমপ্লেক্স ।

বিভার কথাগুলোয় অতীন যেন একটা চরম ধাক্কা খেল। শীতের শিরশিরে হাওয়াতেও অতীন ঘেমে উঠল, উত্তেজিত হয়ে ভীষণ একটা রাগে বিভার হাত দুটো খামচিয়ে সজোরে তাকে দরজার দিকে ধাক্কা দিয়ে ঠেলে লিভিংরুম ছেড়ে বেরিয়ে গেল । ঠেলা সামলাতে না পেরে বিভা দরজার পাশে আচম্বিতে পড়ে গেল, হয়ত বা চোটও পেল কিন্তু পড়ে গিয়েও সে কেমন একটা স্থবির হয়ে বসে রইল। এতবড় অপমানে তার চোখে এক ফোঁটা জল পর্যন্ত এল না , চুপ করে গুম হয়ে সে বসে থেকে সে ভাবল , অতীনের পৌরুষে সে কি এমন ঘা মারল যে তাকে অমন করে ছুড়ে ফেলে দিয়ে গেল অতীন । অতীনের পুরুষকার এতটাই বড়ো যে তার নারীত্বের কোন মূল্যই রইল না তার কাছে । তবে সত্যি বলতে সে তো নীলের সাথে কিছুই করে নি … শুধু শুধু একটা মিথ্যে সন্দেহের বশে অতীন তাকে যা খুশি বলে গেল। একটা ছেলে আর একটা মেয়ের মাঝে কি উত্তর বৈবাহিক বন্ধুত্ব হতে পারে না? মানবিক সম্পর্ক থাকতে পারে না? … শুধুই শরীরী সম্পর্ক ? মেয়েদের কি মন বলে কিছু থাকতে নেই? তারা কি শুধুই একতাল মাংস? আর সেইজন্যই কি অতীন তার ওপর শুধু স্বামীত্বের অধিকারই দেখালো তার কষ্টটুকু বুঝল না ? বিভার মাথার মধ্যে সব ওলোটপালট হয়ে যাচ্ছিল ……কতক্ষন সে দরজার পাশে ওইভাবে পড়ে ছিল সে নিজেও জানে না, বেশ অনেক্ষন পর যন্ত্র চালিতের মত দরজার পাশ থেকে উঠে নিজের ঘরে গিয়ে দেখল অতীন দরজা বন্ধ করে দিয়েছে… একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে পাশের ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে বিছানায় বসলো । আচমকা ধাক্কায় হাতের বিভিন্ন জায়গায় চোট পেয়েছিল বিভা ,সেই চোটগুলো তে হাত রাখতে রাখতে বিভা ক্রমশ আরো কঠিন হয়ে যেতে লাগল , … এ বিভা যেন অন্য বিভা… ।
সারারাত অতীন আর বিভা দুজনে দু ঘরে রইল… কেউ ঘর ছেড়ে বেরোল না… রাতের খাওয়া হল না। অতীন মাঝরাতে একবার ঘর ছেড়ে লিভিং এ এসে দেখল টিভিটা সাইলেন্ট মোডে চলছে, লাইট জ্বলছে, ফ্ল্যাটের গেট লাগানো নেই।। সেন্টার টেবিলে রাখা কফি জুড়িয়ে জল। অতীন ঘাড় ঘুড়িয়ে দেখল পাশের ঘরের দরজা বন্ধ। এক এক করে আলো নিভিয়ে , টিভি বন্ধ করে, দরজায় তালা দিয়ে, কফির কাপ দুটো কিচেনের সিঙ্কে নামিয়ে রেখে ,পাশের ঘরে দরজার সামনে গিয়ে একবার দাঁড়ালো …তারপর মাথা নামিয়ে ফিরে এল নিজের ঘরে ।
ওদিকে গোটা রাত ধরে বিভা দুচোখের পাতা এক করতে পারল না…সে ভেবে চলল একটাই কথা … সে তো কোনও প্রতারণা করেনি , বদলে অতীন তার অক্ষমতার কথা না জানিয়ে বিভার প্রতি অন্যায় করেছে। তবে কেন এত বড়ো অপমান সে সহ্য করবে? আর সবচেয়ে বড়ো কথা কিছু না করেই যদি এত কথা হয় , তাহলে কিছু করলেই বা ক্ষতি কি ছিল ?

  
This entry is part 7 of 8 in the series এখানেই গল্পের শেষ নয়

পর্ব- ৭

সারা রাত অপমানের জ্বালায় পুড়ে পুড়ে ভোরের দিকে অদ্ভুত এক ক্লান্তিতে ঘুম এসে গেছিল, বিভার। ঘুম যখন ভাঙল … তখন ঘড়ি বলছে প্রায় এগারোটা… বিছানায় উঠে বসলো বিভা । গায়ে হাতে অসহ্য একটা ব্যাথাও টের পেল। বিধ্বস্তভাবে পর্দার ফাঁক দিয়ে বাইরের আকাশটার দিকে চেয়ে রইল, …গত রাতের কথাগুলো মনে হতেই এক অফুরান বিস্বাদে ভরে গেল মনটা … ভাবল ইশশশশ্‌ কেন যে ভাঙল ঘুমটা। ঘুমটা যদি না ভাঙত কত ভালো হত… মুক্তি ই মুক্তি… চরম তৃপ্তি । কিন্তু পরক্ষণেই বিভার মনে হল, এত সহজে সে ছেড়ে দেবে অতীনকে? নাহ কিছুতেই না। অতীন তার ইচ্ছমত যা খুশি তাই করবে বিভার সাথে আর সে মেনে নেবে ? না… যে লুকোচুরি খেলা অতীন শুরু করেছে , সেই খেলার শেষ বিভাই করবে । বিছানা ছেড়ে উঠে ঘরের দরজা খুলে বাইরে গেল বিভা, পাশের ঘরের দরজা খোলা, ঘরটাও মোটামুটি গুছোনো… কিচেন ফাঁকা , লিভিং ফাঁকা … ব্যালকনির দরজা লাগানো … দরজার কাচের মধ্যে দিয়ে যতদূর চোখ গেল, খোলা এক বুক আকাশ যেন উপুর হয়ে আছে বিভার ব্যালকনির ছাদে। বেশ একটা মেঘলা মেঘলা ভাব… শীতের শুরুতে ঠান্ডা ফেলার জন্য একটা নিম্নচাপ হতে পারে, আকাশটা যেন তেমনি নির্দেশ দিচ্ছে , কেমন একটা থমথমে ভাব । লিভিং থেকে ফিরে এসে বিভা দেখল, বাথরুমের দরজা খোলা। নিজের ঘরে এল বিভা… কাল এই খাটটায় অতীন শুয়েছিল একা , তাকে ঢুকতে দেয়নি ঘরের দরজা বন্ধ রেখে। বিভা খাটের কোণায় বসল …উদাস হয়ে চেয়ে রইল খাটের পিছনের দেওয়ালে রাখা একদল ছুটন্ত ঘোড়ার ছবির দিকে, মনে মনে ভাবল, আচ্ছা সে কি এমন অন্যায়টা করেছিল? অতীন কি চাইলে পারত না একবার তার দরজায় এসে দাঁড়াতে ? আজ পর্যন্ত বিভা ঝগড়া কখনো বাসি করে নি, নিজের দোষ না থাকলেও , গোঁ ধরে না থেকে মিটিয়ে নিয়েছে নিজে থেকেই। এই প্রথম সে নিজে থেকে এগোতে পারল না, কিন্তু কই অতীনও তো এগিয়ে আসলো না , কিন্তু সত্যিই কি অতীন নিরপরাধ, তার কি উচিত ছিল না বিভার সাথে খোলাখুলি কথা বলা? … এক মুহূর্ত আরো কি যেন ভাবল বিভা ? তারপর তার মনে হল অতীন গেল কোথায়? তবে কি…চলে গেল …তাকে ফেলে? আচ্ছা অতীনের অফিসের ব্যাগটা কই ? স্টাডি টেবিলে চোখ পড়তেই… বিভা দেখল ব্যাগ নেই …আলমারি খুলে হলুদ ফাইলটাও চোখে পড়ল না বিভার। তারপর মনে হল …ওহো আজ তো অতীনের অফিসে স্মল স্কেল ইন্ডাস্ট্রি গ্লোবালাইজেশানের জন্যে ফরেন ডেলিগেটসদের সেমিনার… আর এই মিটিংএর জন্যই তো কাল বাড়ি বসে সে ফাইনাল রিপোর্ট তৈরি করছিল, সন্ধ্যেবেলা ব্রজেশ্বরদার ফোন এসেছিল… অতএব অতীন অফিসেই গেছে । তাছাড়া ছেলেরা খুব আরাম প্রিয়, তাদের সাজানো বাগান ছেড়ে তারা অন্য বাগানে ঘুরতে যেতে পারে কিন্তু সন্ন্যাস নিয়ে সহজে পাহাড়ে যেতে পারে না। তার জন্য সমস্ত ইন্দ্রিয় সুখ ছাড়তে হয়। অতএব অতীন বাবু আর যাই হোক বিবাগী হতে পারে না… । তবু একবার সুনিশ্চিত করনের জন্য অফিসের নম্বরে ফোন করল বিভা ল্যান্ডলাইন থেকে,
-হ্যালো
-হ্যা-লো, কি চাই?
-আচ্ছা সেলস ডিপার্টমেন্টের অতীনবাবু কি আজ এসেছেন?
-হ্যাঁ , এসেছেন , কিন্তু এখন সিটে নেই … আপনি কে বলছেন ম্যাডাম? হ্যালো হ্যালো …

কিছু না বলেই ফোনটা কেটে দিল, বিভা ।তারপর মনে মনে হাসল …. যা ভেবেছিল , ঠিক তাই। মোল্লার দৌড় ওই মসজিদ পর্যন্তই । নাহ, তাহলে অতো চিন্তার কোনো কারণ নেই, অতীনবাবু এখন অফিসে নিজের ভাবমূর্তি বজায় রেখে হেসে হেসে কাজ করে যাচ্ছে … আগের দিন রাত্রিতে সে যে মিথ্যে সন্দেহে তার বউয়ের গায়ে হাত তুললো, কেউ জানলই না। বিভা মফস্বলের একটা সাধারণ মেয়ে… যার জগতটাও খুব খুব ছোট … তবুও মুখোশের আড়ালে থাকা এই মানুষগুলোকে সে কোনদিনই সহ্য করতে পারত না… আজও পারে না। তাই নরম স্বভাবের মেয়েটা হঠাৎই কেমন প্রতিবাদী হয়ে উঠল নিজের অজান্তেই।

ওদিকে অতীনের মাঝরাতে সেই যে ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছিল, সত্যি বলতে আর সে ভাবে ঘুমটা আসেই নি, একটা অপরাধবোধ তাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছিল। বিভাকে তার বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয়, কিন্তু এক এক সময় নিজের অক্ষমতার কারণে হারিয়ে ফেলার ভয়ও হয়, তখন কেমন একটা অধিকারবোধ, আধিপত্য, প্রকারন্তরে গোঁয়ারতুমি পেয়ে বসে। মনে হয় এই নীল বোধহয় তার এমন সাজানো সংসারটাকে চোখের পলকে ওলোটপালোট করে দিল। রাগ হয়… কিন্তু তারপর ভাবে না বিভা ওরকম নয়… কিন্তু বিভা নীলকে নিয়ে বেশি উৎসাহ দেখালে একটা হিংসেও হয়। … কিন্তু এর মানেটা তো এইটাই যে সে বিভার প্রতি যথেষ্ট সচেতন, সেটা কি ভালোবাসা নয়…!!! কিন্তু বিভা কি তা বোঝে না ..বিভার বাচ্চাদের প্রতি এতো ভালবাসা আর তার নিজের অপারগতা… এই দুয়ের দ্বন্দ্বে সে কিভাবে বিভাকে যে আসল সত্য বলবে বুঝে উঠতে পারছিল না, যার ফলে দিনকে দিন অতীন যেন কেমন অসহায় হয়ে উঠছিল। একটা অদ্ভুত আশঙ্কা নীল কে নিয়ে তার মাথায় চেপে বসছিল , হয়ত অহেতুক কিন্তু ভাবনাটা যে নামছিল না মাথা থেকে।…এইসব নানা কথা ভাবতে ভাবতে তার সারারাত আর ঘুমই হল না, সকাল বেলা উঠে বিভার ঘরের সামনে গিয়ে বিভাকে ডাকতেও কেমন একটা কুন্ঠাবোধ হল তার, শেষ পর্যন্ত বিভা উঠছে না দেখে নিজেই নিজের কাজ গুছিয়ে, স্নান করে কিছু মুখে না দিয়েই অফিসে বেরিয়ে গেল। ভাবল, অফিস ক্যান্টিনে কিছু খেয়ে নেবে ক্ষণ …আর পরে সময়মত বিভাকে ফোন করে নেবে।

একদিনের একটা ঘটনা পরিবারের দুটো মানুষের মধ্যে কতটা দেওয়াল তুলে দিয়েছে এই কথা ভাবতে ভাবতে বেশ কিছুটা সময় আলগোছে বয়ে গেল বিভার । সাতপাঁচ অনেক ভেবেও বিভা কোনো কূলকিনারা পেল না… অগত্যা, সে ওয়াশ রুমে গেল… গিজার অন করল, বেসিনের সামনের আয়নায় চোখ পড়তেই দেখল ঠোঁটের কোনে কালশিটে একটা দাগ। … হাতের দু একটা জায়গাতেও একইরকম দাগ… চোখেমুখে জলের ঝাপটা দিল। কালকে অতীনের খামচে ধরা জায়গাগুলো নখের আঁচড়ে ক্ষতবিক্ষত হয়েছিল , সেখানে জলের ছিটে লাগতেই কেমন একটা চিড়বিড় করে উঠল … হয়ত বা মনটাও জ্বালা করে উঠল।…কিন্তু এত কিছু দেখেও তার একটু কাঁদতে ইচ্ছে করল না…চোখের সব জল কি শুকিয়ে গেল তার? মনে মনে ভাবল বিভা … একটা রাতে সে কি এতটাই বদলে গেল?… কই আজ তো তার অতীনের জন্য একটুও অনুকম্পা হচ্ছে না… তিন বছর যে লোকটার সাথে ঘর করল তার প্রতি এতটুকুও কৃতজ্ঞতা আসছে না বিভার ! বরং নীলের কথা তার মনে পড়ে যাচ্ছে অতীনকে ছাড়িয়ে। সে ভাবতে চেষ্টা করল নীলের জন্য কি অনুভুতি হচ্ছে তার? … এই কথাটা ভাবতেই মনে হল… ‘ ওহো নীলকে একটা ফোন করতে হবে? ‘যাক স্নানটা তো সেরে নি আগে ’…
অনেক্ষন ধরে ঠান্ডাগরম জলে স্নান করল বিভা … স্নান সেরে বাইরে এসে একটা ঘন জাম রঙের তাঁতের শাড়ি পরল … ইচ্ছে করল না কপালে সিঁদুরটা ছোঁয়াতে , ভিজে চুলটা আঁচড়ে, একটু সাজল নিজের জন্যে , …এতকাল তো সে অনেক সেজেছে অতীনের জন্যে ,… আজ মনে হল একটু নিজের জন্য বাঁচতে , কিচেনে এসে এক কাপ কফি বানাল বিভা , তারপর মোবাইলটা খুলে সবার প্রথম নীলকেই ফোনটা করল
-হ্যালো… নীল
-উফফফফ… মেমসাহেব… বলো ফোন করলে তবে?
-হুম…
-বিশ্বাস কর , এই কদিন মনে হয়েছে কি এক নির্বাসন দিয়েছ যেন তুমি আমাকে, বুকের মধ্যে একটা ভারি পাথরের চাপ… এখন তোমার কণ্ঠস্বরে বেশ হাল্কা লাগছে… কি হয়েছিল তোমার। আমায় বলবে না?
-বলব , তাই তো তোমায় ডাকছি নীল… আজ এক্ষুনি আমার বাড়ি আসতে পারবে কি ?
-মজা করছ?
-না সত্যি… পারলে এখনি এসো… অনেক কথা বলার আছে।
-এখনি? কি হয়েছে বল তো? অতীনদা আছে তো ?
-না ও অফিসে। তুমি যদি এখনি আসো… তবে কথা হবে , না হলে, আমাকে আর তুমি ফোন কর না নীল।
-এরকমভাবে বলছ কেন? আচ্ছা তুমিই বলো… অতীনদা নেই আমার যাওয়াটা কি ভালো দেখাবে?
-আমি আজ খুব বেপরোয়া নীল… হয়ত বা মন থেকে স্বৈরিণীও । আসবে তো এস না হলে ফোন রেখে দিচ্ছি।
-কি বাজে বকছ … আচ্ছা দেখছি …
-না দেখছি না…
-আচ্ছা এইভাবে যাওয়া যায় নাকি?
-খুব যায়… চাইলেই যায়। তুমি চাও না তাই বলো।
-না ঠিক তা নয়… আচ্ছা যাচ্ছি… কিন্তু এখন তো পৌনে বারোটা , আমাকে কিন্তু দুটো আড়াইটের মধ্যে ফিরে আসতে হবে …ভালো করে ভেবে দেখ তোমার অসুবিধে হবে না তো?
-না …বললাম তো… তাহলে এস… আমি তোমার অপেক্ষায় রইলাম।
বিভা ফোন কেটে দিল ।
নীল একটু দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে গেল।তারপর ঘড়ি দেখে ভাবল, সময় কম। নিজের কাজগুলো একজন সহকর্মীকে একটু দেখে দিতে বলে, নীল হসপিটাল থেকে বেরিয়ে পড়ল… একটা ট্যাক্সি ধরল… বিভার বাড়ি তার কর্মক্ষেত্র থেকে খুব দূরে নয়…মনে মনে ভাবতে থাকল কি হয়েছে বিভার। এই কদিনে সে যতটা চিনেছে তাকে ,সহজ বলেই তো মনে হয়েছে । সত্যি বলতে তার ইমলির সাথে সম্পর্কটা এখন দুই বাড়ির কথা রাখতে গিয়ে একপ্রকার দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে , কিন্তু মনের খিদেটা সে বিভার সাথে কিছুটা হলেও ভাগ করে নিয়েছিল… কিন্তু আজ এমন কি হল যে বিভা তাকে ডেকে পাঠালও। ভাবল অতীনদাকে কি একবার ফোন করবে? পরক্ষনেই মনে হল, ‘না ,আগে দেখি তো কি হয়েছে, হয়ত দুজনের মধ্যে ঝগড়াঝাটি কিছু হয়ে থাকবে,…তাই হবে… সে যেমন ইমলির জন্য বিভাকে বলে, হয়ত বিভাও তেমনি অতীনদার জন্যে তাকে কিছু বলবে… ঠিক আছে নো প্রবলেম, দেখাই যাক না কি বলে?’

  
This entry is part 8 of 8 in the series এখানেই গল্পের শেষ নয়

This content is password protected. To view it please enter your password below:

  
PAGE TOP
HTML Snippets Powered By : XYZScripts.com
Copy Protected by Chetans WP-Copyprotect.
Skip to toolbar