পর্ব – ৬


     গেটের মুখেই অনীশকে সাদরে অভ্যর্থনা জানালেন জমির মালিক প্রবীণ সুকুমার দাস । ভদ্রলোক স্বভাবে বেশ অমায়িক । ঋত্বিকবাবুও নিজেদের পরিচয় দিলেন সুকুমার বাবুকে।ভদ্রলোকের উৎসাহ দেখে মনে হল, অম্বরীশ মিত্রের ফোন পেয়ে আগে থেকেই উনি সচেতন ছিলেন । সুকুমারবাবু অনীশকে বাড়ির ভিতর যাওয়ার জন্য অনুরোধ জানালেন । কিন্তু ঋত্বিকবাবু বললেন ,
-আগে জমিটা একটু ঘুরে দেখতে চাই।
-দেখবেন ক্ষণি , এতটা পথ আসলেন আগে একটু জিরিয়ে নিলে হত না?
-না না , ঠিক আছে এতটা পথ আর কোথায়!!
অগত্যা সুকুমারবাবু সম্মতিসূচক ঘাড় নেড়ে তার সঙ্গের মাঝবয়সী মানুষটির সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন…
-ও আমার ভাইপো সুশান্ত , ঠিক আছে যান তাহলে ওর সাথেই ঘুরে আসুন চারপাশটা …আমি আজকাল কোমরের ব্যথায় একটু কাবু হয়ে গেছি।
এতক্ষণ পর অনীশ কিছু বলল,
-সেকি? তাহলে তো আপনার কষ্টই হচ্ছে দাঁড়িয়ে থাকতে…
-না তেমন নয় …তবে বেশিক্ষণ দাঁড়াতে একটু অসুবিধে হয় ।
-ঠিক আছে, আপনি ভেতরে থাকুন আমরা একটু জায়গাটা দেখে নি, তারপর কথা বলছি।
-হ্যাঁ হ্যাঁ, অবশ্যই।
……সুশান্তবাবু অনীশ আর ঋত্বিকবাবুকে পুরো জমিটাই ঘুরে ঘুরে দেখাতে লাগলেন। সাড়ে এগারো কাঠা জমির মধ্যে সাত কাঠা জমিতে কারখানার শেড, গেট, স্টোর ,এমন কি একটা বড়ো মেশিন রুম পর্যন্তও করা আছে। সুকুমার বাবুর মাতামহের আমলে ওখানে একটি লেদ কারখানা ছিল। যা সুকুমার বাবু ধরে রাখতে পারেন নি ঠিকমতো , লিজে দিয়ে দিয়েছিলেন । বছর খানেক হল সেও উঠে গেছে। অনীশ চুপটি করে দেখে যাচ্ছিল সব, আর ঋত্বিকবাবুর সাথে সুশান্তবাবুর কথা হচ্ছিল মাঝে সাঝে । সুশান্ত বাবু বলে চললেন,
-এখন এই পুরো জায়গাটাই ফাঁকা পড়ে আছে। ভিতরের দিকে বাকি সাড়ে চার কাঠা জমিতে কাকার নিজস্ব বাড়ি আর একটি বাঁধানো পুকুর আছে, পুকুরের ধারে অল্প একটু বাগান।
-তাহলে তো আপনাদের এ সব দেখাশোনা করার জন্য প্রচুর লোক আছে?
-হ্যাঁ তা ছিল এককালে …চাকর বাকরে বাড়ি গমগম করতো। এখন অবশ্য কেউই নেই সেরকম , তাই এসব আমিই একটু দেখভাল করি। এইসব জমিজমা ছোট কাকার মাতৃকূলের সম্পত্তি । আমাদের আসল বাড়ি তারকেশ্বর লাইনে …..আমার বাবা আর ছোট কাকার বাবা ছিলেন ভাই ভাই। কাকা বিয়ে থা করেন নি…শৌখীন মানুষ ছিলেন …একা দেখাশোনা করে উঠতে পারতেন না…তাই আমাকে ডেকে নিয়েছিলেন । তা বেশ কয়েক বছর আগের কথা।
-আচ্ছা জমি বিক্রি মানে তো কারখানাটা সমেতই বিক্রি করতে হবে…আর তাহলে আপনারা কি ঐ বাকি অংশটুকুতেই থাকবেন?
-দেখি কাকা কি বলেন? আসলে ব্যবসাটা বন্ধ হয়ে যেতে এখন একটু অবস্থাটা পড়ে গেছে তো…তাই কাকা এখানে আর থাকতেও চাইছেন না , বলছেন তারকেশ্বর চলে যাবেন । কিন্তু বাড়িটার ওপর তো একটা মায়া পড়ে গেছে …দেখি কি বলেন…উনি যা বলবেন।

……জায়গা দেখা শেষে সুশান্তবাবু বাড়ির ভেতর ওনাদেরকে নিয়ে আসলেন……সামনের বারান্দা পেরিয়ে বৈঠকখানায় নিয়ে এসে বসালেন। বাড়িটা বেশ পুরোনো আমলেরই… আসবাবপত্রও বেশ পুরোনো দিনের , সেই সাদা নাইলন তারে বোনা কাঠের সোফা …একটা কাঠের গোল টেবিল …উল্টোদিকে একটা আরাম কেদারায় সুকুমারবাবু বসে ছিলেন। অনীশকে দেখে বললেন,
-আসুন আসুন …কি দেখা হল জমি ?…
-হ্যাঁ …
-কেমন দেখলেন বলুন?
-ভালোই…
-সুশান্ত একটু চায়ের কথা বলে এস তো দেখি ভেতরে।
অনীশ বলে উঠল,
-না না চায়ের তেমন প্রয়োজন নেই একটু জল খাব ।
-আরে তা বললে হবে নাকি? জলও খাবেন, চাও খাবেন।
…কথার ফাঁকে ঋত্বিকবাবু কাগজপত্রগুলো দেখতে চাইলেন ।অনীশ খুব অস্বস্তিতে পরে গেল এদের আপ্যায়নে । সুকুমারবাবু সত্যি বেশ অসুস্থ, তাই সুশান্তবাবুই দেরাজের চাবি খুলে জমির দলিলপত্র বার করতে উদ্যোগী হলেন। জমির দাম কাগজপত্র এসব নিয়ে যতক্ষণ কথা হতে লাগল ততক্ষণে সুশান্তবাবু অনীশ আর ঋত্বিকের জন্য একটু জল মিষ্টির তৎপরতা করতে বাড়ির ভেতরে গেলেন । রান্নাঘর থেকে ঘুরে এসেই আবার সুশান্তবাবু তার কাকার নির্দেশের জন্য দাঁড়িয়ে রইলেন ঘরের এক কোণায় । একটু পরেই অনীশের কানে একটা হালকা নূপুরের শব্দ এলো……হাজার চেষ্টা করেও নিজেকে সংযত করতে পারল না অনীশ, তার চোখ সেই শব্দ অনুসরণ করে চলে গেল ঘরের দরজার দিকে, দেখল পর্দার আড়ালে একজোড়া আলতা পড়া পা।…অনীশের অন্যমনস্কতা দেখে সুশান্তবাবুও সেই দৃষ্টি অনুসরণ করে এগিয়ে গেলেন দরজার মুখে, পর্দাটা ঈষৎ তুলে খাবারের ট্রে টা হাতে করে নিয়ে এসে অনীশের সামনে কাঠের টেবিলে রাখলেন। একপলকে যতটুকু চোখে পড়ে অনীশ দেখল ঘোমটা দেওয়া একজন মহিলার শাঁখা পলা পড়া হাত, যার পরনে হলুদ রঙের জমি , আর বেগুনী পাড়ের তাঁতের শাড়ী । সুশান্তবাবু খাবারের ট্রে থেকে দুটি কাচের ডিশ ওনাদের সামনে সাজিয়ে রাখলেন। গরম লুচি, ছোলার ডাল, আলুরদম, দু তিন রকম মিষ্টি …এতসব দেখে দুজনেই কেমন লজ্জা পেয়ে গেল । ঋত্বিকবাবু বললেন,
-বাবা এত আয়োজন ?
অনীশ একটু হেসে বলল,
-এত খেতে পারা যাবে না।
সেই শুনে সুকুমার বাবু হাসলেন ,
-আরে মশাই খেয়ে নিন, খুবই সামান্য কিছু , তাজা বয়স আপনাদের , আর এই তো খাওয়ার সময়…আপনাদের বয়সে আমরা কত খেতাম জানেন!! সত্যি আজ ভাবি সে একটা দিন ছিল বটে !!!
…নিজের মনেই কেমন যেন হেসে উঠলেন সুকুমার বাবু….তারপর সুশান্তবাবুকে বললেন ,
-ওনারা ততক্ষণ খান তুমি বরং জমির দলিল আর পরচার কাগজগুলোকে জেরক্স করে নিয়ে এস সুশান্ত ।
সুশান্তবাবু বেরিয়ে গেলেন কাকার হুকুমে। একটু পরে অনীশের চোখে পড়ল পর্দার বাইরে একটা ছায়ার নড়ে চড়ে ওঠা …আর একগোছা চুড়ির রিনরিন মৃদুশব্দ …দরজায় ঈষৎ টোকা পড়ায় সুকুমার বাবু বললেন,
-চা এনেছ তো ? ভেতরে এস বউমা। ওনারা কলকাতা থেকে এসেছেন।
ভদ্রমহিলা পর্দা সরিয়ে ভেতরে আসলেন। মাথার ওপর ঘোমটা টানা , কাপড়ের কোনাটা দাঁত দিয়ে কামড়ে রাখা… সুকুমার বাবু বললেন , ও সুশান্তর স্ত্রী, বউমার বাপের বাড়িও কোলকাতায় …কালিঘাটে…। কালিঘাট নামটা শুনেই অনীশ নিজের অজান্তেই চোখ তুলে চাইল… চায়ের ট্রে টা টেবিলে নামিয়ে রেখে, ভদ্রমহিলা দাঁতে চেপে রাখা ঘোমটার কোনাটা ছেড়ে , হাতে করে মাথায় কাপড়টা টেনে নিল। তারপর ঘোমটার ফাঁক দিয়ে ডাগর চোখে এক পলক অনীশের চোখে চোখ রেখে বলল,
-কিছুই তো খাওয়া হয় নি দেখছি । কথাটা কানে শিহরণ তুলল অনীশের , অবাক চোখে তাকিয়ে দেখল কপালের লাল সিঁদুরের বড়ো টিপ আর নাকছাবির ঝিকিমিকিতে এক অপরূপ লাবণ্য। অনীশ যেন হাসতে ভুলে গেল। তার পৃথিবীটা কোনদিনই তেমন রঙীন ছিল না তবু যেটুকু রঙ তার মনের অগোচরে লুকিয়ে ছিল সব যেন কেমন এই কারখানা সংলগ্ন বাড়ির পরিবেশে ধূসর হয়ে উঠল সুশান্তবাবুর স্ত্রীকে এক ঝলক দেখে…ছ’বছর পড়ে এমন মলিন পরিবেশে দেখেও , অনীশের চিন্তে একটুও অসুবিধে হল না, সুশান্তবাবুর স্ত্রী আসলে কুরচি ছাড়া আর কেউ নয়।… অনীশ কেমন হারিয়ে গেল তার পুরোনো দিনগুলোয়… সেই সরস্বতী পুজোয় বাসন্তী শাড়িতে দেখা কুরচির ছেলেবেলার ছটফটে রূপে…যদিও আজকের দেখা কুরচি অনেক সুন্দর অনেক পরিণত, তবুও কোথাও যেন তারমধ্যে একটা ছেলেমানুষি অস্থিরতা আজও অমলিন রয়েছে……যেন তাই অনীশকে জানান দেওয়ার জন্যই তার এমন আগমন । অনীশের মুখে কোনও কথা সরছিল না। …চা নামিয়ে রেখে কুরচি চলে গেল অনীশের সামনে দিয়ে …..কুরচি চলে যাবার সাথে সাথে এক অদ্ভুত আকুলতা অনীশকে ঘিরে ধরল!! তার খুব জানতে ইচ্ছে করছিল কেমন আছে কুরচি ? খুশি আছে তো? সুশান্তবাবুর সাথে বয়সের ফারাক অনেকটা হওয়া সত্ত্বেও বিবাহিত জীবনে সে সুখী তো? অনীশকে কি আজও মনে পড়ে তার, নাকি ভুলেই গেছে সে?….কিন্তু এসব জানার আর অবকাশ কই?? ?..একরাশ খারাপ লাগা আর দমচাপা অস্বস্তি নিয়ে অনীশের আর ভালো লাগছিল না এখানে থাকতে …কেমন যেন অধৈর্য লাগছিল…ঋত্বিকবাবু সব খেয়ে নিলেও …অনীশের প্লেটে সবই পড়ে রইল…চা টাও কেমন যেন নামতে চাইছিল না গলা দিয়ে। কি কথা হচ্ছিল কানে যাচ্ছিল না তার । ওদিকে সুকুমার বাবু বলে যাচ্ছিলেন…
-আমি তো অকৃতদার….. সুশান্ত আমার সাথে এখানে আছে অনেকগুলো বছর……বিয়ে করবে না ,করবে না করে…শেষমেশ একটু বয়সেই বিয়ে করল…এখন একটি বছর তিনেকের ছেলে হয়েছে …বউমা বেশ চালাক চতুর গোছানো , আমার যা কিছু সব ওদেরই থাকবে … ঐ আমার সব জমিজমা কারখানা দেখাশোনা করত এতদিন …সত্যি বলতে আগের কোম্পানির সাথে লিজটা আর চালাতে চাইনি ….জমিটা তো ফাঁকাই পড়েছিল…বিজ্ঞাপন দিলাম , আপনারা কাগজ দেখে যোগাযোগ করলেন …যা হোক দেখে শুনে যাচ্ছেন …অম্বরীশ বাবুর সাথে কথা বলুন, দেখুন কি বলেন? ঋত্বিক তার ফাঁকা প্লেটেই হাতটা ধুয়ে নিল…কিন্তু অনীশ একটু ইতস্তত করে বলল ,
-হাত টা একটু…
-হাত ধোবেন? কিন্তু আপনি তো কিচ্ছুই খেলেন না? বউমা?
গলাটা তুলে একটু ডাক দিতেই কুরচি পর্দার আড়ালে এসে দাঁড়ালো…তার নূপুরের আওয়াজে সুকুমার বাবু বললেন ,
– ওনাকে একটু ভেতরে নিয়ে যাও তো , উনি হাত ধোবেন।
কুরচি বলল,
-ভেতরে আসুন…
বৈঠকখানা থেকে বেড়িয়ে দোতলায় ওঠার সিঁড়ির একপাশে একটা বেসিনে গিয়ে হাত ধুলো অনীশ… দেখল কুরচি কেমন পরিপূর্ণ রূপে দাঁড়িয়ে আছে, হয়ত কিছু বলার জন্য …কিন্তু দুজনের মাঝে কিছু শব্দ বিনিময় হওয়ার আগেই সুশান্তবাবুকে আসতে দেখেই কুরচি সরে গেল সিঁড়ির নিচে ।সুশান্তবাবু বেসিনের পাশে রাখা তোয়ালেটা হাত মোছার জন্য এগিয়ে দিয়ে বললেন,
-এই নিন, আপনি তো কিছুই খেলেন না ।
অনীশ ঈষৎ হাসল , দেখল দূরে বারান্দায় একটি মেয়ে একটি বাচ্চা ছেলেকে কোলে নিয়ে খাঁচায় রাখা পাখির সাথে খেলছে…বাচ্ছাটার আদুরে মুখ…বড়োবড়ো চোখ…কপালে কাজলের টিপ, তার মন বলছিল, ‘এই কুরচির সন্তান ।’

……অনীশ বৈঠকখানায় ফিরে আসার পর কাগজপত্রের জেরক্স নিয়ে উঠে পড়ল ঋত্বিকবাবু…সবাই বৈঠক খানা ছাড়িয়ে এগিয়ে গেল বারান্দার দিকে… তারপর সুকুমারবাবু আর সুশান্তবাবুর সাথে কথা বলতে বলতে গেটের কাছে পৌঁছে …ফিরে দেখবে না ভেবেও একবার ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকালো অনীশ…, অনীশের চোখজোড়া কেমন যেন তন্ন তন্ন করে খুঁজতে লাগল কুরচিকে… নাহ, কেউ নেই বারান্দায় … মুখটা সামনের দিকে ফেরাতে গিয়ে হঠাৎ মনে হল দোতলার একটা জানলায় হলুদ শাড়িতে কেউ দাঁড়িয়ে আছে …আর একবার ফিরে তাকাতেই সরে গেল অবয়বটা ।…সুকুমার বাবু পুরো পথটা না আসলেও সুশান্তবাবু শেষ পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন। অনীশ আরও একবার ভালো করে চেয়ে দেখল সুশান্ত বাবুর দিকে…।না কোনও অসহিষ্ণুতা বা হিংসে নিয়ে নয় বরং উনি যে কুরচির স্বামী …এই অনুভবটায় কেমন যেন একটা আত্মিক টান অনুভব করল সে তার মনের মধ্যে …তাই নিজে থেকেই তার সাথে হাত মিলিয়ে বলল,
-চলি তাহলে…আজকের মত। বাবা ফোন করবেন পড়ে।
-আচ্ছা ।
-ভাল থাকবেন।
-আপনিও ।

দুজনের মধ্যে হালকা একটু হাসি বিনিময়ের পর……অনীশ গাড়িতে এসে বসল ঋত্বিক বাবুর পাশে। গাড়ি স্টার্ট নিয়ে এগিয়ে চলল সামনের দিকে…আর অনীশ গাড়ির আয়নার মধ্যে দিয়ে অপলকে তাকিয়ে রইল কারখানার শেডের ওপর থেকে দূরে মাথা উঁচিয়ে থাকা কুরচির বাড়ির ছাদের পাঁচিলটুকুর দিকে…।ক্রমশ তা যেন অদৃশ্য হয়ে যেতে লাগল গাড়ির গতি বাড়ার সাথে সাথে । আর একটু এগিয়েই রাস্তা বাঁক নিল মোড়ের মাথায়……॥

……………………………………………………… ক্রমশ


Series Navigation<< প্ল্যাটফর্ম নম্বর তেরো /৫প্ল্যাটফর্ম নম্বর তেরো/৭ >>
© Copyright 2014 @indrila, All rights Reserved. Written For: Oimookh