পর্ব-২


     এক একদিন রাতে লেখার ভুত চাপে অনীশের। তখন সারাদিনের সমস্ত ক্লান্তি অবসাদ…চাওয়া পাওয়া সবকিছু সরিয়ে রেখে তার ভেতরে চলে এক ভাঙ্গাগড়া… শব্দ নির্মানের প্রবল দায়…সে যেন এক প্রসব যন্ত্রণা …কিছু ভালো লাগে না তখন অনীশের…স্টাডি রুমের আলো জ্বলতে থাকে কত রাত পর্যন্ত ……শব্দ সৃষ্টির তাড়নায় সে তার অলীক ভাবনাগুলোকে ভেঙ্গে চুড়ে নিংড়ে বীর্যপাত ঘটায় তার কলমের ডগায়। তারপর গভীর রাতে যখন আবেগ প্রশমন হয় তার খাতার পাতায়, নেমে আসে এক পরম শান্তি।
……সেদিনও এমনি অনেকটা রাত জেগে লেখালেখির পর অনীশের আর ঘুম আসতে চায় নি। স্টাডি ছেড়ে ঘরে এল অনীশ। বিছানায় বসে পাশের টেবিল ল্যাম্পটা জ্বালিয়ে সিগারেট ধরালো সে। রাত তখন পৌনে তিনটে হবে। পাশে অকাতরে ঘুমিয়ে আছে পৃথা। কপালের ওপর খোলা চুলগুলো ফ্যানের হাওয়ায় মাঝে মাঝে মুখে এসে পড়ছে, রাত পোশাকে শরীরের সমস্ত বাঁধন তখন হালকা…ঘরের সেই আলো আঁধারির মধ্যে কেমন যেন অনন্য সাধারন হয়ে উঠেছে পৃথা । তার সেই স্নিগ্ধ মায়াময়ী মুখের দিকে অপলকে তাকিয়ে রইল অনীশ বেশ কিছুক্ষণ। সকালে পেলেকে নিজের হাতে রেডি করে স্কুলে পাঠানো থেকে রাতে সবার খাওয়া দাওয়ার পর বাবার পান সেজে দেওয়া পর্যন্ত চলে তার কর্মকান্ড। এক কথায় বেশ গুছিয়ে নিয়েছে পৃথা তাদের সংসারটাকে । সত্যি বলতে সে সংসার করতেই ভালোবাসে। আর সব মেয়েদের মনের ভেতর যেমন ঘর বরের, সুখী গৃহকোণের একটা নিটোল ভাবনা থাকে, পৃথারও তেমনই কিছুটা আছে মনে হয়। না হলে অনীশের মত এমন ভাবুক ছেলের সাথে ঘর করা মুখের কথা নয়…। ছোটোবেলা থেকেই অনীশের যেন কেমন স্বপ্ন স্বপ্ন মন। তার মনোজগতের ভালোলাগা না লাগা, ভাঙ্গাগড়ার হদিশ বোধ করি সে ছাড়া আর কেউই জানে না । তার এই খামখেয়ালিপনা কোনোদিন তাকে কেরিয়ার সচেতন হতেও দেই নি… ইঁদুরদৌড়ে নাম লেখাতে যেভাবে ছুটে চলেছে নতুন প্রজন্ম অনীশ তার আওতার মধ্যে পড়েই না। তার মধ্যে সেই ইচ্ছেটার সিকি ভাগও দেখতে পাওয়া যায় না। তাই তার বাবা অম্বরীশ মিত্র তাদের পারিবারিক ল্যাবরেটরি ইন্সট্রুমেন্টের ব্যবসার কাজে ব্যাস্ত রাখতে চেষ্টা করেছেন তার একমাত্র সন্তান অনীশকে, তা প্রায় তার বিয়ের পর থেকেই । যদিও এখন সে ব্যবসার কাজকর্ম বেশ দায়িত্ব নিয়েই দেখাশনা করে তবুও তার ভালো লাগে না এই দিনগত পাপক্ষয়ের ব্যাপারটা… রোজকার এত হিসেব নিকেশ লাভ ক্ষতি। মাঝে মাঝে কেমন যেন জীবন-যন্ত্রনা হয়ে দাঁড়ায় তার কাছে এই সমস্ত ফ্যাক্টরির কাজ, ওয়ার্কশপের কাজের দেখভাল করাটা। তার বেরিয়ে পড়তে ইচ্ছে করে সব কিছু ছেড়েছুড়ে সেই আগের মতন…একা একা…উদ্দেশ্যহীন ভাবে।
……………ছেলের এইসব বাউন্ডুলে ভাবগতিক দেখেই অম্বরীশ নিজে থেকেই খোঁজখবর করে অনীশের সাথে পৃথার বিয়ের সম্বন্ধটা করেছিলেন একটু আগেভাগেই…তার ধারণা ছিল …‘কাচায় না নোয়ালে বাঁশ …পাকলে পরে ঠাস ঠাস’… । হাজারো ওজোর আপত্তি থাকলেও বাবার মুখের ওপর না বলে ওঠার সাহস করে উঠতে পারে নি অনীশ। শেষমেশ অনীশ আর পৃথার বিয়েটা হয়েই যায়। যদিও কিন্তু বিয়ের প্রথম প্রথম তার পৃথাকে মানতে বেশ অসুবিধে হয়েছিল… কারন ইতিমধ্যেই সে প্রেমে আঘাত পেয়ে খানিকটা বিধ্বস্ত হয়েই পড়েছিল ……তারপর ধীরে ধীরে পৃথার মমতায় আর বন্ধুতায় অনেকটা ঝড় ঝাপটা কাটিয়ে , তাদের সমান্তরাল সম্পর্কটা পেলের হাত ধরে একটা সামতলিক রূপরেখা ফিরে পেয়েছে একসময় । দেখতে দেখতে আজ তাদের বিবাহিত জীবন প্রায় বছর ছয়েকের হতে চলল। আর কেমনভাবে অনীশও যেন এই ক’বছরে বেশ নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে পৃথার ওপর। সেদিনের সেই অনীশ আজ অনেক বেশি গৃহি ।
…এইসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে অনেক সাধ্যি সাধনার পর যখন ঘুম এল অনীশের দুচোখ জুড়ে , তখন প্রায় ভোর হয়ে এসেছে। …ঘুমের মধ্যে ধোঁয়া ধোঁয়া এক গভীর অন্ধকারের মাঝে, থেকে থেকে ভেসে উঠতে লাগলো সারি সারি অচেনা মুখ…… কুলি হাঁকাহাঁকি …চা ওয়ালার ডাক “চায়ে গরম …চায়ে গরম” …… ট্রেনের ঘষটানির শব্দ… চারিদিকে শুধু যাত্রীদের ঢল , কালিঝুলি মাখা ভিখারি পথশিশুর মুখ… ইতস্তত বিক্ষিপ্ত মানুষের জটলা ।… ব্যাস্ততার এক সুনিপুন চিত্র …কানে আসতে থাকলো কিছু টুকরো টুকরো কথা। সুদীর্ঘ এক প্ল্যাটফর্ম…বেঞ্চে বেঞ্চে রাখা বাক্স প্যাঁটরা… কিন্তু সবাই যেন স্থির চিত্রের মত উন্মুখ হয়ে আছে কিসের অপেক্ষায়… ঘন ঘন মাইকে টিং টং শব্দ …এরই মাঝে শোনা গেল একটা ঘোষণা …“ টু থ্রী নাইন আপ পাঁশকুড়া লোকাল সকাল ছটা পনেরো, প্ল্যাটফর্ম নম্বর চোদ্দোর পরিবর্তে প্ল্যাটফর্ম নম্বর তেরো থেকে ছাড়বে ।” …চারিদিকের চিত্রটা যেন মুহূর্তের মধ্যে বদলে যেতে লাগলো… কেমন সরব হয়ে উঠল আশপাশটা …ছোটাছুটি ….. ডাকাডাকি …হৈ হৈ…গম গম করে উঠল…কিসের যেন একটা চরম ব্যাস্ততা …দমচাপা অপেক্ষা…হঠাৎ সব যেন কেমন নড়ে চড়ে উঠল… সরে সরে যেতে লাগলো প্ল্যাটফর্মটা… জানলা দিয়ে যতদূর চোখ যায় শুধু এক নিমেষহীন দৃষ্টি … একবুক অতৃপ্তি …চারিদিকের ভীড় ঠেলে ট্রেনটা স্টার্ট নিয়েও ঝাঁকুনি দিয়ে থেমে গেল আর সেই সঙ্গে তীব্র এক হুইসেলের শব্দে চমকে উঠে পা দুটো খাটের ধারে ঠুকে গেল অনীশের… ঘুমটা ভেঙ্গে গেল তার…ঘন ঘন শ্বাস প্রশ্বাসের ওঠাপড়ায় ততক্ষণে পলকে গায়েব হয়ে গেছে প্ল্যাটফর্মের সেই দৃশ্যপট, এখন চারিদিকে শুধু এক সীমাহীন নীরবতা… চোখ মেলে ঠায় তাকিয়ে রইল অনীশ সিলিং-এর দিকে… কেমন যেন বোকা হয়ে গেছে সে…। সারা শরীর ঘামে ভিজে গেছে …গলায় আকন্ঠ এক তৃষ্ণা… বাইরে তখন ভোরের মৃদু আলোর হাতছানি আর পাখির কিচিরমিচির শব্দ। …স্বপ্ন কেন এমন হয়? আর কেনই বা এমনভাবে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায় মানুষকে তা আজও অনীশ বুঝে উঠতে পারে নি …। কেন যে দেখে এই স্বপ্নটা সে বারে বারে…?কে জানে!
-কিগো এতো ঘামছো কেন? জল খাবে? দাঁড়াও আমি দিচ্ছি।
-না না ঠিক আছে। আমি নিয়ে নিচ্ছি । তুমি শুয়ে থাকো।
বিছানায় উঠে বসে, সাইড টেবিলে রাখা জলের জগ থেকে এক নিঃশ্বাসে অনেকটা জল খেয়ে নিল অনীশ।পৃথাও তখন উঠে পড়েছে… আলগোছে হাত খোঁপা বানাচ্ছে তার চুলে। বিছানা ছেড়ে উঠে দক্ষিনের বারান্দায় এসে দাঁড়ালো অনীশ। নিচে তাকিয়ে দেখলো বসুধা তখন সবেমাত্র স্নান সেরে তামার ঘটি থেকে সদর দরজায় জল ছিটচ্ছেন…পরনে লাল পেড়ে শাড়ি… কপালে সিঁদুরের বড় টিপ… হাতে ফুলের সাজি। মায়ের এই চেহারাটার মধ্যে কেমন একটা স্বস্তির আশ্রয় খুঁজে পায় অনীশ…। বাগানে আজ অনেক ফুলের সমারোহ …জবা , টগর , গন্ধরাজ , গাঁদা …। বেশ একটা হালকা হাওয়ায় তার গায়ের ঘামটা শুকিয়ে আসছে…আর ধীরে ধীরে ঝাপসা হয়ে আসছে তার ভোরের দেখা স্বপ্নের রেশটা…।

……………………..……………………..……………………..………………..ক্রমশ