অনিকেতকে বুঝতে সবারই বেশ ভুল হয় ।ওর ধাঁচটা অনেকটা নারকেলের মত। ওপর থেকে যতই শক্ত হোক ভেতরটা কিন্তু নরম সাদাই।আজকাল সারাদিন লোহা পট্টিতে বসে থেকে থেকে অনিকেতের মনে হয় তার আর মন বলে কিছুই নেই, সবই কেমন যেন মেটালিক হয়ে গেছে…যেটুকু রাগ অনুরাগ ছিল তাতেও বোধহয় মরচে ধরে গেছে। বাপ ঠাকুরদার ব্যবসা , ভাল না লাগলেও ছেড়ে তো আর দিতে পারে না……সর্বোপরি সে ব্যবসায় যখন লাভজনক একটা অঙ্ক মাসের শেষে আয় হয়…তাই সারাদিন এই কালিকা হার্ডওয়ার্সের ঝাঁপ খুলে রাখতেই হয়… তারপর কয়েকজন কর্মচারীও তো সেই বাবার আমল থেকেই রয়ে গেছে।
সে আগে একটা সময় ছিল যখন বন্ধুমহলে অনিকেত লাহার একটা দরের জায়গা ছিল।আর দেখতে শুনতে তো বেশ ভালই ছিল তাই তার প্রেমিকার অভাব কোনোদিনই ছিল না।কিন্তু কোন প্রেমটাই বেশি দিন টিকতো না তার ওই খামখেয়ালী হাভভাব আর সাবেকি দেমাকটার জন্য। সবচেয়ে বড়ো কথা খুব সহজে মহিলামহলে তার কথার নেশা জমাতে পারলেও প্রেম টিকিয়ে রাখার বশীকরন মন্ত্রটা তার অজানাই ছিল।
অনিকেতের বন্ধু মৈনাক ছিল তার হরিহর আত্মা। মৈনাকের বোন ছুটকী … ভাল নাম ময়ুরাক্ষী। ময়ুরাক্ষীকে তার বেশ লাগত। আসলে ময়ুরাক্ষীর মধ্যে ওই ন্যাকা ন্যাকা প্রেম প্রেম ভাবটা কোনোদিনই ছিল না। ময়ুরাক্ষী ডানাকাটা পরী না হলেও বেশ সুন্দরীই ছিল। কিন্তু তার অনিকেত কে তেমন আহামরি কোনদিনই লাগে নি। তবু মেয়েরা যেহেতু ছেলেদের চোখের ভাষা খুব ভালই বোঝে, তাই ছুটকীরও বুঝতে অসুবিধে হত না কতটা প্রশ্রয় সে অনিকে দেবে আর কতটা তার কাকিমার ভাইপো সৌরভকে দেবে! ময়ুরাক্ষীর এই অবজ্ঞাটাই অনিকেতকে ভেতর থেকে যেমন জ্বালিয়ে দিয়েছিল তেমনি দক্ষিণ চব্বিশ-পরগনার ছেলে সৌরভকে তার প্রতিদ্বন্দী করে তুলেছিল। কলকাতার বুকে চার চারটে বাড়ি আর তিন তিনটে গাড়ির মালিকানা থাকা সত্ত্বেও অনিকেত লাহা যে, ময়ুরাক্ষীর চোখে সামান্য এক সরকারি ডাক্তার সৌরভের সমকক্ষও নয় … একথা ভাবলেই নিজেকে ভীষণ অসহায় লাগত অনির।এই অভিমানটাই ময়ুরাক্ষীর থেকে তাকে অনেকটা সরিয়ে নিয়েছিল ধীরে ধীরে। মৈনাক চাকরী পেয়ে শিলিগুড়ি চলে যাবার পর থেকে যোগাযোগটাই কমিয়েই দিয়েছিল অনি ওই বাড়ির সাথে। তবু অনিকেতের ইমশানটাকে নিয়ে ময়ুরাক্ষী কম ছেলেখেলা করেনি।
…..ছুটির দিন অনি বাড়ি বসে বেগম আখতারের গান শুনছে বাবুর মত মন নিয়ে , বেশ ফুরফুরে মেজাজ..এমন সময় ফোন বেজে উঠল দালানের । উত্তর কলকাতার বনেদী বাড়ি। বাড়িময় দাসদাসী … একজন ফোন ধরে জিগ্যেস করলেন …… “কাকে চাইছেন”
অনিকেত দা আছেন?
ধরুন ডেকে দিচ্ছি,
পাশের ঘর থেকে অনি এসে ফোন ধরল … “হ্যালো”
“আমি ছুটকী”…যেন কান দিয়ে এক সুরেলা ঝরনার রিনিঝিনি মাধুরী অনির সারা শরীরে বয়ে গেল ।
কি ব্যস্ত আছো অনি দা?
অদ্ভুত একটা ভাল লাগায় আচ্ছন্ন হয়ে অনি বলল …না ওই একটু গান শুনছিলাম আর কি। তা হঠাৎ কি মনে করে…?
না আজ সন্ধ্যায় আমাদের বাড়িতে একটা জলসা আছে মায়ের তরফ থেকে আমি নিমন্ত্রণ করলাম, দাদা তো নেই এখানে তাই…এসো কিন্তু অবশ্যই ।
কিসের জলসা?
এলেই বুঝতে পারবে।
আচ্ছা ঠিক আছে , যাব ক্ষনি।
অনির মনটা যেন এখন থেকেই ঘরের চৌকাঠ পেরিয়ে ময়ুরাক্ষীর বাড়ির গেটের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইল ।যাবে না ,যাবে না করেও সন্ধ্যেবেলা গাড়ি নিয়ে গেল অনি ময়ুরাক্ষীর বাড়ি….. আর গিয়েই বুঝল ময়ুরাক্ষী কি রসিকতাটাই না তার সাথে করেছে…মাসিমা খুব আপ্যায়ন করলেন যদিও…কিন্তু মৈনাকের দায়িত্বটাও চাপিয়ে দিলেন অনির ওপর…আর জলসা বলেতো কিছুই ছিল না যেটা ছিল সেটা হল সৌরভ আর ছুটকীর পাটিপত্র…মানে বিবাহের পুর্বে আশীর্বাদ…অনির খুব, খুব খারাপ লেগেছিল ছুটকীর এই ব্যবহার… বলতে গেলে মনটা ভেঙ্গেই গিয়েছিল…..শুধুমাত্র মাসিমার কথা ভেবে বেরিয়ে আসতে পারেনি… তার চোখের সামনেই ওদের আশীর্বাদ হয়ে গেল …অপমানে আহত অনি কেমন হিমশীতল হয়ে গিয়েছিল…… অনির সেই মুখে কি দেখেছিল ময়ুরাক্ষী কে জানে……তবে তার যে এমন মজা করাটা উচিত হয় নি সেটা খুব বুঝেছিল সে।কিন্তু সেদিন সবার মাঝে আর কিছু বলে উঠতে পারে নি অনিকে।তারপর যতবার ফোন করেছে, অনি ফোন ধরে নি…এমন কি বিয়ের দিন যায়ও নি… কিন্তু তারপর থেকে ময়ূরাক্ষীও যেন একটু সমঝে গেছিল…আর বিয়েরদিন সন্ধ্যে বেলা থেকে বারে বারে খোঁজ নিয়েছিল অনিকেত দা এসেছে কিনা…বিয়ের আসরেও তার কেমন যেন অস্থির লেগেছে নিজেকে…যাহোক অবশেষে বিয়েটা হয়েই গেল।অনিও আর ওদের বাড়িমুখো হয়নি বছর খানেক…এত বড়ো অপমান সে জীবনে ভুলতে পারবে না …এই অভিমানে মৈনাকের সাথে যোগাযোগটাও বিছিন্ন করে দিয়েছিল…তার নিজের একমাত্র লক্ষ বলতে ছিল ব্যবসা আর মনোরঞ্জন বলতে নাটক দেখা…ব্যস…জীবন থমকে গিয়েছিল …প্রেম বিষয়টা তার কাছে বিষ হয়ে উঠেছিল…যত নারীসঙ্গ সব কেমন যেন পানসে লাগতে শুরু করেছিল তার …তার পৌরুষে এমন ঘা মেরেছিল ময়ূরাক্ষী…যার জন্য সে ঠিক করেছিল কোনোদিন তাকে ক্ষমা করবে না…।
নিজের সীমাবদ্ধ গন্ডীর মধ্যে প্রতি শুক্রবার কি শনিবার অ্যাকাডেমী তে নাটক দেখা…সেদিনও ঠিক নিয়ম করে দুপুর বেলা গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে অ্যাকাডেমী চত্বরে এসে টিকিট কেটে পরের শো এর জন্য অপেক্ষা করছিল অনি …হঠাৎ কোন এক নারী কন্ঠ পিছন থেকে ডেকে উঠল “ আরে অনিকেত দা না”…ঘুরে তাকিয়ে অনিকেত চমকে উঠল …এত ময়ুরাক্ষী! এতদিনের পুষে রাখা অভিমান কিন্তু তাকে দেখে তুঁসের আগুনের মত জ্বলে উঠল না ……খুব ভালো করে ময়ুরাক্ষীর মুখের দিকে তাকিয়ে বলল একা নাকি…? ময়ুরাক্ষী মুখ নিচু করে বলল “হুম…”
সেকি সৌরভ কোথায়?
না আমি একাই এসেছি …ও থাকে কোথায়?
ময়ুরাক্ষীর কিছু যেন বদল হয়েছে সেটা যে কি যদিও তা চোখেমুখে ধরা যাচ্ছে না কিন্তু আচরনে তা স্পষ্ট….. হাতে কিছুক্ষন সময় থাকায় টুকরো টাকরা কিছু কথা হল ……অনির বেশ লাগলেও পুরোনো ব্যাথাটা একটু একটু খোঁচা দিচ্ছিল বইকি…… তবুও সে তা প্রকাশ করতে পারল আর কোথায় ! ময়ুরাক্ষী ফোন নম্বর চেয়ে নিল নিজে থেকেই … তার অন্তত আর একবার অনির সাথে দেখা করার সাধটা পূর্ণ হল… কিন্তু সত্যিই পুরন হল কি ?…তার অপেক্ষাটা যেন আবার তৈরি হল …ইচ্ছেটাও যেন বেশ বেড়ে গেল। কদিন পর প্রথম ফোনটা ময়ুরাক্ষীই অনিকে করল…ঠাঠা রোদে দোকানে বসে অনির মনে হল কোনো শীতল জলধারা বয়ে গেল মনের ওপর দিয়ে…জুড়িয়ে গেল ভেতরটা ……আচ্ছা তার তো এমন ঠান্ডা ব্যবহার করার কথা নয় …তবুও কেন সে কঠিন হতে পারছে না সে নিজেও বুঝে উঠতে পারল না। শেষমেশ ময়ুরাক্ষী বলেই ফেলল “আমার কিছু কথা আছে অনি দা …তুমি একদিন আমার সাথে দেখা করতে পারো?” প্রথমে অনি এড়িয়ে গেল…কিন্তু ময়ুরাক্ষী নাছোড়বান্দা …ঠিক হল সপ্তাহ দুয়েক পর একটা শুক্রবার ওরা দেখা করবে অ্যাকাডেমী চত্বরে…অনি মনে মনে ভাবল, সেদিন সে জিগ্যেস করবেই কেন এমনটি করেছিল ময়ুরাক্ষী ?….নির্ধারিত শুক্রবারে দেখা হল দুজনের …একটু আগেই পৌঁছেছিলো দুজনে… অনি টিকিট কেটে গাছের নিচে বসলো… চিরকালের ঠোঁটকাটা অনি শেষে জিগ্যেস করেই বসলো ময়ুরাক্ষীকে। যদিও ময়ুরাক্ষী একটু অস্বস্তিতে পরে গেল প্রথমে, তবুও সরল সত্যটা ধীরে ধীরে স্বীকার করল …হ্যাঁ সে অনিকে অপদস্থ করার বাসনাতেই এমন করেছিল কিন্তু তারপর থেকেই তো সে মরমে মরেছে শুধু নয়…… কেমন ভাবে যেন অনির প্রতি দুর্বলও হয়ে পড়েছে……বিয়ের পর থেকে একটা দিনের জন্যও সে নিজেকে ক্ষমা করতে পারে নি, আর তার সমস্ত মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়িয়েছে এই অনিই। সব শুনে অনি মনে মনে হাসে আর ভাবে সত্যি প্রেম কি বিষম বস্তু !এতদিন ধরে যে অনি শুধুমাত্র একটু গুরুত্ব পেতে চেয়েছিল ময়ুরাক্ষীর চোখে আজ সেই ময়ুরাক্ষী তার সামনে দাঁড়িয়ে তাকে ভালোবেসে ফেলার কথা শোনাচ্ছে আর সে ভেবেই পাচ্ছে না কি উত্তর দেবে! অনিও বোধহয় এই একটা বছরে অনেক বদলে গেছে তার নিজের অগোচরে… আলগোছে খানিকটা সময় পেরিয়ে যাওয়ার পর অনিকেত বলল….“তকে কয়েকটা কথা বলি ছুটকী , একথা ঠিক যে আমি তোকে ভালবাসতাম …আর তাই বিয়ে করে একটা সম্মানজনক জায়গাও দিতে চেয়েছিলাম …কিন্তু তখন হয়তো তোর সৌরভকে আমার চেয়ে অনেক বেশি যোগ্য মনে হয়েছিল……সেটা হতেই পারে কিন্তু তাই বলে আমার ইমোশনটাকে নিয়ে তোর অমন করা উচিত হয়নি সেটা তুই নিজেও বুঝেছিস…যাক সে কথা…এবার আসি আজকের কথায় …আজও হয়ত আমি তোকে ভালবাসি… কিন্তু নিজের চাওয়াটাকে বাস্তবায়িত করব বলে আমি কিন্তু তোর সাথে কোনো পরকীয়া করতে পারব না…কারন সৌরভের না থাকার সুযোগ নিয়ে আজ তুই বলবি আমাকে অ্যাকাডেমীতে দেখা করতে …কাল বলবি নলবোন …পরশু মন্দারমনি বা দীঘার কোনো হোটেলে …ধীরে ধীরে মনের টানটা শুধুমাত্র শরীরের টান হয়ে উঠবে ……আর ভালোবাসাটা অপমানিত হবে লুকোচুরি খেলে…না …আমি ভালবাসাটাকে কোনোদিন এত নিচু করে দেখেনি …আর দেখতেও পারব না…”
ময়ুরাক্ষীঃ কিন্তু আমি তো আরও কিছু বলতে চেয়েছিলাম অনিদা…
অনিকেতঃ আমার কথা এখনও শেষ হয়নি ছুটকী…যদি কোনোদিন তোর মনে হয় সৌরভ তোর যোগ্য নয় এবং তুই ওই সম্পর্কটা থেকে পুরোপুরি বেরিয়ে আসতে চাস তবেই আমায় বলিস……ডেফিনেটলি আমি তোকে আপন করে নেব…আর সত্যি বলতে জীবনে নারীসঙ্গ আমি কম করি নি…তাই তোর কাছে আমি এমন আসঙ্গ চাই না…
ময়ুরাক্ষীঃ কিন্তু অনি দা আমি তো এত তাড়াতাড়ি এই সম্পর্ক থেকে বেরোতে পারবো না !
অনিকেতঃ সেটা তুই ভাব…বেরোতে চাইলে কোন কিছুই অসম্ভব নয়…কিন্তু কি চাস আগে বুঝে নে কারন আমি তোকে শ্যাম আর কূল দুই রাখতে কখনও বলব না…আর গোপন আভিসারিকা বলে তোকে মেনেও নিতে পারবো না…এবার তুই ভেবে দেখ…টেক ইওর টাইম… আমার আর কিছু বলার নেই…।……এই বলে ঘড়ির সময় দেখল অনি।কথায় কথায় নাটকের সময় কখন পেরিয়ে গেছে…… পাঞ্জাবির পকেটে রাখা টিকিট দুটো ছিঁড়ে ফেলে, অনি তার নতুন কেনা লাল ইনোভার দরজা খুলে ভেতরে গিয়ে বসলো।একবারের জন্যও সে পিছন ফিরে ময়ূরাক্ষীকে দেখল না।যদিও তার খুব ইচ্ছে করছিল ময়ুরাক্ষীর বাড়ানো হাতটা একবার ধরে,কিন্তু নিছক সময় কাটানোর সময় যে আর নেই অনির…গাড়ি ছাড়তে যতক্ষণ সময় নিল ততক্ষণ ময়ুরাক্ষী অপলক চেয়ে রইল অনিকেতের লাল গাড়িটার দিকে।অন্তঃদহনে পুড়ে যাচ্ছিল ময়ুরাক্ষী।ভেবে পাচ্ছিল না সত্যি অনিকেত তাকে ফিরিয়ে দিয়ে, তার অপমানের প্রতিশোধ নি্‌ল, নাকি তাকে দ্বিচারিতা থেকে সাবধান করল।কিছুটা গিয়ে গাড়িটা লালবাতির নিষেধে দাঁড়ালো, গাড়ির আয়নার মধ্যে দিয়ে অনি দেখল… বিবশ ময়ুরাক্ষী দাঁড়িয়ে আছে স্থবির হয়ে…আর গাড়ির কাচের বাইরে একটা বাচ্ছা ছেলে এক গোছা গোলাপ নিয়ে জিগ্যেস করছে “বাবু গোলাপ নেবেন…টাটকা লাল গোলাপ”!!…রাস্তার লাল আলো সবুজ হল…গাড়ি স্টার্ট নিয়ে রেড রোডের দিকে বেঁকে গেল..ক্রমশ সন্ধ্যের অন্ধকারে কাচের মধ্যে দিয়ে ময়ুরাক্ষী দূর থেকে দূরে সরে যেতে যেতে ঝাপসা হয়ে গেল…।

© Copyright 2014 @indrila, All rights Reserved. Written For: Oimookh