This entry is part 1 of 6 in the series শূন্য থেকে শুরু

 

shunyo theke shuru/oimookh/@indrila

shunyo theke shuru/oimookh/@indrila

প্রথম পর্ব:

_____________________________________________________________________________________________________________________________

 

চোখের সামনে সব কিছু ঝাপসা হয়ে আছে …কারোর মুখই ঠিক ষ্পস্ট বোঝা যাচ্ছে না… কানে ভেসে আসছে শুধু কিছু কথার রেশ …কেউ যেন ডাকছে  ‘ মা মা ওমা’…পাশ  থেকে আরেকটা অপরিচিত কণ্ঠস্বর ‘মিসেস সেন …একবার তাকিয়ে দেখুন …আপনাকে ডাকছে তো’ … চোখটা কোনক্রমে একটু ফাঁক করে ঘোলাটে চোখে মোহনা দেখল, একটা সুঠাম অবয়ব, ঝাঁকড়া চুল, চওড়া কাঁধ …অনেকটা যেন আবীরের অল্পবয়সের চেহেরার মত… ‘কে ও’!!! ধীরে ধীরে চোখটা আরও একটু  খুলল মোহনা …ওহ্‌ , ও যে আয়ান।এমন অচেনা লাগছে কেন? মুখটা কেমন ফ্যাকাশে করে দাঁড়িয়ে আছে।  আয়ানের পিছনে মোহনার দাদা মল্লার। আর সেই অপরিচিত কণ্ঠস্বরের মানুষটি, আর কেউ নন,  ডঃ পরেশ গুপ্ত। ডঃ গুপ্ত বললেন,  ‘দেখি একটু জিভটা দেখান তো ?’ মোহনা কেমন যেন যন্ত্রচালিতের মত জিভটা বের করে ফেলল…। ডাক্তার বললেন ‘ বেশ বেশ। কি চিনতে পারছেন ছেলেকে?’ ঈষৎ ঘাড় নাড়ল মোহনা।  আয়ান বলল … ‘মা তুমি ঠিক আছো তো?’  মোহনা নিজের ডান হাতটা বাড়িয়ে আয়ানকে ছুঁতে চাইল … আয়ান মায়ের হাতটা নিজের হাতে নিয়ে নিল, বলল … ‘ডোন্ট ওয়ারি মা সব ঠিক আছে ’  …একটু হাসতে চেষ্টা করল মোহনা….. চোখটা আবার কেমন ঝাপসা হয়ে গেল… কোথাও যেন একটা ব্যথার অনুভুতি , গলাটা শুকনো লাগছে … চোখের পাতাটা কেমন ভারী ভারী ঠেকছে…চোখটা আবার বুজে গেল মোহনার… একফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল চোখের কোণা দিয়ে… । ডঃ গুপ্ত বললেন,   

-‘ব্যস ব্যস আর চিন্তার কিছু নেই……এবার ঘুমোন …

-ডঃ আঙ্কেল মায়ের সেন্সেটা আবার চলে গেল কেন?

– ওটা তো হবেই , এখনও অ্যানাস্থেসিয়ার ঘোরটা কাটে নি তো তাই…চলো আমরা বাইরে যাই …মোহনাকে রেস্ট করতে দাও…

মল্লার বলল ‘ভয়ের কিছু নেই তো?’

-আরে না না …ভয়ের কারণটা কাটাতেই তো এত কিছু। বাই দ্য ওয়ে আমি ফ্রেশ হয়ে চেম্বারে আসছি…আপনারা ওখানেই আসুন।  

মল্লার আর আয়ান মোহনার সামনে আরেকটু দাঁড়িয়ে রইল…সিস্টার বললেন, ‘ প্লিজ   আপনারা এবার বাইরে যান…।’ ওরা নিঃশব্দে বেরিয়ে গেল । মোহানার দুচোখ জুড়ে তখন ঘুমের ঝাঁপি … চেষ্টা করেও চোখ খুলে রাখতে পারলো না । এত ঘুম যে তার কোথায় ছিল কে জানে! …আজ কত বছর হয়ে গেল মোহনার চোখে নিশ্চিন্ত  ঘুম নেই…আছে শুধু সময়ের সাথে সাথে অনন্ত পথ চলা… আর অলীক নিয়মের এক বেড়াজাল…।এই ক’বছরে আয়ানকে নিয়ে একা এগিয়ে চলাটাই কেমন যেন অভ্যেস হয়ে গেছে মোহানার । ..স্কুলের চাকরী আর আয়ানকে বড়ো করে তোলার অদম্য ইচ্ছেই নিজেকে একটুও থেমে থাকতে দেয় নি সে…বাড়ির সবাই বলত ‘অনেক তো হল মোহনা,  আয়ানকে একটা হোস্টেলে দিয়ে একটু কি নিজের মত করে শ্বাস নেওয়া যায় না? …তোর নিজেরও তো একটা জীবন আছে ।’ ‘না যায় না…আয়ানকে বাদ দিয়ে  আমার আবার নিজের জীবন কি?’… মোহানা কারোর কথা কানে তোলেনি …কেমন যেন নেশার মত ছুটে চলেছে নিজের অন্তহীন এক লক্ষ্যে… বাঁধা পড়ে গেছে একঘেঁয়ে এক রোজনামচায় ।  আর সময় বয়ে গেছে তার নিজের তাগিদে।

……………………………………………………………………………………………………ক্রমশ

  
This entry is part 2 of 6 in the series শূন্য থেকে শুরু

পর্ব – ২। 

____________________________________________________________________________________________________________________________

কলকাতার ঝাঁ চকচকে নার্সিংহোমে, জানলার কাচের মধ্যে দিয়ে রাতের শহরটাকে দেখতে বেশ লাগছিল মোহনার …দূরে রাস্তার স্ট্রীট লাইটের আলোগুলো জোনাকির মতো জ্বলছে …ফ্লাইওভারের রেলিংএর ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে চলমান গাড়ি …বেশ কয়েকটা নিয়ন সাইনের হোর্ডিংও চোখে পড়ছে …এ যেন শিল্পীর ইজেলে আঁকা রাতের কলকাতার নিস্তব্ধ তিলোত্তমা রূপ …পাশে সাদা পোশাকে সিস্টার একগাল হেসে জিগ্যেস করলেন … ‘হাউ আর ইউ ফীলিং ম্যাম?’

মোহানার চোখের ভাষাই বুঝিয়ে দিল সে এখন অনেকটা ভালো বোধ করছে…যদিও বুকের বাঁদিকে একটা চিনচিনে ব্যথা আছে তখনও।

-একটু জল দেবেন ?

-সরি , আজ নয় ম্যাম …কাল অবশ্যই দেব , আজ শধুই স্যালাইন চলবে…জল দিলে অ্যনাস্থেসিয়ার কারনে একটু ভমিটিং হতে পারে …প্লিজ ম্যাম …প্লিজ কো-অপারেট উইথ আস।

-ডঃ গুপ্ত এসেছিলেন?   

-হ্যাঁ … ওনার নির্দেশেই তো আপনাকে কেবিনে শিফট করা হল। যাবার আগে আরেকবার আসবেন নিশ্চয় ।

……এরপর আর কিছু বলার ইচ্ছে করছিল না মোহনার।  খুব ইচ্ছে করছিল আবীরের একটু ছোঁয়া পেতে… ঠিক আয়ান হওয়ার পর, যেমন মাথায় হাত রেখেছিল আবীর …মুখটা নামিয়ে ঝুঁকে জিগ্যেস করেছিল … ‘ খুব কষ্ট হচ্ছে মন,…কি করি বলো তো, এই কষ্টটা যে আমি চাইলেও নিতে পারব না…নইলে তোমার জায়গায় আমিই …।’ মোহনা হেসে ফেলেছিল। ওই যন্ত্রনার মধ্যেও আবীরের অসহায় মুখটা দেখে মোহনা বলেছিল ‘ এইটুকু  সহ্য না করতে পারলে, মা হয়ে উঠব কি করে!!!’ আবীর মোহনাকে মন বলে ডাকত …কতদিন কেউ তাকে আর মন বলে ডাকে না ।  

পরেশ গুপ্ত ঘরে আসলেন…কলকাতার নাম করা হার্ট স্পেশালিস্ট। মোহনার সাথে যদিও আগে থেকেই পরিচয় । ওনার মিসেস স্কুল কমিটিতে আছেন, সেই সূত্রে বেশ কয়েকবার গেছেও মোহনা ওঁদের বাড়ি। সিস্টারকে কি যেন জিগ্যেস করলেন… মনিটারিং দেখলেন, মোহনার পাল্‌স চেক করলেন, ‘কি , অসুবিধে হচ্ছে কিছু!!!… কিছু বুঝতে পারছেন?……আপনার কিন্তু নবজন্ম হল মোহনা!!… এখন চাইলেও আর আপনার হৃদস্পন্দন বন্ধ হবে না… মোহনা হাসলো একটু , ভাবলো সত্ত্যি , তার আর হৃদয় বলে কিছু রইল না……কিন্তু কই কষ্ট তো কিছু কমে নি… আবেগ তো সেই একি রকম আছে… আসলে মন বস্তুটা আর যেখানেই থাক হৃদযন্ত্রে থাকে না যে , তবু কেন যে মনের কষ্টে বুকে ব্যথা হয় কে জানে ?  … দেখতে গেলে সে এখন এক হৃদয়হীন মানুষ… কিম্বা বলা যায় যান্ত্রিক হৃদয় সম্বলিত নারী। আ লেডি উইথ মেটালিক হার্ট।  নিজের মনেই হাসলো মোহানা …অথচ তার যে একটা জীবন্ত হৃদয় ছিল সে ভাবতেই ভুলে গেছিল… ওই বলে না, দাঁত থাকতে দাঁতের মর্যাদা দেয় না মানুষ…অনেকটা সেইরকম ই …  তার পারিপার্শ্বিক মানুষ জনের কথায়, সে তো কবে থেকে শুনে আসছে , সে নাকি হৃদয়হীনা এক মহিলা ।  তার স্কুলের সহকর্মীদের কাছ থেকে শুনেছে  স্টুডেন্টরা  আড়ালে আবডালে তাকে ‘জল্লাদ’ বলে ডাকে,  …তার মধ্যে নাকি মায়া মমতার লেশ মাত্র নেই …সে অবলীলায় ছাত্রছাত্রীদের খাতার নম্বর কেটে উড়িয়ে দেয়… তাদের পাস ফেল নিয়ে নাকি তার কোনও মাথা ব্যথাই নেই…তার মা’ও মাঝে মাঝে বলত আয়ানকে শাসন করা নিয়ে … ‘তুই দিনে দিনে এমন কঠিন কেন হয়ে যাচ্ছিস মৌ। ছেলেটাকে অত বকা ঝকা কি না করলেই নয়?’ …এমনকি আয়ান তো মাঝে মাঝে বলেই ফেলত… ‘তুমি এত হার্টলেস কেন মা? কেন বোঝোনা আমার বাবার মত ইঞ্জিনিয়ার হতে ইচ্ছে করে না…অঙ্কে ভালো হলেই বুঝি ইঞ্জিনিয়ার হতে হবে …আমাকে কেন তুমি ইংলিশ লিটারেচার নিয়ে পড়তে দিতে চাও না ? …কেন তুমি এত ঘড়ি ধরে নিয়ম মেনে সব কাজ করতে বলো…কেন বুঝতে চাওনা আমার নিয়মে চলতে ভাল লাগে না মা…!!!! কথাগুলো কানে বাজছিল মোহনার  …সত্যিই জীবনটাকে সে বড়ো বেশি  নিয়মে বেঁধে ফেলেছে …স্কুল ,বাড়ি , আয়ান , আর তার পড়াশোনা…এর মধ্যেই জীবনটা তার সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে।

পরেশ গুপ্ত চার্ট দেখে বেরিয়ে গেলেন…যাবার আগে বলে গেলেন… ‘তাহলে মোহনা আমি এখন আসছি, কোনও চাপ নেই… আমি আছি তো, ওকে,  টেক রেস্ট…যত রেস্ট করবে তত তাড়াতাড়ি কষ্টের অবসান!!!!

……কষ্টের অবসান ?…এত সহজে সব কষ্টের অবসান? শরীরের কষ্ট একরকম কিন্তু মনের কষ্ট যে আরও বেশি ! … হঠাৎ করে তার জীবনটা অমন দুর্বিপাকে না পড়লে আজ মোহনার জীবনটা হয়ত এমন চাপের হত না। আজ খুব মনে পড়ছিল তার পুরোনো  সেই সব কথা। তখন মোহানারা টাটানগরে থাকত। সুখী পরিবার। আবীর মোহনা আর আয়ান … যেন একটা সম্পুর্ণ সামতলিক ক্ষেত্র…সমবাহু ত্রিভুজ।  সেপ্টেম্বর মাস …ভাদ্রমাস …কদিন পরেই পুজো…কলকাতায় আসার সব ঠিকঠাক, শুধু পুজোতে নয়,  একেবারে টাটানগরের পাত্তারি গুটিয়ে কলকাতা অফিসে ট্রান্সফার নিয়ে নতুন সংসার শুরু করার কথা…সন্তোষপুরের ফ্ল্যাটের পজেশান পর্যন্ত হাতে এসে গেছে…। সাথে সাথে মোহনারও নতুন জীবন , সেন্ট্রাল স্কুলে চাকরীর কনফার্মেশান …কিন্তু বাধ সাধল আবীরের অফিস…কলকাতায় যাবার আগে শেষ ট্যুর মুম্বাই…এক সপ্তাহের জন্য…। আয়ানের ক্লাস টেস্ট চলছে ,নইলে সবাই মিলেই একটু বেড়ানো হয়ে যেত…অগত্যা আবীরকে একাই যেতে হবে।   মুম্বাই যাবার দিন সকালবেলা আবীরের ব্রেকফাস্ট হয়ে গেছে…ব্যাগ অ্যান্ড ব্যাগেজ সব গুছনো…একটা ফোন এল…কথা বলতে বলতে আবীর সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠছিল একটা ফাইল আনতে …দুটো করে সিঁড়ি টপকে উঠতে গিয়ে দোতলার কয়েকটা সিঁড়ি আগেই পা ফস্কে পড়ল হাফ ল্যান্ডিঙে …আর জ্ঞান হারাল…আশপাশের কয়েকজন মিলে সঙ্গে সঙ্গে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল হসপিটালে… কিন্তু সে জ্ঞান আর ফেরেনি…সব শেষ!!!!! আয়ান তখন সবে ক্লাস ফোর… কোথা থেকে কি যে হয়ে গেল !! মোহনার চোখটা ভিজে যাচ্ছিল …কাঁদতে ইচ্ছে করছিল চিৎকার করে…কিন্তু পারল কই কাঁদতে !সেদিনের পর থেকে সেই কান্না বুকে চেপে চেপেই হয়ত আজ তার এই হৃদয়ঘটিত অসুখ…সবাই বলে মেয়েদের নাকি কই মাছের জান , কিন্তু তার কি এমন বয়স ? সবে তো এই চল্লিশে পা রেখেছে… এর মধ্যেই পেসমেকার!!! …ভাবতে ভাবতে মোহনা কেমন যেন উদাস হয়ে গেল।

……………………………………………………………………………………………………………………………….ক্রমশ

  
This entry is part 3 of 6 in the series শূন্য থেকে শুরু

পর্ব – ৩।

…… অনেকদিন পর আজ আয়ান মামার বাড়িতে  শুয়েছে…  আজ কেন জানি না তার কিছুতেই ঘুম আসছে  না…মনে মনে ভাবছিল মাকে কতটা হার্ড ফেস করতে হয়েছে জীবনে…বাবার অভাবটা মা যতটা পেরেছে  মেটানোর চেষ্টা করে এসেছে এই ক’বছরে…কিন্তু মায়ের জীবনে বাবার অভাব তো থেকেই গেছে? তারওপর দিনে দিনে মায়ের সাথে সেও কেমন যেন একটা দুরত্ব তৈরি করে ফেলেছে?  কৈ আর তো সে আগের মত মায়ের গলা জড়িয়ে শুতে পারেনা…মায়ের সাথে সেভাবে গল্পও খুঁজে পায় না…সব সময় মায়ের ঐ নীতিকথাগুলোও তার আজকাল ভালো লাগে না । এক একসময় তো অসহ্য লাগে… তাই তো না বুঝেই সে মায়ের সাথে তর্ক করে , মাকে হয়ত আঘাত করে  । কিন্তু আয়ান জানে সেদিন মাঠ থেকে ঘুরে এসে মাকে খাটে অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকতে দেখে সে কি ভয়টাই না পেয়েছিল!!!…ফোন করে জানিয়েছিল মামাকে আর ডঃ আঙ্কেলকে … মানে পরেশ গুপ্তকে…ওনার বাড়িও সন্তোষপুরেই । মায়ের সাথে আগে গেছিল বেশ কয়েকবার ওনার বাড়ি।… বাবার মারা যাওয়াটা আয়ান দেখেনি …তখন সে স্কুলে ছিল…  তার আজও মনে পড়ে সেদিন পরীক্ষা চলছিল তার … প্রিন্সিপাল স্যার তাকে ক্লাসরুম থেকে ডেকে নিয়ে এসেছিলেন , তারপর তার হাত ধরে বলেছিলেন…

-আয়ান, আগার তুমারা কই দোস্ত আকেলা হো জায়ে তো তুমহে কেয়া করনা চাহিয়ে?

-উস্কে সাথ দেনা চাহিয়ে স্যার।

-আচ্ছা বাচ্চা  , তব যাও তুমারে মাম্মিকে পাস।

-কিঁউ?

-কিঁউ কি আজ উও আকেলি হ্যায়  …উনকো তুমারা জরুরত হ্যায়…উনেভি তুমারা সাথ চাহিয়ে…তুম দোঙ্গে  না বেটা?

-হাঁ…লেকিন?

-চলো…এক আঙ্কেল আয়া হ্যায় তুমহে লেনে…উনকে সাথ চলে যাও।

……আয়ানের মনে পরে কৈলাস আঙ্কেল নিতে গেছিল তাকে …। গোটা রাস্তা অজানা একটা ভয় তাকে ঘিরে ধরেছিল …। মা একলা কেন? বাবা মুম্বাই গেছে বলে?…কিন্তু বাড়ি এসে সবার কথা, অত মানুষের ভিড় আর মাকে কান্নাকাটি করতে দেখে সে মায়ের কাছে পর্যন্ত যায় নি…পাশের বাড়ির কিট্টি আন্টি তাকে ভাত খাইয়ে দিয়েছিল।  বিকেলের দিকে কে যেন গাড়ি করে তাকে সেই জায়গাটায় নিয়ে গেছিল …যেখানে যেতে চাইলেই মা আগে বকতো…নদীর ধারে শ্মশান ঘাট…উফফফ…আজও মনে পড়লে তার মাথাটা ঝিমঝিম করে ।  

           … না না আর নয় …এবার থেকে মায়ের খেয়াল তো তাকেই রাখতে হবে। মনে মনে আরও ভাবলো সে , না এবার থেকে সে আর মায়ের কথার অবাধ্য হবে না…যা বলবে তাই করবে…যা চায় তাই করবে। মা চায় ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াতে, তাই পড়বে সে…। ভালো করে প্রিপারেশন নেবে জয়েন্টের…মা হয়ত আয়ানের মধ্যে দিয়েই তার বাবাকে খুঁজে পেতে চায়, তার জন্য মা তো অনেক কষ্ট করেছে…কিন্তু সে কিই বা করতে পেরেছে মায়ের জন্য??  আঁতিপাঁতি করে ভাবতে থাকে আয়ান, ‘মা আর কি চায়…হ্যাঁ হ্যাঁ মা চায় ঘরটা যেন আমি পরিস্কার রাখি …জায়গার জিনিস জায়গায় রাখি’ …নো প্রবলেম তাই করব…..এবার থেকে সব গুছিয়ে রাখব। ভাবতে ভাবতে মনে হল ‘আচ্ছা মা কি চাইত জুবিন আঙ্কেল তাদের বাড়ি আসুক???’ একবার দেখবে নাকি আঙ্কেলকে ফোন করে, …ভাবা মাত্রই জুবিন আঙ্কেলের পুরোনো নম্বরটায় ফোন করল আয়ান… ‘নাহ চেঞ্জ হয়ে গেছে’… মনে মনে আয়ান বলল ‘দেখি কাল সকালে একবার অফিসে ফোন করে দেখব ।’ 

………………………………………………………………………………………………………………..ক্রমশ

 

  
This entry is part 4 of 6 in the series শূন্য থেকে শুরু

পর্ব -৪।

আজ সারা রাত মোহনাকে খেতে দেওয়া হবে না … এটা ভেবেই কেমন যেন খিদে পাচ্ছিল মোহনার…। অথচ কতদিন গেছে মোহনা আবীরের কথা ভেবে ভেবে মন খারাপ করে কিছু খাই নি পর্যন্ত। এটাই বোধহয় মানুষের কমন সাইকোলজি…বাধা দিলেই একটা তীব্র আকাঙ্খা জন্মায়…। আয়ান বিরিয়ানি খেতে ভালবাসে…সপ্তাহের ছুটির দিনগুলোয় তার প্রায় দিনই বিরিয়ানির বায়না চলে ,কিন্তু  মোহনা রাজি না… ব্যস আয়ানও রাগ দেখিয়ে ঘরে গিয়ে খাব না বলে বসে থাকে…মোহনা হয়ত বাবা বাছা বলে অন্য খাবার খাওয়াতে পারত কিন্তু তা না করে দুজনের খাবার বেড়ে টেবিলে চাপা দিয়ে মোহনা এসে নিজেও না খেয়ে শুয়ে থেকেছে…। আয়ানের রাগ পড়লে যখন ফ্রিজ খুলে খাবার খুঁজতে এসে টেবিলে রাখা খাবার চোখে পড়ে, তখন নিজে থেকেই দুটো ডিশ মায়ের ঘরে নিয়ে গিয়ে বলেছে… ‘কি মুশকিল তুমি কেন খাও নি?…সারাদিন খেটে খুটে আমার রাগের সাথে পাল্লা দিচ্ছ?…নাও আমি খাইয়ে দিচ্ছি ,চলো’…এই বলে এক টুকরো রুটি ছিঁড়ে সবজি দিয়ে মায়ের মুখে ধরেই বলত ‘এবার তুমি একটু খাইয়ে দাও আমায় ।’…আজ মোহনার মনে হচ্ছে সে না বলত বলেই আয়ান অমন বায়না করত…কি ক্ষতি ছিল হ্যাঁ বললে ?  দু তিন দিন খেলে নিজেই হয়ত আর খেতে চাইত না…কিন্তু সত্যি আজ তারও কেমন যেন বিরিয়ানি খেতে ইচ্ছে করছে আয়ানের সাথে…।আয়ানটা যে কি করছে? …বাচ্ছা ছেলে টুয়েলভে উঠেছে সবে…হঠাৎ করে মোহনার এমন অ্যাটাক হওয়াতে ছেলেটা যেন কেমন চুপ মেরে গেছে…। আবীরের বাড়ির সাথে সম্পর্ক তো নেই বললেই চলে…আবীরের বাবা মা কেউই আর বেঁচে নেই…থাকার মধ্যে আছে এক ননদ …মাঝে সাঝে ফোনে কথা হয়…তাও ঐ গা ছাড়া গোছের…থাকেও তো গোরখপুরে…মোহনা কোনও খবরই দেয় নি। আর বাপের বাড়িতে দাদা বউদি নিজেদের নিয়েই ব্যস্ত…আর মা তো প্রায় বাতেই পঙ্গু…তবুও তার পেসমেকার বসানোর খবরে দাদা এসেছে…আয়ানের সাথে আছে… ডাক্তারের সাথে কথা বলা …ইন্সিওরেন্সের কাগজপত্র রেডি করা…অ্যাডমিসন সব নিয়েই আয়ানকে গাইড করেছে…। সেদিন রাতে তো এটাও বলেছে …

-মৌ তুই কেন একা থাকবি? আমি  বুঝিনা তোর কিসের এত জেদ…আমাদের নিজেদের অতবড়ো বাড়ি থাকতে তুই একা কেন ফ্ল্যাটে পড়ে আছিস? …এ বাড়ি যতটা আমার ততটাই তোর …তুই বাড়িতে থাকলে মারও তো একটু শান্তি হয় …তোরও কথা বলার কেউ থাকে । তুই কিন্তু অপারেশনের পর আয়ানকে নিয়ে বাড়িতেই থাকবি , এই আমি বলে রাখলাম।

-আর আমাদের ফ্ল্যাটের কি হবে শুনি?

-ও নিয়ে পরে ডিসাইড করবি । কবে তোর বউদি তোকে কি বলেছে সেই নিয়ে এত কিসের অভিমান বলত।? অনু নিজেও তার জন্য অনুতপ্ত। আমাদের আর কি আছে বল । নিম্মি রিসার্চ করছে , বাইরে,  এইতো আর একবছর কাটলেই হয়ত রিমোর সাথে বিয়ে করে সেট্‌ল করে যাবে অস্ট্রেলিয়ায়…। তুই আর আয়ান থাকলে আমাদেরও তো ভালো লাগে …আয়ান এত ভালো ছেলে …এত ছোট বয়সে বাবাকে হারিয়েছে… আমাদেরও তো কিছু করার ইচ্ছে করে ওর জন্য।

… মোহনা আর উত্তর করেনি,  চুপ করে শুনেছিল। দাদা কোনদিন তাকে এমন করে বলেনি …তবে সত্যি বলতে সে তো আবীরকে হারিয়ে দাদা বউদির কাছেই উঠেছিল…ছিলও বেশ… মায়ের আদরে,  দাদার স্নেহে মনের মাঝে একটা প্রলেপ গড়ে উঠেছিল… আবীরের কলকাতা অফিসের অনেকেই দেখা করতে এসেছিল…কোম্পানি অফারও করেছিল মোহানাকে চাকরির জন্য…কিন্তু মোহানা চাইনি কারন ইতি মধ্যেই তার  স্কুলে চাকরিটা হয়ে গিয়েছিল ,জয়েনও করে গিয়েছিল।  ধীরে ধীরে সামলেও উঠছিল মোহনা, স্কুল আর আয়ানকে নিয়ে । মাঝে মাঝে আসত আবীরের জুনিয়র জুবিন । জুবিন ভার্গব যদিও অবাঙালি ছেলে কিন্তু ভীষণ ভালোবাসত বাংলা সংস্কৃতি। ওর মুখে ঝরেঝরে বাংলা শুনে কেউ বলবে না, ও বাঙালি নয়। মোহনার সমবয়সি কিংবা একটু ছোটই হবে…কলকাতা অফিসে ওর পোস্টিং হয়েছিল মাস ছয়েক আগেই …আবীরকে কলকাতা আনার ব্যাপারে ওই সবচেয়ে বেশি তৎপর ছিল।..আবীরকে খুব ভালবাসত জুবিন, টাটানগরে থাকতে মাঝে মাঝে একসাথে উইকেন্ড কাটাত ওদেরই সাথে , কমপ্লিট ব্যাচিলার… আবীর মারা যাবার পর কলকাতাতেও তাই জুবিন মাঝে মাঝেই খোঁজ নিতে আসত আয়ান আর মোহনার…  ধীরে ধীরে কেমন যেন একটা ভরসার জায়গা গড়ে উঠছিল মোহনার সাথে । মোহনার দাদা মল্লারেরও  বেশ লাগত জুবিনকে…  দায়িত্বয়ান , স্কলার , হাসমুখ প্রকৃতির ছেলে ছিল জুবিন। অনুজা মানে মোহনার বউদিও খুব পছন্দ করত জুবিনকে। একবছর নিম্মির জন্মদিনে অনুজা জুবিনকে ইনভাইট করেছিল…সারাদিন সবাই মিলে হই হই করে কাটিয়ে বিকেলবেলা জুবিন তার গাড়িতে নিম্মি, আয়ান আর মোহনাকে নিয়ে একটু বেরোলো ।  ঘোরাঘুরি করে ,শপিং করে , আইস্ক্রীম খেয়ে আবার বাড়ি ফিরে এল সবাই । একটু দেরি হয়ে গিয়েছিল ফিরতে…তাই জুবিন বাড়ির মুখে ওদের নামিয়ে দিয়ে চলে গিয়েছিল।  সেদিন মোহনার মনটা বেশ ভালো ছিল। নিম্মি আর আয়ানও খুব খুশি ,তাদের নতুন গিফট নিয়ে নিজেদের মধ্যে বেশ ব্যস্ত ছিল । মোহনার গলায় অনেকদিন পর রবীন্দ্রসঙ্গীতের দুকলি শুনে অনুজা বলেছিল,

-বেশ তো দুটিতে মিলে মিশে গেছ দেখছি…এবার কি একটু নতুন করে জীবনটাকে ভেবে দেখতে পারো না মৌ?

-বউদি । কি বলছ তুমি?

-কেন ভুল কি বলেছি? তোমাকে খুশি দেখলে আমাদেরও ভাল লাগে ।

-তার জন্য নতুন ভাবনার কি আছে?

-আছে বইকি?  এক বছর তো কাটল । একা থাকাটা যে কতটা অভিশাপ তা তো বোঝোই। একবার নতুন করে জুবিনকে নিয়ে ভেবে দেখলে ক্ষতি কি…।

-আমরা খুব ভাল বন্ধু বউদি…এর চেয়ে বেশি কিছুই না… আর প্লিজ তুমি এইসব কথা এরকম ভাবে বলো না…আয়ান শুনলে খুব বাজে ব্যাপার হবে।

-কেন ? আয়ান তো বেশ ভালোবাসে জুবিনকে…

-প্লিজ বউদি আমি এখন এসব নিয়ে ভাবছি না। অনেকদিন পর আজ আয়ানকে খুশি দেখে আমার বেশ হাল্কা লাগছিল …।তাই বোধহয় নিজের অজান্তেই গুন গুন করছিলাম…। কিন্তু তুমি সেটার অন্য মানে করছ।

-না না মৌ …একথা কেন বলছ…আমি কি তোমায় ভালবাসি না…তোমার ভাল থাকা না থাকা কি আমাকে ভাবায় না?

-তা নয় বউদি…তুমি জান না আয়ান কতটা অ্যটাচড্‌ ছিল আবীরের সাথে…

-সব ছেলেমেয়েই অ্যটাচড্‌ থাকে তার বাবা মায়ের সাথে …সেরকম হলে আয়ানকে হোস্টেলে রেখে একটু নিজের মত শ্বাস নিলে ক্ষতি কি? তোমার তো নিজের একটা জীবন আছে নাকি ? তাছাড়া আমরা সবাই জুবিনকে খুব পছন্দ করি…তুমি চাইলে তোমার দাদা কথা বলতে পারে ওর সাথে।

– প্লিজ বউদি …তুমি এসব বলা বন্ধ কর।

অনুজা চুপ করে গেছিল…কিন্তু বিষয়টা থেমে থাকে নি। …

আজকের রাত্রিটা বড়ো দীর্ঘ লাগছে মোহনার…মরফিন ইঞ্জেকশান দেওয়ার পরও ঘুম আসতে চাইছে না ।…সিস্টার বললেন,

-আপনার নার্ভগুলো ভীষন এক্সাইটেড হয়ে আছে ম্যাম…নয়ত এতক্ষনে ঘুম এসে যেত আপনার। ঘুমনোর চেষ্টা করুন…নাহলে আমাকে আবার ডঃ গুপ্তকে ফোন করতে হবে।

-না না …আমি ঘুমনোর চেষ্টা করছি।

মোহনা চোখ বুজে ফেলে…কিন্তু ঘুম কই? মনে মনে ভাবতে থাকে না আর পুরোনো কথা নয় এবার ভাববে নতুন একটা ভোরের কথা…ভোরবেলা অপারেশনের পর আজ সারাদিন  তাকে ICU তে রেখেছিল… কাউকে দেখাও করতে দেয়নি ,  …ডঃ বলেছিলেন কাল কেবিনে শিফট করবে মোহনাকে, কিন্তু সন্ধ্যের পর  ডঃ গুপ্তর নির্দেশে তাকে কেবিনে শিফট করা হয়েছে….. আর কিছুক্ষন আগে হলে দেখা হত আয়ানের সাথে…মোহনা ভাবলো, ‘ছেলেটা বড়ো মুখচোরা …যত চোটপাট খালি মায়ের ওপর…আজ অ্যানাস্থেসিয়ার ঘোরে কেমন যেন আবীরের মতই লাগছিল ওকে …আচ্ছা আজ আবীর থাকলে কি করত ? তার ‘মনে’র এমন অবস্থার কথা শুনলে!!…হয়ত সারাদিন ICUএর সামনে বসে থাকত…সত্যি বলতে আবীর থাকলে হয়ত মোহনার এমন হতই না…।মনে পড়ে যাচ্ছিল আবীরের সাথে সেই ভালোবাসার মুহূর্তগুলো …আবীর মানুষটা ছিল ভীষণ হুড়ে…যা করত সবের মধ্যেই একটা বুদ্ধিদীপ্ততার পরিচয়  থাকত । এমনকি আদরটাতেও একটা অন্যরকম নেশা হয়ে যেত। আবীরের কথা ভাবতে ভাবতে কেমন যেন ঘোর ঘোর লাগে মোহনার …ঘুম এসে যায় কি এক অনাবিল ভালো লাগায় ।

…………………………………………………………………………………………….ক্রমশ

  
This entry is part 5 of 6 in the series শূন্য থেকে শুরু

পর্ব – ৫।

সারারাত ধরে আয়ান ছটফট করেতে থাকে মায়ের জন্য ।  সে জানে এবার তার মায়ের কথা মত চলাই উচিত… আর সেই কথা মেনে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে গেলে তো তাকে হোস্টেলে যেতেই হবে ,ভালোই হবে মা মামার বাড়িতে দিদানের সাথে থাকলে …তার চিন্তাটা কমবে। তার খুব মনে আছে আগে মামার বাড়ি থাকাকালিন নিম্মিদিদির সাথে কত মজা হত, তখন তো ওরা সন্তোষপুরের ফ্ল্যাটে যায়ই নি …মামা বলত ‘কি লাভ ওখানে একা থেকে ।এখানে সবার সাথে থাক’…ভালোই লাগত প্রথম প্রথম এখানে থাকতে …কিন্তু এখান থেকে মা চলে গিয়েছিল তো তারই জন্য। আয়ান তখন ছোট হলেও বছর দশেক বয়স…তার মনে আছে বড়ো মামীর সাথে মায়ের কথা হচ্ছিল জুবিন আঙ্কেল কে নিয়ে , সেদিন ছিল নিম্মিদিদির বার্থ ডে,  যদিও সে জুবিন আঙ্কেলকে বেশ ভালোইবাসত কিন্তু সেদিন মামীকে যা বলতে শুনেছিল তার কারনেই তার মনে একটা অদ্ভুত ভয় হয়েছিল… ভেবেছিল মা বোধহয় জুবিন আঙ্কেলের জন্যই তাকে হোস্টেলে পাঠিয়ে দেবে…তবে কি জুবিন আঙ্কেল তার বাবার জায়গাটা নিয়ে নেবে? কেমন যেন অভিমান হয়েছিল মায়ের ওপর…মায়ের কাছে কে বেশি প্রিয় জানতে ইছে করেছিল আয়ানের…মনে মনে একটা ঈর্ষা তৈরি হচ্ছিল জুবিন আঙ্কেলের ওপর… তার মনে পড়ছিল  , মার ঘর থেকে মামী  চলে যাবার পর সে ঘরে এসে চুপচাপ শুয়ে পড়েছিল…। মা তখন দিদানের কাছে ছিল। যদিও শুয়ে পড়েছিল আয়ান কিন্তু ঘুম আসেনি ।…একটু পরে মা এল …

-কিরে ঘুমিয়ে পড়েছিস…আয়ান?…আরে সত্যি তো ঘুমিয়ে গেছে দেখছি ছেলেটা !!

মোহনা বড়ো আলোটা নিভিয়ে …আয়নার সামনে গিয়ে বসল…ড্রেসিং টেবিলের স্পট লাইটটা জ্বলছিল, মায়ের হাতে ছিল বাবার একটা ছবি। এমন সময় মায়ের মোবাইলে একটা ফোন আসে … মা ফোনটা ধরে,  মায়ের কথাগুলো কানে আসলেও জুবিন আঙ্কেলের কথাগুলো শুনতে পাই নি আয়ান। মা বলছিল ,

–তুমি পৌঁছে গেছ তো জুবিন…আমার চিন্তা হচ্ছিল একটু..

-হ্যাঁ অনেক রাত হল …তুমি এবার রেস্ট কর …কাল কথা হবে কেমন …

-বাই অ্যান্ড থাঙ্কস আগেইন জুবিন… সত্যি আজকের দিনটা খুব ভালো কাটালাম আমরা সবাই…

-হ্যাঁ আয়ান ঘুমিয়ে পড়েছে । আর পারে নাকি…যা হই হই করল তোমার সাথে

-ওকে,  বাই …টেক কেয়ার…গুড নাইট ।

…খুব সাধারন কথা কিন্তু আয়ানের কান্নায় গলা বুজে এসেছিল..চোখটা জ্বালা করে উঠেছিল । মাকে যেন চাইলেও ছুঁতে পারছিল না আয়ান… কেমন দূরের মনে হয়েছিল…বাজে মনে হয়েছিল । রাত্রিবেলা মোহনা যখন গভীর ঘুমে …তখন আয়ান বিছানা ছেড়ে উঠে জুবিনের দেওয়া সমস্ত উপহারগুলো ছিঁড়ে, মাটিতে ফেলে তছনছ করে দিয়েছিল…নতুন প্যাকেটের আওয়াজে ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছিল মোহনার …তার অমন কান্ড কারখানায় অবাক হয়ে গিয়েছিল মোহনা…একটুও বকে নি আয়ানকে, শুধু কাছে টেনে বলেছিল..

-কি হয়েছে ?…ওগুলো তোর পছন্দ হয়নি?

-না হয়নি তো। একদম হয় নি।

-ঠিক আছে,  কাল চেঞ্জ করে নেব, কিন্তু তুই ওগুলো নষ্ট করছিস কেন?

-না না ,আমি আর কারোর দেওয়া জিনিস নেব না…সবাই বাজে…  জুবিন আঙ্কেল বাজে , মামী বাজে…তুমিও বাজে। হ্যাঁ হ্যাঁ তুমিও খুব খুব বাজে।

মোহনা জড়িয়ে ধরেছিল আয়ানকে…তখন আয়ানের কি জেদ…ঠেলে সরিয়ে দিয়েছিল মোহনাকে , হাত পা ছুঁড়ছিল রাগে অভিমানে …কিন্তু মোহনা অসীম ধৈর্যে আয়ানকে বুকের মধ্যে চেপে ধরে শান্ত করেছিল…বলেছিল,

-কি কষ্ট হচ্ছে আমায় বল না …

-তুমি কি আমাকে হোস্টেলে পাঠিয়ে দিতে চাও?

-না না কক্ষনও নয় সোনা  …

-ঠিক তো…

-হ্যাঁ একদম ঠিক , আমি তো তোকে ছাড়া থাকতেই পারব না বাবা।

-তবে মামী কেন বলছিল…?

-মামী এমনি বলেছিল…

-না, আমি জানি, মামী জুবিন আঙ্কেলের জন্য বলেছিল তাই না… আমি কিছুতেই  এখানে থাকব না আর…আমরা আমাদের ফ্ল্যাটে থাকব। মামী বাজে… জুবিন আঙ্কেল বাজে …সবাই বাজে…থাকব না এখানে…কিছুতেই থাকব না।

আয়ান ফোঁপাচ্ছিল, মোহনা একেবারে নিথর হয়ে গিয়েছিল…সারারাত আয়ানকে কোলে আঁকড়ে ধরে রেখেছিল…। আয়ানের আজও মনে পড়ে , কিছুদিন পরে জুবিন আঙ্কেল এসেছিল মায়ের সাথে দেখা করতে …আয়ান জানে না কি কথা হয়েছিল শুধু শুনেছিল যাবার সময় মা জুবিন আঙ্কেলকে বলেছিল ‘তুমি আর এখানে এস না জুবিন …কখনও কোনও অসুবিধে হলে আমি জানাব।’ …ব্যস সেই আঙ্কেলের শেষ আসা , এরপর আর কোনওভাবে কোন যোগাযোগ হয়নি আঙ্কেলের সাথে…তার কিছুদিনের মধ্যে আয়ানরা মামার বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছিল সন্তোষপুরের ফ্ল্যাটে।……আজ এত বছর পরে আয়ানের খুব মনে হচ্ছে  জুবিন আঙ্কেলের কথা।

               …সকালবেলা মামীর ডাকে দরজা খুললো আয়ান…

-আয়ান উঠে পড়, বাবা। মামা নার্সিং হোমে ফোন করেছিল……মৌ ভালো আছে …কাল রাতেই কেবিনে শিফ্‌ট করেছে…তুই রেডি হয়ে নে, মামার সাথে ব্রেকফাস্ট করে বেরোবি।

আয়ান বেশ আশ্বস্ত হল…বলল

-আমি এখনি তৈরি হয়ে নিচ্ছি,

-কি খাবি বল ব্রেকফাস্টে ?

-তুমি যা দেবে…

-ফরমালিটি মামীর সাথে!

-না না তা কেন?

-এই যে তোর মা বলে ,তোর নাকি খাওয়া নিয়ে বড়ো জেদ?

-ওতো মায়ের সাথে এমনি করি…এবার এখানে থাকলে তোমাকেও জ্বালাব।

-তবে রে দুষ্টু ছেলে !!

…মামী হাল্কা আদরে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় আয়ানের। হাসতে হাসতে আয়ান বাথরুমে  যায়।  ফ্রেশ হয়ে এসে আয়ান আবীরের পুরোনো কলিগদের কয়েকজনকে ফোন করবে বলে মায়ের ফোন নম্বরের খাতাটা হাঁৎড়াতে থাকে। অনুজা বলে,

– হ্যাঁরে চা খাবি তো?

-হ্যাঁ …দাও।

………………………………………………………………………………………………………………ক্রমশ

 

  
This entry is part 6 of 6 in the series শূন্য থেকে শুরু

পর্ব – ৬।

জানলার পর্দাটা সরাতেই সকালের ঝকঝকে রোদ্দুর কাচের ভেতর দিয়ে চোখে পড়লো মোহনার …চিরকালই মোহনার চোখে আলো পড়লে ঘুম ভেঙ্গে যায়…আজও তার অন্যথা হল না। সিস্টারের এক গাল হাসিতে ‘গুডমর্নিং’ শুনে মোহনার বেশ লাগলো । সিস্টার বললেন,

 -চলুন আপনাকে একটু ফ্রেশ করে দি। আজ আপনার বাড়ি থেকে দেখা করতে আসবে একে একে।  স্যালাইন খুলে দিলে তারপর জল খেতে পারবেন।

অনেকদিন পর মোহনার মনটা বেশ লাগছে , আয়ানকে দেখতে পাবে বলে… আসলে আয়ান ছাড়া তো সে তার নিজের বলে কাউকেই ভাবতে পারে না… তাই মোহনারও যত জেদ ঐ আয়ানেরই ওপর…কিন্তু জেদ করে কি কিছু পাওয়া যায়…? আর আয়ানের জেদের কাছে তার সব জেদ যে তুচ্ছ এটা আয়ান কি বোঝে!!! মনে মনে  মোহনা বলে ‘তোর জন্য আমি যে সব করতে পারি আয়ান…কিন্তু এটা কি তুই বুঝিস? আসলে তুই নিজেকে যত বড়োই ভাবিস না কেন , তুই যে আমার কাছে সবসময় ছেলেমানুষই থাকবি রে। তাই তোর ছোট্ট মনটায় যাতে আঘাত না লাগে তার জন্যই তো তুই যা চেয়েছিস মেনে এসেছি এতদিন ধরে…সে তোর মামার বাড়ি থেকে চলে আসাই হোক বা জুবিনের থেকে দূরে সরে থাকাই হোক…।’  মোহনার আবার মনে পড়ে গেল , সেই রাতের কথা। সেদিন আয়ানের অমন আচরনের পর সেও তো বড় ভয় পেয়ে গিয়েছিল… কি করলে ছেলেটার মন থেকে মিথ্যে ভাবনাটা দূর করবে তাই নিয়ে কত ভেবেছিল…তার জন্যই তো ,কদিন জুবিনের কোনও ফোন পর্যন্ত ধরে নি সে । অবশেষে জুবিন ল্যান্ডলাইনে ফোন করে, কথা হয় অনুজার সাথে , অনুজা তাকে বিকেলে বাড়ি আসতে বলে… মোহনা না চাইলেও অনুজার তত্ত্বাবধানে জুবিনের সাথে কথা বলতে বাধ্য হয় সে ।  অনেকটা যেন একটা আলোচনা সভার মত…।

যদিও মোহনা চাইনি অনুজা থাকুক,  তবুও অনুজা ছিল ওদের মাঝে…আর অনুজার উদ্দেশ্যই ছিল জুবিনের সাথে মোহনাকে যেভাবে হোক বেঁধে ফেলার । তাই মোহনাকে চা করতে বলে অনুজা তার অনুপস্থিতিতে জুবিনকে বলেছিল…

-তুমি কি মোহনার ব্যাপারে কোনও সিদ্ধান্ত নিতে চাও জুবিন?

জুবিন একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছিল। পরিবেশটা হাল্কা করতে বলেছিল,

-বউদি, আমি মোহনাকে একটা সেকেন্ড থট ভাবার কথা বলতে চেয়েও পারিনি…কারণ আমি জানি আবীরদা যেরকম মানুষ ছিলেন তাতে করে ওর পক্ষে অন্য কাউকে মেনে নেওয়াটা সম্ভব নয়।   

কথাগুলো কিচেন থেকে মোহনার কানে যেতেই উত্তেজিত ভাবে সে বলেছিল,

-হোয়াট দ্য হেল গোইং অন…বউদি, আমার লাইফ আমি কিভাবে কাটাব , সেটা কি তোমরা ঠিক করে দেবে।

-কি হয়েছে কি মৌ…আয়ান এখন ছোটো…তাছাড়া তোমার তো একটা জীবন আছে। কি এমন বয়স তোমার?  জুবিন যদি রাজি থাকে , আই থিঙ্ক…

-প্লিজ , স্টপ দিস ননন্সেন্স…

-কেন ? এইভাবে বেরানো ঘোরা করছো, আজ বাদে কাল লোকে কিছু বললে তখন? তার থেকে সময় থাকতে নিজেদের মধ্যে একটা বোঝাপোড়া করে নিতে আপত্তি কোথায়?

-একটা ছেলে আর একটা মেয়ে মানেই অন্য কিছু কেন ভাবো বউদি… ?

-আমি না মৌ…সমাজ ভাবতে পারে । আমি জানি তোমরা বন্ধু কিন্তু এর চেয়ে একটু বেশি ভেবে দেখলে ক্ষতি কি? শুধু কি তাই তোমার ছেলেও তো তোমাদের শুধু বন্ধু ভাবতে পারছে না মৌ …আজ ও ছোটো, কিন্তু ব্যাপারটার অন্যরকম মানে করার চেয়ে একটা সুস্থ সম্পর্কে গেলে তোমার অসুবিধের কি আছে?

-প্লিজ তুমি থামো, বউদি আমি চাইনা এই কথাগুলো আয়ানের কানে যাক।

-কিন্তু মৌ জুবিনও তো বিয়ে থা করে নি , তুমি কতদিন এভাবে ওর সাথে মিছিমিছি ঘুরে বেড়াবে ? ওরও তো কোনও এক্সপেক্টেশন থাকতে পারে?

বউদির এই ধরনের কথায় মোহনা কতটা কষ্ট পাচ্ছিল সেটা বুঝতে জুবিনের একটুও অসুবিধে হয়নি তাই বোধহয় , জুবিন উঠে পড়েছিল সোফা ছেড়ে … আর মোহনার দিকে তাকিয়ে বলেছিল ,

-না না মোহনা,  আমি কোনও কিছুর আশায় এখানে আসি না…জাস্ট আবীরদাকে ভালবাসি বলেই হয়ত , আয়ানের জন্য আসতাম , কিন্তু এখন মনে হচ্ছে… ব্যাপারটা ইতিমধ্যেই আয়ানের মনে একটা অন্য এফেক্ট ফেলেছে…যেটা হয়ত সময়ের সাথে সাথে আরও বিপদজনক হয়ে উঠতে পারে, সরি মোহনা,  আমার মনে হয় আমার এখানে আসাটা ঠিক হচ্ছে না …

-হ্যাঁ ,একেবারে ঠিক কথা বলেছ।  তুমি আর এবাড়িতে এস না জুবিন…আমার কোনও অসুবিধে হলে আমি তোমাকে জানাব …।  

……জুবিন আর আসেনি …ফোনও করেনি …মোহনাও ডাকে নি আর কোনওদিন… এরপরই প্রায় মাস খানেকের মধ্যে মোহনা আয়ানকে নিয়ে  আবীরের সন্তোষপুরের ফ্ল্যাটে  উঠে গিয়েছিল। বাড়ির কারোর কথা শোনেনি…। মানিক তলা থেকে চলে আসার পর আয়ান একবার জিগ্যেস করেছিল মোহনাকে ‘ মা জুবিন আঙ্কেল আর আসে না তো?  

-আঙ্কেল ব্যস্ত আছে বোধহয়।

-মা, আঙ্কেল আমার ফোন কেটে দেয় কেন?

-তুই ফোন করেছিলি ?

-তোমাদের মধ্যে ঝগড়া হয়েছে ?

-না তো।

-তবে?

-জুবিন আঙ্কেল কে তুই মিস করিস?

-কিছুটা।

-বাবার থেকে বেশি ?

-বাবার কথা আসছে কেন? বাবা তো…

-বাবা তো…কি ?

-বাবা তো চাইলেও আসবে না। কিন্তু জুবিন আঙ্কেল তো …?

– কিন্তু আজ , কেউ যদি বলে জুবিন আঙ্কেলকে তোর বাবার জায়গায় বসাতে…তুই পারবি?

– না না… না…। 

-আমিও পারব না সোনা…।

ছোট্ট আয়ান এসে মোহনার গলাটা জড়িয়ে বুকে মুখ লুকিয়ে ফুঁপিয়ে উঠেছিল..।

……সেই থেকে মোহনার আয়ানকে নিয়ে একা একা পথ চলা শুরু। এর মাঝে পরিবর্তন বলতে যা হয়েছে তা হল সময়ের সাথে সাথে মোহনা নিজেকে আরও আর কঠিন করে ফেলেছে। আজকাল মাঝে মাঝে তার ভীষণ একা লাগে…যখন আয়ান অবাধ্য হয়ে ওঠে কেমন যেন হেল্পলেস লাগে… যদিও আয়ান খুব সেন্সেটিভ তবুও এক এক সময় সে মাকে ঠিক বুঝতে পারে না। মনে মনে ভাবলো মোহনা,  ‘নাহ আর নয় অনেক হয়েছে , এইতো জীবন…কে বলতে পারে কাল কি হবে?  শুধু কালকের কথা আর ভাববে না সে , এবার থেকে সে বর্তমানেই বাঁচতে শিখবে…ছোট ছোট মুহুর্তগুলো থেকেই তার ভালো লাগা খুঁজে নেবে…স্কুলের ছেলেমেয়েদের ওপর আর রাগ দেখাবে না…বেশি বেশি নম্বর কাটবে না…হই হই করবে ,সবাইকে নিয়ে থাকবে, দাদাদের সাথেই না হয় সময় কাটাবে…নিজের জন্য নয় এবার থেকে সে আয়ানের জন্যই নতুন ভাবে বাঁচবে । সব থেকে বড়ো কথা আজ আয়ানকে সে বলবে , ‘এই মোহনা আর আগের মোহনার মত গুমরে গুমরে থাকবে না রে । তার সেই জীবন্ত হৃদযন্ত্রটা তো বাতিল হয়েই গেছে কিন্তু যাবার আগে তাকে জীবনের সারটুকু শিখিয়ে দিয়ে গেছে…তার কানে কানে বলে গেছে ‘আনন্দ কর তাই নিয়ে যা তোমার কাছে এসেছে সহজে, যা রয়েছ তোমার চারিদিকে, তার মধ্যেই তোমার চিরন্তন সত্যের খোঁজ। ’ আরো বলবে, ‘আয়ান আমার এই মেটালিক হার্টটা আগের চেয়ে অনেকটা লিবারেল জানিস তো।এই হার্টটা আমায় বলেছে তোমার পাঁচটা না দশটা না একটাতো মোটে ছেলে …ওর মনের ইচ্ছেটা তুমি মেনেই নাও…তাই আমি বলি কি তোর ইচ্ছে মত তুই ইংলিশ নিয়েই পড়িস  …আমি আর আপত্তি করব না…’ আয়ানের খুশি ঝলমল মুখটার কথা চিন্তা করে মোহনার মনটা ভরে উঠল । মনে মনে এও ভাবলো আমি যত জেদই দেখাই তোর চাওয়ার কাছে আমার সব জেদ ফিকে হয়ে যায় …। আর সত্যি তো তুই জিতলে আমি সুখীই হই…তবুও তোর ওপর জোর খাটাতে ইচ্ছে করে …কারণ কেবল তুইই যে আমার একান্ত নিজের।

ভাবতে ভাবতে হঠাৎ দরজায় টোকা… মোহনা মুখ ঘুরিয়ে দেখল আয়ান আর দাদা… দাদা জিগেস করল …কিরে কেমন লাগছে?

-ভালো …

আয়ান এসে মায়ের হাতটা ধরল…মাথায় হাত বুলিয়ে দিল…

দাদা বলল,

-নিচে ডঃ গুপ্ত এসেছেন তোরা কথা বল, আমি একটু দেখা করে আসছি…

– আমি যাব মামা…?

-না তুই মায়ের কাছে থাক।

সিস্টার বললেন , ‘ওনাকে বেশি কথা বলাবেন না প্লিজ’।

আয়ান ঘাড় নাড়ল…

মোহনা আয়ানের মাথায় হাত রেখে বলল, ‘তোকে কিছু বলার আছে…’

-আমারও তোমাকে কিছু বলার আছে…আগে তুমি বলো।

-না তুই…

-না তুমি…

মোহনা ধীরে ধীরে আলতো গলায় থেমে থেমে বলল,

-আমি বলছি কি ,আমি অনেক ভাবলাম জানিস, তারপর মনে হল,…তুই তোর ইচ্ছামত ইংলিশ নিয়ে পড়তে পারিস আমার আর কোনও আপত্তি নেই।

-সেকি গো, আমি তো ভাবলাম তোমায় বলব, আমি জয়েন্টে এ বসব ইঞ্জিনিয়ারিং-এর জন্য। অনেক  হয়েছে আর মনমানি করব না… তোমার সব কথা শুনব এবার থেকে। তোমার ইচ্ছেটাকেই আমার বলে জানব…তুমি তো আমার ভালোর জন্যই সব বল…

-আচ্ছা…এইগুলোই বলার ছিল বুঝি তোর?

-না…

-তবে?

-তোমাকে একটা ফোন করতে হবে মা… আমার করা একটা ভুল তোমাকেই শুধরে দিতে হবে…তুমি প্লিজ না কর না…

-কিন্তু কাকে ফোন করব? কি ভুল …বুঝলাম না।

-দাঁড়াও …এক মিনিট , এই নাও ধরো আমি ফোন কানেক্ট করে দিয়েছি…

-আরে কার সাথে কথা বলব সেটা তো বল…

-জুবিন আঙ্কল…

-কিন্তু কেন? না না …

-কেন না?……প্লিজ মা সময় যেখানে থেমে ছিল , আমি চাই শুধু আরও একবার সময়ের সেই গতিটাকে ফিরে দেখতে…বাকি তো আবার সব সময়ের খেলা ……প্লিজ মা,  আমার জন্যে …রিং হচ্ছে …কথা বল তুমি।

মোহনা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল আয়ানের দিকে…এ কোন আয়ান …ছেলে না বন্ধু …না অভিভাবক…? আজ কত বড়ো লাগছে ওকে…চোখটা কেমন ঝাপসা হয়ে আসছে …কাঁপা কাঁপা হাতে ফোনটা ধরল…মোহনা…রিং হচ্ছে  ওপ্রান্তে…কিন্তু কি বলবে ও,  জুবিনকে ফোন করে…জুবিন এখন আছেই বা কোথায়? …বিয়ে করেছে কিনা জিগ্যেস করবে ?…না না এসব কি জিগ্যেস করা যায় নাকি?…

-হ্যালো…

-হ্যালো জুবিন…

-হুম কে ?

-আমি মোহনা বলছি…

-মোহনা?? সেকি… কোথায় তুমি? কেমন আছো ?

-ভালো…তুমি কোথায় আছো এখন?

……..এইভাবে শব্দ এর পর শব্দ , পদ , বাক্য…বাক্যের উদ্দেশ্য বিধেয়…পেরিয়ে কথা এগিয়ে চলল সময়ের গন্ডী ভেঙ্গে , আর আয়ান মোহনার পাশ থেকে উঠে এসে দাঁড়ালো জানলার পাশে…ফিরে দেখলো মায়ের সহজাত নরম হাসিটা , জানলার পাশে টলটলে জল…খোলা আকাশ , ঝলমলে রোদ্দুর……মনে হল এতকাল সে সত্যি কত ছেলেমানুষ ছিল, অবুঝ ছিল…মায়ের খুশিটুকুকে কেড়ে নিয়ে মাকে নিজের করে ধরে রাখতে চেয়েছিল সে , কিন্তু এমনভাবে তো ভালো থাকাও যায় না ভালো রাখাও যায় না…… সে জানে না শেষ পর্যন্ত সে কি নিয়ে পড়বে …সে এও জানে না জুবিন আঙ্কেলের সাথে মায়ের কতটা  যোগাযোগ হবে … কিন্তু তাদের দুজনের মনের মধ্যেই যে ‘না এর বেড়াজাল’ ছিল সেটা ভাঙ্গাটা যে খুব জরুরি ছিল… মনের এই গন্ডীটাকে ভাঙতে না পারলে তার ও তার মায়ের  নীলকন্ঠের জীবন তাদের কাছে যে দুর্বিসহ হয়ে উঠেছিল……মনে পড়ে যাচ্ছিল সেই টাটানগরের স্কুলের স্যারের কথা । উনি বলতেন কেউ যদি তোমাকে বুঝতে না পারে …তুমি তাকে কি জোর করে বোঝাতে পারো? জোর করে কি কিছু পাওয়া যায় ?…তার চাইতে তুমি একধাপ নিচে এসে তাকেই বোঝার চেষ্টা করে দেখ ……কত শান্তি ! সত্যি প্রিন্সিপাল স্যারের প্রতিটা কথা জীবনের কত বড় সত্য…উনি বোধহয় এটাই বোঝাতে চেয়েছিলেন …মা একলা…তাকে সঙ্গ দেওয়ার কেউ নেই…তাকেই তো সঙ্গ দিতে হবে সারাজীবন … তা সে কখনও সন্তানের মত…কখনও বন্ধুর মত …কখনও বা অভিভাবকের মত…সব মিলিয়ে আয়ান একটা লম্বা শ্বাস নিল…এবার তার নিজেকে কেমন যেন একটু বড়ো বড়ো মনে হতে লাগলো।   

_____________________________________________শেষ_________________________________________________

  
PAGE TOP
HTML Snippets Powered By : XYZScripts.com
Copy Protected by Chetans WP-Copyprotect.
Skip to toolbar