
কথার ওপর কেবল কথা @Oindrila
আজকের সকালটা আর পাঁচটা সকালের থেকে একেবারে অন্যরকম । বলা ভালো ভীষণ ভীষণ মনখারাপের । গতকাল আমাদের স্কুলের রি-ইউনিয়ন ছিল ,অনেকের সাথে দেখা হল যদিও আমাদের ব্যাচের সেরকম কাউকে চোখেই পড়ল না….তবুও বড় ছোটো সবার মাঝে নিজেকে একা মনে হয়নি। এই স্কুলের ব্যাপারে আমার একটি অভিমান আজও মনের মধ্যে জমা হয়ে আছে….উচ্চ মাধ্যমিকে স্কুলে থার্ড হওয়া আর অঙ্কে হায়েস্ট স্কোর পাওয়া সত্ত্বেও স্কুল থেকে প্রাইজ ডিস্ট্রিবিশনে আমার কেন কোনো ডাক আসে নি….সে প্রশ্ন আজও মনকে কিঞ্চিৎ কষ্ট দেয় বইকি! সারাজীবনে স্কুলে অনেক প্রাইজ পেয়েছিলাম , সর্বোপরি স্কুলের সব বিষয়ে মাথা গলানো মেয়েদের মধ্যে আমিও পড়তাম….তাই আমার নামের পরিচিতির মোহ আমাকে কোনোদিন খ্যাতির কাঙাল করে তোলে নি। এই স্কুলই কিন্তু আমাকে শিখিয়েছে ‘তোমার বাইরের আমিত্বের বাইরেও তোমার একটা ভেতরের আমি আছে যার কাছে ষোলো আনা সৎ থাকাটা জরুরী ।’ ছোটোবেলা থেকেই আমি লক্ষ্য করেছি আমার ভালোবাসার বিষয়গুলো বড় তাৎক্ষণিক আর ক্ষণস্থায়ী…তবুও যখন যা আগলাতে গেছি তাই হারিয়ে গেছে….তাই আমার অ্যাটাচমেন্টে বড় ভয়…জীবনের প্রতিটি বাঁকে এসে আজ আমি নিজেই এড়িয়ে চলি সমস্ত রকম মোহ…হারিয়ে ফেলার ভয়ে আমার ভালোবাসার বেষ্টনী থেকে নিজেই নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখি। এতে আমার কম কষ্ট হয় না ,তবুও সে কষ্ট ….হারিয়ে ফেলার কষ্ট থেকে একধাপ কম।তাই আমি অভ্যস্ত হতে চেষ্টা করি ‘ ধরি মাছ না ছুঁই পানি’র জীবনবোধে।তবু তো অতি সামান্য এক মানুষ ,তাই মাঝে মাঝে ভেসেও যাই ।ঠিক যেমন কাল আপ্লুত হয়ে যাচ্ছিলাম প্রাক্তন দিদিমণিদের মাথায় হাত রাখায়।তাই ধীর পায়ে অপরাহ্নের আলোয় ফিরে দেখতে চাইলাম আমার স্কুলকে ,যার সাথে আমার সেই ছেলেবেলার বারো বছরের সখ্যতা।
আজকের এই স্কুল আমাদের কাছে অনেকটা অপরিচিত । নতুন স্কুলবাড়ী ,নতুন ঝাঁ চকচকে টিচারস রুম, আমাদের সময়কার সেই আলো আঁধারী ঘরটাকে মনে করিয়ে দিচ্ছিল….তাই আমি আর আমার ক্যামেরা হাঁৎড়ে বেড়াচ্ছিলাম আমার পুরোনো শৈশব ও কৈশোরকে….খুঁজে খুঁজে এলাম পুরোনো স্কুলবাড়িতে ….সেই সিঁড়ি ,সেই অফিসঘর ,সেই ক্লাস রুম….চোখের সামনে এক একবার ভেসে উঠছিল ছোটো ছোটো মেয়ে ভরতি ক্লাস…..কানের কাছে বেজে উঠছিল হৈ হৈ শব্দ ,ছুটির ঘন্টা,ক্লাসে ক্লাসে দিদিমণিদের পড়ানোর শব্দ…আবার যেন পলকে চারপাশ নিস্তব্ধ হয়ে যাচ্ছিল।আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে ঘাঁটছিলাম আমার অতীত, ছুঁতে চাইছিলাম সেইসব স্মৃতি ….বুক ভরে নিতে চাইছিলাম পুরোনো চেনা গন্ধ ….পরিচিত স্বস্তির পরিবেশ….এইভাবে আরও এগিয়ে গেলাম আমার সেই কাঙ্খিত স্হানে …..মনের অবচেতনে যেখানে কত সুখদুঃখের নথি রেখে এসেছিলাম ….কাঁঠালগাছ আর তার নীচের বাঁধানো বেদী, যার নীচে বসে আমরা টিফিন খেতাম, কুমীরডাঙ্গা খেলতাম , মা যখন ছুটির পর আনতে আসতো লুকিয়ে থাকতাম তার আড়ালে, বন্ধুর সাথে আড়ি হয়ে গেলে একা একা যেখানে ইঁটের টুকরো দিয়ে কাটাকুটি খেলতাম….কিন্তু কই?…কোথায় সে জায়গা ?….খুঁজে না পেয়ে একটি মেয়েকে জিজ্ঞেস করলাম….’কাঁঠাল তলাটা কোথা দিয়ে যাব রে ?’ …..সে বলল ‘কাঁঠাল গাছ কোথায় এখন….ওইখানেই তো আমাদের টিচারস রুম’….হা কপাল…নেই সেই কাঁঠালতলা? নেই সেই কাঁঠাল গাছ ? ….আমি তো তারই টানে ছুটে এসেছিলাম আজ আমার ক্যামেরা নিয়ে ….কেমন যেন স্বজন হারানোর ব্যথায় মনটা মোচড় দিয়ে উঠল।…..আমার অতীতের অনেক প্রিয় মানুষ, আমার মা, বাবা ,দিদান, বাংলার দিদিমনি প্রীতিকণাদি ,কাশীনাথ স্যারের মতো কাঁঠাল গাছটাও আজ আর নেই…..।মনে পড়ে প্রতিবছর পিকনিকে মাংস ভাতের আগে এঁচোড়ের ডালনা হতোই হতো, এযে আমাদের স্কুলের গাছের ফল, দুপুরবেলা বেঞ্চে মাথা রেখে ক্লাসের জানলা দিয়ে যার ডালে কাঠবেড়ালির ছুটে বেড়ানো দেখতাম, যে গাছের গোড়ায় একবার আমি কুড়িয়ে পাওয়া একটা দু-টাকার কয়েন মাটি চাপা দিয়ে রেখে বলেছিলাম “ এটা আমার পাওয়া টাকা …তোমার কাছে জমা রাখ , যদি কেউ না নেয় আমি দরকার পড়লে বার করে নেব।” আরও একবার দিদিমনির বকা খেয়ে এই গাছেরই নিচে দাঁড়িয়ে জানতে চেয়েছিলাম আমার অপরাধ কি? সেদিন হয়ত সে তার নিরপেক্ষ জবাব জানাতে পারে নি কিন্তু পরম মমতায় নিঃশব্দে আমার চোখের জলের সাক্ষী থেকেছে ।এই গাছ যেমন স্কুলের প্রাণকেন্দ্র ছিল , তেমনই আমার জীবনে যে কত বড় বন্ধু ছিল তা কেবল আমিই জানি । এমনই আমার আনন্দ, অভিমান,রাগ,ঝগড়া….কত অমূল্য স্মৃতির সাক্ষ্য বহনকারী সেই কাঁঠালগাছের কোনো ছবিও তো আমার কাছে নেই….যা দেখে কিছু দন্ড পল অনুপল আমি সুখানুভূতি নিতে পারি….রয়ে গেছে শুধু কালো কফিনে ঢাকা স্মৃতির অবগুন্ঠন।সবার অলক্ষ্যে কয়েক ফোঁটা জল গড়িয়ে গেল ওই নতুন টিচারস রুমের সামনে।শুনতে অবাক লাগলেও একথা সত্যি ,এই স্কুল আর ওই কাঁঠালতলা আমার জীবনে অঙ্গাঙ্গী জড়িয়ে….এই স্কুল যতটা আজকের পড়ুয়াদের ঠিক ততটাই আমার ….শুধু কিছু সিনিয়রেরা অতীত আঁকড়ানোর সাহস নিয়ে আধিপত্য দেখাতে পারে কিন্তু সেই সাহস আমার মধ্যে নেই….কারণ এই স্কুলই যে আমাকে শিখিয়েছে কোনোকিছুই আমার নয়….আমি বলে এখানে কিছু হয় না…..।তাই আজকে নিজেকে এই স্কুলের অংশ ভাবতে চেষ্টা করেও যেন আটকে গেলাম, হেরে গেলাম, ওই একাধিপত্যের কাছে….যাক সে কথা।কিন্তু সত্যি বলতে কাঁঠাল তলা হারিয়ে যাওয়ার সেন্টিমেন্টটা আমার সারা জীবনে পাওয়া দুঃখগুলোর মধ্যে অন্যতম।
……….আমার মেয়ের স্কুলেও একটি বাঁধানো আমগাছের বেদী আছে।আমি সচরাচর মেয়ের স্কুলে যাই না ,কিন্তু যখনই যাই একবার ঘুরে আসি সেই জায়গা থেকে।অপলকে তাকিয়ে দেখি….অগোচরে চেনা সুবাস পাই আমার মেয়েবেলার।এই আমগাছটিও কিন্তু আমার অনেক সুখদুঃখের সাক্ষী ।প্রতিবার মেয়ের সাফল্য যেমন ভাগ করে আসি তেমনি স্কুলের সিস্টেমের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগও আওড়ে আসি অভিমানের গলায়….আর মনে মনে বলি….এই যেমনটি তুমি ,তেমনটি আছে আমার এক কাঁঠাল গাছ!!!!…..কিন্তু না আজ আর সে নেই….আজ সে অতীত….সময়ের করাল গ্রাস আমাদের বহুদিনের এই সখ্যতাকে সমূলে উৎপাটন করেছে……সময়ের উন্নতির হাত ধরে বদলে গেছে আমার চারপাশ…..কিন্তু কেমন করে বলবো যে, আজও আমি সেই স্কুল পড়ুয়া মেয়েটার মতোই আকাশ দেখি, পা ফেলতে চাই সবুজ ঘাসে….আঁকড়ে থাকতে চাই আমার হারানো সময়….. কারণ মনের অগোচরে আমি যে আজও পারিনি নিজেকে বদলাতে……..।