পর্ব – ৫।
সারারাত ধরে আয়ান ছটফট করেতে থাকে মায়ের জন্য । সে জানে এবার তার মায়ের কথা মত চলাই উচিত… আর সেই কথা মেনে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে গেলে তো তাকে হোস্টেলে যেতেই হবে ,ভালোই হবে মা মামার বাড়িতে দিদানের সাথে থাকলে …তার চিন্তাটা কমবে। তার খুব মনে আছে আগে মামার বাড়ি থাকাকালিন নিম্মিদিদির সাথে কত মজা হত, তখন তো ওরা সন্তোষপুরের ফ্ল্যাটে যায়ই নি …মামা বলত ‘কি লাভ ওখানে একা থেকে ।এখানে সবার সাথে থাক’…ভালোই লাগত প্রথম প্রথম এখানে থাকতে …কিন্তু এখান থেকে মা চলে গিয়েছিল তো তারই জন্য। আয়ান তখন ছোট হলেও বছর দশেক বয়স…তার মনে আছে বড়ো মামীর সাথে মায়ের কথা হচ্ছিল জুবিন আঙ্কেল কে নিয়ে , সেদিন ছিল নিম্মিদিদির বার্থ ডে, যদিও সে জুবিন আঙ্কেলকে বেশ ভালোইবাসত কিন্তু সেদিন মামীকে যা বলতে শুনেছিল তার কারনেই তার মনে একটা অদ্ভুত ভয় হয়েছিল… ভেবেছিল মা বোধহয় জুবিন আঙ্কেলের জন্যই তাকে হোস্টেলে পাঠিয়ে দেবে…তবে কি জুবিন আঙ্কেল তার বাবার জায়গাটা নিয়ে নেবে? কেমন যেন অভিমান হয়েছিল মায়ের ওপর…মায়ের কাছে কে বেশি প্রিয় জানতে ইছে করেছিল আয়ানের…মনে মনে একটা ঈর্ষা তৈরি হচ্ছিল জুবিন আঙ্কেলের ওপর… তার মনে পড়ছিল , মার ঘর থেকে মামী চলে যাবার পর সে ঘরে এসে চুপচাপ শুয়ে পড়েছিল…। মা তখন দিদানের কাছে ছিল। যদিও শুয়ে পড়েছিল আয়ান কিন্তু ঘুম আসেনি ।…একটু পরে মা এল …
-কিরে ঘুমিয়ে পড়েছিস…আয়ান?…আরে সত্যি তো ঘুমিয়ে গেছে দেখছি ছেলেটা !!
মোহনা বড়ো আলোটা নিভিয়ে …আয়নার সামনে গিয়ে বসল…ড্রেসিং টেবিলের স্পট লাইটটা জ্বলছিল, মায়ের হাতে ছিল বাবার একটা ছবি। এমন সময় মায়ের মোবাইলে একটা ফোন আসে … মা ফোনটা ধরে, মায়ের কথাগুলো কানে আসলেও জুবিন আঙ্কেলের কথাগুলো শুনতে পাই নি আয়ান। মা বলছিল ,
–তুমি পৌঁছে গেছ তো জুবিন…আমার চিন্তা হচ্ছিল একটু..
…
-হ্যাঁ অনেক রাত হল …তুমি এবার রেস্ট কর …কাল কথা হবে কেমন …
…
-বাই অ্যান্ড থাঙ্কস আগেইন জুবিন… সত্যি আজকের দিনটা খুব ভালো কাটালাম আমরা সবাই…
…
-হ্যাঁ আয়ান ঘুমিয়ে পড়েছে । আর পারে নাকি…যা হই হই করল তোমার সাথে
…
-ওকে, বাই …টেক কেয়ার…গুড নাইট ।
…খুব সাধারন কথা কিন্তু আয়ানের কান্নায় গলা বুজে এসেছিল..চোখটা জ্বালা করে উঠেছিল । মাকে যেন চাইলেও ছুঁতে পারছিল না আয়ান… কেমন দূরের মনে হয়েছিল…বাজে মনে হয়েছিল । রাত্রিবেলা মোহনা যখন গভীর ঘুমে …তখন আয়ান বিছানা ছেড়ে উঠে জুবিনের দেওয়া সমস্ত উপহারগুলো ছিঁড়ে, মাটিতে ফেলে তছনছ করে দিয়েছিল…নতুন প্যাকেটের আওয়াজে ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছিল মোহনার …তার অমন কান্ড কারখানায় অবাক হয়ে গিয়েছিল মোহনা…একটুও বকে নি আয়ানকে, শুধু কাছে টেনে বলেছিল..
-কি হয়েছে ?…ওগুলো তোর পছন্দ হয়নি?
-না হয়নি তো। একদম হয় নি।
-ঠিক আছে, কাল চেঞ্জ করে নেব, কিন্তু তুই ওগুলো নষ্ট করছিস কেন?
-না না ,আমি আর কারোর দেওয়া জিনিস নেব না…সবাই বাজে… জুবিন আঙ্কেল বাজে , মামী বাজে…তুমিও বাজে। হ্যাঁ হ্যাঁ তুমিও খুব খুব বাজে।
মোহনা জড়িয়ে ধরেছিল আয়ানকে…তখন আয়ানের কি জেদ…ঠেলে সরিয়ে দিয়েছিল মোহনাকে , হাত পা ছুঁড়ছিল রাগে অভিমানে …কিন্তু মোহনা অসীম ধৈর্যে আয়ানকে বুকের মধ্যে চেপে ধরে শান্ত করেছিল…বলেছিল,
-কি কষ্ট হচ্ছে আমায় বল না …
-তুমি কি আমাকে হোস্টেলে পাঠিয়ে দিতে চাও?
-না না কক্ষনও নয় সোনা …
-ঠিক তো…
-হ্যাঁ একদম ঠিক , আমি তো তোকে ছাড়া থাকতেই পারব না বাবা।
-তবে মামী কেন বলছিল…?
-মামী এমনি বলেছিল…
-না, আমি জানি, মামী জুবিন আঙ্কেলের জন্য বলেছিল তাই না… আমি কিছুতেই এখানে থাকব না আর…আমরা আমাদের ফ্ল্যাটে থাকব। মামী বাজে… জুবিন আঙ্কেল বাজে …সবাই বাজে…থাকব না এখানে…কিছুতেই থাকব না।
আয়ান ফোঁপাচ্ছিল, মোহনা একেবারে নিথর হয়ে গিয়েছিল…সারারাত আয়ানকে কোলে আঁকড়ে ধরে রেখেছিল…। আয়ানের আজও মনে পড়ে , কিছুদিন পরে জুবিন আঙ্কেল এসেছিল মায়ের সাথে দেখা করতে …আয়ান জানে না কি কথা হয়েছিল শুধু শুনেছিল যাবার সময় মা জুবিন আঙ্কেলকে বলেছিল ‘তুমি আর এখানে এস না জুবিন …কখনও কোনও অসুবিধে হলে আমি জানাব।’ …ব্যস সেই আঙ্কেলের শেষ আসা , এরপর আর কোনওভাবে কোন যোগাযোগ হয়নি আঙ্কেলের সাথে…তার কিছুদিনের মধ্যে আয়ানরা মামার বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছিল সন্তোষপুরের ফ্ল্যাটে।……আজ এত বছর পরে আয়ানের খুব মনে হচ্ছে জুবিন আঙ্কেলের কথা।
…সকালবেলা মামীর ডাকে দরজা খুললো আয়ান…
-আয়ান উঠে পড়, বাবা। মামা নার্সিং হোমে ফোন করেছিল……মৌ ভালো আছে …কাল রাতেই কেবিনে শিফ্ট করেছে…তুই রেডি হয়ে নে, মামার সাথে ব্রেকফাস্ট করে বেরোবি।
আয়ান বেশ আশ্বস্ত হল…বলল
-আমি এখনি তৈরি হয়ে নিচ্ছি,
-কি খাবি বল ব্রেকফাস্টে ?
-তুমি যা দেবে…
-ফরমালিটি মামীর সাথে!
-না না তা কেন?
-এই যে তোর মা বলে ,তোর নাকি খাওয়া নিয়ে বড়ো জেদ?
-ওতো মায়ের সাথে এমনি করি…এবার এখানে থাকলে তোমাকেও জ্বালাব।
-তবে রে দুষ্টু ছেলে !!
…মামী হাল্কা আদরে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় আয়ানের। হাসতে হাসতে আয়ান বাথরুমে যায়। ফ্রেশ হয়ে এসে আয়ান আবীরের পুরোনো কলিগদের কয়েকজনকে ফোন করবে বলে মায়ের ফোন নম্বরের খাতাটা হাঁৎড়াতে থাকে। অনুজা বলে,
– হ্যাঁরে চা খাবি তো?
-হ্যাঁ …দাও।
………………………………………………………………………………………………………………ক্রমশ
© Copyright 2014 @indrila, All rights Reserved. Written For: Oimookh