This entry is part 6 of 6 in the series বল মন 'সুখ' বল

পর্ব – ৬। (শেষ পর্ব )

কঙ্কার চলে যাওয়াটাকে অনুসরণ করে মিথিল মনে মনে বলে উঠল… ‘প্লিজ কঙ্কা , প্লিজ আমাকে ভুল বুঝো না। আমি তোমাকে আঘাত না করলে তুমি হয়ত আরও একবার দুর্বল হয়ে যেতে আমার ওপর । কিন্তু সত্যি বলতে, তুমি তো তোমার জায়গায় ঠিকই ছিলে কঙ্কা… আজ এতদিন পরে তোমাকে এত কাছ থেকে দেখে আমি বুঝেছি, সম্পর্ক ভেঙ্গে দিয়েছ কিন্তু আমাকে মন থেকে সরিয়ে রাখতে তুমিও পারোনি.. …চেষ্টা করেছ মাত্র…হয়ত ক্ষত বিক্ষত হয়েছ তুমিও। …সেদিন তোমার কথাগুলো না বুঝলেও তোমার চলে যাবার পর প্রতিটা মুহুর্তে , বিশেষত সৃঞ্জার চাওয়ায় ওকে সঙ্গ দেওয়ার মুহুর্তে আমি বুঝেছি দিনের পর দিন আমি ভেবে বাসবের হাতে নিজেকে ছেড়ে দিতে তোমার কি যন্ত্রণাটাই না হত! আমার সত্যি তোমার প্রতি আর কোনও অভিযোগ নেই কঙ্কা। আমি আজও চাই তোমাকে আমার পাশে পেতে কিন্তু পরিণতি তো সেই একটাই …যন্ত্রণা!!! নতুন করে কিছু যখন দিতে পারব না তোমাকে , কি লাভ তোমার জীবনটাকে আবারো এলোমেলো করে দিয়ে!!!’

…… কঙ্কার বেরিয়ে যাবার পর এসব ভাবত ভাবতে বেশ কিছুক্ষণ ফাঁকা অফিসে চুপ করে বসে রইল মিথিল । তারপর কঙ্কার প্রতি অদ্ভুত এক মমতায় জে .কে.কন্সট্রাকশনের এর ওনারকে ফোন করল মিথিল।
-হ্যালো মিঃ কুমার! একটু কথা ছিল,কনফিডেন্সিয়াল!!! বিজি নাকি?
-না না আমি ফ্রি আছি আপাতত , কি কথা বলুন ।
– আচ্ছা দেখুন তো বাসব সিনহা অ্যান্ড এন্টারপ্রাইজ থেকে যে রেট টা কোট করা হয়েছে সেটা অরিজিনাল থেকে কতটা ডিফার করছে………
-আপনি কি বাসব সিনহা অ্যান্ড এন্টারপ্রাইজকে রেফার করছেন?
-না ঠিক তা নয় , আসলে উনি আমার বিশেষ পরিচিত । যদি রেট টা লোয়েস্ট কোটের কাছাকাছি থাকে তবে কি একবার ডেকে পাঠিয়ে কথা বলে দেখবেন ? …কিন্তু প্লিজ আমার রেফারেন্স দেবেন না যেন ।
-ব্যস ব্যস… মিঃ সেনগুপ্তা আর বলতে হবে না , আমি দেখে নেব । তবে আজ তো আমার অফিস বন্ধ হয়ে গেছে, কালও ছুটি , যদি পসিবেল হয় , তবে কথা বলে কালই আপনাকে কনফার্ম করে দেব । কারন দু তারিখেই তো বেলা দুটোর পর অফিসিয়ালি কোটেশন ডিক্লিয়ার করতে হবে।
-থ্যাঙ্ক ইউ মিঃ কুমার…থ্যাঙ্ক ইউ সো মাচ। আপনি দেখলেই হবে… প্লিজ ডোন্ট টেক ইট আদারওয়াইজ।
– ইটস ওকে মিঃ সেনগুপ্তা…আই উইল ট্রাই মাই লেভেল বেস্ট। তবে আপনি যে মিটিং-এ বলেছিলেন যা হবে সব লিগালি!!!সেটা রাখা গেল নাত শেষ পর্যন্ত ? বাট সাপ্লায়ার ভালো তো?
-হোপ সো…আই অ্যাম রিয়েলি সরি মিঃ কুমার…
– সরি বলার কিছু নেই…ইটস নাথিং বাট অ্যান আন্ডারস্ট্যান্ডিং মিঃ সেনগুপ্তা । তবে মালটা ঠিকঠাক সাপ্লাই করলেই হল ।
– হ্যাঁ …সেটাই …ওকে বাই , রাখছি মিঃ কুমার, আমাকেও বেরোতে হবে, থ্যাঙ্কস আগেইন …এনজয় ইওরসেলফ।
……ফোনটা ছেড়ে দিয়ে চুপ করে বসে রইল মিথিল…মনে মনে ভাবল …যা মন থেকে মানি না তাও তোমার জন্যই করলাম কঙ্কা… এই কম্প্রমাইসটুকু হয়ত পরে ভারি ঠেকবে তবুও করলাম… শুধু তুমি একটু ভালো থেক কঙ্কা আমি আর কিছু চাই না। …নাহ আর বসে থাকলে চলবে না বেশ দেরি হয়ে গেল…এখনি সৃঞ্জা ফোন করবে।’
…গৌরদাকে অফিস বন্ধ করতে বলে বাইরে বেরিয়ে এল মিথিল। কলকাতা আজ সত্যি তিলোত্তমা সাজে সেজে উঠেছে। ইংরেজ দুশো বছর রাজত্ব করে গেছে বলে পুরোনো কলকাতার সাহেবিয়ানার গন্ধটা আজও কেমন যেন অক্ষত রয়ে গেছে। হাঁটতে হাঁটতে ফ্লুরিজের দিকে এগোতে লাগল মিথিল। মামমামের জন্য কেক আর মেয়োনিজ কিনতে হবে, সঙ্গে একটা গিফটও… যেতে যেতে চারপাশের এত ভিড়ের মাঝেও মিথিলের নিজেকে কেমন একা একা লাগছিল, একটা বুক চাপা কষ্ট তার মনের ভেতরটাকে দুমড়ে মুচড়ে পিষে ফেলছিল…ঝাঁ চকচকে শহরের কেতাদুরস্ত এই জীবনটা যেন কেমন দুর্বিষহ হয়ে উঠছিল ক্রমশ । কি করছে , কেন করছে সবই অর্থহীন । মনটা আজ আবার নতুন করে বিষন্ন লাগছিল তার । ইচ্ছে করছিল না রাতের জলসায় যেতে কিন্তু না গেলে সৃঞ্জা অশান্তি করবে…অগত্যা আর উপায় কি ? মনে মনে বলল মিথিল , ‘কেন এলে কঙ্কা ? আবার কেন এলে …আর এলেই যখন , কেন চলে গেলে !!! …হঠাৎ পিটারক্যাটের সামনের রাস্তায় একটা গাড়ির হেডলাইটের আলোয় মিথিলের চোখে পড়ল রাস্তার ফুটপাথের আধো আলো আধো ছায়ায় কতকগুলো রাস্তার কুকুরের সাথে ঠান্ডায় গুটিসুটি মেরে বসে আছে সকালের সেই বাচ্ছা ভিখারি ছেলেটা। গায়ে একটা ছোটো ছেঁড়া সোয়েটার আর নোংরা হাফ প্যান্ট । কি মনে হল মিথিলের , ছেলেটার দিকে এগিয়ে গেল সে । কাছে গিয়ে জিগ্যেস করল ,
-কিরে সকালে খুব লেগেছিল না ?
-না সাহিব, লাগে নি আমার।
-ঠিক তো ?
-হাঁ সাহিব।
মিথিল বলল ‘কি নাম তোর ? তোর সাথে কেউ থাকে না?’
-ছোটু নাম আছে সাহিব। আমার সাথে আরও কয়েকটা ছেলে থাকে , এখন ওরা হোটেলের বাসন সাফা করছে, আমি তো পারবনা তাই…
তাকিয়ে দেখল মিথিল ছেলেটার পা দুটো অকেজো …কিন্তু মুখটা কেমন মায়াবি…একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, পকেট থেকে একটা পাঁচশ টাকার নোট বার করে একটু ইতস্তত করে ছেলেটার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে মিথিল বলল,
– এই নে ধর । এটা তোর।
–এত্তো টাকা সাহিব!
-হুম …যা খুশি , কিনে খাস।
অপটু ইংরেজি শব্দে সে মিথিলকে একটা সেলাম ঠুকে বলল,
-থ্যাঙ্কু সাহিব।
ছেলেটার ফাঁকা মাথায় হাত দিয়ে মিথিল কিছু ভাবল, তারপর নিজের গলা থেকে কঙ্কার দেওয়া মাফলারটা সযত্নে খুলে ছেলেটার মাথায় জড়িয়ে দিল । খুশিতে উচ্ছ্বল হয়ে ছেলেটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে থাকল মাফলারটা । ছেলেটাকে খুশি দেখে মিথিলের মনে হল তার টাকাটার চেয়েও এই মাফলারটা বোধহয় তাকে বেশি সুখী করে তুলল…। এক্টা অদ্ভুত ভালোলাগায় চোখটা জলে চিকচিক করে উঠল মিথিলের । ততক্ষনে পকেটে ফোনটা ভাইব্রেট করছে । পকেট থেকে মোবাইলটা বার করে ফোনটা ধরল মিথিল । সৃঞ্জার ফোন…..,
-হ্যালো, কোথায়? আমি কখন থেকে রেডি হয়ে আছি, মিটিং হল তোমার?
-হ্যাঁ আমি বেরিয়ে পড়েছি , ফ্লুরিজে যাচ্ছি মামমামের জন্য কেক নিতে …তুমি ওখানেই চলে এস।
…মিথিল ফোনটা পকেটে রেখে ছেলেটার দিকে তাকাতেই সে খুশি খুশি বলে উঠল,
-গুড বাই সাহিব। হ্যাপ্পি নিউ ইয়ের …।
মিথিল বাচ্ছাটার দিকে তাকিয়ে একটু হেসে আলগোছে বলল , ‘হ্যাপি নিউ ইয়ার…ছোটু’ তারপর সামনের রাস্তা পেরিয়ে ফ্লুরিজের দিকে এগিয়ে চলল আর মনে মনে ভাবল ‘এরা কি অল্পেতেই সুখী … আসলে সুখ জিনিসটা বড় গোলমেলে’ …কিন্তু সুখ কাকে বলে ? সুখের পরিভাষাটা কি? সুখের অনুভুতিটা কেন এমন তরল? কেন এমন অস্থায়ী? তা খুঁজতে খুঁজতে মিথিল তার গন্তব্যের খুব কাছে পৌঁছে গেল …তবু কিন্তু তার প্রশ্নের কোনও সদুত্তর পেল না মিথিল… সুখ যেন মরীচিকা!!! কেমন যেন হেঁয়ালির মতই মনে হল সব …শুধু মনের কোণে অজান্তেই একটা গানের দুটো কলি বেজে ঊঠল,
‘ বল মন সুখ বল , বলে চল অবিরল , তোর সুখ নামে যদি সুখ আসে জীবনে
বল মন বলে চল, না ভেবেই ফলাফল, যদি তোর ডাকে বসন্ত আসে শ্রাবনে’।
____________________________________________________শেষ

  
This entry is part 5 of 6 in the series বল মন 'সুখ' বল
পর্ব – ৫।

অফিস থেকে বেরিয়ে এল কঙ্কা। বছরের শেষদিন । ডিসেম্বর মাস। কড়া ঠান্ডা। আলোকিত পথঘাট , হোটেল , রেস্তরাঁ গাছপালা সব কিছু ঝলমল করছে নতুন বছরের অপেক্ষায়। চারিদিকে বেশ মানুষের ঢল , জনজোয়ার বইতে শুরু করেছে কলকাতার আনাচে-কানাচে…পার্ক স্ট্রীটের অলি গলি পাকস্থলিতে । সবাই কত কত খুশি। কিন্তু কঙ্কার মনটা অস্থির লাগছে , কিছুটা এই বিসদৃশ ঘটনার জন্য কিছুটা বা মিথিলের জন্য। কঙ্কা জানে মিথিল এমন নয়… আর আজকের এই কথার তেমন তাৎপর্যও নেই… হয়ত মিথিলের কিছুই করার নেই , তাই নিজের অপারগতা ঢাকতেই এমন অভিনয় করল সে। কঙ্কার বাসবকে চিনতে ভুল হলেও মিথিলকে চিনতে তার এতটুকুও ভুল হয় নি। কিন্তু বাসবকে সে কি বলবে ? এই ভাবনা ভাবতে ভাবতেই কঙ্কার ফোন বেজে উঠল… ‘আলো আলো রঙ, জমকালো চাঁদ ধুয়ে যায়/ চেনা শোনা মুখ, জানা শোনা হাত ছুঁয়ে যায়, ধীরে ধীরে ঘুম ঘিরে ঘিরে গান রেখে যায়/ কিছু মিছু রাত পিছু পিছু টান ডেকে যায়’ …..বাসবের ফোন। …স্ক্রীনের দিকে তাকিয়ে প্রবল অনীহায় ফোনটা ধরতে বাধ্য হল কঙ্কা। বাসবকে এড়িয়ে তো যাওয়া যাবে না, পেরিয়ে যেতে হবে কিম্বা বলা ভালো মাড়িয়েই যেতে হবে।
-হ্যালো
-কি কথা হল তোমার বুড়ো বয়ফ্রেন্ডের সাথে?
-ওভাবে বলছো কেন?
-আচ্ছা, বুড়ো বললাম বলে বুঝি রাগ হল?
-নাহ , বয়ফ্রেন্ড বলছ বলে গায়ে লাগছে।
– সরি সরি…এক্স বয়ফ্রেন্ড…এবার ঠিক আছে তো।
-চুপ কর ভালো লাগছে না আমার।
-কেন পুরোনো প্রেম উথলে উঠেছে বুঝি। কি মুখে উত্তর নেই কেন?
-ভাল্লাগছে না কথা বলতে।
-তা লাগবে কেন? আমি যে বর তা ওই বর্বরটা কি বলল। আমার ব্যাপারটা একটু সেট করে দেবে কি? তোমার সাথে এতো যে সময় কাটালো তা কি এমনি এমনি? ইন্টারেস্ট দিতে হবে তো!
-কিসের ইন্টারেস্ট? কি সব বলছ?
-ও তুমি বুঝবে না …ছাড়ো। তা বলছেটা কি শুনি ? তুমি আদৌ বলেছ নাকি শুধু নাকে কেঁদে এলে?
– বাজে কথা কেন বলছ ? বলেছিলাম … কিন্তু দেরি হয়ে গেছে…আগে হলে হয়ত হত কিন্তু এখন আর সম্ভব নয়। ফাইনাল লিস্টিং হয়ে গেছে।
-আচ্ছা তাই নাকি …তা বলতে পারতে তোমার প্রানসখাকে এটা সেটিং করে দিলে আমি না হয় অ্যালাও করতাম কদিনের জন্য কলকাতার বাইরে কোনো রিসোর্টে ।
-প্লিজ বাসব স্টপ দিস ননসেন্স । তোমার কার্যোদ্ধারের জন্য তুমি কতটা নিচে নামতে পারো তা আমার অজানা নয়।
-আহা চটছ কেন ? নীচে তো তোমরা নিজেরাই নেমেছ সবার আড়ালে , আমি তো সেই আড়াল তুলে দিয়েছি……তবে আড়ালে আবডালে থাকা কেন? তার চাইতে খুললাম খুল্লাই তো ভালো। তাই না…আমারও কাজ হত তোমারও সুখ হত ।
-সুখ?? সুখ কাকে বলে তুমি জানো নাকি বাসব ? যবে থেকে তোমার হাত ধরে পথে নেমেছি সুখের ঠিকানা আমি পথেই হারিয়েছি। …আর সুখ খুঁজিনা আমি তোমার মাঝে , বুঝেছ। সুখ দিতে হবে না আমায় পারলে একটু শান্তি দাও ।
প্রচন্ড একটা ঘৃণায় ফোনটা কেটে দিল কঙ্কা। একটা ট্যাক্সি আসছিল সামনে …হাত দেখিয়ে তাতে উঠে পড়ল । চোখটা কেমন জ্বালা জ্বালা করছে …কঙ্কার মন বলছে যেদিকে দুচোখ যায় চলে যাবে …কিন্তু বুবুন ? তার কি হবে ? …ছেলেটা যে এখনও ছোটো। গায়ের চাদরটা মুখের কাছে টেনে কান্না চাপতে চাপতে ,মিথিলকে বলতে না পারা কথাগুলো কঙকা নিজের মনেই আওড়ে গেলো , ‘ মিথিলদা, সত্যি আমার কিছুই চাওয়ার ছিল না তোমার কাছে । আমি জানি, তুমি আমায় আজও ভালোবাসো …আর বাসো বলেই বোধহয় আজ তুমি আমায় এমন কঠিন কথায় ফিরিয়ে দিলে …আমি জানি, তুমি আমার থেকে সরে থাকতে চাও নি , কিন্তু বাসব যে আমাকে দিনের পর দিন ইচ্ছে করে তোমার দিকে ঠেলে দিচ্ছিল কিছু সুবিধে পাবার লোভে,আর এটা জানতে পারার পরই আমি সরে যেতে চেয়েছি তোমার জীবন থেকে। তার জন্য আমাকে অনেক কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে মিথিলদা … ।তবু বাসবের অভিসন্ধি আমি কিছুতেই সত্যি হয়ে উঠতে দিই নি ,আর দেবও না। …বারে বারে মনে হয়েছে তোমার কাছে ছুটে যাই …, খোলা হাওয়ায় বুক ভরে শ্বাস নিই কিন্তু পরক্ষনেই মনে হয়েছে এর সুযোগ বাসব নেবে। নাহ কিছুতেই না …তোমার থেকে দূরে থাকতে হবে আমাকে । নিজের সাজানো পরিকল্পনা ভেস্তে যেতে দেখে রাগে অন্ধ হয়ে গেছে বাসব । তোমার ক্ষতি করার ভয় দেখিয়েছে…তোমার অফিসে পরিবারে বদনাম করার হুমকি দিয়েছে । ভেবেছিলাম , জানো তোমাকে সব বলব , কিন্তু যেদিন তুমি অভিমান করে আমার ফোন ধরবে না বলেছিলে, সেদিন ভেবেছিলাম এই বেশ হয়েছে …ধীরে ধীরে আমি তোমার চোখের আড়াল হতে হতে তোমার মনের আড়ালও হয়ে যাব ।শুধু একটাই কষ্ট মনের মধ্যে তোলপার করত…তুমি ভুল বুঝলে আমাকে। …… তাই বিশ্বাস করো একবার শুধু তোমার সাথে দেখা করে সব জানাব বলেই , বাসবকে মিথ্যে বলে কাজের অছিলায় তোমার দ্বারস্থ হয়েছিলাম। কিন্তু এসে মনে হল …কি আর বলব তোমায়? … তোমার ওই চোখ, তোমার ওই না বলা কথা , কফি কাপ হাত তুলে দেওয়ার অজুহাতে আঙ্গুলে আঙ্গুল ছোঁয়ানো, আপাত গাম্ভীর্যয় মনে হল আবার বুঝি তোমাকে দুর্বল করে ফেললাম !!! সত্যি কথাগুলো সব বললে , হয়ত আবার তোমাকে ঘেঁটে ফেলব…!!! অগত্যা প্রসঙ্গটা বদলাতে বাসবের কথা তুললাম, ভাবলাম বলেই ফেলি বাসবের কথা তোমাকে , সত্যি যদি বাসবের কাজটা তুমি করে দিতে পার…যদি ব্যাবসাটা একটু ঠিক হয়,তাহলে বাসবের অমানবিকতাটা কিছুটা কমলে হয়ত দুর্বিষহ জীবনটা একটু একটু করে নতুন বছরে আলোর মুখ দেখবে নয়ত নিজেকে তোমার চোখে খারাপ করে সারাজীবনের মত অন্ধকারে মুখ লুকিয়ে রাখব । নাহ আর তোমায় আমি কোনোভাবেই বিরক্ত করব না মিথিলদা , আজ থেকে আমি তোমায় আমায় ভালোবাসার সমস্ত দায় থেকে মুক্তি দিলাম…’।
মোবাইলে বাসবের ফোন নম্বরের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে থাকতে জলে ঝাপসা হয়ে উঠল তার চোখ দুটো। অবশেষে কঙ্কা মোবাইলের কন্ট্যাক্টসে গিয়ে মিথিলের ফোন নম্বরটা ডিলিট করে দিল তার ফোন থেকে । যেন চিরকালের মত সমস্ত পিছুটানকে অস্বীকার করে কঙ্কা তার অতীতের পাতা উলটে ফেলতে চাইল বর্ষশেষের শেষবেলায়। যেন তার আগামী জীবনের সমস্ত টানাপোড়েনে মিথিলের স্মৃতির বোঝাকে সমাধিস্থ করে ফেলতে চাইল । কিন্তু চাইলেই কি সব পারা যায়???? …অগত্যা পড়ে রইল শুধু একরাশ আত্মখননের দীর্ঘশ্বাস আর তার নতুন বছরের নতুন যুদ্ধ শুরুর ভাবনা। …আর এইভাবনার দীর্ঘসূত্রতা কে সঙ্গে করেই কঙ্কার গাড়ি এগিয়ে চলল কলকাতা শহরের মধ্যে দিয়ে তার নিজের বৃত্তের কেন্দ্রবিন্দুর দিকে, আলো আলো রাত আর জমকালো চাঁদকে পিছনে ফেলে ।

__________________________________________ক্রমশ

 

  
This entry is part 4 of 6 in the series বল মন 'সুখ' বল

পর্ব – ৪।

অফিসের পরিবেশটা আজ একটু হালকা হালকাই…তবুও নিউ প্রোজেক্টের এস্টিমেটটা দেখা বাকি আছে , বেলেঘাটার সাইটের ওয়ার্কিং ড্রয়িং-এর কপি, ইন্সপেকশন রিপোর্ট , ক্লায়েন্টের সাথে মিটিং সামলে লাঞ্চে গৌরদাকে দিয়ে কিছু ক্যাথলিন কেক আর চিকেন স্যান্ডুইচ আনতে দিল মিথিল সবার জন্য। তারপর কফি , কেক , স্যান্ডউইচ খেয়ে জে .কে. কন্সট্রাকশনের অফিসে বেরিয়ে গেল । যাবার আগে মিথিল কতকগুলো অ্যামোনিয়া প্রিন্ট রেডি করতে দিয়ে গেল তার পি. এ. বিপুলকে । কাল ছুটি , তাই আজই কাজটা করে রাখতে হবে । বিপুল গৌরদাকে সব বুঝিয়ে দিল।
…গৌরদা সেই প্রিন্টগুলো রেডি করে নিয়ে রিশেপ্সনে এসে দাঁড়াতেই , চোখে পড়ল কঙ্কনাকে। কঙ্কনা আগেও যেহেতু এসেছে এই অফিসে তাই গৌরদা ভালোই চিনত তাকে … বলল ‘কি ম্যাডাম , কেমন আছেন?’
– আরে গৌরদা যে, সব ভালো তো ? অফিস কেমন চলছে ?
– আমি ভালো আছি আর অফিসও ভালো চলছে , তবে আপনার কি আজ আসার কথা ছিল।
– হ্যাঁ । মিথিলদা আছেন ?
– না বেরিয়েছেন …একটু অপেক্ষা করুন এসে যাবেন।
-ঠিক আছে , আমি বসছি ভিসিটিং-এ।
… বসে থাকতে থাকতে কত পুরোনো কথা কঙ্কার মনে পড়ছিল। সত্যি বলতে তার সারাদিনে বহুবার বহুকাজের মধ্যে এমনি মনে পড়ে যায় পুরোনো সেইদিনগুলো , মনে পড়ে যায় মিথিলকে। ইচ্ছে করে মিথিলকে দেখতে। ফোনে কথা শুনতে। রাতে ঘুমের ঘোরে মিথিলকে স্বপ্ন দেখে চোখের পাতা জলে ভারী হয়ে যায় কঙ্কার। স্মৃতি তো সততই সুখের ,তাই কখনও কখনও নিজের মনেই পুরোনো কথায় হেসে ওঠে কঙ্কা , কিন্তু তারপর বাস্তবের একাকিত্বে বড়ো ফাঁকা ফাঁকা লাগে, মনটা কেমন যেন অসাঢ় হয়ে থাকে , কোনও কিছুতেই সায় দেয় না…… তার ওপর মাঝ রাতে বাসবের জোড়াজোড়িতে তার দম বন্ধ হয়ে আসে , ইচ্ছে করে মিথিলের কাছে ছুটে যায় কিন্তু…
…ভাবতে ভাবতে প্রায় পৌনে সাতটা বেজে যায়। হঠাৎ কাচের দরজা ঠেলে ঝড়ের গতিতে অফিসে ফিরে আসে মিথিল। কঙ্কাকে চোখে পড়তে হাঁটার গতি একটুও শ্লথ না করে চোখের ইশারায় কঙ্কাকে ভেতরে আসতে বলে। নিজের কেবিনের দরজা খুলে ভেতরে চলে যায় মিথিল । এক মুহুর্তের জন্য কেমন একটা জড়তায় কঙ্কা যেন স্থির হয়ে যায়… মিথিলের আসাটা এক ঝলক মনে পড়তেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে মিথিলের গলায় তার দেওয়া মাফলারটা। মনে মনে ভিজে যায় কঙ্কা। কিন্তু নাহ, তার তো দুর্বল হলে চলবে না …। সত্যি তো এইরকম সম্পর্কের কোনও পরিণতিই হয় না , তো কি লাভ আছে দুটো মানুষের মিথ্যে চাওয়ায় দুটো পরিবারকে সংকটের মুখে ফেলার!… তার চেয়ে এই ভালো…যে যার নিজের বৃত্তেই আবদ্ধ থাক। একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে কঙ্কা এগিয়ে গেল কেবিনের দিকে, তারপর দরজা খুলে ভিতরে গেল। কেবিনের দরজায় কঙ্কাকে দেখে মিথিল শান্ত স্বরে বলল ,
-ভেতরে এস কঙ্কা।
…তারপর বেল দিয়ে গৌরদাকে ডেকে দুকাপ কফি দিতে বলল মিথিল। কঙ্কা বসল মিথিলের একেবারে সোজাসুজি। মিথিল চোখ থকে চশমা খুলে এক গ্লাস জল খেয়ে মাথার পিছনে হাত রেখে চেয়ারটা একটু হেলিয়ে একদৃষ্টে তাকিয়ে দেখল কঙ্কাকে। আগের চেয়ে কঙ্কা যেন একটু ম্লান , একটু স্থুল , একটু আটপৌরে । কঙ্কাও অবশ্য এতক্ষন নীরবে তাকিয়েছিল মিথিলের দিকে, আর মনে মনে মেলাচ্ছিল মিথিলকে, নাহ্‌ কোনও পরিবর্তন হয়নি মিথিলের শুধু মাথার চুলে ঈষৎ পাক ধরেছে আর চশমার ফ্রেমটা চেঞ্জ হয়েছে । কঙ্কাকে চুপ থাকতে দেখে মিথিল নিজে থেকেই বলে ,

– কি ভালো আছো তো?
– হুম আমি ঠিক আছি । তুমি?
… একটু অর্থপূর্ণ হাসল মিথিল। … মনে মনে বলল ‘আজও কি আমায় ভাবো কঙ্কা?’
কঙ্কাও যেন মনে মনে উত্তর করল ‘ ভাবি গো ভাবি আজও তোমার কথা ভাবি আমি। কিন্তু আমার হাত পা যে বাঁধা মিথিলদা এটুকু কি তুমি বোঝো!’
কফি এল… কঙ্কা একটু চুপ থেকে ,বলল
-আমার ওপর খুব বিরক্ত হয়েছ তাই না?
-নাহ!
-সত্যি বলছ?
– জানি না…মানে ভাবি নি। কি বলবে বলছিলে?
একটু সময় নিল কঙ্কা। আনত মুখ , টেবিলের কাচে নখ দিয়ে আঁচড় কাটা, দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ানো , বুকের কাছে আঁচলের আড়ালে শ্বাস-প্রশ্বাসের ওঠাপড়া … কঙ্কার এই স্বভাবগুলো মিথিলের খুব চেনা। তার খুব ইচ্ছে করছিল সবার অলক্ষ্যে কঙ্কাকে জড়িয়ে একটা দীর্ঘ চুমু দিতে। কিন্তু সব ইচ্ছে কি সব সময় পূরণ হয়! মিথিলের ঠোঁটটা শুকিয়ে আসছিল, নাহ্‌ একটা সিগারেট ধরাতে হবে। মাথার চুলগুলো হাতে করে ঝাঁকিয়ে আপাত গম্ভীর স্বরে বলল,
-আমি আজ একটু তাড়াতাড়ি বেড়িয়ে যাব কঙ্কা। কি বলবে বল।
মিথিলের এই আপাত রাগটাও আবার কঙ্কা খুব ভালো চেনে। সে জানে এমন রাগের সময় মিথিলের খুব কাছে গিয়ে মিথিলের হাত দুটো ধরলেই তাকে উস্কে দেওয়া যায়। কিন্তু দুজনে দুজনকে এত ভালোভাবে জানার পরও কে যেন এক অদৃশ্য পাঁচিল তুলে দিয়েছে তাদের মাঝে…তাদের মাঝের সেতু আর খেয়া দুইই গেছে আজ হারিয়ে , এখন দুজন যেন নদীর দুই কুলে দাঁড়িয়ে একে অপরের দিকে দীর্ঘ শ্বাস টুকুই ছুঁড়ে দিতে পারে। অবশেষে মিথিলের দিকে সোজাসুজি চোখ রেখে কঙ্কা বলল,
– যাক, তবে কাজের কথায় আসি… মিথিলদা বাসব জে .কে.কন্সট্রাকশনের টেন্ডার কোট করেছে। ফাইনাল লিস্টিং-এর আগে তুমি যদি একটু সুপারিশ করতে, তাহলে বাসব কাজটা পেতে পারে । ওকে একটা সুযোগ করে দেবে , কাজটা পেলে ওর একটা হিল্লে হয়ে যেত। বেশ কয়েক বছর ধরে ওর ব্যাবসাটা মার খাচ্ছে ।
মিথিল যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিল না। তবুও ঘোরটা কাটিয়ে বলল,
– তুমি কি এইজন্যই আমার সাথে দেখা করতে এসছিলে? আমি তো ভাবলাম তোমার আমাকে আরো কিছু বলার আছে।
কঙ্কা চুপ করে গেল , তারপর বলল,
– নিজেদের কত রকম সুবিধে অসুবিধের কথা আগে আমরা দুজনে দুজনকে বলেছি তো মিথিলদা , আজ কি আমি এতটাই পর হয়ে গেছি যে …
কথাটা শেষ করতে পারল না কঙ্কা …গলাটা কান্নায় বুজে এল।
-এটা তুমি বলছ কঙ্কা? আমি তো সরে আসতে চাইনি তোমার কাছ থেকে? তুমি সরিয়ে দিয়েছ নিজের ঔদ্ধত্যে । দিনের পর দিন তোমাকে ফোন করেছি, মেসেজ পাঠিয়েছি, তুমি কোনো জবাব দাও নি। এরপরও তোমার মনে হয় আমি তোমার জন্য এসব করব ? কেন করব ? কি পাব আমি? একটা সময় তোমাকে আমি ধরে রাখতে চেয়েছিলাম এটা সত্যি কিন্তু আজ আমার কোনো আগ্রহই নেই তোমার ব্যাপারে । তাহলে কেন করতে যাব আমি এসব?
-আমি জানি মিথিলদা, চাইলে তুমি করতে পারো । কিন্তু করবে কেন? ইটস্‌ আ মিলিয়ন ডলার কোয়েশ্চেন! আসলে জানো সম্পর্কটা যে জায়গায় থেমে গেছে এর চেয়ে আর এগোনোর ছিল না বলেই বোধহয় সুতোটা কেটে গেছিল। কিন্তু আমি সত্যি ভাবিনি তুমি আজ এতো হিসেব কষবে ।আজ বুঝছি জীবনে তো কত ভুলি করেছি এটাও একরকমের ভুলই । এর চেয়ে ভালো ছিল তুমি যদি বলতে এই কাজটার বিনিময়ে তুমি আমাকে আগের মতই কাছে ধরে রাখতে চাও। তবু বুঝতাম আজও আমার প্রতি তোমার কিছু ভালোলাগা আছে। কিন্তু আজ তো তোমার কোনো চাওয়াই নেই আমার কাছে …তাই কেনই বা ভাববে তুমি আমার কথা? ঠিক বলেছ তুমি …..একেবারে ঠিক!!!
মিনিট খানেক চুপ করে থেকে কঙ্কা সিট ছেড়ে উঠে পড়ল । তারপর নিঃশব্দে এগিয়ে গেল সামনের দিকে ।পিছনে ফিরে মিথিলকে দেখার ইচ্ছেটা শেষবারের মত সংবরণ করল।

_____________________________________ক্রমশ

  
This entry is part 3 of 6 in the series বল মন 'সুখ' বল

পর্ব – ৩।

…সারা কলকাতা শহরটাই কদিন ধরে কেমন যেন উৎসবের আমেজে মেতে আছে। সেই বড়দিনের সময় থেকেই রাস্তা ঘাটে দোকানে বাজারে আলোর রোশনাই …তার সাথে যোগ হয়েছে ল্যান্টারন্‌স , বেল্‌স , স্ট্রীমার্‌স,স্টার্‌স… আরো কত কি? গাড়ি নিয়ে বালিগঞ্জ থেকে পার্ক স্ট্রিট আসতে আসতে পুরোনো কথাগুলো আবার মিথিলকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যেতে লাগল। সত্যি বলতে মিথিল কিন্তু কঙ্কাকে কম ভালোবাসে নি । তবে মিথিল আর কঙ্কার সম্পর্কটা কোনও পূর্ব নির্ধারিত বা সুপরিকল্পিত সম্পর্ক ছিল না… এটা একটা দুর্ঘটনা কিম্বা বলা ভালো ভাগ্যের খেলা। বন্ধুমহলে যদিও মিথিল আর সৃঞ্জা ভীষণ আইডিয়াল কাপ্‌লই ছিল, তবুও যেন সৃঞ্জার বাবা মায়ের সমস্ত বিষয়ে মতামত জ্ঞাপন আর সৃঞ্জার মন-মর্জীর তোয়াক্কা করতে করতে মন থেকে কেমন যন্ত্র হয়ে উঠছিল মিথিল…একটা অদ্ভুত শূন্যতা তৈরি হচ্ছিল তার মনের মধ্যে দিনে দিনে …যার কারনটা মিথিল চেষ্টা করেও ঠিক খুঁজে পায় না। এমনি এক সময় মিথিলের নতুন অফিসের ট্যাক্স কনসালটেন্ট বরুন মিত্রের কাছ থেকে অডিটর হয়ে মিথিলের অফিসে আসে কঙ্কনা সিন্‌হা। তার দায়িত্ববোধ, ধৈর্য , যত্ন ও রুচিশীল ব্যবহারে ধীরে ধীরে একটু একটু করে মিথিলের মনের ফাঁকটা তার অজান্তেই কেমনভাবে যেন ভরে উঠছিল। সেই ভালোলাগার পরিভাষাটা দিনে দিনে বদলাতে লাগল কঙ্কানার জীবনে বাসবের দুর্বিষহ অত্যাচারের কারনে। বাসবের কন্ট্রাক্টরী ব্যবসার ঘাটা আর মাঝে মাঝে সাইকোপ্যাথের মত ভয়াবহ আচরণ দিনে দিনে কঙ্কনাকেও যেন মিথিলের দিকে এগিয়ে আনছিল…যার সর্বশেষ পরিনতি হল… কঙ্কনা ধীরে ধীরে মিথিলের কাছে কঙ্কা হয়ে উঠল আর দুজনের মাঝের অফিসিয়াল রিলেশনটা মুখ মুখোশের আড়ালে আনফিসিয়ালি মন ছেড়ে শরীরে এসে দানা বাঁধল। আর মানুষের মন তো পদ্ম পাতায় জল… যে সময় একটু একটু করে মিথিলের মন সৃঞ্জার থেকে কঙ্কার দিকে সরে যাচ্ছিল, সেই সময় মিথিল নিজের মনের সাথে লুকোচুরি খেলতে খেলতে একটাই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বেরাচ্ছিল …একসাথে কি দুজনকে ভালোবাসা যায় না ??? কঙ্কার কারণে সে তো আর সৃঞ্জাকে অবহেলা করছে না ! কই তার তো আগের মত নিজেকে আর ফাঁকা লাগে না, বেশ তো সৃঞ্জা আর কঙ্কাতে মনটা ভরেই রয়েছে তার …। কাজে কত মনযোগ দিতে পারছে ! তাছাড়া কঙ্কা অত ডিমান্ডিং ছিল না, আর সেও মিথিলের মধ্যে একটা পরম নিশ্চিন্ত আশ্রয় পেয়েছিল। ফলত দুজনার সম্পর্কের মাঝে খেয়া আর সেতু দুটোই গড়ে উঠেছিল ভাগ্যের নিপুণ চালে।মিথিলের মনে হয়েছিল, যে সম্পর্ক একে অন্যকে সমৃদ্ধ করছে সে সম্পর্ক খারাপ কেন হবে ? সৃঞ্জা যেমন তার নিজের স্পেস খুঁজে নিয়েছে তার বাবা মা ভাই বোন বন্ধু বান্ধবের মাঝে, ঠিক তেমনই মিথিলও স্পেস খুঁজেছে কঙ্কার মাঝে। এর মাঝে দোষের কি আছে? শুধু বিবেকের দংশন বলতে একটু সত্যগোপন অর্থাৎ লুকোচুরি…এটুকু মানিয়ে নিতেই হয়। … সত্যিই তো সারাজীবনে সব কথা কি সবাইকে বলার ? বলা যায় নাকি বলাটা উচিৎ। আর তাছাড়া সত্যগোপন আর মিথ্যাচার তো এক নয়?… এইভাবে বেশ কাটছিল দুজনের , দুজনের মাঝে এত সুন্দর বোঝাপড়ায় কোনো সমস্যাও ছিল না। আর মিথিল দিব্যি শ্যাম কূল বজায় রেখে জীবনটা উপভোগ করছিল। কিন্তু কোথা থেকে কি যে হল তাদের পাক্কা দু বছরের মধুর সম্পর্কটা কেমন যেন পান্‌সে হয়ে উঠতে লাগলো । ধীরে ধীরে কঙ্কা যেন কেমন বদলে যেতে লাগলো । যে ব্যালান্সটা মিথিল পাক্কা খেলোয়ারের মত করতে সক্ষম হচ্ছিল…কঙ্কা কিন্তু সত্যিই পারছিল না। তার পরিবারে মিথিলকে নিয়ে যতটা জল ঘোলা হয়েছিল তার থেকেও বেশি সে আত্মদহনে পুড়ছিল । মিথিলকে বোঝানোর চেষ্টা করলেও, মিথিল কিছুতেই বুঝতে চাইছিল না । আর খুব সত্যি বলতে ,জোর করে আর যাই হোক ভালোবাসা হয় না। তাই মিথিলের চাপাচাপিতে কঙ্কা ধীরে ধীরে শরীরে মনে স্থবির হয়ে যাচ্ছিল। এক অদ্ভুত মানসিক যন্ত্রনা হাত থেকে মুক্তি পেতে সে এড়িয়ে চলতে চাইছিল মিথিলকে। কিন্তু সে কথা মিথিলের উপলব্ধির বাইরে ছিল বোধহয় ।

……দিনের পর দিন বিভিন্ন অছিলায় কঙ্কা সরে থাকতে থাকতে শেষ পর্যন্ত একদিন মিথিলের সাথে টানাপড়েনটায় ইতি টেনেই দিয়েছিল। মিথিলের আজও বেশ মনে আছে কঙ্কার সাথে তার শেষ কথোপকথনটা । কঙ্কার মুখে তখন কেবলি একটাই কথা…
– মিথিলদা , আমার ভীষণ ক্লান্ত লাগছে ।
-কিসের ক্লান্তি কঙ্কা?
– একদিকে তুমি আর অন্যদিকে বাসব …আমি যেন ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছি। আমি অভিনয় করতে করতে হাঁফিয়ে উঠছি মিথিলদা …কোনটা আসল আর কোনটা অভিনয় আমার গুলিয়ে যাচ্ছে।
-অভিনয় বলছ কেন?
– অভিনয় নয়? বাসবের সাথে কি আমি মিথ্যে ভালোবাসার অভিনয় করছি না? আমি কি মেশিন মিথিলদা?
-আমি বুঝতে পারছি না তোমার অসুবিধেটা কোথায় হচ্ছে কঙ্কা ? আমরা সারাদিনে তো কাজের মাঝেও নিজেদের মধ্যে একটা কোয়ালিটি টাইম কাটাই কঙ্কা, তারপরও তুমি বলছ!!! আমি সারাদিন যতটা অ্যাটাচ্‌ড তোমার সাথে থাকি ফোনে , এস.এম.এস-এ ততটা আমি আমার ফ্যামিলিকেও সময় দিই না। …তুমি চাইলে আমি তোমাকে সময় দিই তো?
-কিন্তু মিথিলদা শুধু কি এইটুকুতেই শান্তি ? আমার তো একটা মন আছে বল । যখন তোমাকে কাছে পেতে ইচ্ছে করে বাসব এসে আমার অঙ্গরাজ্যের অধিকর্তা হয়ে বসে, বাসবের ছোঁয়া আর তোমার ছোঁয়া কি এক ?? তোমাকে চিন্তা করে যদি বা বাসবকে মেনেও নিয়ে বিছানায়, তবু অদ্ভুত একটা বৈসাদৃশ্য আমাকে ভীষণভাবে অতৃপ্ত করে তোলে…তখন আমার নিজের ওপরই রাগ হয়, ঘৃণা হয় … বিশ্বাস করো , কান্না পায় , একা লাগে…পাগল পাগল লাগে। মনে হয় আমি কি সাঙ্ঘাতিক ভুল করেছি তোমার সাথে নিজেকে জড়িয়ে। এভাবে আমি নিজেই নিজের কাছে ছোট হয়ে যাচ্ছি মিথিলদা । মনে প্রানে শরীরে ভালোবাসব তোমাকে আর বাসব তার স্বামীত্বের অধিকারে সহবাস করতে বাধ্য করবে আমাকে ওর সাথে। আমি এটা আর মানতে পারছি না ।
-দুররর, তুমি বড় বেশি ভাব কঙ্কা। এগুলোকে এত প্রশ্রয় দিতে নেই।
-না মিথিলদা না…আমার মনে হচ্ছে আমিও বোধহয় সাইকো হয়ে যাচ্ছি দিনে দিনে, প্রতারণা করছি সব চাইতে বেশি আমার সন্তানের সাথে। বুবুনের কি দোষ বলো ? ওকি পাচ্ছে ওর মাকে পুরোপুরি ? আমি কি নিজের সমস্যা নিয়ে ব্যস্ত থেকে ওকে অবহেলা করছি না? আমি কি পারছি ওকে একটা সুস্থ জীবন দিতে?
-কিন্তু তুমিই তো বলতে কঙ্কা বাসবের সাথে তোমার কোনোভাবেই মিলমিশ হয় না, ওর একগুয়েমি , অল্পশিক্ষা, প্রকারন্তরে অমানবিক আচরণ তোমাদের মাঝে দিনে দিনে একটা অদৃশ্য পাঁচিল তৈরি করে দিয়েছে! যে বাসবের হাত ধরে তুমি একদিন বাড়ি ছেড়েছিলে সেই বাসবকে আজ তোমার অচেনা লাগে , আর তুমি সেই বাসবকে আঁকড়ে ধরেই বা বাঁচবে কি করে? তুমি ওর থেকে সরে এসে স্বাধীনভাবে বাঁচো কঙ্কা । আমি যতটা পারব তোমাকে সাহায্য করব। আমি বলছি তুমি ভালো থাকবে।
-কিন্তু বুবুনের তো মা বাবা দুজনকেই চাই বলো…ওর তো আমাদের দুজনের হাত ধরেই বেড়ে ওঠার কথা। আর সত্যি বলো এতদিন ছিলাম তো এই অমিল নিয়েই ? তখন পারলাম কি করে? আসলে কি জানো মিথিলদা, মানুষষের কাছে বেশি অপশন থাকা উচিত নয়? তাহলেই মনের মাঝে না পাওয়াগুলো বড় বেশি খোঁচা মারে । মনে অস্থিরতা আসে , স্বার্থপরের মত নিজের ভালোটুকুই বুঝতে চায়… সত্যি বলতে তোমার সাথে সৃঞ্জার সম্পর্ক এতটা তিক্ত নয় তো , তাই তুমি আমার জ্বালাটা বুঝতে পারছো না। না , মিথিলদা , না…আমি অনেক ভেবেছি…আমি আর পারছি না…আমায় তুমি ক্ষমা কর … আমায় তুমি মুক্তি দাও!!!
ভাবনার সুতোটা তখনও ঠিকমতো কাটে নি …হঠাৎই ড্রাইভার ইকবাল গাড়িতে প্রচন্ড জোর ব্রেক কষলো । গাড়িটা থেমে গেল অফিসের একটু আগেই…ইকবাল চিৎকার করে উঠল,
-ওই শালা , শুয়ার কে পিল্লা , মরনা চাহতা হ্যায় ক্যায়া?
-কি হল ইকবাল ? গালি দিচ্ছ কেন?
-আরে সাব , আভি আভি চাক্কে কে নিচে চলা যাতা …শালা ভিখ মাঙ্গনেবালা!
… কাচের জানলার ভিতর দিয়ে মিথিল দেখল একটা বাচ্ছা ভিখারী ছেলে, যার কোমর থেকে বাকি শরীরটা একেবারেই অকেজ , দুটো হাত দিয়ে টেনে টেনে হেঁটে রাস্তাটা পেরিয়ে ফুটপাথে গিয়ে উঠল। রাস্তা পার হতে গিয়ে মিথিলে গাড়ির নীচে চলে যেত, আরেকটু হলেই। ছেলেটাকে অফিসের পাশে বেশ কয়েবার বসে থাকতে দেখেছে মিথিল আগে । মাঝে সাঝে জুলজুল করে চেয়ে থাকতে দেখে মিথিল পাঁচ দশটাকা দিয়েছেও …আজ গাড়ি থেকে মিথিল দেখল, এই প্রচন্ড ঠান্ডায় একট ছেঁড়া সোয়েটার পরে ন্যাড়া মাথায় ফুটপাথের এক পাশে মাথা নামিয়ে ইকবালের গালি খাচ্ছে। ইকবাল বলে যাচ্ছে,
– আবে বুরবক ইসতারা কই রাস্তা ক্রশ করতা হ্যায় ক্যায়া?
মিথিল বলল,
– গালি মাত দো , ছোড় দো ইকবাল, দের হো রাহা হ্যায় … গাড়ি পার্ক করনেকা জরুরত নেহি হ্যায়, মুঝে উতার জানে দো …অর তুম থোরাসা আগে যাকে গাড়ি ঘুমাকে , ঘর চলা যাও …মেমসাবকো বাহার যানা হ্যায় ।
…মিথিল গাড়ি থেকে নেমে ছেলেটার দিকে যেতে গিয়ে… একবার ঘড়িটা দেখল, তারপর আর সেদিকে না গিয়ে সোজা অফিসের দিকে হাঁটা লাগালো।
_______________________________________ক্রমশ

  
This entry is part 2 of 6 in the series বল মন 'সুখ' বল

পর্ব – ২।

আজ বছরের শেষ দিন। কাল নতুন বছরে মামমামের জন্য গিফট কিনতে হবে কিছু মিথিলকে । আজ অফিসে জে.কে.কন্সট্রাকশনের সাথে ভাইটাল মিটিং আছে তার । টেন্ডার কোট নিয়ে ফাইনাল আলোচনা। রাতে আবার থার্টি ফার্স্ট ইভের জন্য সৃঞ্জার বন্ধু আর তাদের হাব্বিদের নিয়ে লেট নাইট পার্টি… তার মধ্যে কঙ্কার ফোনটা এসে যেন সব গুলিয়ে দিল মিথিলের আজকের প্ল্যানিংটাকে। সত্যি মেয়েরা অনেকটা পারে । অথচ একটা সময়ে এই কঙ্কাই তাকে দিনের পর দিন এড়িয়ে চলেছে , বহু চেষ্টা করেও সে নাগাল পায় নি কঙ্কার… অনেক বুঝিয়েও তাদের মাঝের পোড়ে পাওয়া সম্পর্কের রেশটুকুকে রক্ষা করতে পারে নি সে…শেষ পর্যন্ত কঙ্কার সাথে স্বপ্নিল সম্পর্কটার ইতি টানতে বাধ্য হয়েছিল মিথিল । তার খুব খুব অসুবিধে হয়েছিল কঙ্কাকে মন থেকে সরিয়ে রাখতে। কঙ্কার সাথে কাটানো সময়গুলো তাকে মাঝে মাঝে ভীষণ অস্থির করে তুলত। এমনকি সৃঞ্জার সাথে অতি ঘনিষ্ঠ মুহুর্তেও তার কেবলি কঙ্কার ছোঁয়াটা মনে পড়ে যেত । খুব সত্যি বললে যদিও কঙ্কার সাথে তার হয়ত একটা পরকীয়া সম্পর্কই ছিল কিন্তু সৃঞ্জার থেকেও অনেক বেশি সহজ ছিল মিথিল কঙ্কার কাছে। আসলে তাদের দুজনের মধ্যের চাওয়া পাওয়াটা যে অতটা দুর্বার ছিল না। কিন্তু সেই সব তো চুকে বুকে গেছে নয় নয় করে আজ বছর তিনেক হল। তবে সম্পর্কটা যেমন একদিনে শেষ হয়ে যায় নি তেমনি মিথিলের সব ভুলে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসাও অত সহজ হয় নি । … বেশ খানিকটা সময় পার হয়ে গেছিল নিজেকে সব কিছুর বাইরে নিয়ে যেতে, তারপর ধীরে ধীরে নিজের মনটাকে সৃঞ্জাতে সীমাবদ্ধ করতে পেরেছিল মিথিল…একটা সময় পরে সৃঞ্জাকেই জীবনের একমাত্র অবলম্বন ভাবতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল সে এই কটা বছরে। অথচ তিন বছর পর আজ হঠাত কি এমন হল যে কঙ্কা নিজে থেকে দেখা করতে চাইছে মিথিলের সাথে ? তাহলে কি কঙ্কা আবার ফিরতে চাইছে নাকি তাদের পুরনো সম্পর্কের বৃত্তে । সে কি আবার ফিরে দেখতে চাইছে পুরোনো দিনগুলোকে । কিন্তু কঙ্কা যে বলেছিল সে আর চায় না এই সম্পর্কটাকে টিকিয়ে রাখতে। একদিকে মিথিল আর একদিকে তার স্বামী বাসব …দুজনের মাঝে সে হাঁফিয়ে উঠেছিল! কঙ্কা তো আরও বলেছিল ,যে বাসব যত খারাপই হোক হাজার হলেও সে তার অগ্নিসাক্ষী করা স্বামী, তার একমাত্র সন্তান বুবুনের বাবা , তাকে অস্বীকার করবে কি করে কঙ্কা! আর মিথিলের সাথে তো পরকীয়া প্রেম…আনকন্ডিশনাল লাভ ! …সম্পর্কটা চালিয়ে যাবার আদৌ কোনও দায়বদ্ধতা ছিল কি কঙ্কার ?ছিল না বোধহয় আর তাই স্বার্থপরের মত নিঃশব্দে মিথিলের হাত ছেড়ে দিয়েছিল কঙ্কা । অবশ্য মিথিলও বলেছিল ,
-দেখ , কঙ্কা জোর করে তো সম্পর্ক রাখা যায় না …অসুবিধে থাকলে তুমি সময় নাও …কিছুদিন দুরত্ব বজায় রাখো, কিন্তু একেবারে সরে যেও না …সত্যি বলতে আমরা দুজনেই সংসারে বাঁধা পড়ে আছি চাইলেও কেউই কিন্তু নিজেদের জায়গা থেকে সরে আসতে পারব না কোনোদিনই …তবু দুজনেই দুজনের কাছে একটা উন্মুক্ত খোলা জানলা…এমন করে জানলাটা বন্ধ করে দিলে আরও গুমরে মরবে কঙ্কা!… কাছে থাকতে হবে না। কিন্তু এমন দুরত্বে কি থাকা যায় না যাতে হাত বাড়ালে ছোঁয়া যায় …একটা পরম নিশ্চিন্ত আশ্রয়!!!… কিন্তু না কঙ্কা রাজি হয়নি । কি যে হয়েছিল ? কে জানে ? শেষমেশ মিথিল বিরক্ত হয়ে বলেছিল,
– ঠিক আছে আমি তোমার কথাই মেনে নিলাম, কিন্তু মনে রেখ, আজ যেমন ভাবে তুমি এড়িয়ে যাচ্ছ , এরপর যদি কোনদিন তুমি ভুল বুঝে ফিরে আসতে চাও ,আমিও কিন্তু তোমাকে চিনতে পারব না।‘’
…কিন্তু কই সকালবেলা ফোনে কঙ্কা নামটা শোনার পর, সে ফোনটা কাটতে পারল না তো ?

……একথা সেকথা ভাবতে ভাবতে আজ মিথিলের একটু দেরিই হয়ে গেল। একবারে স্নান সেরে বেরিয়ে ড্রেসকোর্ট করার সময় আজ এতদিন পর সাদা আর ধুসর রঙের মাফলারটা কেমন যেন গলায় জড়াতে ইচ্ছে করল মিথিলের । একবছর জন্মদিনে কঙ্কা দিয়েছিল তাকে । মাফলারটা নেড়েচেড়ে দেখতে দেখতে একটা লুকোনো চেনা গন্ধ তাকে বারে বারে পুরোনো দিনগুলোতে ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল ।মনে মনে এক অমোঘ টান আজও তাকে কঙ্কার প্রতি আকৃষ্ট করে তুলছিল।

-কিগো ব্রেকফাস্ট করবে তো?
-হ্যাঁ চল, হয়ে গেছে , যাচ্ছি।
সৃঞ্জার ডাকে সাতপাঁচ ভাবা বন্ধ করে মাফলারটা গলায় ফেলে ডাইনিং-এ এসে বসল মিথিল। খাবার ততক্ষনে রেডি । মামমাম এসে গলা জড়িয়ে বলল,
– গুড মর্নিং পাপা।
– মর্নিং মামমাম।
– সন্ধ্যেবেলা ফ্লুরিজের কেক আনছো তো? দাদাইও খাবে বলেছে।
– হুম , মনে আছে আমার…আর তার সঙ্গে একটা সারপ্রাইজ গিফটও ।
– পাপা, আজ তো তোমাদের থার্টি ফার্স্টের পার্টি থাকবে , আমি তো মামার বাড়ি থাকব রাতে , আমার সাথে তো তোমার আজ আর দেখাই হবে না , কাল দেখা হবে মামার বাড়িতে। …তুমি কিন্তু প্লিজ দিদুন আর দাদাই এর কাছে কাল তাড়াতাড়ি মাকে নিয়ে পৌঁছে যাবে… একদম আমার ঘুম ভাঙ্গার আগেই …আমি যেন ঘুম থেকে উঠেই তোমাকে দেখতে পাই আর সবার প্রথম হ্যাপি নিউ ইয়ারটা তোমার মুখেই শুনতে পাই।
– ওকে মাই লিটীল অ্যাঞ্জেল। তাই হবে । তুমি কিন্তু আজ দিদুন আর দাদাইকে একদম বিরক্ত করবে না।
সৃঞ্জা বলল,
-তুমি অফিসে পৌঁছে একবার গাড়িটা পাঠিয়ে দিও, আমি মামমামকে মায়ের কাছে রাখতে যাব…মা দুপুরে খেতে বলেছে…আমরা ওখানে পৌঁছে গাড়ি ছেড়ে দেব । বিকেলে আমি একটু পার্লারে যাব। কিন্তু সন্ধ্যেবেলা তুমি কি করবে শুনি ?
-মানে? যাব তো পার্টিতে।
– না তুমি কি আমাকে নিতে আসবে নাকি ,আমি পৌঁছে যাব তোমার অফিসে।
-দেখে নিচ্ছি…মিটিং হয়ে গেলে জানিয়ে দেব । তুমি রেডি হয়ে থেকো। … আর না হয় এক কাজ কর গাড়ি ছাড়তে হবে না, তুমি গাড়িটা রেখ… আমার কাজ মিটে গেলে আমি ফোন করে দেব তুমি গাড়ি নিয়েই চলে এস অফিসে একসাথে বেরিয়ে যাব।
-হুম সেটাই ঠিক হবে…তবে প্লিজ দেরি কর না যেন।
____________________________________ক্রমশ।

  
This entry is part 8 of 8 in the series এখানেই গল্পের শেষ নয়

This content is password protected. To view it please enter your password below:

  
This entry is part 7 of 8 in the series এখানেই গল্পের শেষ নয়

পর্ব- ৭

সারা রাত অপমানের জ্বালায় পুড়ে পুড়ে ভোরের দিকে অদ্ভুত এক ক্লান্তিতে ঘুম এসে গেছিল, বিভার। ঘুম যখন ভাঙল … তখন ঘড়ি বলছে প্রায় এগারোটা… বিছানায় উঠে বসলো বিভা । গায়ে হাতে অসহ্য একটা ব্যাথাও টের পেল। বিধ্বস্তভাবে পর্দার ফাঁক দিয়ে বাইরের আকাশটার দিকে চেয়ে রইল, …গত রাতের কথাগুলো মনে হতেই এক অফুরান বিস্বাদে ভরে গেল মনটা … ভাবল ইশশশশ্‌ কেন যে ভাঙল ঘুমটা। ঘুমটা যদি না ভাঙত কত ভালো হত… মুক্তি ই মুক্তি… চরম তৃপ্তি । কিন্তু পরক্ষণেই বিভার মনে হল, এত সহজে সে ছেড়ে দেবে অতীনকে? নাহ কিছুতেই না। অতীন তার ইচ্ছমত যা খুশি তাই করবে বিভার সাথে আর সে মেনে নেবে ? না… যে লুকোচুরি খেলা অতীন শুরু করেছে , সেই খেলার শেষ বিভাই করবে । বিছানা ছেড়ে উঠে ঘরের দরজা খুলে বাইরে গেল বিভা, পাশের ঘরের দরজা খোলা, ঘরটাও মোটামুটি গুছোনো… কিচেন ফাঁকা , লিভিং ফাঁকা … ব্যালকনির দরজা লাগানো … দরজার কাচের মধ্যে দিয়ে যতদূর চোখ গেল, খোলা এক বুক আকাশ যেন উপুর হয়ে আছে বিভার ব্যালকনির ছাদে। বেশ একটা মেঘলা মেঘলা ভাব… শীতের শুরুতে ঠান্ডা ফেলার জন্য একটা নিম্নচাপ হতে পারে, আকাশটা যেন তেমনি নির্দেশ দিচ্ছে , কেমন একটা থমথমে ভাব । লিভিং থেকে ফিরে এসে বিভা দেখল, বাথরুমের দরজা খোলা। নিজের ঘরে এল বিভা… কাল এই খাটটায় অতীন শুয়েছিল একা , তাকে ঢুকতে দেয়নি ঘরের দরজা বন্ধ রেখে। বিভা খাটের কোণায় বসল …উদাস হয়ে চেয়ে রইল খাটের পিছনের দেওয়ালে রাখা একদল ছুটন্ত ঘোড়ার ছবির দিকে, মনে মনে ভাবল, আচ্ছা সে কি এমন অন্যায়টা করেছিল? অতীন কি চাইলে পারত না একবার তার দরজায় এসে দাঁড়াতে ? আজ পর্যন্ত বিভা ঝগড়া কখনো বাসি করে নি, নিজের দোষ না থাকলেও , গোঁ ধরে না থেকে মিটিয়ে নিয়েছে নিজে থেকেই। এই প্রথম সে নিজে থেকে এগোতে পারল না, কিন্তু কই অতীনও তো এগিয়ে আসলো না , কিন্তু সত্যিই কি অতীন নিরপরাধ, তার কি উচিত ছিল না বিভার সাথে খোলাখুলি কথা বলা? … এক মুহূর্ত আরো কি যেন ভাবল বিভা ? তারপর তার মনে হল অতীন গেল কোথায়? তবে কি…চলে গেল …তাকে ফেলে? আচ্ছা অতীনের অফিসের ব্যাগটা কই ? স্টাডি টেবিলে চোখ পড়তেই… বিভা দেখল ব্যাগ নেই …আলমারি খুলে হলুদ ফাইলটাও চোখে পড়ল না বিভার। তারপর মনে হল …ওহো আজ তো অতীনের অফিসে স্মল স্কেল ইন্ডাস্ট্রি গ্লোবালাইজেশানের জন্যে ফরেন ডেলিগেটসদের সেমিনার… আর এই মিটিংএর জন্যই তো কাল বাড়ি বসে সে ফাইনাল রিপোর্ট তৈরি করছিল, সন্ধ্যেবেলা ব্রজেশ্বরদার ফোন এসেছিল… অতএব অতীন অফিসেই গেছে । তাছাড়া ছেলেরা খুব আরাম প্রিয়, তাদের সাজানো বাগান ছেড়ে তারা অন্য বাগানে ঘুরতে যেতে পারে কিন্তু সন্ন্যাস নিয়ে সহজে পাহাড়ে যেতে পারে না। তার জন্য সমস্ত ইন্দ্রিয় সুখ ছাড়তে হয়। অতএব অতীন বাবু আর যাই হোক বিবাগী হতে পারে না… । তবু একবার সুনিশ্চিত করনের জন্য অফিসের নম্বরে ফোন করল বিভা ল্যান্ডলাইন থেকে,
-হ্যালো
-হ্যা-লো, কি চাই?
-আচ্ছা সেলস ডিপার্টমেন্টের অতীনবাবু কি আজ এসেছেন?
-হ্যাঁ , এসেছেন , কিন্তু এখন সিটে নেই … আপনি কে বলছেন ম্যাডাম? হ্যালো হ্যালো …

কিছু না বলেই ফোনটা কেটে দিল, বিভা ।তারপর মনে মনে হাসল …. যা ভেবেছিল , ঠিক তাই। মোল্লার দৌড় ওই মসজিদ পর্যন্তই । নাহ, তাহলে অতো চিন্তার কোনো কারণ নেই, অতীনবাবু এখন অফিসে নিজের ভাবমূর্তি বজায় রেখে হেসে হেসে কাজ করে যাচ্ছে … আগের দিন রাত্রিতে সে যে মিথ্যে সন্দেহে তার বউয়ের গায়ে হাত তুললো, কেউ জানলই না। বিভা মফস্বলের একটা সাধারণ মেয়ে… যার জগতটাও খুব খুব ছোট … তবুও মুখোশের আড়ালে থাকা এই মানুষগুলোকে সে কোনদিনই সহ্য করতে পারত না… আজও পারে না। তাই নরম স্বভাবের মেয়েটা হঠাৎই কেমন প্রতিবাদী হয়ে উঠল নিজের অজান্তেই।

ওদিকে অতীনের মাঝরাতে সেই যে ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছিল, সত্যি বলতে আর সে ভাবে ঘুমটা আসেই নি, একটা অপরাধবোধ তাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছিল। বিভাকে তার বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয়, কিন্তু এক এক সময় নিজের অক্ষমতার কারণে হারিয়ে ফেলার ভয়ও হয়, তখন কেমন একটা অধিকারবোধ, আধিপত্য, প্রকারন্তরে গোঁয়ারতুমি পেয়ে বসে। মনে হয় এই নীল বোধহয় তার এমন সাজানো সংসারটাকে চোখের পলকে ওলোটপালোট করে দিল। রাগ হয়… কিন্তু তারপর ভাবে না বিভা ওরকম নয়… কিন্তু বিভা নীলকে নিয়ে বেশি উৎসাহ দেখালে একটা হিংসেও হয়। … কিন্তু এর মানেটা তো এইটাই যে সে বিভার প্রতি যথেষ্ট সচেতন, সেটা কি ভালোবাসা নয়…!!! কিন্তু বিভা কি তা বোঝে না ..বিভার বাচ্চাদের প্রতি এতো ভালবাসা আর তার নিজের অপারগতা… এই দুয়ের দ্বন্দ্বে সে কিভাবে বিভাকে যে আসল সত্য বলবে বুঝে উঠতে পারছিল না, যার ফলে দিনকে দিন অতীন যেন কেমন অসহায় হয়ে উঠছিল। একটা অদ্ভুত আশঙ্কা নীল কে নিয়ে তার মাথায় চেপে বসছিল , হয়ত অহেতুক কিন্তু ভাবনাটা যে নামছিল না মাথা থেকে।…এইসব নানা কথা ভাবতে ভাবতে তার সারারাত আর ঘুমই হল না, সকাল বেলা উঠে বিভার ঘরের সামনে গিয়ে বিভাকে ডাকতেও কেমন একটা কুন্ঠাবোধ হল তার, শেষ পর্যন্ত বিভা উঠছে না দেখে নিজেই নিজের কাজ গুছিয়ে, স্নান করে কিছু মুখে না দিয়েই অফিসে বেরিয়ে গেল। ভাবল, অফিস ক্যান্টিনে কিছু খেয়ে নেবে ক্ষণ …আর পরে সময়মত বিভাকে ফোন করে নেবে।

একদিনের একটা ঘটনা পরিবারের দুটো মানুষের মধ্যে কতটা দেওয়াল তুলে দিয়েছে এই কথা ভাবতে ভাবতে বেশ কিছুটা সময় আলগোছে বয়ে গেল বিভার । সাতপাঁচ অনেক ভেবেও বিভা কোনো কূলকিনারা পেল না… অগত্যা, সে ওয়াশ রুমে গেল… গিজার অন করল, বেসিনের সামনের আয়নায় চোখ পড়তেই দেখল ঠোঁটের কোনে কালশিটে একটা দাগ। … হাতের দু একটা জায়গাতেও একইরকম দাগ… চোখেমুখে জলের ঝাপটা দিল। কালকে অতীনের খামচে ধরা জায়গাগুলো নখের আঁচড়ে ক্ষতবিক্ষত হয়েছিল , সেখানে জলের ছিটে লাগতেই কেমন একটা চিড়বিড় করে উঠল … হয়ত বা মনটাও জ্বালা করে উঠল।…কিন্তু এত কিছু দেখেও তার একটু কাঁদতে ইচ্ছে করল না…চোখের সব জল কি শুকিয়ে গেল তার? মনে মনে ভাবল বিভা … একটা রাতে সে কি এতটাই বদলে গেল?… কই আজ তো তার অতীনের জন্য একটুও অনুকম্পা হচ্ছে না… তিন বছর যে লোকটার সাথে ঘর করল তার প্রতি এতটুকুও কৃতজ্ঞতা আসছে না বিভার ! বরং নীলের কথা তার মনে পড়ে যাচ্ছে অতীনকে ছাড়িয়ে। সে ভাবতে চেষ্টা করল নীলের জন্য কি অনুভুতি হচ্ছে তার? … এই কথাটা ভাবতেই মনে হল… ‘ ওহো নীলকে একটা ফোন করতে হবে? ‘যাক স্নানটা তো সেরে নি আগে ’…
অনেক্ষন ধরে ঠান্ডাগরম জলে স্নান করল বিভা … স্নান সেরে বাইরে এসে একটা ঘন জাম রঙের তাঁতের শাড়ি পরল … ইচ্ছে করল না কপালে সিঁদুরটা ছোঁয়াতে , ভিজে চুলটা আঁচড়ে, একটু সাজল নিজের জন্যে , …এতকাল তো সে অনেক সেজেছে অতীনের জন্যে ,… আজ মনে হল একটু নিজের জন্য বাঁচতে , কিচেনে এসে এক কাপ কফি বানাল বিভা , তারপর মোবাইলটা খুলে সবার প্রথম নীলকেই ফোনটা করল
-হ্যালো… নীল
-উফফফফ… মেমসাহেব… বলো ফোন করলে তবে?
-হুম…
-বিশ্বাস কর , এই কদিন মনে হয়েছে কি এক নির্বাসন দিয়েছ যেন তুমি আমাকে, বুকের মধ্যে একটা ভারি পাথরের চাপ… এখন তোমার কণ্ঠস্বরে বেশ হাল্কা লাগছে… কি হয়েছিল তোমার। আমায় বলবে না?
-বলব , তাই তো তোমায় ডাকছি নীল… আজ এক্ষুনি আমার বাড়ি আসতে পারবে কি ?
-মজা করছ?
-না সত্যি… পারলে এখনি এসো… অনেক কথা বলার আছে।
-এখনি? কি হয়েছে বল তো? অতীনদা আছে তো ?
-না ও অফিসে। তুমি যদি এখনি আসো… তবে কথা হবে , না হলে, আমাকে আর তুমি ফোন কর না নীল।
-এরকমভাবে বলছ কেন? আচ্ছা তুমিই বলো… অতীনদা নেই আমার যাওয়াটা কি ভালো দেখাবে?
-আমি আজ খুব বেপরোয়া নীল… হয়ত বা মন থেকে স্বৈরিণীও । আসবে তো এস না হলে ফোন রেখে দিচ্ছি।
-কি বাজে বকছ … আচ্ছা দেখছি …
-না দেখছি না…
-আচ্ছা এইভাবে যাওয়া যায় নাকি?
-খুব যায়… চাইলেই যায়। তুমি চাও না তাই বলো।
-না ঠিক তা নয়… আচ্ছা যাচ্ছি… কিন্তু এখন তো পৌনে বারোটা , আমাকে কিন্তু দুটো আড়াইটের মধ্যে ফিরে আসতে হবে …ভালো করে ভেবে দেখ তোমার অসুবিধে হবে না তো?
-না …বললাম তো… তাহলে এস… আমি তোমার অপেক্ষায় রইলাম।
বিভা ফোন কেটে দিল ।
নীল একটু দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে গেল।তারপর ঘড়ি দেখে ভাবল, সময় কম। নিজের কাজগুলো একজন সহকর্মীকে একটু দেখে দিতে বলে, নীল হসপিটাল থেকে বেরিয়ে পড়ল… একটা ট্যাক্সি ধরল… বিভার বাড়ি তার কর্মক্ষেত্র থেকে খুব দূরে নয়…মনে মনে ভাবতে থাকল কি হয়েছে বিভার। এই কদিনে সে যতটা চিনেছে তাকে ,সহজ বলেই তো মনে হয়েছে । সত্যি বলতে তার ইমলির সাথে সম্পর্কটা এখন দুই বাড়ির কথা রাখতে গিয়ে একপ্রকার দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে , কিন্তু মনের খিদেটা সে বিভার সাথে কিছুটা হলেও ভাগ করে নিয়েছিল… কিন্তু আজ এমন কি হল যে বিভা তাকে ডেকে পাঠালও। ভাবল অতীনদাকে কি একবার ফোন করবে? পরক্ষনেই মনে হল, ‘না ,আগে দেখি তো কি হয়েছে, হয়ত দুজনের মধ্যে ঝগড়াঝাটি কিছু হয়ে থাকবে,…তাই হবে… সে যেমন ইমলির জন্য বিভাকে বলে, হয়ত বিভাও তেমনি অতীনদার জন্যে তাকে কিছু বলবে… ঠিক আছে নো প্রবলেম, দেখাই যাক না কি বলে?’

  
This entry is part 6 of 8 in the series এখানেই গল্পের শেষ নয়

পর্ব- ৬

সন্ধ্যের দিকে নীলের মনটা কেমন যেন একটু করছিল। বাইরে বেরোল কিন্তু ভালো লাগল না… ফিরে এসে ইমলিকে ফোন করল একবার …কিন্তু ফোনটা বেজেই গেল । পরিবর্তে এসএমএস এল , ‘এখন স্যারের কাছে ….ফোন কর না , ফেরার সময় আমি মিসড কল করব। কথা হবে ।’ ইমলি এ বছর উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে, এডুকেশনে অনার্স নিয়ে কলেজে ভরতি হয়েছে। ওর দিদির বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত বাড়িতে ওর বিয়ের কথা কেউ ভাববেই না… অথচ নীলের সাথে ইমলির সম্পর্কটা বেশ কয়েক বছরের…বলা ভালো সেই স্কুলে পড়া কালীন। ইমলি , নীলের বাবার বন্ধুর মেয়ে। ছোটবেলার ভালোলাগা পরে দুই পরিবারের মধ্যে অলিখিত এক সম্পর্কের জন্ম দিয়ে দিয়েছে, যেখান থেকে নীল আর বেরোনোর কথা ভাবতেও পারে না। তখন দিনের পর দিন এত কথা বলেছে এখন আর কথাই খুঁজে পায় না …আসলে শুধু কথায় এখন আর মন ভরে না, তার বাইরেও আরো কিছু পেতে ইচ্ছে করে …কিন্তু সুযোগ কই? নীল তো ঢাকুরিয়ায় পেয়িং গেস্ট থাকে এক বৃদ্ধা মাসিমার বাড়ি, আর ইমলি তো নদীয়ায় । নীলের আসল বাড়ি শান্তিপুরে । চাকরী সূত্রে তার কলকাতায় আসা… থাকা। সম্পর্কটা কেমন যেন খুব কাছের হয়েও দূরের হয়ে যাচ্ছে …ইচ্ছে করলেও ছোঁয়া যায় না। মাঝে মাঝে একঘেয়ে লাগে নীলের, বড্ড এলোমেলো লাগে , সারাদিনে ওই এক আধটা ফোন … মিসড্‌কল… এসএমএস। দুজনের মাঝে একটা কমিটমেন্ট আছে কিন্তু মনের দূরত্ব হয়ে গেছে যোজন কয়েক। আজ দুতিনদিন ধরে বিভাও ফোনটা কেন জানি না ধরছে না। বয়সে বড়ো বলেই বোধহয় বিভা অনেকটা বুঝতে পারে নীলকে … কেমন একটা দিদির মত হাবভাব …কিন্তু কি একটা মায়া… কি একটা আকর্ষণ, কন্ঠস্বরে কি একটা নেশা, ভাল লাগা, গোটা শরীরটা মাঝে মাঝে উত্তাল হয়ে ওঠে নীলের, কান দিয়ে একটা শিরশিরানি বয়ে যায়। কিন্তু হঠাৎ কি এমন হল বিভার, যে এড়িয়ে যাচ্ছে নীলকে… কেমন একটা অস্বস্তি হচ্ছিল নীলের। চোখ বন্ধ করলে বিভার সেদিনের ওই মায়াবি মুখটা ভেসে উঠছিল… মনে হচ্ছিল অতীনদার থেকে সে অনেক বেশি বিভাকে বোঝে … বিভার মনে একাকিত্বের একটা মেঘ আছে, হয়ত কোনও লুকোনো কষ্ট , তার মিষ্টি কন্ঠস্বরে উচ্ছ্বলতার সাথে সাথে একটা বিষন্নতাও ঝরে পড়ে ঝরনার জলের মত… বিভার মুডের ভ্যারিয়েশনের ভাইব্‌সগুলো নীলকে কেমন যেন টানে। আর কথার ফাঁকে ফাঁকে ‘উঁহু’ বলে এক ঝলক হাসি নীলের শুকনো বুকটা কেমন জলে ভরিয়ে দেয়। দিনে দিনে নীলের কেমন যেন অভ্যেস হয়ে দাঁড়াচ্ছিল বিভাকে ফোন করাটা। তাই বোধহয় এমন সিগারেট খেতে না পাওয়ার মত ছটফট করতে থাকে নীল। ভাবে সকালে দু তিনবার ফোন করেছিল কিন্তু একবারও কথা হয় নি তেমনভাবে… বিভার সাথে খুব কথা বলতে ইচ্ছে করে নীলের। কিন্তু মোবাইলটা তো এখন ও বন্ধ। ল্যান্ডলাইনেও পাওয়া যাচ্ছে না। নীল ভাবে অতীনদা নিশ্চয় বাড়ি আছে তাহলে অতীনদার মোবাইলেই একবার ফোন করে দেখবে নাকি? ভাবা মাত্রই কাজ … ফোনটা রিং হতে থাকে । অতীন তখন কফি বানাচ্ছিল বিভার জন্য…ফোনের শব্দে কিচেন থেকে মাথাটা বের করে বিভাকে বলল, ‘ দেখ তো কে ? বিভা দেখল নীলের ফোন … কেমন যেন মনটা থই থই জলে ভরে গেল… কথা বলতে ইচ্ছে করল নীলের সাথে। একটু ইতস্তত করে ধরল অতীনের ফোনটা,
– হ্যাঁ বল
– যাক … , এতক্ষন পরে অতীনদার ফোনে তোমায় পেলাম । তোমার ল্যান্ডলাইন মোবাইল সব বন্ধ কেন গো? কি হয়েছে ?আমি কি কিছু ভুল করেছি?
– নাহ, এমনি। তুমি কেন ফোন করলে তাই বল।
– না সেরকম কিছু না আসলে ইমলির ব্যাপারে একটু কথা ছিল … তুমি একদিন ওর সাথে কথা বলবে। আমাকে নিয়ে ও কি ভাবছে, একটু যদি … আমি একদিন নিয়ে যাব ওকে তোমার কাছে।
– ঠিক আছে পরে কথা হবে ক্ষণ এ বিষয়ে … আজ নয়… অন্য কোনওদিন…
– তোমার কি হয়েছে মেমসাহেব ? মনটা খারাপ মনে হচ্ছে… আমায় বলা যাবে কি?
– হুমমম, বলব …পরে… এখন না
– বলবে তো ঠিক
– হুম এখন রাখছি …ব্যাস্ত আছি ।
– ফোনটা ছেড়ে দেবে এখনি? ওকে বাই।কিন্তু প্লিজ মোবাইলটা খুলে রাখ মেমসাহেব … ওটা বন্ধ থাকলে খুব একা লাগছে।
– আচ্ছা। বাই ।
ফোনটা কেটে সাইড টেবিলে রাখতে গিয়ে বিভা দেখল অতীন পিছনে দুহাতে দুটো কাপ নিয়ে দাঁড়িয়ে … কেমন যেন জেরা করার মত বলল, কে ফোন করেছিল?
-নীল
-আমার মোবাইলে?
-হ্যাঁ ল্যান্ডলাইনে পায় নি … আমার মোবাইল সুইচড্‌ অফ তাই…
-তো কি বলছে?
-কথা হয়নি।
-হুম সেটা তো দেখলাম কি যেন পরে বলবে বললে। এখন বললে না কেন বিভা?
-ভাল্লাগছে না ।
-তাই নাকি আমি আছি বলে?
বিভা অন্যসময় হলে ভয়ে ভয়ে উত্তর করত, কিন্তু অতীনের মেডিক্যাল রিপোর্ট টা দেখার পর তার মনের মধ্যে যে ঝড় উঠেছে, শুধু সেটাকে দাবিয়ে রাখার চেষ্টায় নিজেকে শান্ত রেখেছে বিভা। তাই হয়ত আগের চেয়ে কিছুটা ঔদাসীন্য দেখিয়ে চুপ করে রইল।
-অতীন আবারও বলল, কি হল উত্তর দিলে না যে?
বিভা স্থির চোখে তাকালো অতীনের দিকে…
বিভার চোখের এই স্থির ভাষাটা অতীনের বড় অচেনা … সে তো এতকাল বিভাকে ভয় পেতেই দেখেছে …আজ হঠাৎ কি এমন হল সে বুঝে উঠতেই পারছিল না… কিছুক্ষন চুপ করে থেকে কফির কাপ দুটো সেন্টার টেবিলে নামিয়ে রেখে বিভার খুব কাছে এসে তাকে এক ঝটকায় সোফা থেকে টেনে তুলে বলল,
– কি এমন কথা বিভা যা আমার সামনে বলতে পারলে না। বল না, কি কথা যা নীলকে বলা যায় আমায় না।
বিভা সোজাসুজি অতীনের চোখে চোখ রেখে বলল ,
– এমন কিছু নয় … তাছাড়া আমার আর নীলের মাঝে তেমন কোন কথা হয়ও না…কিন্তু সত্যি বল , তুমি কি আমায় সব কথা বল? তোমার মেডিক্যাল রিপোর্টটার কথা কি আমাকে বলেছিলে ?
আচমকা এমন একটা প্রশ্নে হতচকিত হয়ে উঠল অতীন , তারপর রাগে অন্ধ হয়ে , বলল,…

-ও বুঝেছি .. তুমি আমার আলমারিতে হাত রেখেই গোয়েন্দাগিরি শুরু করেছ? নিজের দোষ ঢাকতে, এখন নতুন ইস্যু খুঁজছো ঝামেলা করার জন্যে। তা তোমার বারোয়ারি বন্ধুর সাথে দুঃখের কথাগুলো শেয়ার করতে চাইছিলি বুঝি, আমি এসে পড়ায় ব্যাঘাত ঘটল? আমার পিঠ পিছে তোমরা কি কর আমার বুঝতে একটুও বাকি নেই? বিভা তুমি একেবারে যা-তা হয়ে গেছ। তোমার মত মেয়ে আর যাই হোক ঘরের বউ হতে পারে না …
-আচ্ছা তাই বুঝি? আর এটা বলবে না আমার মত মেয়ে , চাইলেও মা হতে পারে না । তার এমন দুর্গতি তার স্বামীর অক্ষমতার দায় তাকে সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হয়।

এই বলে বিভা অতীনের শক্ত করে ধরে রাখা হাতদুটো নিজের হাতে একে একে সরিয়ে দিয়ে বলে,
-অযথা চিৎকার করো না, চিৎকার আমিও করতে পারি …তাতে তোমার মান সম্মান কি খুব বাড়বে ? আর নীলকে নিয়ে তুমি যা ভাবছ সেগুলো সত্যি নয়।ভুল …ভাবনাগুলো তোমার সম্পূর্ণ মনগড়া… আসলে ওটা তোমার কমপ্লেক্স ।

বিভার কথাগুলোয় অতীন যেন একটা চরম ধাক্কা খেল। শীতের শিরশিরে হাওয়াতেও অতীন ঘেমে উঠল, উত্তেজিত হয়ে ভীষণ একটা রাগে বিভার হাত দুটো খামচিয়ে সজোরে তাকে দরজার দিকে ধাক্কা দিয়ে ঠেলে লিভিংরুম ছেড়ে বেরিয়ে গেল । ঠেলা সামলাতে না পেরে বিভা দরজার পাশে আচম্বিতে পড়ে গেল, হয়ত বা চোটও পেল কিন্তু পড়ে গিয়েও সে কেমন একটা স্থবির হয়ে বসে রইল। এতবড় অপমানে তার চোখে এক ফোঁটা জল পর্যন্ত এল না , চুপ করে গুম হয়ে সে বসে থেকে সে ভাবল , অতীনের পৌরুষে সে কি এমন ঘা মারল যে তাকে অমন করে ছুড়ে ফেলে দিয়ে গেল অতীন । অতীনের পুরুষকার এতটাই বড়ো যে তার নারীত্বের কোন মূল্যই রইল না তার কাছে । তবে সত্যি বলতে সে তো নীলের সাথে কিছুই করে নি … শুধু শুধু একটা মিথ্যে সন্দেহের বশে অতীন তাকে যা খুশি বলে গেল। একটা ছেলে আর একটা মেয়ের মাঝে কি উত্তর বৈবাহিক বন্ধুত্ব হতে পারে না? মানবিক সম্পর্ক থাকতে পারে না? … শুধুই শরীরী সম্পর্ক ? মেয়েদের কি মন বলে কিছু থাকতে নেই? তারা কি শুধুই একতাল মাংস? আর সেইজন্যই কি অতীন তার ওপর শুধু স্বামীত্বের অধিকারই দেখালো তার কষ্টটুকু বুঝল না ? বিভার মাথার মধ্যে সব ওলোটপালট হয়ে যাচ্ছিল ……কতক্ষন সে দরজার পাশে ওইভাবে পড়ে ছিল সে নিজেও জানে না, বেশ অনেক্ষন পর যন্ত্র চালিতের মত দরজার পাশ থেকে উঠে নিজের ঘরে গিয়ে দেখল অতীন দরজা বন্ধ করে দিয়েছে… একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে পাশের ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে বিছানায় বসলো । আচমকা ধাক্কায় হাতের বিভিন্ন জায়গায় চোট পেয়েছিল বিভা ,সেই চোটগুলো তে হাত রাখতে রাখতে বিভা ক্রমশ আরো কঠিন হয়ে যেতে লাগল , … এ বিভা যেন অন্য বিভা… ।
সারারাত অতীন আর বিভা দুজনে দু ঘরে রইল… কেউ ঘর ছেড়ে বেরোল না… রাতের খাওয়া হল না। অতীন মাঝরাতে একবার ঘর ছেড়ে লিভিং এ এসে দেখল টিভিটা সাইলেন্ট মোডে চলছে, লাইট জ্বলছে, ফ্ল্যাটের গেট লাগানো নেই।। সেন্টার টেবিলে রাখা কফি জুড়িয়ে জল। অতীন ঘাড় ঘুড়িয়ে দেখল পাশের ঘরের দরজা বন্ধ। এক এক করে আলো নিভিয়ে , টিভি বন্ধ করে, দরজায় তালা দিয়ে, কফির কাপ দুটো কিচেনের সিঙ্কে নামিয়ে রেখে ,পাশের ঘরে দরজার সামনে গিয়ে একবার দাঁড়ালো …তারপর মাথা নামিয়ে ফিরে এল নিজের ঘরে ।
ওদিকে গোটা রাত ধরে বিভা দুচোখের পাতা এক করতে পারল না…সে ভেবে চলল একটাই কথা … সে তো কোনও প্রতারণা করেনি , বদলে অতীন তার অক্ষমতার কথা না জানিয়ে বিভার প্রতি অন্যায় করেছে। তবে কেন এত বড়ো অপমান সে সহ্য করবে? আর সবচেয়ে বড়ো কথা কিছু না করেই যদি এত কথা হয় , তাহলে কিছু করলেই বা ক্ষতি কি ছিল ?

  
This entry is part 5 of 8 in the series এখানেই গল্পের শেষ নয়

পর্ব- ৫

নীলের সাথে বিভার বন্ধুত্বটা হবে না হবে না করেও কেমন যেন দিনকে দিন বেড়ে যেতে থাকে। সারাদিনের কাজের মাঝে টুকটাক এসএমএস … কখনো ধাঁধাঁ , কখনো জোকস , কখনও বা ছোটো ছোটো হাসি ঠাট্টা অভিমান … ফোনের টিং টিং আওয়াজ সব মিলিয়ে বেশ লাগতে থাকে বিভার । কেমন যেন একটা ভরে থাকার অনুভব …সেই একাকিত্বটা এখন আর তাকে তাড়া করে বেড়ায় না। … মাঝে মাঝে নীলের ভুলভাল কথায় তর্ক হয়, রাগ হয় …তখন কিছুদিন কথা বার্তা বন্ধ থাকে , তারপর আবার বিভাই নীলের রাগ ভাঙ্গিয়ে নিজে থেকে ফোন করে। গম্ভীর গলায় নীল বলে,
– ফোন করেছ কেন?
বিভা বলে ,
-রাগ কমেনি দেখছি। আচ্ছা বাবা সরি, ঘাট হয়েছে আমার ,কথা বলতে হবে না …কিন্তু বড়ো বলে একটা সম্মান তো করতে পারো…
তখন নীল বলে,
-তুমি বড়ো বলেই যে সবসময় ঠিক হবে এমন কিন্তু নয় মেমেসাহেব … তুমি বড় হতে পারো কিন্তু আমার অভিজ্ঞতা তোমার থেকে অনেক বেশি।
নীল যখন রেগে থাকে বিভার কেমন যেন একা একা লাগে… মাঝে মাঝে ভাবে নীলকে জিগ্যেস করবে কেন সেদিন রাতে সে অমন মেঘ জলের এসএমএস করেছিল … কি বলতে চেয়েছিল সে? কিন্তু যখনই বিভা জিগ্যেস করতে যায় কেমন একটা অস্বস্তি তাকে ঘিরে ধরে।
বিভা আর নীলের বন্ধুত্বটা যতটা গভীর হয়ে উঠছিল, অতীন যেন কেমন একা হয়ে যাচ্ছিল। সত্যি বলতে দুটো মানুষের মাঝের সম্পর্কের সুতোটা যখন আলগা হতে থাকে তখন একজন আরেকজনকে কি সত্যি বুঝতে চায়? চায় না বোধহয়… পরিবর্তে আধিপত্য দেখাতে চায়, নিজেকে বোঝাতে চায় … একে অন্যকে দোষারোপ করতে থাকে… যার ফলে দুরত্বটা বাড়তে বাড়তে একজন অপরজনের কাছে দিনে দিনে অপরিচিত হয়ে ওঠে। এক্ষেত্রেও তার অন্যথা হয় নি। বিভার প্রতি অতীনের আচরণটা ধীরে ধীরে কেমন কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে উঠতে থাকে অনাবশ্যক ভাবেই। একটা সন্দেহের জালে বিভার জীবনটা জড়িয়ে পড়তে থাকে… মাঝে মাঝেই অতীন বিভার ফোন নিয়ে কললিস্ট চেক করে , এসএমএস দেখে , … কিছু দেখতে না পেলে বলে , ‘ আগে আগেই সব ডিলিট করে রেখেছ, তাই না?’ অপমানে বিভার মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে যায়। আর অতীনের চোয়ালটা কঠিন । বিভা সহজ করার জন্যে অতীনের গায়ে হাত ছোঁয়ালে এক ঝটকায় অতীন হাত সরিয়ে দেয় বিভার । বিভা ভেতরে ভেতরে ক্ষয়ে যায়। মুখে কিচ্ছুটি বলে না। মনে মনে অতীনের জন্যে তার মায়াও হয়… ভাবে ,
ধ্যুত আর ফোন করবে না নীলকে । সত্যিই তো কে এই নীল …একটা উড়ো অশান্তি…যার জন্যে অহেতুক অতীন তার থেকে দূরে সরে থাকছে… সন্দেহ করছে…নিজেদের সম্পর্কটা শুধু শুধু নষ্ট হয়ে যাচ্ছে …কি লাভ আছে তার নিজের সংসারে এমন ঝামেলা করে। অতীনের সাথে জেদাজেদিতে নীলের সাথে কথা বলাটা একটা নেশার মত হয়ে যাচ্ছে তার কাছে অথচ , একটু সহানুভুতির আদান প্রদান ছাড়া আর কিই বা আছে ??? হতে পারে নীল অবিবাহিত বলে তাদের হাসি ঠাট্টা নিয়ে অতীন খারাপ ভাবে কিন্তু বিভা তো জানে তার সীমাবদ্ধতার কথা। তাই গত কদিন ধরে বিভা নিজের সাথে বোঝাপড়া করে , সকাল থেকে ফোনটা বন্ধ করেই রেখেছে। অতীন যা যা পছন্দ করে তাই করবার চেষ্টাও করছে, কিন্তু এতেও কি সামান্য স্বস্তিটুকু পাওয়ার উপায় আছে! একে তো ফোনটা বন্ধ করতে হবে কেন সেই প্রশ্নে অতীন জর্জরিত করে তুলছে উপরন্তু মোবাইল বন্ধ থাকায় নীল এমন ভুলভাল কাজ করছে , যে যা সত্যি নয় তাকেও অতীন সত্যি মনে করতে শুরু করছে।
সন্ধ্যেবেলা আজ অনেকদিন পর অতীন আর বিভা টিভিতে সিনেমা দেখছে একসাথে । আজ অতীন সকাল থেকে অফিসও বেরোয় নি। যদিও বেলায় চা খেতে গিয়ে নীলের ব্যাপারে একটু কড়া কড়া কথা হয়েছে… কিন্তু দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর পরিবেশ একদম ঠান্ডা। অনেকদিন পর আজ একটা ডাকাতিয়া দুপুরের আবেশ এখনও বিভাকে কেমন আদুরে করে রেখেছে। অতীনের গায়ে হেলান দিয়ে দুজনে মিলে একটা কোয়ালিটি টাইম এনজয় করছিল। আঙ্গুলে আঙ্গুল জড়িয়ে সোফায় বসেছিল দুজনে, এমন সময় অতীনের ফোনে তার অফিস থেকে ব্রজেশ্বরদার ফোন এল…স্মল স্কেল ইন্ডাস্ট্রীর লাস্ট সেলস্ ফিগারটা কত? শেষ দুবছরের মার্জিনাল ডিফারেন্স কত ?এইসব জানতেই অফিসের ফোন…। কাল যে অতীনের অফিসে একটা বড়ো সেমিনার আছে । অতীন বিভাকে বলল,
-একটু ফাইলটা এনে দেবে বিভা …
-যাচ্ছি, কোথায় আছে বলো ।
-আমার আলমারির একদম ওপরের তাকে, হলুদ রঙের ফাইল।
-আনছি…
বিভা ফাইলটা আনতে গেল …বিভার আস্তে দেরী দেখে ব্রজেশ্বরদার সাথে একটু কালকের প্ল্যানিং নিয়ে অতীনের কথাও হল। কথা বলতে বলতে অতীন হাঁক পাড়ে,
– কি গো পেলে ?
-হ্যাঁ , দিচ্ছি।
একটু দেরী হলেও বিভা কিন্তু ফাইলটা খুঁজে এনে দিল অতীনকে। তারপর বলে ,
-তুমি কথা বলো, আমি আলমারিটা বন্ধ করে আসছি। পায়ে পায়ে ফিরে যায় বিভা । আলমারির পাল্লার পাশে দাঁড়িয়ে চুপ করে একটা বন্ধ খামে রাখা কিছু কাগজ বার করে পড়তে থাকে বিভা… পড়তে পড়তে বিভার চোখ দুটো জলে ভরে উঠতে থাকে… খামটা একটা ডায়গনেস্টিক সেন্টারের আর কাগজগুলো সাধারণ কাগজও নয়, মায়ো ক্লিনিক্যাল রিপোর্ট – মেল ফার্টিলিটি টেস্ট। যা বলছে, অতীনের স্পার্ম কাউন্ট নরমালের থেকে অনেক অনেক নিচে… এটা পড়ে বিভার একটুও বুঝতে অসুবিধে হল না, তার কনসিভ করতে চাওয়ায় অতীনের বাধাটা আসলে কোথায় ! … এক মুহুর্তের জন্যে বিভার জীবনখাতার আগাম পাতাগুলো সাদা হয়ে গেল… অতীনের অক্ষমতার কথায় যতটা না অনুকম্পা হল , রাগ হল অনেক বেশি । … কারণ সব জেনেও নিজের অসুবিধে গোপন রাখতে সে বিভাকে কামপিলগুলো খেয়ে যেতে বাধ্য করেছে। দিনের পর দিন ওই অসুধ খেয়ে বিভার হরমোনাল ডিসব্যালান্স হত, পাশাপাশি মাথা ঘোরা , গা বমি তো ছিলই। এমনকি তার দিদির কথা শুনে বিভা যখন ,’বলত এই পিলগুলো বেশি খাওয়া ঠিক নয় , পরে কনসিভ করতে প্রবলেম হতে পারে সেটা শুনে অতীন গা করত না।’ তার মানে ও সব বুঝত কিন্তু …. ! এরপর ধীরে ধীরে তার মনে হয় ,এও তো এক মিথ্যের আশ্রয়… এক রকমের প্রতারণা ! যা অতীন দীর্ঘ একবছর ধরে করে আসছে তার সাথে। বিভার মাথায় সব তালগোল পাকিয়ে যায়।মনের মধ্যে একটা উদ্দাম ঝড়ের আভাস টের পায় বিভা। ততক্ষণে অতীন লিভিং থেকে ডাকাডাকি শুরু করে দিয়েছে , ‘ শুনছ … কি করছ… এস না। …কিগো?… বিভা?’ নিজের মনের সাথে যুদ্ধ করতে থাকে বিভা… তার এই কদিনের সুসম্পর্ক গড়ে তোলার সুচেষ্টাটা ফালতু মনে হতে থাকে… খামটা সযত্নে আলমারির যথাস্থানে রেখে চোখ মুছে ঘরের আলো নিভিয়ে ধীর পায়ে অতীনের কাছে যায় বিভা। তার খুব ইচ্ছে করছিল অতীনকে একবার জিগ্যেস করতে , ‘সত্যি কথাটা এমনভাবে কেন গোপন করলে তুমি? তুমি সহজ কথাটা একবার সহজ ভাবে বলেই দেখতে আমি মেনে নিতে পারি না… চাইলে দুজনে মিলে ডাক্তার কনসাল্ট করতাম,… নিজের অক্ষমতার কথা বলতে পৌরুষে খুব লাগত বুঝি, তাই বোধহয় দুষ্টুকেও আজকাল তোমার আর পছন্দ হয় না… এরকম আরো অনেক কিছুই ভাবলো বিভা, কিন্তু কেন জানি না অতীনকে হাসতে দেখে নিজের কষ্টটাকে ভুলে থাকতে চাইল বিভা। অতীন হঠাৎ বিভার হাত ধরে টেনে বলল,
-বসো না যেমন বসেছিলে… উঠে পড়লে কেন? তারপর বিভার থমথমে মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ কি হয়েছে তোমার?’ বিভা চুপ করে থেকে বলল, ‘ কিছু না… তুমি চা খাবে?’ অতীন বলল, ‘ নাহ … চলো আজ আমি কড়া কফি করে তোমাকে খাওয়াই। অন্যসময় হলে বিভার হয়ত খুব আনন্দ হত, কিন্তু বিভা শূন্য চোখে তাকিয়ে রইল টিভি স্ক্রীনের দিকে … কফি বানাবে বলে অতীন সোফা ছেড়ে উঠে পড়ল।

  
This entry is part 4 of 8 in the series এখানেই গল্পের শেষ নয়

পর্ব- ৪

নীলের সাথে ইমলির সম্পর্কটা কেন এমন ছাড়া ছাড়া বিভা ঠিক বোঝে না। যতবারই কথা হয়েছে নীলের সাথে বিভার মনে হয়েছে নীল কেমন যেন জোর করে বয়ে বেড়াচ্ছে সম্পর্কটা । নীলের পেড়াপেড়িতে বেশ কয়েকবার ইমলির সাথে কথাও হয়েছিল বিভার , কিন্তু ইমলি সেটা ভালো চোখে নেয় নি বোধহয়। যদিও ইমলির বয়সটা বেশ কম তাও , ইমলিকে বড়ো হিসেবি ঠেকেছিল বিভার। তবুও যখনই ইমলি নীলের ফোন ধরত না , নীল বিভাকে ইমলির সাথে কথা বলতে জোর করত। প্রথম প্রথম বিভার বেশ অস্বস্তি হত , কি বলবে ভেবে পেত না । তার ওপর ইমলি যখন জিগ্যেস করত ‘আচ্ছা বিভাদি বলোতো, তোমার সাথে ওর কি এত কথা হয় …আমি তো ওর সাথে বলার মতো কথাই খুঁজে পাই না’। … বিভা হাসত , মুখে কিছু না বললেও মনে মনে কেমন একটা মায়া লাগত নীলের ওপর। আসলে সেও জানে না নীলের সাথে সে কি এত কথা বলে। সত্যি বলতে নীলের সাথে তার বেশ কয়েক মাস টুকটাক ফোনেই যা কথা হত। কিন্তু যে বার অতীন অফিসের কাজে শিলিগুড়ি গিয়েছিল, সেই বার বিভা একা থাকতে পারবে না বলে আভাকে থাকতে বলেছিল… কিন্তু অসুস্থ শাশুরিকে ছেড়ে আভা কেমন করেই বা থাকে? … অগত্যা দুষ্টুকে রেখেছিল বিভার কাছে কদিনের জন্য। অতীন বার বার বিভাকে বলেছিল, ‘একা একটা বাচ্চাকে নিয়ে থাকতে পারবে না ’ বিভা কথা কানেই তোলে নি। দুষ্টুকে নিয়ে তার বেশ কাটছিল।সকালে ঘুম থেকে উঠে দুষ্টুকে নিয়ে কাছাকাছি একটু বাজার করা, দুপুরে ভাত খাওয়ানো , ঘুম পাড়ানো , তারপর বিকেলবেলা দুস্টুকে নিয়ে পার্কে যাওয়া । সেখানে আর পাঁচটা বাচ্চার সাথে দুষ্টুর খেলা দেখতে বিভার বেশ লাগত। সন্ধ্যেবেলা দুজনে মিলে গল্পের বই পড়ত, টিভি দেখত, তারপর অল্প কিছু রান্না করে খেয়ে খাইয়ে , অতীনের সাথে ফোনে সব কিছুর বিস্তারিত গল্প করে , তারপর শুতে যাওয়া । এক সপ্তাহের মধ্যে এইভাবে বেশ কটা দিন তো কেটেই গেছিল । কিন্তু একদিন বিকেলে দুষ্টুকে নিয়ে খেলতে গিয়ে হঠাৎ মাঠে কি একটা কামড়াতে দুষ্টুর পায়ে রক্ত জমাট হয়ে নীল হয়ে গেছিল…কি বিচ্ছিরিভাবে ফুলে উঠেছিল পা টা, … সে কি কান্না দুষ্টুর, কাঁদতে কাঁদতে ছেলেও যেন কেমন ঝিমিয়ে পড়েছিল। বিভা ভয় পেয়ে অতীনকে ফোন করল , অতীন তখন মিটিং-এ । ফোন সাইলেন্ট… । দিদিকে ফোন করল বিভা , দিদির ফোনও বেজে বেজে কেটে গেল। শেষমেষ বিভা একটা ট্যাক্সিতে উঠে পড়ল দেশপ্রিয় পার্কের দিকে এক ডাক্তারের কাছে যাবে বলে । এমন সময় হঠাৎই নীলের ফোন , বেশ কয়েবার ফোনটা বাজার পর , বিভা ফোন ধরেই খুব বিরক্তি নিয়ে বলেছিল… পরে কথা বলব, আমি এখন খুব বিপদে আছি।
-বিপদ …আরে কি হয়েছে বলোই না?
-একটু ইতস্ততঃ করে বিভা পুরো ঘটনাটা বলতেই, নীল বলেছিল, ‘কোথাও না , তুমি সোজা হরিশ মুখার্জ্জী রোডে, শম্ভুনাথ পন্ডিত হসপিটালে এসো। আমি ওখানে এমারজেন্সিতে আছি, তুমি কাউন্টারে এসো, ভয়ের কিছু নেই , সব ঠিক হয়ে যাবে’।
বিভার আজো মনে পড়ে সে কিভাবে দুষ্টুকে নিয়ে গিয়েছিল, দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে। কাউন্টারের বাইরে দুষ্টুকে কোলে নিয়ে এগিয়ে আসতে দেখেই , সুঠাম চেহেরার বেশ লম্বা একটি ছেলে কাউন্টার ছেড়ে বেরিয়ে এসে জিগ্যেস করেছিল,
-তুমি বিভা???
-হ্যাঁ…
-আমি নীল , এসো আমার সাথে এসো…ডাক্তার আছেন ভেতরে।
শম্ভুনাথ পন্ডিত হস্পিটালের আউট ডোরে ডাক্তার দেখেছিলেন দুষ্টুকে , বলেছিলেন ‘হয়ত কোনও বিষাক্ত কীটের দংশন’। …তারপর দুষ্টুর পায়ের ওই জায়গাটা একটু চিড়ে জমে থাকা রক্ত বের করে দেওয়ার পর, ওষুধ লাগিয়ে ব্যান্ডেজ করে, ইঞ্জেকশান দিয়ে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে বলছিলেন। প্রায় ঘন্টাখানেক বাদে দুষ্টু একটু স্বাভাবিক হওয়ার পর বিভার খেয়াল হয়েছিল নীলের কথা, কাউন্টারের দিকে তাকাতেই চোখাচোখি হয়েছিল নীলের সাথে। ইতিমধ্যে সে বেশ কয়েকবার এসে দেখে গেছে বিভাকে, নীলের প্রতি অসীম কৃতজ্ঞতায় বিভার মনটা ভরে গেছিল। সেদিন অল্প কিছু কথার পর, ফাইনাল চেক আপ করিয়ে, নীল ট্যাক্সিতে পৌঁছে দিয়েছিল বিভা আর দুষ্টুকে । কিন্তু বাড়ি আসে নি । কারণ ট্যাক্সিতে ওঠার পরই অতীনের ফোন … সব শুনে খুব বকেছিল বিভাকে দুষ্টুর প্রতি অবহেলার জন্য। চুপচাপ সব বকুনি শুনে বিভার তখন কাঁদো কাঁদো অবস্থা । তাও কিছুটা স্বাভাবিক হতে চেয়ে বিভা বলেছিল, ‘তুমি কি নীলের সাথে কথা বলবে, ও পাশেই আছে’ । কথা হয়েছিল অতীন আর নীলের। নীলের প্রতি কৃতজ্ঞতা দেখিয়ে অতীন তাকে বলেছিল, ‘অনেক অনেক ধন্যবাদ নীল, আমি কলকাতা ফিরলে একদিন আসুন আমার বাড়ি , তখন কথা হবে, খাওয়া-দাওয়া হবে।’ নীল বোধহয় এক মুহূর্ত কিছু ভেবেছিল। তারপর বলেছিল, …সে হবে ক্ষন, আগে আপনি ফিরুন তো দাদা।’
……এই ঘটনার পর থেকেই নীলের সাথে বিভার একটা সুন্দর বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। কলকাতায় ফিরে আসার পর অতীন একটা রবিবার নিমন্ত্রণও করেছিল, নীলকে । সেদিন খুব সুন্দর করে সেজেছিল বিভা। অনেক রাত পর্যন্ত গল্প হয়েছিল… খাওয়া দাওয়া…একটু আধটু লাল জলও চলেছিল অতীন আর নীলের । তারপর নীল বেড়িয়ে পড়েছিল বাড়ির উদ্দেশ্যে, বিভার খুব ভালো লেগেছিল, অনেকদিন পর কলকাতায় চেনা পরিচিত কাউকে পেয়ে…। বেশ আনন্দের সাথে অতীনকে জিগ্যেস করেছিল,
-কেমন লাগলো তোমার নীলকে? …
অতীন গম্ভীর হয়ে জড়ানো শব্দে বলেছিল,
-ঠিকই আছে …কিন্তু তোমার নজরটা ঠিক ছিল না , হাভ ভাব বদলে গেছিল?
-মানে?
-লড়বে নাকি আমার সাথে এই টপিকে, ..লেটস স্টার্ট বেবি …আমি রেডি।
-এ আবার কি কথা… রাত দুপুরে যত্তসব উল্টোপাল্টা ।
-তোমার তাই মনে হচ্ছে বুঝি ? কিন্তু একটা কথা বলো তুমি সেদিন ওর সাথে দেখাই করতে গিয়েছিলে, কি তাই তো?
-তুমি কি পাগল হয়ে গেছ?
– তুমি আগে তো কোনওদিন এমন করে সাজোনি বিভা, আজ কেন সেজেছিলে? ওকে ইম্প্রেসড করার জন্য? কি এমন দেখতে ছেলেটাকে?
…এরকমই কিছু কথার জ্বালায় বিভাকে এফোঁড় ওফোঁড় করে, সেই রাতে অতীন বিভার অঙ্গরাজ্যের ওপর আধিপত্য বিস্তার করেছিল। সেদিন অতীনের সোহাগের পরিভাষাটা এতটাই অন্যরকম ছিল যে, বিভা গোটারাত দুচোখের পাতা এক করতে পারে নি। অতীন যখন বেঘোরে ঘুমোচ্ছিল, বিভা তখন জলভরা চোখে ভেবেছে, একবার নীলকে ফোন করে বলবে নাকি, যে সে যেন আর তার সাথে যোগাযোগ না রাখে… । আর কোনোদিন যেন ফোন না করে, অতীন পছন্দ করছে না ব্যাপারটা…। নাকি আর ফোন ধরবেই না নীলের। বুঝিয়ে দেবে ব্যস অনেক হয়েছে আর নয়। অবশেষে ভোর রাতে মনের সাথে বেশ যুদ্ধ করে মোবাইলটা হাতে নিয়ে অন করতেই , একটা এসএমএস … !!! একরাশ মন খারাপ নিয়ে চোখের জল মুছে বিভা একদৃষ্টে চেয়েছিল স্ক্রীনের দিকে…। ভেবেছিল, এ হেঁয়ালীর মানে কি??? এসএমএস টা নীলের। গত রাতে বাড়ি পৌঁছে নীল কেন জানিনা নেশার ঘোরে বিভাকে লিখেছিল,
‘তোমাকে আজ না দেখলে বুঝতেই পারতাম না মেমসাহেব তোমার মধ্যে ,এত মেঘ… এত জল আছে, … মেম…, তুমি সবসময় খুব হাসি খুশি থেকো, হাসলে তোমায় ভারি সুন্দর দেখায়…
শুভ রাত্রি। নীল।
……………………..……………………..…………………(ক্রমশ)

  
PAGE TOP
HTML Snippets Powered By : XYZScripts.com
Copy Protected by Chetans WP-Copyprotect.
Skip to toolbar