This entry is part 3 of 6 in the series বল মন 'সুখ' বল

পর্ব – ৩।

…সারা কলকাতা শহরটাই কদিন ধরে কেমন যেন উৎসবের আমেজে মেতে আছে। সেই বড়দিনের সময় থেকেই রাস্তা ঘাটে দোকানে বাজারে আলোর রোশনাই …তার সাথে যোগ হয়েছে ল্যান্টারন্‌স , বেল্‌স , স্ট্রীমার্‌স,স্টার্‌স… আরো কত কি? গাড়ি নিয়ে বালিগঞ্জ থেকে পার্ক স্ট্রিট আসতে আসতে পুরোনো কথাগুলো আবার মিথিলকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যেতে লাগল। সত্যি বলতে মিথিল কিন্তু কঙ্কাকে কম ভালোবাসে নি । তবে মিথিল আর কঙ্কার সম্পর্কটা কোনও পূর্ব নির্ধারিত বা সুপরিকল্পিত সম্পর্ক ছিল না… এটা একটা দুর্ঘটনা কিম্বা বলা ভালো ভাগ্যের খেলা। বন্ধুমহলে যদিও মিথিল আর সৃঞ্জা ভীষণ আইডিয়াল কাপ্‌লই ছিল, তবুও যেন সৃঞ্জার বাবা মায়ের সমস্ত বিষয়ে মতামত জ্ঞাপন আর সৃঞ্জার মন-মর্জীর তোয়াক্কা করতে করতে মন থেকে কেমন যন্ত্র হয়ে উঠছিল মিথিল…একটা অদ্ভুত শূন্যতা তৈরি হচ্ছিল তার মনের মধ্যে দিনে দিনে …যার কারনটা মিথিল চেষ্টা করেও ঠিক খুঁজে পায় না। এমনি এক সময় মিথিলের নতুন অফিসের ট্যাক্স কনসালটেন্ট বরুন মিত্রের কাছ থেকে অডিটর হয়ে মিথিলের অফিসে আসে কঙ্কনা সিন্‌হা। তার দায়িত্ববোধ, ধৈর্য , যত্ন ও রুচিশীল ব্যবহারে ধীরে ধীরে একটু একটু করে মিথিলের মনের ফাঁকটা তার অজান্তেই কেমনভাবে যেন ভরে উঠছিল। সেই ভালোলাগার পরিভাষাটা দিনে দিনে বদলাতে লাগল কঙ্কানার জীবনে বাসবের দুর্বিষহ অত্যাচারের কারনে। বাসবের কন্ট্রাক্টরী ব্যবসার ঘাটা আর মাঝে মাঝে সাইকোপ্যাথের মত ভয়াবহ আচরণ দিনে দিনে কঙ্কনাকেও যেন মিথিলের দিকে এগিয়ে আনছিল…যার সর্বশেষ পরিনতি হল… কঙ্কনা ধীরে ধীরে মিথিলের কাছে কঙ্কা হয়ে উঠল আর দুজনের মাঝের অফিসিয়াল রিলেশনটা মুখ মুখোশের আড়ালে আনফিসিয়ালি মন ছেড়ে শরীরে এসে দানা বাঁধল। আর মানুষের মন তো পদ্ম পাতায় জল… যে সময় একটু একটু করে মিথিলের মন সৃঞ্জার থেকে কঙ্কার দিকে সরে যাচ্ছিল, সেই সময় মিথিল নিজের মনের সাথে লুকোচুরি খেলতে খেলতে একটাই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বেরাচ্ছিল …একসাথে কি দুজনকে ভালোবাসা যায় না ??? কঙ্কার কারণে সে তো আর সৃঞ্জাকে অবহেলা করছে না ! কই তার তো আগের মত নিজেকে আর ফাঁকা লাগে না, বেশ তো সৃঞ্জা আর কঙ্কাতে মনটা ভরেই রয়েছে তার …। কাজে কত মনযোগ দিতে পারছে ! তাছাড়া কঙ্কা অত ডিমান্ডিং ছিল না, আর সেও মিথিলের মধ্যে একটা পরম নিশ্চিন্ত আশ্রয় পেয়েছিল। ফলত দুজনার সম্পর্কের মাঝে খেয়া আর সেতু দুটোই গড়ে উঠেছিল ভাগ্যের নিপুণ চালে।মিথিলের মনে হয়েছিল, যে সম্পর্ক একে অন্যকে সমৃদ্ধ করছে সে সম্পর্ক খারাপ কেন হবে ? সৃঞ্জা যেমন তার নিজের স্পেস খুঁজে নিয়েছে তার বাবা মা ভাই বোন বন্ধু বান্ধবের মাঝে, ঠিক তেমনই মিথিলও স্পেস খুঁজেছে কঙ্কার মাঝে। এর মাঝে দোষের কি আছে? শুধু বিবেকের দংশন বলতে একটু সত্যগোপন অর্থাৎ লুকোচুরি…এটুকু মানিয়ে নিতেই হয়। … সত্যিই তো সারাজীবনে সব কথা কি সবাইকে বলার ? বলা যায় নাকি বলাটা উচিৎ। আর তাছাড়া সত্যগোপন আর মিথ্যাচার তো এক নয়?… এইভাবে বেশ কাটছিল দুজনের , দুজনের মাঝে এত সুন্দর বোঝাপড়ায় কোনো সমস্যাও ছিল না। আর মিথিল দিব্যি শ্যাম কূল বজায় রেখে জীবনটা উপভোগ করছিল। কিন্তু কোথা থেকে কি যে হল তাদের পাক্কা দু বছরের মধুর সম্পর্কটা কেমন যেন পান্‌সে হয়ে উঠতে লাগলো । ধীরে ধীরে কঙ্কা যেন কেমন বদলে যেতে লাগলো । যে ব্যালান্সটা মিথিল পাক্কা খেলোয়ারের মত করতে সক্ষম হচ্ছিল…কঙ্কা কিন্তু সত্যিই পারছিল না। তার পরিবারে মিথিলকে নিয়ে যতটা জল ঘোলা হয়েছিল তার থেকেও বেশি সে আত্মদহনে পুড়ছিল । মিথিলকে বোঝানোর চেষ্টা করলেও, মিথিল কিছুতেই বুঝতে চাইছিল না । আর খুব সত্যি বলতে ,জোর করে আর যাই হোক ভালোবাসা হয় না। তাই মিথিলের চাপাচাপিতে কঙ্কা ধীরে ধীরে শরীরে মনে স্থবির হয়ে যাচ্ছিল। এক অদ্ভুত মানসিক যন্ত্রনা হাত থেকে মুক্তি পেতে সে এড়িয়ে চলতে চাইছিল মিথিলকে। কিন্তু সে কথা মিথিলের উপলব্ধির বাইরে ছিল বোধহয় ।

……দিনের পর দিন বিভিন্ন অছিলায় কঙ্কা সরে থাকতে থাকতে শেষ পর্যন্ত একদিন মিথিলের সাথে টানাপড়েনটায় ইতি টেনেই দিয়েছিল। মিথিলের আজও বেশ মনে আছে কঙ্কার সাথে তার শেষ কথোপকথনটা । কঙ্কার মুখে তখন কেবলি একটাই কথা…
– মিথিলদা , আমার ভীষণ ক্লান্ত লাগছে ।
-কিসের ক্লান্তি কঙ্কা?
– একদিকে তুমি আর অন্যদিকে বাসব …আমি যেন ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছি। আমি অভিনয় করতে করতে হাঁফিয়ে উঠছি মিথিলদা …কোনটা আসল আর কোনটা অভিনয় আমার গুলিয়ে যাচ্ছে।
-অভিনয় বলছ কেন?
– অভিনয় নয়? বাসবের সাথে কি আমি মিথ্যে ভালোবাসার অভিনয় করছি না? আমি কি মেশিন মিথিলদা?
-আমি বুঝতে পারছি না তোমার অসুবিধেটা কোথায় হচ্ছে কঙ্কা ? আমরা সারাদিনে তো কাজের মাঝেও নিজেদের মধ্যে একটা কোয়ালিটি টাইম কাটাই কঙ্কা, তারপরও তুমি বলছ!!! আমি সারাদিন যতটা অ্যাটাচ্‌ড তোমার সাথে থাকি ফোনে , এস.এম.এস-এ ততটা আমি আমার ফ্যামিলিকেও সময় দিই না। …তুমি চাইলে আমি তোমাকে সময় দিই তো?
-কিন্তু মিথিলদা শুধু কি এইটুকুতেই শান্তি ? আমার তো একটা মন আছে বল । যখন তোমাকে কাছে পেতে ইচ্ছে করে বাসব এসে আমার অঙ্গরাজ্যের অধিকর্তা হয়ে বসে, বাসবের ছোঁয়া আর তোমার ছোঁয়া কি এক ?? তোমাকে চিন্তা করে যদি বা বাসবকে মেনেও নিয়ে বিছানায়, তবু অদ্ভুত একটা বৈসাদৃশ্য আমাকে ভীষণভাবে অতৃপ্ত করে তোলে…তখন আমার নিজের ওপরই রাগ হয়, ঘৃণা হয় … বিশ্বাস করো , কান্না পায় , একা লাগে…পাগল পাগল লাগে। মনে হয় আমি কি সাঙ্ঘাতিক ভুল করেছি তোমার সাথে নিজেকে জড়িয়ে। এভাবে আমি নিজেই নিজের কাছে ছোট হয়ে যাচ্ছি মিথিলদা । মনে প্রানে শরীরে ভালোবাসব তোমাকে আর বাসব তার স্বামীত্বের অধিকারে সহবাস করতে বাধ্য করবে আমাকে ওর সাথে। আমি এটা আর মানতে পারছি না ।
-দুররর, তুমি বড় বেশি ভাব কঙ্কা। এগুলোকে এত প্রশ্রয় দিতে নেই।
-না মিথিলদা না…আমার মনে হচ্ছে আমিও বোধহয় সাইকো হয়ে যাচ্ছি দিনে দিনে, প্রতারণা করছি সব চাইতে বেশি আমার সন্তানের সাথে। বুবুনের কি দোষ বলো ? ওকি পাচ্ছে ওর মাকে পুরোপুরি ? আমি কি নিজের সমস্যা নিয়ে ব্যস্ত থেকে ওকে অবহেলা করছি না? আমি কি পারছি ওকে একটা সুস্থ জীবন দিতে?
-কিন্তু তুমিই তো বলতে কঙ্কা বাসবের সাথে তোমার কোনোভাবেই মিলমিশ হয় না, ওর একগুয়েমি , অল্পশিক্ষা, প্রকারন্তরে অমানবিক আচরণ তোমাদের মাঝে দিনে দিনে একটা অদৃশ্য পাঁচিল তৈরি করে দিয়েছে! যে বাসবের হাত ধরে তুমি একদিন বাড়ি ছেড়েছিলে সেই বাসবকে আজ তোমার অচেনা লাগে , আর তুমি সেই বাসবকে আঁকড়ে ধরেই বা বাঁচবে কি করে? তুমি ওর থেকে সরে এসে স্বাধীনভাবে বাঁচো কঙ্কা । আমি যতটা পারব তোমাকে সাহায্য করব। আমি বলছি তুমি ভালো থাকবে।
-কিন্তু বুবুনের তো মা বাবা দুজনকেই চাই বলো…ওর তো আমাদের দুজনের হাত ধরেই বেড়ে ওঠার কথা। আর সত্যি বলো এতদিন ছিলাম তো এই অমিল নিয়েই ? তখন পারলাম কি করে? আসলে কি জানো মিথিলদা, মানুষষের কাছে বেশি অপশন থাকা উচিত নয়? তাহলেই মনের মাঝে না পাওয়াগুলো বড় বেশি খোঁচা মারে । মনে অস্থিরতা আসে , স্বার্থপরের মত নিজের ভালোটুকুই বুঝতে চায়… সত্যি বলতে তোমার সাথে সৃঞ্জার সম্পর্ক এতটা তিক্ত নয় তো , তাই তুমি আমার জ্বালাটা বুঝতে পারছো না। না , মিথিলদা , না…আমি অনেক ভেবেছি…আমি আর পারছি না…আমায় তুমি ক্ষমা কর … আমায় তুমি মুক্তি দাও!!!
ভাবনার সুতোটা তখনও ঠিকমতো কাটে নি …হঠাৎই ড্রাইভার ইকবাল গাড়িতে প্রচন্ড জোর ব্রেক কষলো । গাড়িটা থেমে গেল অফিসের একটু আগেই…ইকবাল চিৎকার করে উঠল,
-ওই শালা , শুয়ার কে পিল্লা , মরনা চাহতা হ্যায় ক্যায়া?
-কি হল ইকবাল ? গালি দিচ্ছ কেন?
-আরে সাব , আভি আভি চাক্কে কে নিচে চলা যাতা …শালা ভিখ মাঙ্গনেবালা!
… কাচের জানলার ভিতর দিয়ে মিথিল দেখল একটা বাচ্ছা ভিখারী ছেলে, যার কোমর থেকে বাকি শরীরটা একেবারেই অকেজ , দুটো হাত দিয়ে টেনে টেনে হেঁটে রাস্তাটা পেরিয়ে ফুটপাথে গিয়ে উঠল। রাস্তা পার হতে গিয়ে মিথিলে গাড়ির নীচে চলে যেত, আরেকটু হলেই। ছেলেটাকে অফিসের পাশে বেশ কয়েবার বসে থাকতে দেখেছে মিথিল আগে । মাঝে সাঝে জুলজুল করে চেয়ে থাকতে দেখে মিথিল পাঁচ দশটাকা দিয়েছেও …আজ গাড়ি থেকে মিথিল দেখল, এই প্রচন্ড ঠান্ডায় একট ছেঁড়া সোয়েটার পরে ন্যাড়া মাথায় ফুটপাথের এক পাশে মাথা নামিয়ে ইকবালের গালি খাচ্ছে। ইকবাল বলে যাচ্ছে,
– আবে বুরবক ইসতারা কই রাস্তা ক্রশ করতা হ্যায় ক্যায়া?
মিথিল বলল,
– গালি মাত দো , ছোড় দো ইকবাল, দের হো রাহা হ্যায় … গাড়ি পার্ক করনেকা জরুরত নেহি হ্যায়, মুঝে উতার জানে দো …অর তুম থোরাসা আগে যাকে গাড়ি ঘুমাকে , ঘর চলা যাও …মেমসাবকো বাহার যানা হ্যায় ।
…মিথিল গাড়ি থেকে নেমে ছেলেটার দিকে যেতে গিয়ে… একবার ঘড়িটা দেখল, তারপর আর সেদিকে না গিয়ে সোজা অফিসের দিকে হাঁটা লাগালো।
_______________________________________ক্রমশ

Series Navigation<< বল মন ‘সুখ’ বলবল মন ‘সুখ’ বল >>
© Copyright 2016 @indrila, All rights Reserved. Written For: Oimookh