রাত তখন বেশ গাঢ়…। গোটা ঘরটা নীল আলোয় ভেসে যাচ্ছে। স্বপ্ন স্বপ্ন সেই মায়াবী মুহুর্তে ঘুমন্ত হিমাদ্রি যত জড়িয়ে ধরছে অন্বেষা ততই হাঁফিয়ে উঠছে। হিমাদ্রির আদরের পরিভাষাটা একটু অন্যরকম ,তাও অন্বেষা যতটা পেরেছে নিজেকে মানিয়ে নি্তেই চেষ্টা করে এসেছে এতকাল…। আজ কিন্তু একটু হাল্কা আপত্তিতে , আলগোছে সরিয়ে দিল হিমাদ্রির বলিষ্ঠ হাতের বাঁধন ……” ছাড়ো না প্লিজ ” তারপর এক ঝটকায় বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ল অন্বেষা…। ঘুরে তাকাল ঘুমন্ত স্বামীর মুখের দিকে…। উফ অসহ্য লাগছে হিমাদ্রির ছোঁয়াটা আজ অন্বেষার…।
ব্যালকনিতে এসে দাঁড়াল অন্বেষা…। নিশুথ রাত…চারপাশ নিরালা নিঝুম…ঝিঁ ঝিঁ ডাকছে থেকে থেকে… তার চোখটা জ্বালা করছে …খানিকটা বুক চাপ লাগছিল সেই সন্ধ্যে থেকে… টিভিতে দেখা টুকরো খবরটা আজ তাকে বড়ো বেসামাল করে দিয়েছে……। ‘ভাস্কর সবুজ সেনগুপ্তের স্থাপত্যের কৃতিত্ব ভারতের সংস্কৃতিকে আরও একবার আন্তর্জাতিক স্তরে তুলে নিয়ে গেছে ‘…একটা ছোট সাক্ষাৎকার……আর কার কাছে কতটা মানে রাখল কে জানে , কিন্তু আজ এতবছর পরেও যেন সেই সমান উত্তাপে অন্বেষাকে তার শিকড় থেকে জ্বালিয়ে দিয়েছে।
আলতো করে ঘরের দরজাটা টেনে দিয়ে , রকিং চেয়ারে এসে বসল অন্বেষা…। বন্ধ দরজার ওদিকে পরম নিশ্চিন্তে যখন হিমাদ্রি নীল আলোয় অচেতন ,তখন উত্তুরে ঠান্ডা হাওয়ায় অন্বেষা সমানে ভিজে চলেছে…চোখের সামনে একটাই দৃশ্য…। সারা ঘরে মাটি আর পাথরের আবক্ষ নিষ্প্রাণ মুর্তির মাঝে দুটো জীবন্ত সত্ত্বার জৈবিক অনুসন্ধান……। সবুজ তার ইচ্ছের রূপ দিতে অন্বেষার শরীর পর্যন্ত পৌঁছেছিল …আর অন্বেষা ?…সে তো সবুজের সৃষ্টিতে মরেই ছিল…মনটাই যখন দিয়ে দিয়েছিল…শরীর আর কি বিষম বস্তু???……সবুজের উষ্ণ পরশে সেই কবেই তো পুড়ে গিয়েছিল অন্বেষা…। কিন্তু কেন সবুজ কাজের নেশায় ভালবাসাটাকে অমন অনিশ্চয়তার পথে ঠেলে দিল? কেন সে শুধু নিজের সৃষ্টিতে বিভোর হয়ে অন্বেষাকে অবহেলা করল ? ………এই ক’বছরে একবারও কি সবুজ তাকে মনে করেনি…? তার সৃষ্টির মাঝে একটু হলেও কি অন্বেষার জায়গা ছিল না ? ………এইসব প্রশ্ন আজ যেন অন্বেষাকে নতুন করে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছিল …।
দরজা ঠেলার শব্দে অন্বেষা কান্নাটাকে বিলকুল গিলে ফেলল…আর কোল্ড ক্রীমের মত করে নোন্তা চোখের জলটা সারা মুখে মেখে ফেলে , পিছন ঘুরে তাকালো……। হিমাদ্রি এসে দাঁড়িয়েছে…। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াতেই হিমাদ্রি তাকে নিজের গরম চাদরে জড়িয়ে নিয়ে বলল..”ঠান্ডা লেগে যাবে যে , ভেতরে চলো”। আশেপাশে দু একটা কাকের ডাক শোনা যাচ্ছে…আকাশের জমাট অন্ধকারটা কেমন যেন ফ্যাকাসে হয়ে এসেছে…..আর একটু পরেই আলো ফুটে যাবে……ভোর হয়ে যাবে …….হিমাদ্রির বাহুবন্ধনে থেকে অন্বেষা মনে মনে আশ্লেষে বলল……’সবুজ হয়ত নাম করা ভাস্কর হতে পারবে, কিন্তু কোনোদিনও হিমাদ্রির মত মানুষ হতে পারবে না…।’
হারানো সময়
Last updated : October 12, 2022