খুব সাবধানে শ্বাস প্রশ্বাসের ওঠাপড়া সামলে টেবিলে রাখা কেকের ওপর ঝুঁকে পড়ে আম্রপালী লিখছিল…“ জীর্ণ পুরাতন যাক ভেসে যাক” । এক হাতে ক্রিম কোন …আর অন্য হাতটা পিছনে রেখে…দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁটটা কামড়ে ধরে খুব মনযোগে তাকিয়ে ছিল লেখাটার দিকে…। পাশ থেকে আদৃতা বলে উঠল…”ফ্যাবুলাস মাম্মা…এক্সেলেন্ট হয়েছে ” …….লেখাটা লিখতে পেরে আম্রপালীর একটা পরিতৃপ্তি হল । আজ বছরের শেষ দিন । আদৃতার কিছু বন্ধুবান্ধব আসবে থার্টিফার্ষ্ট নাইট সেলেব্রেশনে । আর তারই প্রস্তুতিতে এই কেক বানানো । কে বলবে আম্রপালী আর আদৃতা , মা ও মেয়ে… দুজনেই হুল্লোরবাজ । আম্রপালী একটি কাগজের অফিসে সহসম্পাদক আর প্রাচী ওর অফিস কলিগ । প্রাচী আজ ওদের সাথে সহযোগিতায় আছে । কেক সাজানো শেষ হতেই আদৃতা এবার মেতে গেল ঘর সাজানোয় ।

প্রাচী বলল “আদৃতা কত বড়ো হয়ে গেল !”
পালিঃ হুম , তো ?
প্রাচীঃ তা ওর কোনও বয়ফ্রেন্ড হয়েছে নাকি রে?
পালিঃ দাঁড়া আগে আমার বয়ফ্রেন্ড হওয়া শেষ হোক তারপর তো!
প্রাচীঃ যাঃ …ইটস টু মাচ…ও শুনলে কি ভাববে?
পালিঃ ও জানে …মাঝে মাঝে আমাকে রাগায় তো ? বলে প্লিজ মাম্মা তুমি আর আমার আঙ্কেলের সংখ্যা বাড়িও না…আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি নাম মনে রাখতে রাখতে ।
আমি বলি “তোর নাম মনে রাখার দরকার কি ? আমার মনে থাকলেই হবে ।”
দুজনেই হেসে ওঠে ……দুপুরে লাঞ্চ করে বিকালে প্রাচী বেরিয়ে যায় ।
সন্ধ্যেবেলা সারা ঘরটা , লাইট মিউজিক …স্টারস, স্ট্রিমারস , ল্যানটার্ন , লাল নীল আলোয় যেন বদলে গেল । আদৃতার বন্ধুরা সব আসতে শুরু করে দিয়েছে…। হাই আন্টি …হ্যালো আন্টি……পালী ওদেরকে একটু স্পেস দিয়ে উঠে আসে দোতলায় নিজের ঘরে…টিভি চলছে বটে ……কিন্তু পালীর মন কোথায় ?……..ফোনটা নিয়ে একটু নাড়াঘাঁটা করে ভাবে “ দীপ্রকে একটা ফোন করলে হত”……দীপ্রর ফোনটা বেশ কিছুক্ষন রিং হয়ে কেটে যায় । পালীর মনটাও কেমন যেন একটু ভারী ভারী লাগে।
……ছোটোবেলায় বাইরে বাইরে মানুষ হয়েছে পালী , একটা সময় ছিল জামাকাপড়ের মত বয়ফ্রেন্ড বদলাতো …খালি খালি প্রেমে পড়ে যেত…কারোর কথা বলার ধরনে …কারোর হাতের লেখায়…কারোর হাসিতে…কারোর তাকানোয়……কিন্তু কিছুদিন ঘোরাফেরা , খাওয়া-দাওয়ার পর দমটা বন্ধ হয়ে যেত শাসনের ঘনঘটায় । ভাবত কেন এত অধিকারবোধ মানুষের ? দীপ্রর সাথে বিয়ের পর , এমনকি আদৃতা হওয়ার পরও , তার মনটা পালাই পালাই করত । …দীপ্রদের উত্তর কোলকাতার বনেদীয়ানা , অযাচিত শাসন , চোরা চোখের চাউনি, সর্বোপরি আচার বিচার , না-এর বেড়াজালে প্রতিনিয়ত হাঁফিয়ে উঠেছিল আম্রপালী । দীপ্র জানতো তার পক্ষে এইসব আভিজাত্য কাটিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভবই নয়……তাই আর আটকায়নি আম্রপালীকে……আদৃতাকে নিয়ে পালী এসে উঠেছিল তার বাবার বাড়িতে……শেষমেশ দুই পরিবারের চাপে ডাইভোর্সটা হয়েও গিয়েছিল…। কিন্তু দীপ্র আদৃতার সব দায়িত্ব নিয়েছিল। পালীর কোনো ওজোর আপত্তি শোনেনি। ছোটোবেলা থেকেই আদৃতা দেখেছে বাবা মা দুটো ভিন্ন পরিবেশে থাকে…। কিন্তু পরম আস্থায় দুজনে দুজনের পাশে থাকে । …দুজনেই দুভাবে ভালবাসায় তার মনোভাবে স্বাধীনতা এনে দিয়েছিল তাই…বন্ধন আর মুক্তির সংজ্ঞাটা তার কাছে একটু অন্যরকম ।
এই একবছর হল দীপ্র নিউজার্সি গেছে অফিসের কাজে……আগে দুজনে দুবাড়িতে থেকেছে ……দুই শহরে থেকেছে……কিন্তু এতদূরে…এতদিন একে অপরকে না দেখে থাকেনি কখনও । তাই পালী কিন্তু এত বন্ধুর মাঝেও , বন্ধনের টানটা অনুভব করে দীপ্রর সাথেই…..একেবারে মন থেকে …মাঝে মাঝে শরীর থেকেও । এইসব ভাবতে ভাবতে কখন যে তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছিল পালী!……দীপ্রর ফোনে রেশটা কেটে গেল । ফোন ধরে পালী বলল………
হ্যালো
হ্যালো…ফোন করেছিলে…? আমি ড্রাইভ করছিলাম …এই অফিসে ঢুকলাম …বলো কি খবর ? আদৃতা কি করছে ?
ও বন্ধুদের সাথে পার্টিতে নিচের ঘরে…আমি টিভি দেখছি ।
কেন …তোমার ভক্তরা আজ কেউ তোমাকে সঙ্গ দিল না?
যাঃ কি যে বলো…ওরা তো টাইম পাস ……
কি বলছো…এলেবেলে ? এমন সীতাভক্ত হনুমান সব…
তোমার পার্টি সার্টি নেই?
আছে তো ……সবেতো সকাল……সন্ধ্যেটা হতে দাও!!
তুমি কবে আসবে দীপ্র ?…এক বছরে বেশ ক্লান্ত লাগছে আমার…
সে কি…আজ এতো বছর পরে ? তুমি তো এটাই চেয়েছিলে পালী?
তুমিও তো আটকাওনি?
আটকালে কি মানতে তখন ?
চেষ্টাতো করে দেখতে পারতে?
তাই বুঝি ? আচ্ছা এবার ফিরে গিয়ে দেখব ? বাই দ্য ওয়ে আগাম শুভ নববর্ষ
হুম, সেম টু ইউ…তুমি ফিরে এসো দীপ্র…আই উইল ওয়েট ফর ইউ…
ফোনটা কেটে নিজের মনে একটু হেসে এক দু ফোঁটা চোখের জল মুছতে না মুছতেই , দমকা হাওয়ার মত ঘরে ঢুকল আদৃতা…। ঘড়িটা দেখিয়ে পালীর গলা জড়িয়ে ধরে বলল………
“মাম্মা স্টার্টস কাউন্ট ডাউন…….লেটস কাউন্ট …নাইন , এইট , সেভেন , সিক্স , ফাইভ , ফোর , থ্রী , টু , ওয়ান……জিরো …হ্যাপি নিউ ইয়ার টু ইউ !!!!!!!”