পর্ব – ৩।
সকাল বেলাটা বেশ ঝকঝকেই হয়ে আছে আজ… যদিও কিন্তু মাঝে মধ্যেই একটু মেঘের আনাগোনা আকাশে …আর সেই মেঘের মধ্যে দিয়ে যেন সূর্যের আলো ঠিকরে বেরোচ্ছে এক এক সময় …গত কয়েকদিন ধরেই চাঁদের মনটা বড়ো এলোমেলো হয়ে আছে…।চাঁদ সম্পর্কের টানাপোড়েনে একটু বেশি ই বেসামাল হয়ে পড়ে আজকাল ,অথচ সে কিন্তু এরকম ছিল না আগে । তার সহনশীল দৃঢ় স্বভাবটায় যে অস্থিরতার ছোঁয়া এসেছে…..তাতে চাঁদ নিজেকে কেমন একটু অসহায় মনে করছে…..আজ তাকে একটু বেরোতে হবে…..সে দক্ষিণাপনে যাবে….মৃগনয়নীতে তার পর্দার অর্ডার দেওয়া ছিল….ডেলিভারি নিতে হবে । বাসস্ট্যান্ডে এসে চাঁদ ট্যাক্সি ধরল….গাড়ি যখন বিদ্যাসাগর সেতুর ওপরে উঠল …..জানলার ভিতর দিয়ে তার চোখ চলে গেল একটু এগিয়ে থাকা একটা চলন্ত সিটিসি বাসের দিকে ।ক্রমে ক্রমে দূরত্ব কমে বাসটার পাশাপাশি এলে তার চোখে পড়ল বাসের জানলার ধারে বসা যাত্রীদের মুখের ওপর…..অনেক মুখের ভিড়ে সে যেন পনেরো বছর আগেকার চাঁদ কে দেখতে পেল….. ……..অধীর আগ্রহে জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে এপাশ ওপাশ কি এত দেখছে চাঁদ ?…..কাকে খুঁজছে চাঁদ ? ৯:১৫এর সিটিসি বাসে রোজ চাঁদ কলেজের পথে পা বাড়ায়…।কখনও কোনো পিছুটান তাকে এমন করে উদ্বিগ্ন করে নি তো আগে…।সময়টা যেন ছুটছে …..চাঁদ জানলা দিয়ে যতদূর চোখ যায় দেখে যাচ্ছে ….বাসটা স্টার্ট নিল….চাঁদের মনটা কেমন যেন বিমর্ষ হয়ে গেল ……হঠাৎ….রাস্তার উল্টোদিকে চোখ গেল…. চাঁদ দেখল ভীষন দ্রুততায় রাস্তার ওপার থেকে ছুটে আসছে সোহম!!! বাসের গায়ে জোরে দুটো ধাক্কা মারতেই কন্ডাক্টর বেল মারল….বাসের গতি শ্লথ হয়ে আসল…আর বাসের দরজা খুলে হাঁপাতে হাঁপাতে সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসল সোহম….যেন মূর্ত মুহুর্ত…..চাঁদকে দেখে একগাল হেসে বলল ‘ব্যাগটা ধর’….চাঁদ ওর হাত থেকে ব্যাগ….ড্রাফটার সব নিয়ে নিল এমনভাবে….যেন পারলে সোহমকেও ধরে নিত….সোহম একটু দম নিয়ে চাঁদের সিটের সামনে উঠে এসে দাঁড়াল….সোহমের গোটা মুখটা লাল হয়ে আছে….কপালের পাশ দিয়ে ঘাম গড়াচ্ছে….এমনকি দাড়ি গোঁফের খাঁজেও ঘামের বিন্দু চিকচিক করছে…..চাঁদের দিকে তাকিয়ে বলল….’তোর জন্যে পনেরো মিনিট আগের বাসটা ধরতে হল..’চাঁদ বুঝতে পারলো…তার মধ্যে যে প্রচন্ড উত্তেজনাটা ছিলো …..সেটা একটু কমেছে….তার রুদ্ধশ্বাসটাও যেন একটু হালকা হয়েছে….তার পাশে বসা ভদ্রলোকটি সোহমকে মাথা থেকে পা পর্যন্ত বার দুয়েক জরিপ করল….এতক্ষণ পর্যন্ত চাঁদ একটিও কথা বলে নি ….এবার চাঁদ সোহমের আরক্ত মুখের দিকে তাকিয়ে বলল….’জল খাবি?’ সোহম: দে …. ব্যাগের ভেতর থেকে জলের বোতল বার করে সোহমকে দিয়ে চাঁদ বলল ‘বাপরে…এভাবে কেউ দৌড়োয় নাকি…’ সোহম জল খেতে খেতে বলল….’আগে আগে ক্লাসে পৌঁছেই বা লাভ কি? একি স্কুল নাকি….? জলের বোতলের মাথাটা আটকে ব্যাগে ভরতে ভরতে …. চাঁদ: আজও কি আবার গড়িয়া হাটে নেমে যাবি নাকি? চশমার ওপর দিয়ে ঈষৎ ভুরু কুঁচকে একটা অদ্ভুত মন পড়ে ফেলা দৃষ্টি নিয়ে…আর একটা সবজান্তা একপেশে দাঁতে চাপা হাসি হেসে….চাঁদের দিকে তাকিয়ে বলল…… সোহম: নামলে কি তোর ভালো লাগবে ? চাঁদ : (সরাসরি চোখে চোখ রেখে একটু হেসে ) না, ভালো লাগবে না …..তাহলে আর একসঙ্গে যাওয়ার মানে কি হল? ……বাসটা বিদ্যাসাগর সেতুর ওপর উঠতেই হু হু করে গঙ্গার একরাশ ঠান্ডা জোলো হাওয়ায় চাঁদের খোলা চুলটা তার চোখে মুখে ছড়িয়ে গেল…..চাঁদ জানলার দিকে তাকিয়ে ছিল যদিও ….তবু তার মনে হচ্ছিল সোহমের দুজোড়া চোখ যেন নৈশব্দের আড়ালে তাকেই জরীপ করছে……হঠাৎ চাঁদের পাশের ভদ্রলোকটি উঠে পড়ল….আর সোহম বসে পড়ল সিটটায়….চাঁদ যেন এই মুহূর্তটারই অপেক্ষায় ছিলো ….সোহম শার্টের কলারটা পিছনে একটু ঠেলে দিয়ে জানলার হাওয়ায় একবুক শ্বাস নিয়ে বলল….’দে…আমার সম্পত্তি !’…চাঁদের কাছ থেকে নিজের ব্যাগ, ড্রাফটার নিতে নিতে বলল…আমার কিন্ত রোজই এরকম একটু দেরী হবে…’তুই চাইলে অপেক্ষা নাও করতে পারিস…’
চাঁদ: চাইলে কি পনেরো মিনিট মেক আপ করা যায় না? নাহলে তো একসাথে আর যাওয়া হবে না….
সোহম: যায় হয়ত….কিন্তু আমি আমার আমার মতে চলি… দাসত্ব আমার রক্তে নেই বুঝলি ….আমি সোহম… মানে ….আমিই ব্রহ্ম ….চাইলে আমি জগত সৃষ্টি করতে পারি, সময় ছুঁতে পারি, সূর্যকে চালাতে পারি আমার হুকুমে….আর চাঁদ তো মুঠোয়……হা হা হা….কেমন বললাম বল?…তোর চন্দ্রিমা নামটাকে একটু সংক্ষিপ্ত করে দিলাম…..আপত্তি নেই তো ?
চাঁদ: না…তবে আমি কিন্তু তোর হুকুমের টেক্কা নই ,আর আমিও তোকে সোহম সোহম করতে পারব না….
সোহম: আচ্ছা? বেশ…কি বলবি শুনি….
চাঁদ: আমি তোকে ডাকব ‘ওম্ ‘বলে…
সোহম: ওম???
…… একমুহূর্তে সোহমের মনে হল তার চারপাশের পৃথিবীটা বদলে গিয়েছে বুঝি ….ধুসর থেকে লাল নীল রঙিন ….তার ভেতরে বসত করা বেয়াড়া আমিটা তার রক্তমাংসের শরীরের খোলস ছেড়ে বেরিয়ে তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তাকে প্রশ্ন করেছে ‘এ কোন সোহম গাঙ্গুলী?’….
সোহমকে চুপ থাকতে দেখে চাঁদ বলল, ‘ আজ থেকে তোর জীবনে রেনেসাঁস এল ।’
সোহম বলল: সেকি রে? আয়নার সামনে এত বছর ধরে আলগোছে যাকে দেখে আসছি ……তার জন্ম হল মোটে কয়েক সেকেন্ড আগে ?
চাঁদ : হুম … জানিস কি , কে যেন বলেছিলেন ‘মানুষের জন্ম কেবল একবারমাত্র হয়ই না….একটা জীবনে মানুষ কয়েক লক্ষ বার জন্মায় …..জন্ম শুধুমাত্র শরীরের পিতৃদত্ত সম্পত্তি নয় , মানুষ মনে মনে অসংখ্য বার জন্মা নেয় …..শারীরিক জন্মগুলোর মৃত্যু আছে…কিন্তু এই জন্মগুলোর কোনও শেষ নেই….শুধু বিস্তার আছে আজন্ম ….আকাশের মত…..বিজ্ঞানের মত….সূর্যের মত…। সোহম: সাবাস…..তুই কি লেখালিখি করিস নাকি?
চাঁদ: সেরকম নয়….মাঝেসাঝে, ইচ্ছে-টিচ্ছে হলে….কেন বলতো?
সোহম: না চাঁদ…..তুই লেখ….তোর শব্দচয়ণ বেশ ভালো …..তার সাথে এটুকু বলতে পারি….তুই একটা মুহুর্ত তৈরি করতে পারিস….তুই কবিতা পড়িস?
চাঁদ: ভীষণ ভাবে…..আমি এখনকার কবিদের মধ্যে সুবোধ সরকার….পুর্ণেন্দু পত্রী পড়তে ভীষণ ভালোবাসি …..তুই পড়েছিস ???
সোহম: হুমমম……তবে রবীন্দ্রনাথ আমার প্রাণ….আমাদের বাঙালিদের রক্ত মাংস হাড় মজ্জায় মিশে আছেন রবি ঠাকুর ……
এমনি করেই কবি বিষ্ণু দে , শঙ্খ ঘোষ ,দীনেশ দাস …….চাঁদ আর ওমের গতিময় জীবনের প্রাত্যহিকি হয়ে উঠলেন…….আর সঙ্গে তো রইলেনই শক্তি-সুনীল-সুবোধের মত বড়ো মাপের কবিরা…. রবীন্দ্রসদন স্টপেজ আসতেই ওমকে অবাক করে ‘উঠি’ বলে চাঁদ হঠাৎ সিট ছেড়ে উঠে পড়ল….
ওম: কিরে এত তাড়াতাড়ি উঠছিস….একটা স্টপেজ আগেই নামবি নাকি…?
চাঁদ: …(একটু হেসে) আজ আমার ক্লাস সেকেন্ড হাফে….তুই একসাথে যাবি বলেছিলি বলে এই সময়টায় এলাম(একটু থেমে)…..পিজি হসপিটালে আমার এক দিদি আর .এম.ও….ওর সাথে দেখা করব….দরকার আছে । সোহম কি বলবে বুঝে উঠতে পারছিল না……একটু এগিয়ে বাসের দরজার মুখে এসে চাঁদ ওমের দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে বলে ‘আর হ্যাঁ…আমি কিন্তু চেষ্টা করব ৯:১৫ এর বাসটাই ধরার…..তাই’……বাসটা থেমে গেল ,বাসের দরজা খুলে চাঁদ নেমে পড়ল….ও চাইলে ফিরে তাকাতেই পারত…কিন্তু ও জানে আজ হয়ত সোহম ওর চলার পথটা অনুসরণ করবে…..এটা না হলে আজ আরও একবার যে চাঁদ নিজেকে অবহেলিত মনে করবে…থাক না এই ভাবনাটা….ক্ষতি কি আছে….???
……সত্যিই কিন্তু সোহম আজ চাঁদের একটু ফিরে চাওয়ার জন্যে অপেক্ষা করে রইল…মুখে কিছু না বললেও চাঁদের পুতুল পুতুল স্নিগ্ধ মুখটার মধ্যে কোথা থেকে এতটা আত্মপ্রত্যয় এল….তাই ভাবতে ভাবতে নিজেকে একটু অন্যরকম মনে হল সোহমের….কয়েক মুহুর্ত আগে জন্মানো ওমের জন্যে কেমন যেন একটু বদলে যেতে ইচ্ছে করল সোহমের!!!!
……………………………………………………………………………………………………….ক্রমশ