পর্ব – ২
‘এক কাপ চা করতে কত সময় লাগে বিভা’? …খবরের কাগজ হাতে অতীন এসে দাঁড়ালো কিচেনে। ঘড়ি বলছে বেলা এগারোটা সাতচল্লিশ ।অতীন দেখল বিভা একটা ছোটো ট্রেতে দুটো চায়ের কাপ সাজাচ্ছে।
অতীন বলল , থাক অত গুছিয়ে গাছিয়ে দিতে হবে না … হাতেই দাও।
বিভা একটু ইতস্তত করে অতীনের হাতে চায়ের কাপটা তুলে দিয়ে বলল, …না চা টা একটু ভিজতে দিয়েছিলাম। …এই নাও ধরো।
অতীনের হাতে একটা কাপ ধরিয়ে দিয়ে, নিজের চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে, অতীনের পাশ কাটিয়ে বিভা কিচেন থেকে ডাইনিং এ এসে বসল। তারপর পিছনে ঘুরে অতীনকে একটু অন্যমনস্কভাবে চায়ের কাপ হাতে কিচেনের জানলার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে বলল ,
– কি গো তুমি আবার কি ভাবছো , ওখানে দাঁড়িয়ে রইলে যে, এদিকে এসো না?
চায়ে এক চুমুক দিয়ে, অতীন বলল ,
– ভাবতে তো চাইছি না বিভা …কিন্তু ভাবাচ্ছে!
-কে?
-তোমার আচরণ ।
-মানে?
-দিন কে দিন তুমি কেমন যেন বদলে যাচ্ছ বিভা!!! সারাদিন কেমন একটা আনমনা হয়ে থাকো। কি যে ভাবো তুমিই জানো…একটা ঘোরের মধ্যে থাকো …কোনও কিছুতেই খেয়াল নেই। …কি ভাবো বলতো ?
-দুররর… কি আবার ভাববো।
-আরে ভাবো , ভাবো…আমি বলছি। আর কি ভাবো আমি বোধহয় একটু হলেও বুঝতে পারছি, ইদানীং।
-না আমি কিছুই ভাবি না…আর তাছাড়া ভাবার মত আছেটাই বা কি?
দুজনের কথার মাঝে ল্যান্ডলাইনটা বেজে উঠলো।বিভা চেয়ার ছেড়ে উঠে লিভিং স্পেসের সাইড টেবিলে রাখা কর্ডলেসটা ধরল…
-হ্যালো।
-তুমি মোবাইলটা খুলবে নাকি আমি এখানেই কথা বলব?
নীলের ফোন বুঝতে পেরেও অশান্তির ভয়ে ,বিভা চুপ করে রইল। অতীন বলল,
-কে ফোন করেছে?
বিভা ফোনটা নামিয়ে রেখে বলল, ‘জানি না কিছু শোনা গেল না …কেটে গেল লাইনটা’।
অতীন একটু ঠান্ডা চোখে জরীপ করল বিভাকে।
বিভা তার অস্বস্তি ভাবটা কাটিয়ে ফাঁকা কাপ দুটো হাতে নিয়ে কিচেনে যেতে না যেতেই আবার বেজে উঠল ফোন। এবার অতীন নিজেই ফোনটা ধরল। বিভা মনে মনে প্রমাদ গুনল… আগাম ঝড়ের পূর্বাভাস শুনতে পেল তার মনের অতলে…
-হ্যালো কে বলছেন?
-হ্যালো কে অতীন দা? আমি নীল বলছিলাম দাদা । কেমন আছেন?
-ও হো নীল … আমি ওই আছি একপ্রকার …তুমি কেমন আছ বলো …সব ঠিকঠাক চলছে তো?
-হ্যাঁ দাদা… সবই চলছে গড়িয়ে গড়িয়ে…মেমসাহেবের সাথে একটু কথা ছিল দাদা…দেখলাম মোবাইলটা বন্ধ…তাই এখানে ফোন করলাম। কথা বলা যাবে এখন।
-হ্যাঁ হ্যাঁ ধরো দিচ্ছি…অনেকদিন আসোও নি তো? সময় করে এসো একদিন। কথা হবে । …দাঁড়াও ডাকছি বিভাকে।
বিভা ততক্ষণে অপরাধীর মতো মুখে অতীনের পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে । অতীন একটু কঠিন চোয়ালে ফোনটা বিভার দিকে এগিয়ে দিল…বিনা বাক্য ব্যয় করে।
ফোনটা ধরেই বিভা একটু গম্ভীর সুরে বলল,
-হ্যালো …কি ব্যাপার ঝটপট বলো …সময় কম …রান্না করছি।
-আমার ফোনটা ধরে বার বার কেটে দিচ্ছ কেন মেমসাহেব…একটু কথা ছিল ইমলির ব্যাপারে।
-শোনো না নীল এখন তো আমি ব্যস্ত আছি… তুমি সন্ধ্যেবেলা ফোন করো, তখন ফ্রী থাকব। কথা বলতে পারব।
-সন্ধ্যেবেলা ? আচ্ছা বেশ্… ফোন ধরবে তো তখন। আমার নাম শুনে কেটে দিও না প্লিজ …আমি কথা দিচ্ছি আর ডিস্টার্ব করব না… বাট মোবাইলটা খুলে রেখ প্লিজ । আমি সত্যি ফোন করব না সময়ের আগে ,কিন্তু ফোনটা খোলা না থাকলে দমটা কেমন বন্ধ লাগছে মেমসাহেব…প্লিজ ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড ।
-আচ্ছা ঠিক আছে…এখন রাখছি পরে কথা হবে। বাই।
ভালো করে কোনো কথা বলা বা শোনার মত মানসিকতা তখন বিভার ছিল না । ফোনটা ছাড়া মাত্রই অতীন বলে উঠল…
-আচ্ছা আমাকে একটা সোজা বাংলা বোঝাবে বিভা ?
-কি ?
-নীল তোমাকে সব ব্যাপারে এতো কেন ফোন করে? তুমি কে হও ওর? দিনের পর দিন ফোনে এত কিসের দহরম মহরম? আজকাল তোমার ভাবগতিক আমার মোটেই ভালো ঠেকছে না বিভা।একটা অপরিচিত ছেলের সাথে হঠাৎ ফোনে আলাপ …আর ব্যাস তারপর থেকেই…
অতীন কে কথা শেষ করতে না দিয়েই বিভা বলে উঠল, …
– ‘আর কতদিন অপরিচিত থাকবে? এতই যদি তোমার আপত্তি ছিল …তবে বাড়িতে ঘটা করে নিমন্ত্রন কে করতে বলেছিল?’
-বাহ…আমার বউ অচেনা একটি ছেলের সাথে দিনের পর দিন ফোনে গল্প করবে..তারপর যখন সেই ছেলেটি দেখা করতে বলবে , তখন বাড়ির বাইরে গিয়ে দুজনে দেখা করবে…কেউ দেখলে কি ভাববে বিভা?
-বাজে কথা কেন বলছ? নীল আমাকে কোথাও দেখা করতে বলে নি…ইনফ্যাক্ট আমাদের কোনদিন দেখা হবে ভাবিও নি … দুষ্টুর অ্যাক্সিডেন্ট টা না ঘটলে হয়ত আমাদের দেখা হতই না…আর তাছাড়া আমি তো দেখলাম নীল কে বাড়িতে আনায় তুমিই বেশি উৎসাহী ছিলে।
-সেটা ভদ্রতা বিভা… না হলে কোথাকার কে একটা ছেলে তাকে বাড়ি ডেকে এনে গল্প মারার কোনও ইচ্ছাই আমার ছিল না।
-কেন আমি তো বলেছিলাম বাইরে কোথাও খাইয়ে দাও…তুমিই তো বেশি বাড়াবাড়ি করে বাড়িতে ডেকেছিলে।
-আমি না ডাকলে তোমরা বাইরে দেখা করতে … করেছিলে তো।
-মোটেই না। ওটা একটা অ্যাক্সিডেন্ট।
-তুমি সিওর !!! ওটা ডেটিং নয়???
-ভদ্রভাবে কথা বলো অতীন।
-আচ্ছা তুমি কি ভদ্র কাজটা করছ?
-প্লিজ চুপ কর। আমার ভালো লাগছে না…
-হ্যাঁ তা লাগবে কেন? এখন আমার সাথে কথা বলতেই তোমার ভালো লাগে না… আমি জানি বিভা।
-প্লিজ অতীন এভাবে বলোনা…আচ্ছা কেন বলতো, বাইরের একটা ছেলে কে নিয়ে আমরা নিজেদের মধ্যে এমন একটা ঝগড়া করছি।
-তুমি সেটা বোঝো কি?
-হ্যাঁ বুঝি তো, তাই তো আমি ওকে এড়িয়ে চলি আজকাল…ফোন ধরি না , কথা বলি না…বিশ্বাস করো নীলের কোনো অস্তিত্ত্ব নেই আমার কাছে …… আমার তো শুধু তুমি আছো ।…এই নতুন শহরে আমার আর কে আছে বলো ? সত্যি বলতে তুমি না থাকলে আমার বড়ো একা একা লাগে… দুষ্টুটা থাকলে তবুও কিছুটা সময় কাটে কিন্তু তুমি তো আবার দিদিকে বারণ করেছ দুষ্টুকে আমার জিম্মায় রাখতে…
-না না বিভা, দুষ্টু তোমার দিদিভাইয়ের একমাত্র অবলম্বন । তোমার জাম্বো মারা যাওয়ার পর দিদির ওই ছেলে ছাড়া আর কেউ নেই। আর অন্যের সন্তানের দায়িত্ব নিয়ে পালন না করতে পারলে …নেওয়া উচিত নয় বিভা। দুষ্টুর আরো বড়ো ক্ষতি হতে পারত!!!
-মানছি কিন্তু আমি ওর কোনও অবহেলা করি নি অতীন । আচ্ছা আমরা কি পারি না অতীন আমাদের নিজেদের সন্তানের কথা ভাবতে? এখনও কি সময় হয় নি বলতে চাও…নয় নয় করে আমাদের বিয়ের তিন বছর তো হল… কি বলো তুমি?
-না এখনো সময় হয়নি বিভা … আমাকে একটু গুছিয়ে নিতে দাও। আমি তো বলেছি… সময় আসলে তোমাকে বলতে হবে না…আমিই বলব তোমায়।
আমার রোজ রোজ ওই ওষুধগুলো খেতে ভালো লাগে না অতীন, এবার তুমি আমাকে কনসিভ করতে দাও। আমার ভীষণ একা একা লাগে ।
…কথাগুলো বলতে বলতে কান্নায় বুজে আসে বিভার কণ্ঠস্বর …অতীন পরম মমতায় বিভার মাথায় হাত রাখে…আর এইভাবেই ধীরে ধীরে অতীন আর বিভার সম্পর্কের মাঝের মেঘটা কেটে যেতে থাকে…কিন্তু বিভার মনের মধ্যে তখনো অদ্ভুত এক মিশ্র অনুভুতির যুগপৎ ভাবনার মেঘের সমাবেশ ,যা তাকে প্রবলভাবে অস্থির করে তুলতে থাকে শরীরে মনে ।
……………………..