পর্ব- ৬
সন্ধ্যের দিকে নীলের মনটা কেমন যেন একটু করছিল। বাইরে বেরোল কিন্তু ভালো লাগল না… ফিরে এসে ইমলিকে ফোন করল একবার …কিন্তু ফোনটা বেজেই গেল । পরিবর্তে এসএমএস এল , ‘এখন স্যারের কাছে ….ফোন কর না , ফেরার সময় আমি মিসড কল করব। কথা হবে ।’ ইমলি এ বছর উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে, এডুকেশনে অনার্স নিয়ে কলেজে ভরতি হয়েছে। ওর দিদির বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত বাড়িতে ওর বিয়ের কথা কেউ ভাববেই না… অথচ নীলের সাথে ইমলির সম্পর্কটা বেশ কয়েক বছরের…বলা ভালো সেই স্কুলে পড়া কালীন। ইমলি , নীলের বাবার বন্ধুর মেয়ে। ছোটবেলার ভালোলাগা পরে দুই পরিবারের মধ্যে অলিখিত এক সম্পর্কের জন্ম দিয়ে দিয়েছে, যেখান থেকে নীল আর বেরোনোর কথা ভাবতেও পারে না। তখন দিনের পর দিন এত কথা বলেছে এখন আর কথাই খুঁজে পায় না …আসলে শুধু কথায় এখন আর মন ভরে না, তার বাইরেও আরো কিছু পেতে ইচ্ছে করে …কিন্তু সুযোগ কই? নীল তো ঢাকুরিয়ায় পেয়িং গেস্ট থাকে এক বৃদ্ধা মাসিমার বাড়ি, আর ইমলি তো নদীয়ায় । নীলের আসল বাড়ি শান্তিপুরে । চাকরী সূত্রে তার কলকাতায় আসা… থাকা। সম্পর্কটা কেমন যেন খুব কাছের হয়েও দূরের হয়ে যাচ্ছে …ইচ্ছে করলেও ছোঁয়া যায় না। মাঝে মাঝে একঘেয়ে লাগে নীলের, বড্ড এলোমেলো লাগে , সারাদিনে ওই এক আধটা ফোন … মিসড্কল… এসএমএস। দুজনের মাঝে একটা কমিটমেন্ট আছে কিন্তু মনের দূরত্ব হয়ে গেছে যোজন কয়েক। আজ দুতিনদিন ধরে বিভাও ফোনটা কেন জানি না ধরছে না। বয়সে বড়ো বলেই বোধহয় বিভা অনেকটা বুঝতে পারে নীলকে … কেমন একটা দিদির মত হাবভাব …কিন্তু কি একটা মায়া… কি একটা আকর্ষণ, কন্ঠস্বরে কি একটা নেশা, ভাল লাগা, গোটা শরীরটা মাঝে মাঝে উত্তাল হয়ে ওঠে নীলের, কান দিয়ে একটা শিরশিরানি বয়ে যায়। কিন্তু হঠাৎ কি এমন হল বিভার, যে এড়িয়ে যাচ্ছে নীলকে… কেমন একটা অস্বস্তি হচ্ছিল নীলের। চোখ বন্ধ করলে বিভার সেদিনের ওই মায়াবি মুখটা ভেসে উঠছিল… মনে হচ্ছিল অতীনদার থেকে সে অনেক বেশি বিভাকে বোঝে … বিভার মনে একাকিত্বের একটা মেঘ আছে, হয়ত কোনও লুকোনো কষ্ট , তার মিষ্টি কন্ঠস্বরে উচ্ছ্বলতার সাথে সাথে একটা বিষন্নতাও ঝরে পড়ে ঝরনার জলের মত… বিভার মুডের ভ্যারিয়েশনের ভাইব্সগুলো নীলকে কেমন যেন টানে। আর কথার ফাঁকে ফাঁকে ‘উঁহু’ বলে এক ঝলক হাসি নীলের শুকনো বুকটা কেমন জলে ভরিয়ে দেয়। দিনে দিনে নীলের কেমন যেন অভ্যেস হয়ে দাঁড়াচ্ছিল বিভাকে ফোন করাটা। তাই বোধহয় এমন সিগারেট খেতে না পাওয়ার মত ছটফট করতে থাকে নীল। ভাবে সকালে দু তিনবার ফোন করেছিল কিন্তু একবারও কথা হয় নি তেমনভাবে… বিভার সাথে খুব কথা বলতে ইচ্ছে করে নীলের। কিন্তু মোবাইলটা তো এখন ও বন্ধ। ল্যান্ডলাইনেও পাওয়া যাচ্ছে না। নীল ভাবে অতীনদা নিশ্চয় বাড়ি আছে তাহলে অতীনদার মোবাইলেই একবার ফোন করে দেখবে নাকি? ভাবা মাত্রই কাজ … ফোনটা রিং হতে থাকে । অতীন তখন কফি বানাচ্ছিল বিভার জন্য…ফোনের শব্দে কিচেন থেকে মাথাটা বের করে বিভাকে বলল, ‘ দেখ তো কে ? বিভা দেখল নীলের ফোন … কেমন যেন মনটা থই থই জলে ভরে গেল… কথা বলতে ইচ্ছে করল নীলের সাথে। একটু ইতস্তত করে ধরল অতীনের ফোনটা,
– হ্যাঁ বল
– যাক … , এতক্ষন পরে অতীনদার ফোনে তোমায় পেলাম । তোমার ল্যান্ডলাইন মোবাইল সব বন্ধ কেন গো? কি হয়েছে ?আমি কি কিছু ভুল করেছি?
– নাহ, এমনি। তুমি কেন ফোন করলে তাই বল।
– না সেরকম কিছু না আসলে ইমলির ব্যাপারে একটু কথা ছিল … তুমি একদিন ওর সাথে কথা বলবে। আমাকে নিয়ে ও কি ভাবছে, একটু যদি … আমি একদিন নিয়ে যাব ওকে তোমার কাছে।
– ঠিক আছে পরে কথা হবে ক্ষণ এ বিষয়ে … আজ নয়… অন্য কোনওদিন…
– তোমার কি হয়েছে মেমসাহেব ? মনটা খারাপ মনে হচ্ছে… আমায় বলা যাবে কি?
– হুমমম, বলব …পরে… এখন না
– বলবে তো ঠিক
– হুম এখন রাখছি …ব্যাস্ত আছি ।
– ফোনটা ছেড়ে দেবে এখনি? ওকে বাই।কিন্তু প্লিজ মোবাইলটা খুলে রাখ মেমসাহেব … ওটা বন্ধ থাকলে খুব একা লাগছে।
– আচ্ছা। বাই ।
ফোনটা কেটে সাইড টেবিলে রাখতে গিয়ে বিভা দেখল অতীন পিছনে দুহাতে দুটো কাপ নিয়ে দাঁড়িয়ে … কেমন যেন জেরা করার মত বলল, কে ফোন করেছিল?
-নীল
-আমার মোবাইলে?
-হ্যাঁ ল্যান্ডলাইনে পায় নি … আমার মোবাইল সুইচড্ অফ তাই…
-তো কি বলছে?
-কথা হয়নি।
-হুম সেটা তো দেখলাম কি যেন পরে বলবে বললে। এখন বললে না কেন বিভা?
-ভাল্লাগছে না ।
-তাই নাকি আমি আছি বলে?
বিভা অন্যসময় হলে ভয়ে ভয়ে উত্তর করত, কিন্তু অতীনের মেডিক্যাল রিপোর্ট টা দেখার পর তার মনের মধ্যে যে ঝড় উঠেছে, শুধু সেটাকে দাবিয়ে রাখার চেষ্টায় নিজেকে শান্ত রেখেছে বিভা। তাই হয়ত আগের চেয়ে কিছুটা ঔদাসীন্য দেখিয়ে চুপ করে রইল।
-অতীন আবারও বলল, কি হল উত্তর দিলে না যে?
বিভা স্থির চোখে তাকালো অতীনের দিকে…
বিভার চোখের এই স্থির ভাষাটা অতীনের বড় অচেনা … সে তো এতকাল বিভাকে ভয় পেতেই দেখেছে …আজ হঠাৎ কি এমন হল সে বুঝে উঠতেই পারছিল না… কিছুক্ষন চুপ করে থেকে কফির কাপ দুটো সেন্টার টেবিলে নামিয়ে রেখে বিভার খুব কাছে এসে তাকে এক ঝটকায় সোফা থেকে টেনে তুলে বলল,
– কি এমন কথা বিভা যা আমার সামনে বলতে পারলে না। বল না, কি কথা যা নীলকে বলা যায় আমায় না।
বিভা সোজাসুজি অতীনের চোখে চোখ রেখে বলল ,
– এমন কিছু নয় … তাছাড়া আমার আর নীলের মাঝে তেমন কোন কথা হয়ও না…কিন্তু সত্যি বল , তুমি কি আমায় সব কথা বল? তোমার মেডিক্যাল রিপোর্টটার কথা কি আমাকে বলেছিলে ?
আচমকা এমন একটা প্রশ্নে হতচকিত হয়ে উঠল অতীন , তারপর রাগে অন্ধ হয়ে , বলল,…
-ও বুঝেছি .. তুমি আমার আলমারিতে হাত রেখেই গোয়েন্দাগিরি শুরু করেছ? নিজের দোষ ঢাকতে, এখন নতুন ইস্যু খুঁজছো ঝামেলা করার জন্যে। তা তোমার বারোয়ারি বন্ধুর সাথে দুঃখের কথাগুলো শেয়ার করতে চাইছিলি বুঝি, আমি এসে পড়ায় ব্যাঘাত ঘটল? আমার পিঠ পিছে তোমরা কি কর আমার বুঝতে একটুও বাকি নেই? বিভা তুমি একেবারে যা-তা হয়ে গেছ। তোমার মত মেয়ে আর যাই হোক ঘরের বউ হতে পারে না …
-আচ্ছা তাই বুঝি? আর এটা বলবে না আমার মত মেয়ে , চাইলেও মা হতে পারে না । তার এমন দুর্গতি তার স্বামীর অক্ষমতার দায় তাকে সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হয়।
এই বলে বিভা অতীনের শক্ত করে ধরে রাখা হাতদুটো নিজের হাতে একে একে সরিয়ে দিয়ে বলে,
-অযথা চিৎকার করো না, চিৎকার আমিও করতে পারি …তাতে তোমার মান সম্মান কি খুব বাড়বে ? আর নীলকে নিয়ে তুমি যা ভাবছ সেগুলো সত্যি নয়।ভুল …ভাবনাগুলো তোমার সম্পূর্ণ মনগড়া… আসলে ওটা তোমার কমপ্লেক্স ।
বিভার কথাগুলোয় অতীন যেন একটা চরম ধাক্কা খেল। শীতের শিরশিরে হাওয়াতেও অতীন ঘেমে উঠল, উত্তেজিত হয়ে ভীষণ একটা রাগে বিভার হাত দুটো খামচিয়ে সজোরে তাকে দরজার দিকে ধাক্কা দিয়ে ঠেলে লিভিংরুম ছেড়ে বেরিয়ে গেল । ঠেলা সামলাতে না পেরে বিভা দরজার পাশে আচম্বিতে পড়ে গেল, হয়ত বা চোটও পেল কিন্তু পড়ে গিয়েও সে কেমন একটা স্থবির হয়ে বসে রইল। এতবড় অপমানে তার চোখে এক ফোঁটা জল পর্যন্ত এল না , চুপ করে গুম হয়ে সে বসে থেকে সে ভাবল , অতীনের পৌরুষে সে কি এমন ঘা মারল যে তাকে অমন করে ছুড়ে ফেলে দিয়ে গেল অতীন । অতীনের পুরুষকার এতটাই বড়ো যে তার নারীত্বের কোন মূল্যই রইল না তার কাছে । তবে সত্যি বলতে সে তো নীলের সাথে কিছুই করে নি … শুধু শুধু একটা মিথ্যে সন্দেহের বশে অতীন তাকে যা খুশি বলে গেল। একটা ছেলে আর একটা মেয়ের মাঝে কি উত্তর বৈবাহিক বন্ধুত্ব হতে পারে না? মানবিক সম্পর্ক থাকতে পারে না? … শুধুই শরীরী সম্পর্ক ? মেয়েদের কি মন বলে কিছু থাকতে নেই? তারা কি শুধুই একতাল মাংস? আর সেইজন্যই কি অতীন তার ওপর শুধু স্বামীত্বের অধিকারই দেখালো তার কষ্টটুকু বুঝল না ? বিভার মাথার মধ্যে সব ওলোটপালট হয়ে যাচ্ছিল ……কতক্ষন সে দরজার পাশে ওইভাবে পড়ে ছিল সে নিজেও জানে না, বেশ অনেক্ষন পর যন্ত্র চালিতের মত দরজার পাশ থেকে উঠে নিজের ঘরে গিয়ে দেখল অতীন দরজা বন্ধ করে দিয়েছে… একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে পাশের ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে বিছানায় বসলো । আচমকা ধাক্কায় হাতের বিভিন্ন জায়গায় চোট পেয়েছিল বিভা ,সেই চোটগুলো তে হাত রাখতে রাখতে বিভা ক্রমশ আরো কঠিন হয়ে যেতে লাগল , … এ বিভা যেন অন্য বিভা… ।
সারারাত অতীন আর বিভা দুজনে দু ঘরে রইল… কেউ ঘর ছেড়ে বেরোল না… রাতের খাওয়া হল না। অতীন মাঝরাতে একবার ঘর ছেড়ে লিভিং এ এসে দেখল টিভিটা সাইলেন্ট মোডে চলছে, লাইট জ্বলছে, ফ্ল্যাটের গেট লাগানো নেই।। সেন্টার টেবিলে রাখা কফি জুড়িয়ে জল। অতীন ঘাড় ঘুড়িয়ে দেখল পাশের ঘরের দরজা বন্ধ। এক এক করে আলো নিভিয়ে , টিভি বন্ধ করে, দরজায় তালা দিয়ে, কফির কাপ দুটো কিচেনের সিঙ্কে নামিয়ে রেখে ,পাশের ঘরে দরজার সামনে গিয়ে একবার দাঁড়ালো …তারপর মাথা নামিয়ে ফিরে এল নিজের ঘরে ।
ওদিকে গোটা রাত ধরে বিভা দুচোখের পাতা এক করতে পারল না…সে ভেবে চলল একটাই কথা … সে তো কোনও প্রতারণা করেনি , বদলে অতীন তার অক্ষমতার কথা না জানিয়ে বিভার প্রতি অন্যায় করেছে। তবে কেন এত বড়ো অপমান সে সহ্য করবে? আর সবচেয়ে বড়ো কথা কিছু না করেই যদি এত কথা হয় , তাহলে কিছু করলেই বা ক্ষতি কি ছিল ?