পাঠ প্রতিক্রিয়া
মনমাঝি
চন্দ্রাবলী দত্তের কলমে...
লেখিকা ঐন্দ্রিলার মনমাঝি উপন্যাসটি পড়া হয়ে গেছে অনেকদিনই। কিন্তু প্রতিক্রিয়া জানানোর সময় পাচ্ছিলাম না। অবশেষে আজ নববর্ষের দিনে মনে হল ভালোলাগাটুকু জানিয়ে কিছু ভালোবাসার সম্ভার তো তার হাতে তুলে দিতেই পারি। প্রথমেই বলি লেখিকার অধরা সুখ ছুঁয়ে দেখার যে প্রচেষ্টা তা বোধহয় অনেকাংশে সার্থক। থুড়ি লেখিকা নয় গল্পকার, কারণ ঐন্দ্রিলা নিজেকে গল্পকার বা কাহিনীকার বলতেই ভালোবাসেন, তাঁর নিজের কথায় তিনি বলেছেন ‘লিখলেই তো আর সবাই লেখক হতে পারেন না,’ আর তাঁর মতে যে ঐন্দ্রিলা লেখে, তার অস্তিত্ব আলাদা। তিনি নাকি শুধুমাত্র চোখের সামনে কিছু ছবি দেখেন আর তার ধারাভাষ্য পাঠ করেন। সত্যি ঐন্দ্রিলা আপনার কল্পনার জগৎকে কুর্ণিশ না জানিয়ে পারছি না। এমন কথা কজন বলতে পারেন আমার সত্যি জানা নেই। যাই হোক এবার আসি গল্পে।গল্পের প্রেক্ষাপট ঝাড়গ্রাম। আমি একসময় বহু বছর ঝাড়গ্রামে ছিলাম, কিন্তু আমার সেই দেখার চোখকেও ঐন্দ্রিলা তার লেখার জাদুবলে কি নিদারুন পরিবর্তন করে দিয়েছেন তা বলে বোঝানোর নয়। এই রগড়া রোড, এই এন.এইচ, এই লোধাসুলি, ভসরা ঘাট সব আমার অতি পরিচিত, তাই শিমুল আর রুবন যখন বাইকে করে রোহিনী যাচ্ছিল, আমার তো মনে হচ্ছিল ওদের সাথে আমিও ওই পথে হাঁটছিলাম। আবার রুবন আর রূপসা যখন চাঁদনি রাতে মাদলের তালে তালে, ঝিঁঝিঁর আওয়াজে তাল গাছের সারির মধ্যে দিয়ে সরকারি গেস্ট হাউসের আশপাশ দিয়ে বেলপাহাড়ীর পথে বিনপুরের দিকে ফিরে আসছিল, সেও যেন স্বপ্নের মত আমার যাত্রাপথ হয়ে উঠছিল। এতো সুন্দর বর্ণনা অথচ এতটুকুও ক্লান্তিকর নয়, এটা লেখনীর গুণ ছাড়া আর কি বলি। লিখলেই যেমন লেখক হয় না, পড়লেও বুঝি সমঝদার পাঠক হয় না, আর সেই দিক থেকে দেখলে আমার কি আর তেমন সমঝদারি আছে? আমি খুব সাধারণ একজন পাঠক, তবু বিষয়গত বা গুনগত নিক্তিতে মেপে না বলতে পারলেও এটুকু একবাক্যে বলতে পারি, আমার মত সাধারণ পাঠকদের কাছে এ গল্পের স্বাদ ভিন্নতর। টান টান এক আকর্ষণ, পড়া শেষ না করে পারা যায় না, একবার গল্প শুরু করলে বই শেষ না করে ওঠা যাবেই না। এক অদম্য আগ্রহ আর অসীম কৌতুহল। আর শিমুল চরিত্রটি তো অসাধারন সৃষ্টি কিন্তু রুবনের জুড়ি মেলা ভার।গল্পকার এখানে একজন নারী হয়েও কি অসীম দক্ষতায় একজন উদাসী পুরুষের দুঃখ, তার খাঁ খাঁ বুকের কথা লিখেছেন তা গল্পটি না পড়লে বোঝানো যায় না। তবু বলি, ঐন্দ্রিলার লেখা বলে দিয়েছে, ঐন্দ্রিলা একজন সাচ্চা মানবতাবাদী। যিনি নারী হয়েও পুরুষের অসহায়তার কথা লিখতে পারেন, তাঁর দেখার চোখ সত্যিই অন্যরকম। প্রতিটি চরিত্র রাঙাপিসি, পিশেমশাই, বাবা, অভ্র, অহনা,রংগন, চিন্তা, চিন্তার মা, ফুলমণি, রান্টা এমনকি পিসির পাখি গুলমোহর সবাই যেন এক পরম স্বকীয়তায় বর্তমান নিজ নিজ বৃত্তে। পরিবেশ প্রকৃতির আরো এক বৈপরীত্য দেখিয়েছেন গোসাবার বাসন্তীতে। বাংলার গ্রাম, নিরক্ষর মানুষজন, তাদের জন্য কিছু করতে চাওয়ার বাসনায় তৈরি তারাবাতি অরগ্যানাইজেশন, একজন শিক্ষিকা হয়েও সমাজের উন্নতির প্রয়াস এসব কিছুর মধ্যে দিয়েই বারে বারে এক সুতীব্র ইচ্ছে এবং সজাগ দৃষ্টি তৈরি করতে চেয়েছেন গ্রামের সাধারন ও পিছিয়ে পড়া মানুষদের প্রতি। তবে মীনচাষ, মধু সংগ্রহ, ভূমি সংরক্ষন, স্কুলের ছেলেমেয়েদের স্বাস্থ্য উন্নয়ন ইত্যাদি বিষয়গুলোর আরো একটু ডিটেইলিং হলেও বোধকরি ক্লান্তিকর লাগত না। কিন্তু সত্যি বলছি ঐন্দ্রিলা আপনার এই ধরনের লেখা আমাদের প্রত্যাশা আরো আরো বাড়িয়ে দিল। ভবিষ্যতে এমন সৃষ্টিমুখর লেখা পাওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করে আবদার জানাই প্রান্তিক মানুষজনদের কথা এমন ভাবেই আপনি আপনার কাহিনী বিন্যাস দিয়ে তুলে ধরুন, আর আমরা সেই লেখা পাঠ করে নতুন ভাবে বাংলার প্রত্যন্ত গ্রামকে চিনে ওঠার সুজোগ পাই। এক পৃথিবী ভালোবাসার সাধ্য নাইবা থাক ইচ্ছে তো থাকতে পারে, আর সেই আশা নিয়েই বলি আপনি আরো আরো লিখুন, আর দুচোখ ভরা স্বপ্ন গড়ে তুলুন আমাদের মত সাধারণ পাঠকদের জীবনে। অনেক অনেক শুভেচ্ছা, অভিনন্দন আর ভালোবাসা জানাই আপনাকে। শুভ নববর্ষ।
**********************************
© Copyright 2019 @indrila, All rights Reserved. Written For: Oimookh