পর্ব – ৬।
জানলার পর্দাটা সরাতেই সকালের ঝকঝকে রোদ্দুর কাচের ভেতর দিয়ে চোখে পড়লো মোহনার …চিরকালই মোহনার চোখে আলো পড়লে ঘুম ভেঙ্গে যায়…আজও তার অন্যথা হল না। সিস্টারের এক গাল হাসিতে ‘গুডমর্নিং’ শুনে মোহনার বেশ লাগলো । সিস্টার বললেন,
-চলুন আপনাকে একটু ফ্রেশ করে দি। আজ আপনার বাড়ি থেকে দেখা করতে আসবে একে একে। স্যালাইন খুলে দিলে তারপর জল খেতে পারবেন।
অনেকদিন পর মোহনার মনটা বেশ লাগছে , আয়ানকে দেখতে পাবে বলে… আসলে আয়ান ছাড়া তো সে তার নিজের বলে কাউকেই ভাবতে পারে না… তাই মোহনারও যত জেদ ঐ আয়ানেরই ওপর…কিন্তু জেদ করে কি কিছু পাওয়া যায়…? আর আয়ানের জেদের কাছে তার সব জেদ যে তুচ্ছ এটা আয়ান কি বোঝে!!! মনে মনে মোহনা বলে ‘তোর জন্য আমি যে সব করতে পারি আয়ান…কিন্তু এটা কি তুই বুঝিস? আসলে তুই নিজেকে যত বড়োই ভাবিস না কেন , তুই যে আমার কাছে সবসময় ছেলেমানুষই থাকবি রে। তাই তোর ছোট্ট মনটায় যাতে আঘাত না লাগে তার জন্যই তো তুই যা চেয়েছিস মেনে এসেছি এতদিন ধরে…সে তোর মামার বাড়ি থেকে চলে আসাই হোক বা জুবিনের থেকে দূরে সরে থাকাই হোক…।’ মোহনার আবার মনে পড়ে গেল , সেই রাতের কথা। সেদিন আয়ানের অমন আচরনের পর সেও তো বড় ভয় পেয়ে গিয়েছিল… কি করলে ছেলেটার মন থেকে মিথ্যে ভাবনাটা দূর করবে তাই নিয়ে কত ভেবেছিল…তার জন্যই তো ,কদিন জুবিনের কোনও ফোন পর্যন্ত ধরে নি সে । অবশেষে জুবিন ল্যান্ডলাইনে ফোন করে, কথা হয় অনুজার সাথে , অনুজা তাকে বিকেলে বাড়ি আসতে বলে… মোহনা না চাইলেও অনুজার তত্ত্বাবধানে জুবিনের সাথে কথা বলতে বাধ্য হয় সে । অনেকটা যেন একটা আলোচনা সভার মত…।
যদিও মোহনা চাইনি অনুজা থাকুক, তবুও অনুজা ছিল ওদের মাঝে…আর অনুজার উদ্দেশ্যই ছিল জুবিনের সাথে মোহনাকে যেভাবে হোক বেঁধে ফেলার । তাই মোহনাকে চা করতে বলে অনুজা তার অনুপস্থিতিতে জুবিনকে বলেছিল…
-তুমি কি মোহনার ব্যাপারে কোনও সিদ্ধান্ত নিতে চাও জুবিন?
জুবিন একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছিল। পরিবেশটা হাল্কা করতে বলেছিল,
-বউদি, আমি মোহনাকে একটা সেকেন্ড থট ভাবার কথা বলতে চেয়েও পারিনি…কারণ আমি জানি আবীরদা যেরকম মানুষ ছিলেন তাতে করে ওর পক্ষে অন্য কাউকে মেনে নেওয়াটা সম্ভব নয়।
কথাগুলো কিচেন থেকে মোহনার কানে যেতেই উত্তেজিত ভাবে সে বলেছিল,
-হোয়াট দ্য হেল গোইং অন…বউদি, আমার লাইফ আমি কিভাবে কাটাব , সেটা কি তোমরা ঠিক করে দেবে।
-কি হয়েছে কি মৌ…আয়ান এখন ছোটো…তাছাড়া তোমার তো একটা জীবন আছে। কি এমন বয়স তোমার? জুবিন যদি রাজি থাকে , আই থিঙ্ক…
-প্লিজ , স্টপ দিস ননন্সেন্স…
-কেন ? এইভাবে বেরানো ঘোরা করছো, আজ বাদে কাল লোকে কিছু বললে তখন? তার থেকে সময় থাকতে নিজেদের মধ্যে একটা বোঝাপোড়া করে নিতে আপত্তি কোথায়?
-একটা ছেলে আর একটা মেয়ে মানেই অন্য কিছু কেন ভাবো বউদি… ?
-আমি না মৌ…সমাজ ভাবতে পারে । আমি জানি তোমরা বন্ধু কিন্তু এর চেয়ে একটু বেশি ভেবে দেখলে ক্ষতি কি? শুধু কি তাই তোমার ছেলেও তো তোমাদের শুধু বন্ধু ভাবতে পারছে না মৌ …আজ ও ছোটো, কিন্তু ব্যাপারটার অন্যরকম মানে করার চেয়ে একটা সুস্থ সম্পর্কে গেলে তোমার অসুবিধের কি আছে?
-প্লিজ তুমি থামো, বউদি আমি চাইনা এই কথাগুলো আয়ানের কানে যাক।
-কিন্তু মৌ জুবিনও তো বিয়ে থা করে নি , তুমি কতদিন এভাবে ওর সাথে মিছিমিছি ঘুরে বেড়াবে ? ওরও তো কোনও এক্সপেক্টেশন থাকতে পারে?
বউদির এই ধরনের কথায় মোহনা কতটা কষ্ট পাচ্ছিল সেটা বুঝতে জুবিনের একটুও অসুবিধে হয়নি তাই বোধহয় , জুবিন উঠে পড়েছিল সোফা ছেড়ে … আর মোহনার দিকে তাকিয়ে বলেছিল ,
-না না মোহনা, আমি কোনও কিছুর আশায় এখানে আসি না…জাস্ট আবীরদাকে ভালবাসি বলেই হয়ত , আয়ানের জন্য আসতাম , কিন্তু এখন মনে হচ্ছে… ব্যাপারটা ইতিমধ্যেই আয়ানের মনে একটা অন্য এফেক্ট ফেলেছে…যেটা হয়ত সময়ের সাথে সাথে আরও বিপদজনক হয়ে উঠতে পারে, সরি মোহনা, আমার মনে হয় আমার এখানে আসাটা ঠিক হচ্ছে না …
-হ্যাঁ ,একেবারে ঠিক কথা বলেছ। তুমি আর এবাড়িতে এস না জুবিন…আমার কোনও অসুবিধে হলে আমি তোমাকে জানাব …।
……জুবিন আর আসেনি …ফোনও করেনি …মোহনাও ডাকে নি আর কোনওদিন… এরপরই প্রায় মাস খানেকের মধ্যে মোহনা আয়ানকে নিয়ে আবীরের সন্তোষপুরের ফ্ল্যাটে উঠে গিয়েছিল। বাড়ির কারোর কথা শোনেনি…। মানিক তলা থেকে চলে আসার পর আয়ান একবার জিগ্যেস করেছিল মোহনাকে ‘ মা জুবিন আঙ্কেল আর আসে না তো?
-আঙ্কেল ব্যস্ত আছে বোধহয়।
-মা, আঙ্কেল আমার ফোন কেটে দেয় কেন?
-তুই ফোন করেছিলি ?
-তোমাদের মধ্যে ঝগড়া হয়েছে ?
-না তো।
-তবে?
-জুবিন আঙ্কেল কে তুই মিস করিস?
-কিছুটা।
-বাবার থেকে বেশি ?
-বাবার কথা আসছে কেন? বাবা তো…
-বাবা তো…কি ?
-বাবা তো চাইলেও আসবে না। কিন্তু জুবিন আঙ্কেল তো …?
– কিন্তু আজ , কেউ যদি বলে জুবিন আঙ্কেলকে তোর বাবার জায়গায় বসাতে…তুই পারবি?
– না না… না…।
-আমিও পারব না সোনা…।
ছোট্ট আয়ান এসে মোহনার গলাটা জড়িয়ে বুকে মুখ লুকিয়ে ফুঁপিয়ে উঠেছিল..।
……সেই থেকে মোহনার আয়ানকে নিয়ে একা একা পথ চলা শুরু। এর মাঝে পরিবর্তন বলতে যা হয়েছে তা হল সময়ের সাথে সাথে মোহনা নিজেকে আরও আর কঠিন করে ফেলেছে। আজকাল মাঝে মাঝে তার ভীষণ একা লাগে…যখন আয়ান অবাধ্য হয়ে ওঠে কেমন যেন হেল্পলেস লাগে… যদিও আয়ান খুব সেন্সেটিভ তবুও এক এক সময় সে মাকে ঠিক বুঝতে পারে না। মনে মনে ভাবলো মোহনা, ‘নাহ আর নয় অনেক হয়েছে , এইতো জীবন…কে বলতে পারে কাল কি হবে? শুধু কালকের কথা আর ভাববে না সে , এবার থেকে সে বর্তমানেই বাঁচতে শিখবে…ছোট ছোট মুহুর্তগুলো থেকেই তার ভালো লাগা খুঁজে নেবে…স্কুলের ছেলেমেয়েদের ওপর আর রাগ দেখাবে না…বেশি বেশি নম্বর কাটবে না…হই হই করবে ,সবাইকে নিয়ে থাকবে, দাদাদের সাথেই না হয় সময় কাটাবে…নিজের জন্য নয় এবার থেকে সে আয়ানের জন্যই নতুন ভাবে বাঁচবে । সব থেকে বড়ো কথা আজ আয়ানকে সে বলবে , ‘এই মোহনা আর আগের মোহনার মত গুমরে গুমরে থাকবে না রে । তার সেই জীবন্ত হৃদযন্ত্রটা তো বাতিল হয়েই গেছে কিন্তু যাবার আগে তাকে জীবনের সারটুকু শিখিয়ে দিয়ে গেছে…তার কানে কানে বলে গেছে ‘আনন্দ কর তাই নিয়ে যা তোমার কাছে এসেছে সহজে, যা রয়েছ তোমার চারিদিকে, তার মধ্যেই তোমার চিরন্তন সত্যের খোঁজ। ’ আরো বলবে, ‘আয়ান আমার এই মেটালিক হার্টটা আগের চেয়ে অনেকটা লিবারেল জানিস তো।এই হার্টটা আমায় বলেছে তোমার পাঁচটা না দশটা না একটাতো মোটে ছেলে …ওর মনের ইচ্ছেটা তুমি মেনেই নাও…তাই আমি বলি কি তোর ইচ্ছে মত তুই ইংলিশ নিয়েই পড়িস …আমি আর আপত্তি করব না…’ আয়ানের খুশি ঝলমল মুখটার কথা চিন্তা করে মোহনার মনটা ভরে উঠল । মনে মনে এও ভাবলো আমি যত জেদই দেখাই তোর চাওয়ার কাছে আমার সব জেদ ফিকে হয়ে যায় …। আর সত্যি তো তুই জিতলে আমি সুখীই হই…তবুও তোর ওপর জোর খাটাতে ইচ্ছে করে …কারণ কেবল তুইই যে আমার একান্ত নিজের।
ভাবতে ভাবতে হঠাৎ দরজায় টোকা… মোহনা মুখ ঘুরিয়ে দেখল আয়ান আর দাদা… দাদা জিগেস করল …কিরে কেমন লাগছে?
-ভালো …
আয়ান এসে মায়ের হাতটা ধরল…মাথায় হাত বুলিয়ে দিল…
দাদা বলল,
-নিচে ডঃ গুপ্ত এসেছেন তোরা কথা বল, আমি একটু দেখা করে আসছি…
– আমি যাব মামা…?
-না তুই মায়ের কাছে থাক।
সিস্টার বললেন , ‘ওনাকে বেশি কথা বলাবেন না প্লিজ’।
আয়ান ঘাড় নাড়ল…
মোহনা আয়ানের মাথায় হাত রেখে বলল, ‘তোকে কিছু বলার আছে…’
-আমারও তোমাকে কিছু বলার আছে…আগে তুমি বলো।
-না তুই…
-না তুমি…
মোহনা ধীরে ধীরে আলতো গলায় থেমে থেমে বলল,
-আমি বলছি কি ,আমি অনেক ভাবলাম জানিস, তারপর মনে হল,…তুই তোর ইচ্ছামত ইংলিশ নিয়ে পড়তে পারিস আমার আর কোনও আপত্তি নেই।
-সেকি গো, আমি তো ভাবলাম তোমায় বলব, আমি জয়েন্টে এ বসব ইঞ্জিনিয়ারিং-এর জন্য। অনেক হয়েছে আর মনমানি করব না… তোমার সব কথা শুনব এবার থেকে। তোমার ইচ্ছেটাকেই আমার বলে জানব…তুমি তো আমার ভালোর জন্যই সব বল…
-আচ্ছা…এইগুলোই বলার ছিল বুঝি তোর?
-না…
-তবে?
-তোমাকে একটা ফোন করতে হবে মা… আমার করা একটা ভুল তোমাকেই শুধরে দিতে হবে…তুমি প্লিজ না কর না…
-কিন্তু কাকে ফোন করব? কি ভুল …বুঝলাম না।
-দাঁড়াও …এক মিনিট , এই নাও ধরো আমি ফোন কানেক্ট করে দিয়েছি…
-আরে কার সাথে কথা বলব সেটা তো বল…
-জুবিন আঙ্কল…
-কিন্তু কেন? না না …
-কেন না?……প্লিজ মা সময় যেখানে থেমে ছিল , আমি চাই শুধু আরও একবার সময়ের সেই গতিটাকে ফিরে দেখতে…বাকি তো আবার সব সময়ের খেলা ……প্লিজ মা, আমার জন্যে …রিং হচ্ছে …কথা বল তুমি।
মোহনা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল আয়ানের দিকে…এ কোন আয়ান …ছেলে না বন্ধু …না অভিভাবক…? আজ কত বড়ো লাগছে ওকে…চোখটা কেমন ঝাপসা হয়ে আসছে …কাঁপা কাঁপা হাতে ফোনটা ধরল…মোহনা…রিং হচ্ছে ওপ্রান্তে…কিন্তু কি বলবে ও, জুবিনকে ফোন করে…জুবিন এখন আছেই বা কোথায়? …বিয়ে করেছে কিনা জিগ্যেস করবে ?…না না এসব কি জিগ্যেস করা যায় নাকি?…
-হ্যালো…
-হ্যালো জুবিন…
-হুম কে ?
-আমি মোহনা বলছি…
-মোহনা?? সেকি… কোথায় তুমি? কেমন আছো ?
-ভালো…তুমি কোথায় আছো এখন?
……..এইভাবে শব্দ এর পর শব্দ , পদ , বাক্য…বাক্যের উদ্দেশ্য বিধেয়…পেরিয়ে কথা এগিয়ে চলল সময়ের গন্ডী ভেঙ্গে , আর আয়ান মোহনার পাশ থেকে উঠে এসে দাঁড়ালো জানলার পাশে…ফিরে দেখলো মায়ের সহজাত নরম হাসিটা , জানলার পাশে টলটলে জল…খোলা আকাশ , ঝলমলে রোদ্দুর……মনে হল এতকাল সে সত্যি কত ছেলেমানুষ ছিল, অবুঝ ছিল…মায়ের খুশিটুকুকে কেড়ে নিয়ে মাকে নিজের করে ধরে রাখতে চেয়েছিল সে , কিন্তু এমনভাবে তো ভালো থাকাও যায় না ভালো রাখাও যায় না…… সে জানে না শেষ পর্যন্ত সে কি নিয়ে পড়বে …সে এও জানে না জুবিন আঙ্কেলের সাথে মায়ের কতটা যোগাযোগ হবে … কিন্তু তাদের দুজনের মনের মধ্যেই যে ‘না এর বেড়াজাল’ ছিল সেটা ভাঙ্গাটা যে খুব জরুরি ছিল… মনের এই গন্ডীটাকে ভাঙতে না পারলে তার ও তার মায়ের নীলকন্ঠের জীবন তাদের কাছে যে দুর্বিসহ হয়ে উঠেছিল……মনে পড়ে যাচ্ছিল সেই টাটানগরের স্কুলের স্যারের কথা । উনি বলতেন কেউ যদি তোমাকে বুঝতে না পারে …তুমি তাকে কি জোর করে বোঝাতে পারো? জোর করে কি কিছু পাওয়া যায় ?…তার চাইতে তুমি একধাপ নিচে এসে তাকেই বোঝার চেষ্টা করে দেখ ……কত শান্তি ! সত্যি প্রিন্সিপাল স্যারের প্রতিটা কথা জীবনের কত বড় সত্য…উনি বোধহয় এটাই বোঝাতে চেয়েছিলেন …মা একলা…তাকে সঙ্গ দেওয়ার কেউ নেই…তাকেই তো সঙ্গ দিতে হবে সারাজীবন … তা সে কখনও সন্তানের মত…কখনও বন্ধুর মত …কখনও বা অভিভাবকের মত…সব মিলিয়ে আয়ান একটা লম্বা শ্বাস নিল…এবার তার নিজেকে কেমন যেন একটু বড়ো বড়ো মনে হতে লাগলো।
_____________________________________________শেষ_________________________________________________