পর্ব – ৫
অনীশ বেশ থাকতে পারে নিজের মত। একা একা সময়ও কাটাতে পারে… কখনও সিনেমা থিয়েটারে, কখনও গাড়িতে লঙ-ড্রাইভে, আবার কখনো গড়ের মাঠে। তাই কখনো ব্যবসার কাজে বাইরে গেলে তার খারাপ লাগে না… সে নিজেকে দিব্যি রাস্তাঘাট, দোকানপাট, লোকজন, ধানক্ষেত, খানা-খন্দ, পুকুর-ডোবা, এই সবকিছুর মাঝেই হারিয়ে ফেলতে পারে…শুধু দিনের শেষে সবাই যখন ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে থাকে তখন এক-একদিন তার ভীষণ চোখ জ্বালা করে , মনে পড়ে কুরচির কথা …তাদের সেই ছেলেবেলার ভালোবাসার খুনসুটির কথা।
কুরচির কথা ভাবতে ভাবতে অনীশ তার বারান্দার রকিং চেয়ারে শরীরটা এলিয়ে দেয় …বেশ কয়েক বছর আগের কথা তখন কুরচির সামনে গোটা পৃথিবীটা বড়ো ফ্যাকাসে …জীবনটা বড়ো দুর্বিষহ তার বাবার হঠাৎ মারা যাওয়ায়…কুরচি আর তার মা যেন দিনকে দিন তার কাকার পরিবারে গলগ্রহ হয়ে উঠছে……নিত্যদিন উঠতে বসতে তার মেয়ে হয়ে জন্মানোটা তার নিজের চোখেই অপরাধ বলে অনুভূত হচ্ছে…… অথচ কুরচি তখনও কলেজের গণ্ডী পেরোয় নি। ওদিকে অনীশ তখন পড়াশোনার সাথে সাথে একটু আধটু লেখালিখি করছে…একটা দুটো লেখা ম্যাগাজিনে বেরতেও শুরু করেছে… কুরচির সেই অত্যন্ত স্ট্রাগলের দিনগুলোতে অনীশ কুরচির পাশে থাকতে চেয়ে বলেছিল ,
-চল না কুরচি …কোথাও চলে যাই…তুই আর আমি। পারবি না একটু সাহস
করতে… ।
-একটু সবুর কর অনি । বাড়ির পরিবেশটা একটু শান্ত হয়ে যাক…তারপর সব ছেড়ে ছুড়ে শুধু তুই আর আমি।
-দেখিস, আমি ঠিক চালিয়ে নেবো।
-হুম জানি…তুই এর মধ্যে একটা কাজ খুঁজে ফেল… আর আমিও বাড়িটাকে একটু গুছিয়ে নি… আচ্ছা অনি তোর বাবা মানবেন না, না আমাদের এই সম্পর্কটা?
-বাবা নাই বা মানলো … আমি আছি তো, তুই আমায় ভরসা করিস না?
-করি তো…কিন্তু?
-তাহলে আর কোনও কিন্তু নয়। আমি জানি মা আপত্তি করবে না।ইতিমধ্যেই অম্বরীশ তার ছেলের ব্যাপারটা জানতে পেরেছিলেন কানাঘুষোয়…..বার কয়েক চোখেও পড়েছিল ঈষৎ শ্যামলা কুরচিকে অনীশের রাজপুত্রের মতো চেহারাটার পাশে …অনীশকে শুনিয়ে বসুধাকে বলেছিলেন, ‘অনীশ যদি তাঁর কথা না শুনে চলে তাহলে যেন নিজের রাস্তা নিজেই দেখে নেয়… স্বেচ্ছাচারিতা করলে এ বাড়িতে তার কোনও জায়গা হবে না । ‘ আসলে অম্বরীশ অনীশের পাশে কুরচিকে ঠিক মানতে পারেন নি, হয়ত তার পারিবারিক পরিকাঠামোর জন্যই। একবার একা কুরচিকে বাজার করতে দেখে গাড়ি দাঁড় করিয়ে অম্বরীশ কটমটে চোখে তাকিয়ে অপমান করেছিলেন তাকে দম্ভের বশে… অনীশের আজও মনে পড়ে কুরচি অপমানে আহত হয়ে অনীশের বুকে মাথা রেখে কেঁদে ফেলেছিল…আর অনীশ তার মাথায় হাত রেখে খোলা চুলে হাত বুলিয়ে বলেছিল…
-ক্ষমা করে দে কুরচি …ওনার মিথ্যে অহংকারে তোকে ছোটো করতে চেয়ে উনি নিজেই ছোটো হয়ে গেছেন অজান্তে… যখন উনি বুঝবেন তখন নিজেই লজ্জা পাবেন…ওনার চোখ রাঙ্গানিতে কি আমি তোর হাত ছেড়ে দেব?…কুরচি অনীশকে আঁকড়ে ধরে বলেছিল…
-কথা দে অনি , কোনওদিন আমাকে একা ছেড়ে দিবি না তো?
-কথা তো আগেই দিয়েছি কুরচি…আমি যে তোকে ছাড়া অসম্পূর্ণ ।
…সেই প্রথম অনীশ অবাধে ঠোঁট ছুঁয়েছিল কুরচির …ভাবতে ভাবতে অর্ধেক রাত কেটে যায় অনীশের…অপরিসীম ভালবাসার স্মৃতিতে চোখ বুজে আসে তার ।মাঝরাতে ঘুম ভেঙ্গে গেলে পাশটা খালি খালি ঠেকে পৃথার, উঠে পড়ে বিছানা থেকে, বাইরের বারান্দায় এসে ঘুমন্ত অনিকে রকিং চেয়ারে শুয়ে থাকতে দেখে তার চোখের চশমাটা খুলে পরম মমতায় গায়ে একটা চাদর চাপা দিয়ে দেয় । পৃথা জানে অনীশের মাঝে মাঝে একটু একা থাকার দরকার হয় । তাই তার নিজের ভালো না লাগলেও একটু সরে থেকে অনীশকে সেই জায়গাটুকু দেয় পৃথা।
………ঘুমের মধ্যে অনির কানে বাজতে থাকে খাপছাড়া কিছু কথা…এলোমেলো কিছু শব্দ…চারদিকে কেমন যেন সবুজের আঘ্রান…এক রাশ খোলা হাওয়া …কিন্তু হঠাৎ যেন পরিবেশটা গুমোট হয়ে যায়… মনে আসে কিসের একটা উদ্বেগ …কেমন একটা চাঞ্চল্য …এত ভিড় কেন চারিদিকে…কেমন যেন চাপাচাপি…অনীশ চেষ্টা করতে থাকে ভিড় ঠেলে সামনে এগোতে কিন্তু অসম্ভব ধস্তাধস্তি হতে থাকে… কানে আসে কিছু অশালীন মন্তব্য…তার পায়ের নিচের মাটিটা দুলতে থাকে…সে যেন এতক্ষণ একটা ট্রেনের ভিতর ছিল… প্লাটফর্মের একটা তীব্র ঝাঁঝালো গন্ধ নাকে আসছে… ট্রেনটা কি ছেড়ে দিল?… প্ল্যাটফর্মটা সরে সরে যাচ্ছে……কিন্তু তাকে তো নামতেই হবে!!!যে ভাবেই হোক তাকে ঐ চলন্ত ট্রেন থেকে নামতেই হবে…ভয়ানক একটা উত্তেজনা আর দমচাপা কষ্ট… কিছু চোরা চোখের চাউনি…বিশ্রী হাসি আর প্রবল উপেক্ষা নিয়ে অনীশ রাগে লজ্জায় অভিমানে বুকের বাঁদিকটা খামচে ধরে… আর সঙ্গে সঙ্গে একটা চেন টানার কর্কশ আওয়াজে অস্ফুটে তার গলা দিয়ে বেরিয়ে আসে একটা স্বর…
-আঃ
চোখ মেলে অনীশ দেখে পৃথা গাছে জল দিচ্ছে…অনীশের দিকে না ফিরেই পৃথা বলে উঠল…
-আবার নিশ্চয়ই স্বপ্ন দেখছিলে? এই যে মশাই…কাল রাতে কি আমাকে এতটাই অসহ্য লাগছিল যে ব্যালকনিতে এসে ঘুমোতে হল?
-ইসসস্ ঘুমিয়ে গেছিলাম এখানেই ? ডাকোনি কেন?
-কি জানি বাবা…লেখালেখি করে কত রাতে শুয়েছ কে জানে !
চোখমুখ দুহাতে ডলে রকিং চেয়ার থেকে উঠতে গিয়ে গায়ের চাদরটা মাটিতে পরে যেতে দেখে অনীশ একটু আদুরে গলায় বলে…
-আবার গায়ে চাপা দিয়ে দিয়েছিলে? আমার চশমা কই?
-ঘুমোচ্ছ দেখে আর ডাকি নি গো …শুধু শীতে কুঁকড়ে শুয়েছিলে তাই গায়ে চাদরটা দিয়ে দিয়েছি আর চশমাটা খুলে ঘরে রেখেছি … পিসিমনি আছেন খেয়াল আছে কি ? যাও ফ্রেশ হয়ে ডাইনিং-এ যাও। বাবা আজ বেরোবেন না বলেছেন …হয়ত তোমাকেই অফিসে যেতে হবে…কোথায় যেন একটা যাওয়ার কথা বলছিলেন।……ডাইনিং এ এসে অনীশ দেখে বেশ জমাটি আড্ডা চলছে…চা পর্ব প্রায় শেষ। অনীশকে দেখে পিসিমনি বলেন “কিরে ঘুম ভাঙল? তোর ছেলের কি মিষ্টি মিষ্টি কথা রে!”….. পিসিমনির কথায় অনীশ জানতে পারে পেলে বলেছে যে , দাদাই নাকি ওর থেকেও বেশি ব’কে বাবাইকে আর বাড়িতে সবাই বলে, পেলের বাবা পেলের চেয়েও ছোটো ।অনীশ একটু অপ্রস্তুত হাসে পিসিমনির কথায়…অম্বরীশ খবরের কাগজে চোখ বোলাচ্ছিলেন অনীশকে দেখে বলে ওঠেন,
-ভালোই হয়েছে উঠে পড়েছ…তৈরি হয়ে নাও…তোমাকে একবার দাশনগরের দিকে যেতে হবে আজ…ঐ ওয়ার্কশপের জমিটার ব্যাপারে। আজ আমি যেতে পারব না…ঋত্বিক যাবে তোমার সাথে।
-আজই? কিন্তু আমি একা দেখে কি বুঝবো?
-কেন? বুঝবে নাই বা কেন?…আগে তো প্লটটা দেখে এসো… ওদের কাগজপত্রের কপি নিয়ে এসো… আমি অ্যাডভোকেট অরুনাংশুকে দেখাই তারপর তো ফাইনাল করার সময় আমি যাবই…জমি-জায়গা তো একবার দেখায় কেনাকাটি হয় না!!
-ঠিক আছে কখন বেরোতে হবে বলো…আমি অফিসে গিয়ে ঋত্বিকের সাথে কথা বলে তোমায় জানাচ্ছি।
……অফিসে ঢুকে অনীশ ম্যানেজার বাবুকে সব বুঝিয়ে অম্বরীশের টেকনিক্যাল অ্যাডভাইজার ঋত্বিকবাবুকে নিয়ে বেড়িয়ে পড়লো… অফিসে চুপচাপ বসে থাকার চাইতে অনীশের গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়তে ভালোই লাগে। ব্যস্ত কলকাতার যানজট পেরিয়ে …গাড়ির ক্র্যাকাফনি ছাড়িয়ে কোনা এক্সপ্রেস ওয়ে দিয়ে গাড়ি ছুটে চলল… গাড়ির ভেতর সুমনের গান চলছে ‘কতটা পথ পেরোলে তবে পথিক বলা যায়…কতটা পথ পেরোলে পাখি জিরোবে তার দায়…কতটা অপচয়ের পর মানুষ চেনা যায় …প্রশ্নগুলো সহজ আর উত্তরও জানা’
…অনীশ যেন কেমন নস্টালজিক হয়ে পড়ছে… সত্যি কত কত সময়ের অপচয় হয়ে গেছে জীবনে, আজও অনীশ নিজের পরিচয় গড়ে তুলতে পারে নি। কুরচির দেখা অনীশ আর পৃথার দেখা অনীশের মধ্যে কতটুকুই বা পার্থক্য হয়েছে? কিই বা দিতে পেরেছে তার পরিবারকে সে… অথচ তার বাবা নয় নয় করে তাদের এই ব্যবসাকে আজ এমন জায়গায় দাঁড় করিয়েছেন যে মোটামুটি এই ল্যাব ইন্সট্রুমেন্টের ব্যবসায় তারা অনেক বছর বেশ একাধিপত্য বিস্তার করে আছে… চারটে ওয়ার্কশপ তো আছেই ,আর যদি এই দাশনগরের জায়গাটা ফাইনাল হয় তবে এটা পাঁচ নম্বর ওয়ার্কশপ হবে । দাশনগরে সাড়ে এগারো কাটা একটা জমির ন’কাটা বিক্রি আছে …আর এই ব্যাপারে কথা বলতেই সে আর ঋত্বিক বাবু চলেছে জমির মালিকের সাথে কথা বলতে। এইসব দিকে অনীশ আগে কখনও আসেনি… চারপাশের রাস্তাঘাট দোকানপাট সব যেন জলছবির মত সরে সরে যাচ্ছে। দৃশ্যপট বদলে যাচ্ছে পলকে…শহর ছেড়ে শহরতলী…মাঠঘাট পুকুর জলা জঙ্গল পেরিয়ে তাদের গাড়ি ছুটে চলেছে … অতঃপর বেশ কিছু সময় পরে বাসস্ট্যান্ড থেকে কিছুটা ভেতরের দিকে নির্দিষ্টস্থানে এসে পৌঁছালো অনীশ আর ঋত্বিক …চারদিক উঁচু পাঁচিলে ঘেরা বেশ বড়ো একটা কারখানার শেড চোখে পড়ল তাদের বাইরে থেকে … লোহার গেটের মুখে এসে হর্ন দিতেই অনীশ দেখল ভেতর থেকে গেট খুলে দিল এক মাঝবয়সী ভদ্রলোক আর ততক্ষণে তাদের গাড়ির আওয়াজ শুনে গেটের কাছে এগিয়ে আসছেন আরেকজন বেশ বয়স্ক ভদ্রলোক।
…………………….. …………………….. …………………….. …………….ক্রমশঃ
কুরচির কথা ভাবতে ভাবতে অনীশ তার বারান্দার রকিং চেয়ারে শরীরটা এলিয়ে দেয় …বেশ কয়েক বছর আগের কথা তখন কুরচির সামনে গোটা পৃথিবীটা বড়ো ফ্যাকাসে …জীবনটা বড়ো দুর্বিষহ তার বাবার হঠাৎ মারা যাওয়ায়…কুরচি আর তার মা যেন দিনকে দিন তার কাকার পরিবারে গলগ্রহ হয়ে উঠছে……নিত্যদিন উঠতে বসতে তার মেয়ে হয়ে জন্মানোটা তার নিজের চোখেই অপরাধ বলে অনুভূত হচ্ছে…… অথচ কুরচি তখনও কলেজের গণ্ডী পেরোয় নি। ওদিকে অনীশ তখন পড়াশোনার সাথে সাথে একটু আধটু লেখালিখি করছে…একটা দুটো লেখা ম্যাগাজিনে বেরতেও শুরু করেছে… কুরচির সেই অত্যন্ত স্ট্রাগলের দিনগুলোতে অনীশ কুরচির পাশে থাকতে চেয়ে বলেছিল ,
-চল না কুরচি …কোথাও চলে যাই…তুই আর আমি। পারবি না একটু সাহস
করতে… ।
-একটু সবুর কর অনি । বাড়ির পরিবেশটা একটু শান্ত হয়ে যাক…তারপর সব ছেড়ে ছুড়ে শুধু তুই আর আমি।
-দেখিস, আমি ঠিক চালিয়ে নেবো।
-হুম জানি…তুই এর মধ্যে একটা কাজ খুঁজে ফেল… আর আমিও বাড়িটাকে একটু গুছিয়ে নি… আচ্ছা অনি তোর বাবা মানবেন না, না আমাদের এই সম্পর্কটা?
-বাবা নাই বা মানলো … আমি আছি তো, তুই আমায় ভরসা করিস না?
-করি তো…কিন্তু?
-তাহলে আর কোনও কিন্তু নয়। আমি জানি মা আপত্তি করবে না।ইতিমধ্যেই অম্বরীশ তার ছেলের ব্যাপারটা জানতে পেরেছিলেন কানাঘুষোয়…..বার কয়েক চোখেও পড়েছিল ঈষৎ শ্যামলা কুরচিকে অনীশের রাজপুত্রের মতো চেহারাটার পাশে …অনীশকে শুনিয়ে বসুধাকে বলেছিলেন, ‘অনীশ যদি তাঁর কথা না শুনে চলে তাহলে যেন নিজের রাস্তা নিজেই দেখে নেয়… স্বেচ্ছাচারিতা করলে এ বাড়িতে তার কোনও জায়গা হবে না । ‘ আসলে অম্বরীশ অনীশের পাশে কুরচিকে ঠিক মানতে পারেন নি, হয়ত তার পারিবারিক পরিকাঠামোর জন্যই। একবার একা কুরচিকে বাজার করতে দেখে গাড়ি দাঁড় করিয়ে অম্বরীশ কটমটে চোখে তাকিয়ে অপমান করেছিলেন তাকে দম্ভের বশে… অনীশের আজও মনে পড়ে কুরচি অপমানে আহত হয়ে অনীশের বুকে মাথা রেখে কেঁদে ফেলেছিল…আর অনীশ তার মাথায় হাত রেখে খোলা চুলে হাত বুলিয়ে বলেছিল…
-ক্ষমা করে দে কুরচি …ওনার মিথ্যে অহংকারে তোকে ছোটো করতে চেয়ে উনি নিজেই ছোটো হয়ে গেছেন অজান্তে… যখন উনি বুঝবেন তখন নিজেই লজ্জা পাবেন…ওনার চোখ রাঙ্গানিতে কি আমি তোর হাত ছেড়ে দেব?…কুরচি অনীশকে আঁকড়ে ধরে বলেছিল…
-কথা দে অনি , কোনওদিন আমাকে একা ছেড়ে দিবি না তো?
-কথা তো আগেই দিয়েছি কুরচি…আমি যে তোকে ছাড়া অসম্পূর্ণ ।
…সেই প্রথম অনীশ অবাধে ঠোঁট ছুঁয়েছিল কুরচির …ভাবতে ভাবতে অর্ধেক রাত কেটে যায় অনীশের…অপরিসীম ভালবাসার স্মৃতিতে চোখ বুজে আসে তার ।মাঝরাতে ঘুম ভেঙ্গে গেলে পাশটা খালি খালি ঠেকে পৃথার, উঠে পড়ে বিছানা থেকে, বাইরের বারান্দায় এসে ঘুমন্ত অনিকে রকিং চেয়ারে শুয়ে থাকতে দেখে তার চোখের চশমাটা খুলে পরম মমতায় গায়ে একটা চাদর চাপা দিয়ে দেয় । পৃথা জানে অনীশের মাঝে মাঝে একটু একা থাকার দরকার হয় । তাই তার নিজের ভালো না লাগলেও একটু সরে থেকে অনীশকে সেই জায়গাটুকু দেয় পৃথা।
………ঘুমের মধ্যে অনির কানে বাজতে থাকে খাপছাড়া কিছু কথা…এলোমেলো কিছু শব্দ…চারদিকে কেমন যেন সবুজের আঘ্রান…এক রাশ খোলা হাওয়া …কিন্তু হঠাৎ যেন পরিবেশটা গুমোট হয়ে যায়… মনে আসে কিসের একটা উদ্বেগ …কেমন একটা চাঞ্চল্য …এত ভিড় কেন চারিদিকে…কেমন যেন চাপাচাপি…অনীশ চেষ্টা করতে থাকে ভিড় ঠেলে সামনে এগোতে কিন্তু অসম্ভব ধস্তাধস্তি হতে থাকে… কানে আসে কিছু অশালীন মন্তব্য…তার পায়ের নিচের মাটিটা দুলতে থাকে…সে যেন এতক্ষণ একটা ট্রেনের ভিতর ছিল… প্লাটফর্মের একটা তীব্র ঝাঁঝালো গন্ধ নাকে আসছে… ট্রেনটা কি ছেড়ে দিল?… প্ল্যাটফর্মটা সরে সরে যাচ্ছে……কিন্তু তাকে তো নামতেই হবে!!!যে ভাবেই হোক তাকে ঐ চলন্ত ট্রেন থেকে নামতেই হবে…ভয়ানক একটা উত্তেজনা আর দমচাপা কষ্ট… কিছু চোরা চোখের চাউনি…বিশ্রী হাসি আর প্রবল উপেক্ষা নিয়ে অনীশ রাগে লজ্জায় অভিমানে বুকের বাঁদিকটা খামচে ধরে… আর সঙ্গে সঙ্গে একটা চেন টানার কর্কশ আওয়াজে অস্ফুটে তার গলা দিয়ে বেরিয়ে আসে একটা স্বর…
-আঃ
চোখ মেলে অনীশ দেখে পৃথা গাছে জল দিচ্ছে…অনীশের দিকে না ফিরেই পৃথা বলে উঠল…
-আবার নিশ্চয়ই স্বপ্ন দেখছিলে? এই যে মশাই…কাল রাতে কি আমাকে এতটাই অসহ্য লাগছিল যে ব্যালকনিতে এসে ঘুমোতে হল?
-ইসসস্ ঘুমিয়ে গেছিলাম এখানেই ? ডাকোনি কেন?
-কি জানি বাবা…লেখালেখি করে কত রাতে শুয়েছ কে জানে !
চোখমুখ দুহাতে ডলে রকিং চেয়ার থেকে উঠতে গিয়ে গায়ের চাদরটা মাটিতে পরে যেতে দেখে অনীশ একটু আদুরে গলায় বলে…
-আবার গায়ে চাপা দিয়ে দিয়েছিলে? আমার চশমা কই?
-ঘুমোচ্ছ দেখে আর ডাকি নি গো …শুধু শীতে কুঁকড়ে শুয়েছিলে তাই গায়ে চাদরটা দিয়ে দিয়েছি আর চশমাটা খুলে ঘরে রেখেছি … পিসিমনি আছেন খেয়াল আছে কি ? যাও ফ্রেশ হয়ে ডাইনিং-এ যাও। বাবা আজ বেরোবেন না বলেছেন …হয়ত তোমাকেই অফিসে যেতে হবে…কোথায় যেন একটা যাওয়ার কথা বলছিলেন।……ডাইনিং এ এসে অনীশ দেখে বেশ জমাটি আড্ডা চলছে…চা পর্ব প্রায় শেষ। অনীশকে দেখে পিসিমনি বলেন “কিরে ঘুম ভাঙল? তোর ছেলের কি মিষ্টি মিষ্টি কথা রে!”….. পিসিমনির কথায় অনীশ জানতে পারে পেলে বলেছে যে , দাদাই নাকি ওর থেকেও বেশি ব’কে বাবাইকে আর বাড়িতে সবাই বলে, পেলের বাবা পেলের চেয়েও ছোটো ।অনীশ একটু অপ্রস্তুত হাসে পিসিমনির কথায়…অম্বরীশ খবরের কাগজে চোখ বোলাচ্ছিলেন অনীশকে দেখে বলে ওঠেন,
-ভালোই হয়েছে উঠে পড়েছ…তৈরি হয়ে নাও…তোমাকে একবার দাশনগরের দিকে যেতে হবে আজ…ঐ ওয়ার্কশপের জমিটার ব্যাপারে। আজ আমি যেতে পারব না…ঋত্বিক যাবে তোমার সাথে।
-আজই? কিন্তু আমি একা দেখে কি বুঝবো?
-কেন? বুঝবে নাই বা কেন?…আগে তো প্লটটা দেখে এসো… ওদের কাগজপত্রের কপি নিয়ে এসো… আমি অ্যাডভোকেট অরুনাংশুকে দেখাই তারপর তো ফাইনাল করার সময় আমি যাবই…জমি-জায়গা তো একবার দেখায় কেনাকাটি হয় না!!
-ঠিক আছে কখন বেরোতে হবে বলো…আমি অফিসে গিয়ে ঋত্বিকের সাথে কথা বলে তোমায় জানাচ্ছি।
……অফিসে ঢুকে অনীশ ম্যানেজার বাবুকে সব বুঝিয়ে অম্বরীশের টেকনিক্যাল অ্যাডভাইজার ঋত্বিকবাবুকে নিয়ে বেড়িয়ে পড়লো… অফিসে চুপচাপ বসে থাকার চাইতে অনীশের গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়তে ভালোই লাগে। ব্যস্ত কলকাতার যানজট পেরিয়ে …গাড়ির ক্র্যাকাফনি ছাড়িয়ে কোনা এক্সপ্রেস ওয়ে দিয়ে গাড়ি ছুটে চলল… গাড়ির ভেতর সুমনের গান চলছে ‘কতটা পথ পেরোলে তবে পথিক বলা যায়…কতটা পথ পেরোলে পাখি জিরোবে তার দায়…কতটা অপচয়ের পর মানুষ চেনা যায় …প্রশ্নগুলো সহজ আর উত্তরও জানা’
…অনীশ যেন কেমন নস্টালজিক হয়ে পড়ছে… সত্যি কত কত সময়ের অপচয় হয়ে গেছে জীবনে, আজও অনীশ নিজের পরিচয় গড়ে তুলতে পারে নি। কুরচির দেখা অনীশ আর পৃথার দেখা অনীশের মধ্যে কতটুকুই বা পার্থক্য হয়েছে? কিই বা দিতে পেরেছে তার পরিবারকে সে… অথচ তার বাবা নয় নয় করে তাদের এই ব্যবসাকে আজ এমন জায়গায় দাঁড় করিয়েছেন যে মোটামুটি এই ল্যাব ইন্সট্রুমেন্টের ব্যবসায় তারা অনেক বছর বেশ একাধিপত্য বিস্তার করে আছে… চারটে ওয়ার্কশপ তো আছেই ,আর যদি এই দাশনগরের জায়গাটা ফাইনাল হয় তবে এটা পাঁচ নম্বর ওয়ার্কশপ হবে । দাশনগরে সাড়ে এগারো কাটা একটা জমির ন’কাটা বিক্রি আছে …আর এই ব্যাপারে কথা বলতেই সে আর ঋত্বিক বাবু চলেছে জমির মালিকের সাথে কথা বলতে। এইসব দিকে অনীশ আগে কখনও আসেনি… চারপাশের রাস্তাঘাট দোকানপাট সব যেন জলছবির মত সরে সরে যাচ্ছে। দৃশ্যপট বদলে যাচ্ছে পলকে…শহর ছেড়ে শহরতলী…মাঠঘাট পুকুর জলা জঙ্গল পেরিয়ে তাদের গাড়ি ছুটে চলেছে … অতঃপর বেশ কিছু সময় পরে বাসস্ট্যান্ড থেকে কিছুটা ভেতরের দিকে নির্দিষ্টস্থানে এসে পৌঁছালো অনীশ আর ঋত্বিক …চারদিক উঁচু পাঁচিলে ঘেরা বেশ বড়ো একটা কারখানার শেড চোখে পড়ল তাদের বাইরে থেকে … লোহার গেটের মুখে এসে হর্ন দিতেই অনীশ দেখল ভেতর থেকে গেট খুলে দিল এক মাঝবয়সী ভদ্রলোক আর ততক্ষণে তাদের গাড়ির আওয়াজ শুনে গেটের কাছে এগিয়ে আসছেন আরেকজন বেশ বয়স্ক ভদ্রলোক।
……………………..