This entry is part 1 of 8 in the series চাঁদের পরিক্রমণ
চাঁদের পরিক্রমণ@Oindrila

চাঁদের পরিক্রমণ@Oindrila

সে ছিল এক রাঙা ভাঙা চাঁদ …..

যাকে ছুঁয়ে আমি বুঝতে চেয়েছিলাম কলঙ্কের পরিভাষাটা কি ?….জানি না কথায় কথায় চাঁদকে কতটা ছুঁতে পারব…. কিন্তু এই কাহিনীর তাগিদ এক অন্য কাহিনি যার শিরোনাম জীবন !!!!


মুখবন্ধঃ

আজ অনেক বছর পর মনের তাড়নায় লিখতে বসেছি আমার এক দোসরকে নিয়ে…..আজ পর্যন্ত যখনই লিখতে শুরু করি আমার সব ভাবনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে যায় সে…..তাকে এড়িয়ে আমার লেখা অসম্পূর্ণ । তাই ভেবেছি এবার না হয় তাকে নিয়েই কিছু লিখি…… । ধরা যাক তার নাম চন্দ্রিমা…..যদিও তাকে আমরা চাঁদ বলেই জানব….। চন্দ্রিমার একটা কালো মলাটের আখাম্বা ডায়রী ছিল…..আমি তার প্রত্যেকটা অক্ষর পড়ে ফেলেছি। ডায়রীর পাতায় তার প্রত্যেকটা শব্দনির্মাণ আমাকে বুঝিয়েছে সে চিরকাল ই একটু অন্যরকম ….প্রবল জলোচছ্বাসের মধ্যে সে আজন্ম নির্জন দ্বীপ …..আবার দিগন্ত বিস্তৃত রুক্ষ মরুভূমির মাঝে সে অবধারিত শীর্ণ জলধারা……। চাঁদের জোছোনায় আমি সত্যিই চন্দ্রাহত…..। চাঁদের জীবন তিরিশ বছর বয়সে এসে শ্লথ হয়ে গেছে । চাঁদকে দেখলে সুস্থই মনে হয় কিন্তু চাঁদ মানসিক ভাবে বড় অস্থির…..সে অনেক মানুষের মন নিয়ে নাড়াচাড়া করে তবু নিজের মনটাই বুঝে উঠতে পারে না….সবাই যখন হাসে কথা বলে গল্প করে কখনও সে ঐ আনন্দের অনুভূতিতে প্রগলভ হয়ে ওঠে আবার কখনও আনমনা হয়ে যায়……সে হাসে , সাজে, নিত্যনতুন জিনিস কেনে কিন্তু কোনো কিছুতেই যেন পূর্ণতা আসে না ।সম্পৃক্ততার আশায় কি যে খোঁজে তাও জানে না…..সবার মাঝে থেকেও সে একা …….আবার একা থেকেও সে একা নয়……তার দুটো সত্ত্বা….সে মনে মনে কথা বলে বুঝেছে…..তার একটা মন যতটা বাধ্য আরেকটা মন ততটাই বেপরোয়া ।এহেন চাঁদ ছোটোবেলা থেকেই বাবার ক্ষুদে হেল্পার ।বাবা গাছের পাতা ছাঁটছেন, চাঁদ বাবার পিছুপিছু ঘুরছে…..আর টালমাটাল পায়ে গাছের ফুল ছিঁড়ছে…..বলছে…”বাব্বা ফুঃ” বাবাও তেমনি আপাত রাগে বলছেন…..”ছিঃ চাঁদ , ছোটো ছোটো ফুল তুলছ কেন?….তাহলে বড়বড় ফুল গুলো কে তুলবে?” চাঁদ খুশি খুশি গাছের ফোটা ফুলের দিকে তাকিয়ে বলে, “আয়েত্তা তুব্ব”….? একটু এগিয়ে গিয়ে আরেকটা ফুল তুলে , ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে ফেলে দেয় ….এইভাবে ফুল দেখলেই তাকে ছিঁড়তে চাওয়ার বাসনাটা তার মন থেকে অপসারিত হয় চির দিনের জন্যে । ………এটাইবোধহয় ছিল , তার সম্পৃক্ততার উপলব্ধি…..যা তাকে তার সজ্ঞানে, এরপর আর কোনও প্রাপ্তিই এনেদিতে পারে নি । চাঁদ বিশ্বাস করতে চায় পজিটিভিটিতে…যে কোনো ‘না বাচক ‘শব্দ ,যা মনের মধ্যে কৌতূহলের সৃষ্টি করে তাকেই চাঁদ ভেঙে দেখতে চায়…..জানতে চায় কি এমন হিস্ট্রি-মিস্ট্রি-কেমিস্ট্রি আছে তার মধ্যে।

পর্ব ১/


চাঁদের রোজকার পাঁচালীটা যেন একটু বেশি রকম স্বশাসিত…..সে নিয়মের বেড়াজালে আবদ্ধ থাকতে একটুও ভালোবাসে না…..তবুও আবর্তনে তো থাকতেই হয়…. চাঁদ এখন একটি বেসরকারী ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে অধ্যাপনা করে…..সারাদিন ই তার নানান বয়সের মানুষের সাথে ওঠাবসা….শুধু তাই নয় এখনকার এই ছাত্রজীবনটাকে সে ভীষণ কাছ থেকে দেখে বলেই বোধহয় সবসময় একটা তুলনামূলক দৃষ্টিভঙ্গী তার অতীত আর বর্তমানের মধ্যে দ্বন্দ্ব তৈরী করে দেয়….নচেৎ সে তার কলেজ-বাড়ি- পরিবার সবের মধ্যেই একটা তারতম্য বজায় রেখেই চলতে চায়…..শুধু তার মনের হদিস পাওয়া যায় না…..সে এগিয়ে চলতে চায়….কিন্তু অতীত তাকে কেন জানি না আজও বড়ো পিছু টানে……অতীতের কোন সে অসম্পৃক্ততা আজও তাকে কথার নেশায় ভাসিয়ে নিয়ে যায়….তা সে বোধ করি নিজেও বোঝে না…..। আজ চাঁদের সকালটা একটু অন্যরকম…কাকভোরে ঘুম ভেঙে যায় তার । শোবার ঘরের দখিনের জানলাটা তার কাছে মুক্তির স্বাদ ।ভোরবেলায় জানলার ভারী পর্দা সরিয়ে অন্ধকারের মাঝে যে আলো ফুটে উঠছিল ,তার আঘ্রাণ নিল চাঁদ । জানলার গ্রিলে মাথা হলিয়ে উদাস চোখে দূরের নারকেল গাছটার দিকে তাকালো ।চাঁদ ঠিক বুঝে উঠতে পারেনা তার মনে কখন ঝড় ওঠে,কখন মেঘ করে আর কখন বৃষ্টি আসে । চাঁদের জীবনে প্রথম বন্ধু তার বাবা ….তারপর বহু বন্ধু এসেছে….চাঁদ খোঁজে একটা অস্তিত্ব ,যার পাশে থাকায় এক নির্ণিমেষ স্বস্তি……সে সম্পর্কের জটিলতা এড়িয়ে ছোটো ছোটো অনুভুতির পরিবর্তনগুলো বিশ্লেষণ করতে চায় ।সে জানে সম্পর্কের সহজিয়া সুর তো একটাই…..’তুমি খুশী থাকলেই আমি খুশী…এর বাইরে আর কোনো চাওয়া হয় কি ???? …..সকালের রুটিন তার যাই থাকুক খবরের কাগজে একটু চোখ না বোলালে চাঁদের হয় না….আকাশটা আজ বড়ো মেঘলা….বৃষ্টি নামল বলে….আজ তার বেরোতে ভালো লাগছে না…..কিন্ত আজ তাকে ক্লাস নিতে হবে স্ট্রাকচারের…..থার্ড ইয়ারের স্টুডেন্টসদের প্রোজেক্ট সাবমিশান আজ….ভাইভা নিতে হবে..সুতরাং যেতে তাকে হবেই….চাঁদ চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে ব্যালকনিতে এসে দাঁড়াল…..ইচ্ছে অনিচ্ছে মেঘলা আকাশ সব মিলিয়েই সে যেন অতীতের সেই দিনটাকে আরও একবার ফিরে দেখতে চাইল…………….. বেশ কয়েক বছর আগের কথা । চাঁদ তখন উনিশে পা রেখেছে । যাদবপুর ইউনিভার্সিটির সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং-এর ফার্ষ্ট ইয়ারের ছাত্রী………… সেদিন কি হল কে জানে……সকাল থেকে তার একটুও ইচ্ছা নেই কলেজে বেরোনোর, অথচ ড্রয়িং শীট সাবমিশন আছে সেকেন্ড হাফে ।বেশ একটা আলসেমী জড়িয়ে ধরেছে তাকে। গোটা রাতই প্রায় জাগা ড্রয়িং শীটের জন্য। সাঁতরাগাছি থেকে যাদবপুর যেতে দুটো বাস তখন পাল্টাতে হত। দুপুরবেলা চাঁদ খুব অনিচ্ছা সত্ত্বেও বাসে উঠল।বাসের জানলায় মুখ রেখে দেখল রোদ্দুরে ভেসে যাওয়া আকাশটা কেমন যেন থমথম করছে। কোথা থেকে একফালি কালো মেঘ ঝড়ের আভাস দিচ্ছে……একটু পরে বাসটা ছাড়ল …..সঙ্গে দমকা হাওয়া, এলোমেলো বৃষ্টি….বৃষ্টির সাথে সাথে বাসের বন্ধ কাচের জানলায় ছোটো ছোটো শিলের টোকা পড়তে লাগল। চাঁদ ভাবল “ইস্ এখন কি হবে? ছাতাটাও নিই নি….বাস থেকে নেমে কোথায় দাঁড়াব? ভিজে যাব তো…..” ধীরে ধীরে বাস বিদ্যাসাগর সেতুর ওপর দিয়ে ,রবীন্দ্রসদন পেড়িয়ে ,বিড়লা প্ল্যানাটোরিয়ামের বিপরীতে এসে দাঁড়াল । চাঁদকে নামতেই হবে…..এখান থেকে সে যাদবপুরের বাস ধরবে…..ঝিরঝির বৃষ্টির মধ্যে আরও কয়েকজন যাত্রীর সঙ্গে চাঁদও নেমে দাঁড়ালো একটা গাছের নীচে। দূরের দিকে তাকিয়ে ভাবতে থাকল কখন বাস পাবে…..এমন সময় তার খেয়াল হল ‘কই , আমি ভিজছি নাতো?’ ঘাড় ঘুড়িয়ে দেখল…..হ্যাঁ তা প্রায় ফুট ছয়েকের একটা ছেলে তার মাথার ওপর একটা ছাতা হেলিয়ে রেখে তাকে ভিজে যাওয়া থেকে অনেকটাই বাঁচিয়েছে….চোখে হাই পাওয়ারের চশমা , একমুখ খোঁচা খোঁচা দাড়ি,এলোমেলো চুল……এক গাল হেসে প্রশ্ন করল ” ফার্ষ্ট ইয়ার তো ? কোন ব্রাঞ্চ তোর ? ” চাঁদ একটু অপ্রস্তুত হয়ে বলল ” সিভিল “। মনে মনে ভাবল প্রথমেই তুইতোকারী করাটা একটু কেমন যেন লাগে ।পিছনে দাঁড়ানো ছেলেটা বলল ” আমি থার্ড ইয়ার মেকানিক্যাল…” এতক্ষণে চাঁদ বুঝে গেছে এই ছেলেটা তার আজকের সহযাত্রী….এতটুকুও কুন্ঠাবোধ না করে চাঁদ পাল্টা বলে উঠলো “আমি চন্দ্রিমা ব্যানার্জী…..তোর নাম কি? “আমি সোহম গাঙ্গুলী….তোর সিনিয়র….তুই বলাটা কি খুব জরুরি ?”চন্দ্রিমার মুখে একটা দুষ্টুমির হাসি …..বলল “অপরিচিত একটা মেয়েকে তুই যদি তুই বলতে পারিস , আমি কেন নয়?” দুজনের কথার মাঝখানে হুড়মুড় করে যাদবপুর মিনিবাস এসে দাঁড়ালো । সোহম ছাতাটা বন্ধ করে বাসের গায়ে দুটো চাপড মেরে বলল….” আস্তে লেডিস”….চাঁদ ওঠার পর সোহম বাসে উঠেই তার দুজন বন্ধুকে দেখে তাদের মাঝে গিয়ে বসলো….আর যেন চাঁদকে ভুলেই গেল । চাঁদ একদম লাস্ট সিটে গিয়ে বসলো….. অপলক দৃষ্টিতে সোহমের দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ…..তারপর গোটা রাস্তায় আর একটাও কথা হয়নি দুজনের । চাঁদ কেবল জানলা দিয়ে বৃষ্টি দেখেছে আর ভেবেছে….সে যেন ভুলেও আর সোহমের ছাতার মুখাপেক্ষী না হয় । ধীরে ধীরে বাস গড়িয়াহাটের কাছে আসতেই বৃষ্টিটা থেমে যায় বেশ…..চাঁদ দেখে সোহম উঠে পড়েছে আর ওর দুই বন্ধু সৈকত আর দীপান্বিতাকে উদ্দেশ্য করে গলাটা বেশ তুলেই বল….কাজ আছে কয়েকটা….কম্পিউটার ক্লাসে দেখা হবে…..একদম বাসের দরজার মুখে গিয়ে চেঁচিয়ে বলে.”দীপু আমায় রাতে পারলে ফোন করিস একটা….নাম্বারটা মনে আছে তো…..03326608645….করিস কিন্তু….” দীপান্বিতা বলে,”নাম্বার বলার কি আছে? জানি তো ….করে নেব” চাঁদ একটু ফিরে চাইলেও সোহম পিছনে না দেখেই নেমে যায় বাস থেকে……চাঁদের চোখজোড়া কেমন যেন সোহমের চলার পথটা অনুসরণ করতে থাকে আর এমনই মুহুর্তে ফোন নাম্বারটা মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকে…… !!!!

 

………………………………………………………………………ক্রমশ

  
This entry is part 2 of 8 in the series চাঁদের পরিক্রমণ

 

পর্ব – ২/


 

 

মন খারাপ করা একটা দুপুরবেলা……জানলার বাইরের আকাশটা কালো মেঘে সেজে আছে…..চাঁদ হাতের সব কাজ সামলে ফোনটা নিয়ে খাটে এসে বসল ……একটা সময় ছিল, চাঁদের জীবনে ব্যস্ততা কিছু কম ছিল না….ইনফ্যাক্ট সারাটা দিনই প্রায় কেটে যেত অফিস ,সাইট আর বাড়ি করে ।খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু বলতে যারা ছিল আজকাল তাদের সাথেও আর যোগাযোগ হয়ে ওঠে না…..চাঁদ মোবাইলের কনট্যাক্টস দেখতে লাগল….কি আশ্চর্য , এমন কেউ নেই যাকে ফোন করে একটু নিজেকে ভুলিয়ে রাখা যায়…অথচ সে ছিল একটা সময়…তখন সারাদিন কথাই কথা….চাঁদ মিউজিক সিস্টেমটা অন করল….. এফ.এম এ গান বেজে উঠল ……”এমনি বরষা ছিল সেদিন /শিয়রে প্রদীপ ছিল মলিন / তব হাতে ছিল অলস বীন /মনে কি পড়ে প্রিয় “…..এই গানটা শুনতে শুনতে চাঁদ হারিয়ে গেল অতীতে…..হোয়াট আ কো-ইনসিডেন্স ….সেদিনও এই গানটাই বাজছিল……কতদিন আগের কথা ।দিনটা ছিলো একটা শনিবার …..এরকমই দুপুর বেলা চাঁদ কলেজ থেকে ফিরে নিজের ঘরে গান শুনছে …..ভীষণ চাপ যাচ্ছে কলেজে ….ড্রয়িং সাবমিশান চলছে….প্রায় এক সপ্তাহ হল…..চাঁদ নিজের শরীরটা বিছানায় এলিয়ে বালিশটা আঁকড়ে শুয়েছিল…..হঠাৎ কিছু একটা ভেবে উঠে বসল…..টেলিফোনটা সাইড টেবিল থেকে হাতের কাছে নিয়ে একটু ভাবল….. ‘কি যেন নম্বরটা?’……তারপর ডায়াল করল….অপর প্রান্তে রিং শোনা যাচ্ছে ….চাঁদ শ্বাস বন্ধ করে দুটো রিং শুনে লাইনটা কেটে দিল ।….কিন্তু চুপ করে বসে থাকতেও পারল না…ইতস্তত করে আবার ডায়াল করল…..অপর প্রান্তে একটা ভারী কন্ঠস্বর…’হ্যালো’ চাঁদ তড়িঘড়ি ফোনটা কেটে দিল….. একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজেকে একটু শাসন করে , বিছানায় শুতে যাবে, …ফোনটা বেজে উঠল । চাঁদ ভাবল বুঝি বাবার ফোন….’মা তো নীচে থেকে ধরবেই’….কিন্তু ফোনটা দুটো রিং হয়ে কেটে গেল….চাঁদ ফোনের দিকে তাকিয়ে রইল….তার মন বলছিল এখনি আবার রিং হবে…..ভাবামাত্রই ফোনটা সত্যিই বেজে উঠল…..
চাঁদ: হ্যালো
কপটরাগে একটা পুরুষ কন্ঠ বলে উঠলো …’ফোন করে কথা না বলে কেটে দেওয়ার মানে কি ?’ যদিও চাঁদ বিশ্বাস করতে পারছিল না….তবুও রুদ্ধশ্বাসে জিজ্ঞেস করল ‘কে বলছেন ‘? ফোনের ওপার থেকে অবিশ্বাস্য ভাবে সেই অপরিচিত কন্ঠস্বর বলে উঠলো ‘তুই চন্দ্রিমা তো ? ফোনটা তো আমাকেই করলি….তাও নামটা বলতে হবে? চাঁদের মনে তখন কেউ যেন হাঁপর টানছে……স্থবির অবস্থাটা একটু কাটিয়ে বিষ্ময়ের সুরে বললো ‘ সোহম….?….নম্বর পেলি কোথা থেকে?….
সোহম: তুই দিলি তো …(একটু হেসে বলল) চাঁদ: আমি?????….হেঁয়ালি করিস না….বল কে দিল নম্বর ?আর আমি ফোন করেছি তাই বা বললি কেন?
সোহম: আরে বাবা ,দম নিতে দিবি তো …..সেটাই তো কথা….কলার আই ডি ‘র কাজটাই তো এই ম্যাম ।
চাঁদ বেশ খানিকটা লজ্জা পেয়ে বলে….’আসলে বাসে সেদিন তোর এক বন্ধুকে নম্বর টা দিলি না….এতজোরে চিৎকার করে বলছিলি যে আমার কানেও পৌঁছেছিল…..আর আমার মেমারী এমনিতেই বেশ শার্প……’
কথাটা শেষ করার আগেই সোহম চপল স্বরে বললো …..’হুমমম…..আমি জানি তো …..তাই তো নম্বর টা তোকেই শুনিয়ে আবৃত্তি করলাম…..আর সেইদিন থেকেই ভাবছি ফোনটা কবে করবি……কলেজে দেখাও হচ্ছিলো না…..তোরা মেয়েরা ভাঙবি ,তবু মচকাবি না….. ।
এবার চাঁদ বেশ সপ্রতিভ হয়ে বলল’ এর মানেটা কি দাঁড়াল…..সেয়ানা গিরি!! ফোন নং চাইলে আমি কি দিতাম না?
সোহম: বলা যায় না….মুখের ওপর না বলে দিলে মানে লাগত….আফটার অল তোর সিনিয়র তো ।
চাঁদ : অত জুনিয়র সিনিয়র বুঝি না….চাইলে আমি ভাল বন্ধু হতে পারি….তবে ….?
সোহম: তবে কি?…..আচ্ছা ছাড়….তুই ক’টার বাসে এখান থেকে যাস….?
চাঁদ: কেন ? ন’টা কুড়ি….
সোহম: ঠিকই আছে ….সোমবার তাহলে সিটিসি বাসস্ট্যান্ডে ঐসময়ই দেখা হবে….ও.কে…বাই…রাখছি
চাঁদ : আচ্ছা …..বাই টাটা
চাঁদ যেন এতক্ষণ একটা ঘোরের মধ্যে ছিল……দরজায় কলিংবেলের আওয়াজে তার সম্বিত ফিরে এল………… ।
…………………………………………………………………………………………………ক্রমশ

  
This entry is part 3 of 8 in the series চাঁদের পরিক্রমণ

 

পর্ব – ৩।


সকাল বেলাটা বেশ ঝকঝকেই হয়ে আছে আজ… যদিও কিন্তু মাঝে মধ্যেই একটু মেঘের আনাগোনা আকাশে …আর সেই মেঘের মধ্যে দিয়ে যেন সূর্যের আলো ঠিকরে বেরোচ্ছে এক এক সময় …গত কয়েকদিন ধরেই চাঁদের মনটা বড়ো এলোমেলো হয়ে আছে…।চাঁদ সম্পর্কের টানাপোড়েনে একটু বেশি ই বেসামাল হয়ে পড়ে আজকাল ,অথচ সে কিন্তু এরকম ছিল না আগে । তার সহনশীল দৃঢ় স্বভাবটায় যে অস্থিরতার ছোঁয়া এসেছে…..তাতে চাঁদ নিজেকে কেমন একটু অসহায় মনে করছে…..আজ তাকে একটু বেরোতে হবে…..সে দক্ষিণাপনে যাবে….মৃগনয়নীতে তার পর্দার অর্ডার দেওয়া ছিল….ডেলিভারি নিতে হবে । বাসস্ট্যান্ডে এসে চাঁদ ট্যাক্সি ধরল….গাড়ি যখন বিদ্যাসাগর সেতুর ওপরে উঠল …..জানলার ভিতর দিয়ে তার চোখ চলে গেল একটু এগিয়ে থাকা একটা চলন্ত সিটিসি বাসের দিকে ।ক্রমে ক্রমে দূরত্ব কমে বাসটার পাশাপাশি এলে তার চোখে পড়ল বাসের জানলার ধারে বসা যাত্রীদের মুখের ওপর…..অনেক মুখের ভিড়ে সে যেন পনেরো বছর আগেকার চাঁদ কে দেখতে পেল….. ……..অধীর আগ্রহে জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে এপাশ ওপাশ কি এত দেখছে চাঁদ ?…..কাকে খুঁজছে চাঁদ ? ৯:১৫এর সিটিসি বাসে রোজ চাঁদ কলেজের পথে পা বাড়ায়…।কখনও কোনো পিছুটান তাকে এমন করে উদ্বিগ্ন করে নি তো আগে…।সময়টা যেন ছুটছে …..চাঁদ জানলা দিয়ে যতদূর চোখ যায় দেখে যাচ্ছে ….বাসটা স্টার্ট নিল….চাঁদের মনটা কেমন যেন বিমর্ষ হয়ে গেল ……হঠাৎ….রাস্তার উল্টোদিকে চোখ গেল…. চাঁদ দেখল ভীষন দ্রুততায় রাস্তার ওপার থেকে ছুটে আসছে সোহম!!! বাসের গায়ে জোরে দুটো ধাক্কা মারতেই কন্ডাক্টর বেল মারল….বাসের গতি শ্লথ হয়ে আসল…আর বাসের দরজা খুলে হাঁপাতে হাঁপাতে সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসল সোহম….যেন মূর্ত মুহুর্ত…..চাঁদকে দেখে একগাল হেসে বলল ‘ব্যাগটা ধর’….চাঁদ ওর হাত থেকে ব্যাগ….ড্রাফটার সব নিয়ে নিল এমনভাবে….যেন পারলে সোহমকেও ধরে নিত….সোহম একটু দম নিয়ে চাঁদের সিটের সামনে উঠে এসে দাঁড়াল….সোহমের গোটা মুখটা লাল হয়ে আছে….কপালের পাশ দিয়ে ঘাম গড়াচ্ছে….এমনকি দাড়ি গোঁফের খাঁজেও ঘামের বিন্দু চিকচিক করছে…..চাঁদের দিকে তাকিয়ে বলল….’তোর জন্যে পনেরো মিনিট আগের বাসটা ধরতে হল..’চাঁদ বুঝতে পারলো…তার মধ্যে যে প্রচন্ড উত্তেজনাটা ছিলো …..সেটা একটু কমেছে….তার রুদ্ধশ্বাসটাও যেন একটু হালকা হয়েছে….তার পাশে বসা ভদ্রলোকটি সোহমকে মাথা থেকে পা পর্যন্ত বার দুয়েক জরিপ করল….এতক্ষণ পর্যন্ত চাঁদ একটিও কথা বলে নি ….এবার চাঁদ সোহমের আরক্ত মুখের দিকে তাকিয়ে বলল….’জল খাবি?’ সোহম: দে …. ব্যাগের ভেতর থেকে জলের বোতল বার করে সোহমকে দিয়ে চাঁদ বলল ‘বাপরে…এভাবে কেউ দৌড়োয় নাকি…’ সোহম জল খেতে খেতে বলল….’আগে আগে ক্লাসে পৌঁছেই বা লাভ কি? একি স্কুল নাকি….? জলের বোতলের মাথাটা আটকে ব্যাগে ভরতে ভরতে …. চাঁদ: আজও কি আবার গড়িয়া হাটে নেমে যাবি নাকি? চশমার ওপর দিয়ে ঈষৎ ভুরু কুঁচকে একটা অদ্ভুত মন পড়ে ফেলা দৃষ্টি নিয়ে…আর একটা সবজান্তা একপেশে দাঁতে চাপা হাসি হেসে….চাঁদের দিকে তাকিয়ে বলল…… সোহম: নামলে কি তোর ভালো লাগবে ? চাঁদ : (সরাসরি চোখে চোখ রেখে একটু হেসে ) না, ভালো লাগবে না …..তাহলে আর একসঙ্গে যাওয়ার মানে কি হল? ……বাসটা বিদ্যাসাগর সেতুর ওপর উঠতেই হু হু করে গঙ্গার একরাশ ঠান্ডা জোলো হাওয়ায় চাঁদের খোলা চুলটা তার চোখে মুখে ছড়িয়ে গেল…..চাঁদ জানলার দিকে তাকিয়ে ছিল যদিও ….তবু তার মনে হচ্ছিল সোহমের দুজোড়া চোখ যেন নৈশব্দের আড়ালে তাকেই জরীপ করছে……হঠাৎ চাঁদের পাশের ভদ্রলোকটি উঠে পড়ল….আর সোহম বসে পড়ল সিটটায়….চাঁদ যেন এই মুহূর্তটারই অপেক্ষায় ছিলো ….সোহম শার্টের কলারটা পিছনে একটু ঠেলে দিয়ে জানলার হাওয়ায় একবুক শ্বাস নিয়ে বলল….’দে…আমার সম্পত্তি !’…চাঁদের কাছ থেকে নিজের ব্যাগ, ড্রাফটার নিতে নিতে বলল…আমার কিন্ত রোজই এরকম একটু দেরী হবে…’তুই চাইলে অপেক্ষা নাও করতে পারিস…’
চাঁদ: চাইলে কি পনেরো মিনিট মেক আপ করা যায় না? নাহলে তো একসাথে আর যাওয়া হবে না….
সোহম: যায় হয়ত….কিন্তু আমি আমার আমার মতে চলি… দাসত্ব আমার রক্তে নেই বুঝলি ….আমি সোহম… মানে ….আমিই ব্রহ্ম ….চাইলে আমি জগত সৃষ্টি করতে পারি, সময় ছুঁতে পারি, সূর্যকে চালাতে পারি আমার হুকুমে….আর চাঁদ তো মুঠোয়……হা হা হা….কেমন বললাম বল?…তোর চন্দ্রিমা নামটাকে একটু সংক্ষিপ্ত করে দিলাম…..আপত্তি নেই তো ?
চাঁদ: না…তবে আমি কিন্তু তোর হুকুমের টেক্কা নই ,আর আমিও তোকে সোহম সোহম করতে পারব না….
সোহম: আচ্ছা? বেশ…কি বলবি শুনি….
চাঁদ: আমি তোকে ডাকব ‘ওম্ ‘বলে…
সোহম: ওম???

…… একমুহূর্তে সোহমের মনে হল তার চারপাশের পৃথিবীটা বদলে গিয়েছে বুঝি ….ধুসর থেকে লাল নীল রঙিন ….তার ভেতরে বসত করা বেয়াড়া আমিটা তার রক্তমাংসের শরীরের খোলস ছেড়ে বেরিয়ে তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তাকে প্রশ্ন করেছে ‘এ কোন সোহম গাঙ্গুলী?’….

সোহমকে চুপ থাকতে দেখে চাঁদ বলল, ‘ আজ থেকে তোর জীবনে রেনেসাঁস এল ।’
সোহম বলল: সেকি রে? আয়নার সামনে এত বছর ধরে আলগোছে যাকে দেখে আসছি ……তার জন্ম হল মোটে কয়েক সেকেন্ড আগে ?
চাঁদ : হুম … জানিস কি , কে যেন বলেছিলেন ‘মানুষের জন্ম কেবল একবারমাত্র হয়ই না….একটা জীবনে মানুষ কয়েক লক্ষ বার জন্মায় …..জন্ম শুধুমাত্র শরীরের পিতৃদত্ত সম্পত্তি নয় , মানুষ মনে মনে অসংখ্য বার জন্মা নেয় …..শারীরিক জন্মগুলোর মৃত্যু আছে…কিন্তু এই জন্মগুলোর কোনও শেষ নেই….শুধু বিস্তার আছে আজন্ম ….আকাশের মত…..বিজ্ঞানের মত….সূর্যের মত…। সোহম: সাবাস…..তুই কি লেখালিখি করিস নাকি?
চাঁদ: সেরকম নয়….মাঝেসাঝে, ইচ্ছে-টিচ্ছে হলে….কেন বলতো?
সোহম: না চাঁদ…..তুই লেখ….তোর শব্দচয়ণ বেশ ভালো …..তার সাথে এটুকু বলতে পারি….তুই একটা মুহুর্ত তৈরি করতে পারিস….তুই কবিতা পড়িস?
চাঁদ: ভীষণ ভাবে…..আমি এখনকার কবিদের মধ্যে সুবোধ সরকার….পুর্ণেন্দু পত্রী পড়তে ভীষণ ভালোবাসি …..তুই পড়েছিস ???
সোহম: হুমমম……তবে রবীন্দ্রনাথ আমার প্রাণ….আমাদের বাঙালিদের রক্ত মাংস হাড় মজ্জায় মিশে আছেন রবি ঠাকুর ……
এমনি করেই কবি বিষ্ণু দে , শঙ্খ ঘোষ ,দীনেশ দাস …….চাঁদ আর ওমের গতিময় জীবনের প্রাত্যহিকি হয়ে উঠলেন…….আর সঙ্গে তো রইলেনই শক্তি-সুনীল-সুবোধের মত বড়ো মাপের কবিরা…. রবীন্দ্রসদন স্টপেজ আসতেই ওমকে অবাক করে ‘উঠি’ বলে চাঁদ হঠাৎ সিট ছেড়ে উঠে পড়ল….
ওম: কিরে এত তাড়াতাড়ি উঠছিস….একটা স্টপেজ আগেই নামবি নাকি…?
চাঁদ: …(একটু হেসে) আজ আমার ক্লাস সেকেন্ড হাফে….তুই একসাথে যাবি বলেছিলি বলে এই সময়টায় এলাম(একটু থেমে)…..পিজি হসপিটালে আমার এক দিদি আর .এম.ও….ওর সাথে দেখা করব….দরকার আছে । সোহম কি বলবে বুঝে উঠতে পারছিল না……একটু এগিয়ে বাসের দরজার মুখে এসে চাঁদ ওমের দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে বলে ‘আর হ্যাঁ…আমি কিন্তু চেষ্টা করব ৯:১৫ এর বাসটাই ধরার…..তাই’……বাসটা থেমে গেল ,বাসের দরজা খুলে চাঁদ নেমে পড়ল….ও চাইলে ফিরে তাকাতেই পারত…কিন্তু ও জানে আজ হয়ত সোহম ওর চলার পথটা অনুসরণ করবে…..এটা না হলে আজ আরও একবার যে চাঁদ নিজেকে অবহেলিত মনে করবে…থাক না এই ভাবনাটা….ক্ষতি কি আছে….???
……সত্যিই কিন্তু সোহম আজ চাঁদের একটু ফিরে চাওয়ার জন্যে অপেক্ষা করে রইল…মুখে কিছু না বললেও চাঁদের পুতুল পুতুল স্নিগ্ধ মুখটার মধ্যে কোথা থেকে এতটা আত্মপ্রত্যয় এল….তাই ভাবতে ভাবতে নিজেকে একটু অন্যরকম মনে হল সোহমের….কয়েক মুহুর্ত আগে জন্মানো ওমের জন্যে কেমন যেন একটু বদলে যেতে ইচ্ছে করল সোহমের!!!!

……………………………………………………………………………………………………….ক্রমশ

  
This entry is part 4 of 8 in the series চাঁদের পরিক্রমণ

 

পর্ব -৪।


কলেজের গেটের মুখে আসতেই…মোবাইলটা বেজে উঠল ।ব্যাগ থেকে ফোনটা বার করে ধরতে না ধরতেই…..লাইনটা কেটে গেল ….চাঁদ মাথা নামিয়ে ,কার মিসড কল দেখতে দেখতে সামনের ল’নে এগিয়ে যাচ্ছিল …..উল্টোদিক থেকে হঠাৎ একটা ধাক্কা …..ব্যস….হাতের খাতা বই সব নীচে পড়ে ছড়িয়ে গেল ।…বিরক্তি , বিষ্ময়, আর যন্ত্রনা সব মিলিয়ে ….অস্ফুটে একটাই শব্দ বেরিয়ে এল চাঁদের মুখ থেকে……..’উফফফফ’
-সরি ,সরি , এক্সট্রিমলি সরি ম্যাম…..আমি…আমি সব তুলে দিচ্ছি ….গুছিয়ে দিচ্ছি ….
নীচু হয়ে চাঁদের পায়ের কাছে ছড়িয়ে যাওয়া খাতাগুলিকে গুছিয়ে তুলে দিতে যাওয়া ছাত্রটিকে চাঁদ একটু অপ্রস্তুত হয়ে জিজ্ঞেস করল…
-নাম কি ? কোন ইয়ার ?
-পারিজাত বসু ….থার্ড ইয়ার….কম্পিউটার সায়েন্স…ম্যাম।
চাঁদ খাতা গুলো হাতে নিয়ে বলল…
-মনটা কোথায় থাকে…একটু দেখে যেতে পারো না?….
-আর এরকম ভুল হবে না ম্যাম….ওই একটা ফোন নাম্বার খুঁজতে গিয়ে ….
-ইট্’স ওকে….যাও ।

পারিজাত চলে গেল ওর সামনে থেকে….চাঁদ ভাবল …’সেই তো আমিও তো মাথা নামিয়ে ফোনই দেখছিলাম ….ভাগ্যিস ছেলেটা পাল্টা কিছু বলে নি…বললে আমিই বা কি জবাব দিতাম….’
একটু হেসেই ফেলল, চাঁদ নিজের মনে….
কলেজে চাঁদ এখনকার প্রজন্মকে এরকম যত দেখে ,ততই যেন সেই পুরোনো দিনগুলো তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে….

……মনে পড়ছিল…. সেই যেদিন চাঁদ বাসে উঠে বসেছিল একরাশ অপেক্ষা নিয়ে….শেষ পর্যন্ত বাসটা ছাড়ার মুখে হঠাৎ কি যেন ভেবে সিট ছেড়ে উঠে পড়ল…..ভিড় ঠেলে ধাক্কাধাক্কি করে….কান গরম করা কিছু মন্তব্য পেরিয়ে ….বাসের সিঁড়ির কাছে এসে দাঁড়িয়েছে… দরজা খুলে বেরোতে যাবে ….মূর্তিমান ঝড় ….এক্কেবারে মুখোমুখি …ধাক্কা খেতে খেতে বেঁচে গেল…. এতক্ষণে এসে হাজির….সোহম!!
-কিরে নামছিস কেন? চল ভেতরে চল….
চাঁদ একটু ভাবল….তারপর ইতস্তত করে…
-না…আমি একবার যখন সিট ছেড়ে উঠে এসেছি…পরের বাসেই যাব….
-আচ্ছা …ঠিক আছে নাম….তাড়াতাড়ি…এখুনি সবাই চিৎকার করবে ….

চাঁদ নেমে পড়ল বাস থেকে…বাসটা বেরিয়ে গেল…..
বাস থেকে নেমে , দূরে তাকিয়ে বাসস্ট্যান্ডের ভিড় দেখে একটু রাগ দেখিয়ে বলল…..’দূর বাসটা না ছাড়লেই হত….’
-হুমম….তাই তো বলতে চেয়েছিলাম….যাক ছাড় … আজ আমার সময়ের সাথে নিজেকে একটু মিলিয়ে দেখ না…..কিন্তু হঠাৎ যে বড় নেমে পড়লি….

প্রশ্নটা ছুড়ে দিয়ে সেই মিচকে শয়তানি হাসিটা আর চিরাচরিত চশমার ভেতর দিয়ে সেই মন পর্যন্ত ছুঁয়ে ফেলা দৃষ্টিতে তাকালো চাঁদের দিকে…..
-উফফ…চশমাটা নাকের ডগা থেকে তোল । …যেন মূর্তিমান মহাকাল… হ্যাঁ তো কি হয়েছে ?….ইচ্ছে হল তোর সাথে যাবার….তাই….
….তুই এত লম্বা না….তোর দিকে তাকিয়ে কথা বলতে আমার ঘাড়ে ব্যাথা হয়ে যায়…..(চাঁদ একটু হেসে লজ্জা পেয়ে মাথাটা নামিয়ে নিল)
-আচ্ছা ????? আর আমার বুঝি মাথা নামিয়ে কথা বলতে অসুবিধে হয় না?? সবচেয়ে বড়ো কথা ….জীবনে যে ছেলে কখনও কারোর সামনে মাথা নামায় না…. তুই কোন মালিকা-এ-সুলতানা ,যে আমায় মাথা হেঁট করে তোর সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে…..শুনি?
-বাঃ ভালো বলেছিস তো….ধরে নে না রাজিয়া সুলতান…

এই বলে দুজনেই হেসে উঠল…তারপর চাঁদ বলল… ‘ তবু তো কাউকে পেলি যার সামনে তুই অকপটে তোর মাথা নামাতে পারছিস….’

কথার মাঝখানে বাম্পার টপকে টপকে বাস চলে এল…..ঘুরে এসে স্ট্যান্ডে দাঁড়ালো ….অজগরের মত লাইনটা নড়েচড়ে উঠল….আজ আর বাসে সিট পাওয়া যাবে না….লাইন দিয়ে বাসে উঠেই, সোহম কেবিনের দিকে এগিয়ে গেল….চাঁদকে বলল…’এদিকে আয়…’ ড্রাইভারের পিছনে হেল্পারের সিটে কনডাক্টর বসেছিল….গাড়িটা ছাড়ার মুখে সে উঠে পড়তেই ….সোহম চাঁদকে বলল …’বসে যা….আর আমার কলকব্জা গুলো ধরে নে….’
চাঁদ হেসে ফেলল…’তোর কলকব্জা??? কি যে বলিস…যাঃ !!!! কনডাক্টরকে গেটের মুখ থেকে আসতে দেখেই চাঁদ ব্যাগ থেকে টাকা বার করতে করতে বলল’ আজ আমি টিকিট কাটব দাঁড়া…আগের দিন তুই কেটেছিস…..’
চাঁদ কনডাক্টরকে ডাকল….
কনডাক্টর ডাকটা উপেক্ষা করে উল্টো দিকে চলে গেল………

-দেখেছিস….আমি নিজে থেকে টিকিট কাটতে চাইছি…আর উনি ওদিকে হাত পেতে চাইতে চলে গেলেন ….
-তোর এত তাড়া কিসের বল তো টিকিট করার….দাঁড়া না…বাসে ভিড যা….এমনিতেই একবার কনডাক্টর ভেতরে গেলে ,বেরিয়ে আসতে আসতে আমরা সদন পৌঁছে যাব….তখন কে কার টিকিট কাটে ????
-যাঃ…তাই বলে বিনা টিকিটে….
চাঁদকে কথা শেষ করতে না দিয়ে …সোহম গলাটা একটু তুলেই বলল ‘আমি কি তাই বললাম?…তবে টিকিটের জন্যে স্টপেজে দাঁড়িয়ে তো আর পরের বাসটা মিস করব না!!!’
হঠাৎ বাসের সিঁড়ির মুখে দাঁড়ানো ইন্সপেক্টর বললেন ‘আপনাদের টাকাটা বাড়ান দেখি এদিকে….’
সোহম চাঁদের দিকে তাকিয়ে হেসে বলল….’দেখলি কেমন ভাবে ডাকতে হয়….’
চাঁদ হাসল…’বুঝলাম…নে টাকাটা ধর…’
সোহম নিজের বুক পকেট থেকে টাকা বার করে টিকিট করতে দিল…
-এটা কিন্তু ভীষণ বাজে হচ্ছে …রোজ রোজ তুই কাটলে…..দ্যাট’স অ্যান ওব্লিগেশান, ওম….এরকম করলে তো তোর সাথে আর যাওয়াই যাবে না….

-আচ্ছা আচ্ছা …মেরী মা….ফেরার সময় তুইই কাটিস….আর ফেরার সময় কেন এবার থেকে আমি তোর সাথে গেলে টিকিটই কাটবো না…তুই দেখ……
চাঁদের রাগ রাগ মুখটায় এবার একটু হাসির রেখা দেখে সোহম বলল…’ইউ আর সো ইমপালসিভ চাঁদ….জীবনটা এত ছোট্ট নয় , যে একদিনে ফুরিয়ে যাবে….এইভাবেই সব চলছে চলবেও……কালও হয়ত এইভাবে তোর আমার দেখা হবে….তখন কাটবি টিকিট……’

সোহমকে থামিয়ে দিয়ে চাঁদ বলে…’উঁহু….ভুল..পৃথিবী ঘুরছে …ঘুরবে …..থিওরি অফ রিলেটিভিটি…জীবন চলছে চলবে….কিন্তু কে বলতে পারে আজ আমি আছি বলেই কাল থাকব?? আমি মুহূর্তে বিশ্বাস করি ওম্ !!!! কাল কে দেখেছে???
-মানলাম … কিন্তু জীবন তো মুহূর্তেরই কোলাজ….
-এক্জ্যাক্টলি….নট নেসেসারি যে কনটিনিউইটি থাকতেই হবে…..

সোহম আর কথা বাড়ালো না…শুধু মুগ্ধ দৃষ্টিতে একবার চাঁদকে দেখল,তারপর কেমন যেন ভাবনায় ডুবে গেল….এতদিন সবার মুখের কথা সোহম কেড়ে এসেছে …আর আজ এই পাঁচ ফুট দুই-তিন ইঞ্চির মেয়েটার কথায় সে কথা হারিয়ে ফেলছে কেন?…তার খুব ইচ্ছে করছিল চাঁদের হাতটা একবার ছুঁয়ে দেখে….
এমন সময় বাস কনডাক্টর চেঁচিয়ে উঠল…’ এক্সাইড এক্সাইড’ ….চাঁদ বলল ‘বাসটা আজ নন্দনের সামনে দিয়ে এল খেয়াল করিনি …কিরে নামবি তো ….’
সোহম যেন হারিয়ে গিয়েছিল ….বাস থেকে নেমেই দুজনে ছুট লাগালো…. ক্রসিং-এ দাঁড়ানো যাদবপুরের বাস দেখে……ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে সোহম বাসের দরজায় পৌঁছোলো…ইতিমধ্যে চাঁদও এসে পড়ল….যথারীতি বাসে উঠে ,একটাও বসার জায়গা নেই…দুজনেই দাঁড়িয়ে রইল…চাঁদ সিটের সামনে…সোহম পিছনে ….সোহম নিজের মাথা বাঁচাতে ,ঘাড়টা ঈষৎ নীচু করে সামনের দিকে ঝুঁকে ,দুহাতে মাথার ওপরের রডটা ধরে দাঁড়ালো… এতে চাঁদের একটু অস্বস্তিই হচ্ছিল….কারণ দুজনেই বেশ হাঁপাচ্ছিলো,আর সোহমের গরম নিঃশ্বাসটা চাঁদের গায়ে পড়ছিল……চাঁদ একটু পিছন ফিরে তাকাতেই….সোহম বলল…’আজ তোর কি টেস্ট ?’
-মেটিরিয়াল….একটু বইটা দেখতে পারলে হত….কিন্তু আজ এত দেরি হয়ে গেল….! তোর কি সাবজেক্ট…ডিজাইন?
-হুম…মেশিন ডিজাইন ।

…এ কদিন ওদের স্টাডি লিভ ছিল…আজ থেকে ফার্স্ট সেমিস্টার শুরু ….দুজনেই যে আজ প্রথম একসাথে যাওয়ার ভালোলাগাটা একটু উপভোগ করবে তার আর উপায় কোথায় !!!
পার্ক সার্কাসের কাছে আসতেই চাঁদের সামনের মহিলা উঠে পড়লেন….চাঁদ সোহমকে বসতে বলল ।
-আমি তো আগের বাসে বসে এলাম…তুই বসে পড়…
-তুই একটা মেয়ে হয়ে দাঁড়াবি আর আমি কলেজের স্টুডেন্টস ইউনিয়নের এগজিকিউটিভ মেম্বার হয়ে তোর সামনে বসে থাকব! এটা হয় কোনোদিন? তুই বস…আর পারলে বইটা বার করে একটু চোখ বুলিয়ে নে….

একরাশ অস্বস্তি নিয়ে চাঁদ বসে পড়ল ….আর বইটা ব্যাগ থেকে বার করে দেখতে লাগল …
সোহম বলল ‘সব কিছুই ভালোলাগে…যদি রেজাল্টটা ভালো হয়….জানিস তো..!!’

চাঁদ বইটা খুলে বসল বটে…কিন্তু তিন-চারবার ওড়না ঠিক করল…চুলটা নিয়ে একটু নাড়াচাড়া করল….বইয়ের পাতাগুলো ওল্টালো….তবুও তার একটুও মন বসল না….সোহমের দিকে তাকিয়ে দেখল …সে তার বইয়ের দিকেই দেখছিল….চাঁদের সাথে চোখাচোখি হতেই সোহম জানলার দিকে তাকাল…. চাঁদ মাথা নামিয়ে চেষ্টা করছিল মনোসংযোগ করতে ….কিন্তু তার খালি মনে হতে লাগল ওর মাথার ওপর সোহমের দুজোড়া চোখ যেন খোলা বইটার অছিলায় ওকেই পড়তে চেষ্টা করছে…..
…..ওদিকে সোহম জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়েছিল ঠিকই কিন্তু ভাবছিল….চাঁদের মধ্যে কি যেন একটা আকর্ষণ আছে …সেটা কথায়…না …কন্ঠস্বরে…নাকি ব্যক্তিত্বে…কি জানি …. ।
ঢাকুরিয়া ব্রিজের কাছে এসে বাসটা বেশ ফাঁকা হল…সোহম চাঁদের পাশে বসতেই চাঁদ বলল,
-দূর আর পড়তে ভাল্লাগছে না…যা হবে …হবে…আজ একসাথে প্রথম এলাম আর কিছু গল্পই হল না…
-দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে থোড়ী কথা হত ম্যাডাম …বল কি বলবি…
-বলবো না…শুনব …তোর কথা….
-আমার কথা?…আজ থাক…পরে হবে ক্ষণ…তুই ফ্রী থাকলে বলিস…আমি ফোন করব….
…..যাদবপুরে বাস থেকে নেমেই বাসস্ট্যান্ডের সামনে সোহমের সাথে সৈকতের দেখা…
সোহম চাঁদকে বলল’…তুই এগিয়ে যা..বাই…অ্যান্ড বেস্ট অফ লাক…’
কিঞ্চিত ভুরু কুঁচকে, একটু চুপ করে থেকে বলল .. ‘থ্যাঙ্ক ইউ …সেম টু ইউ…বাই…’
…চাঁদ এগিয়ে গেল….মনে মনে ভাবল …এই এড়িয়ে যাওয়াটার কি খুব দরকার ছিল….ওর চেনা মহলে চাঁদ যেন ব্রাত্য….
…সৈকত সোহমকে বলল..’ব্যাপারটা কি?….কে মেয়েটা…আগের দিন বাসে…আজ কলেজে …একসাথে…আগে দেখিনি তো?
-এক জায়গায় থাকি তো…আগে অবশ্য আমিও জানতাম না….
-আচ্ছা আচ্ছা ….তা তুই ডান দিক বাঁদিক দুইদিকই সামলাচ্ছিস নাকি??
-আরে না না…দূর… পরীক্ষাটা দেবার ইচ্ছে আছে কি?? কটা বাজে দেখ!!!
….এই বলে দুজনে দৌড় লাগালো ইউনিভার্সিটির গেটের দিকে …

…………………………………………………………………………………………………ক্রমশ

 

  
This entry is part 5 of 8 in the series চাঁদের পরিক্রমণ

 

পর্ব – ৫/


 

বৃন্দা কদিন হল , কলেজে আসছে না ….পায়ে চোট লেগেছে ….চাঁদ কমন রুমে প্রফেসর বড়ুয়ার কাছে খবরটা শুনে ফোন করল বৃন্দাকে….এ কথা সে কথার পর নিজে থেকেই বলল ‘দুপুরে ক্লাস অফ আছে আমার ….তোমায় দেখে আসব কেমন’ …..তাই দুপুরে বেরোলো চাঁদ…..বৃন্দার বাড়ি বালিগঞ্জে ।
বৃন্দা ভাটনাগর….ফিজিক্সের লেকচারার……বেশ ইনটালেকচ্যুয়াল …….তার বাবার কর্মসূত্রে কলকাতায় অনেক বছর…খুব মিষ্টি স্বভাব…অবিবাহিতা …চাঁদের সাথে বেশ সদ্ভাব । বৃন্দার বাড়ি আগে সে কোনোদিন আসে নি….তাই লোকেশন খুঁজে তাকে যেতে হবে…বিজনসেতু থেকে নেমে গাড়ি পাশের দিকে বাঁক নিতেই কেমন যেন রাস্তাটা চেনা চেনা লাগছিল….আরেকটু এগোতেই তার মনে হল হ্যাঁ সে যেন এই জায়গাটায় আগে এসেছিল….সোহম , দীপা, রুদ্র , সৈকত আর রঞ্জাদির সাথে ।রঞ্জাদির এক আত্মীয়ের বাড়ি জন্মাষ্টমীর নিমন্ত্রণে ….সে কতদিন আগের কথা । কলেজ ক্যাম্পাসে তখন এই পঞ্চ পান্ডবকে কে না চিনত….স্টুডেন্টস ইউনিয়নের সক্রিয় সদস্য ছিল….সৈকত , সোহম আর দীপা ।এই পঞ্চ পান্ডবের বাকি চারজনের সাথে আলাপের দিনটা চাঁদের বেশ মনে পড়ে….সেই যেদিন ইউনিভার্সিটির গেটে চাঁদ আর সোহম দুজনে এক সাথে পা রেখেছিল…..লেকের ধারে বসে থাকা রুদ্র , দীপা আর সৈকত রে রে করে উঠেছিল …’কিরে ? তুই এত আগে আগে কলেজে? ‘…..সৈকত তো চাঁদকে আগেই দেখেছিল ….তবে আলাপ ছিল না ।বাকিদের সাথে চাঁদের আলাপ করিয়ে সোহম জিজ্ঞেস করল….’রঞ্জা কই রে?’….দীপার চোখ অনুসরণ করে চোখ চলে গেল কিছুটা দূরে যেখানে প্রফেসর পি.কে.সির সাথে একটা ফাইল হাতে কথা বলছিল রঞ্জা । কথা শেষ হতেই মুখে একটা মিষ্টি হাসি নিয়ে ওদের সামনে এসে দাঁড়িয়ে বেশ অবাক হয়ে সোহমকে বলল ‘তোর ব্যাপারটা কি !!…আজ এত অ্যাডভ্যান্স….?’….সবার মুখে এক কথা শুনে চাঁদ বেশ বুঝে গেছিলো সোহম কলেজে বরাবর দেরীতেই আসে….দীপা আর রুদ্র ছিল ইলেকট্রিক্যাল ডিপার্টমেন্টের…সৈকত তো মেকানিক্যাল…সোহমের হরিহর আত্মা ….আর রঞ্জা ছিল সোহমের চেয়েও বছর দুয়েক সিনিয়র ….ও কেমিস্ট্রিতে এম .এস.সি করছিল…হোস্টেলে থাকত….বাড়ি ত্রিপুরায়…পুরো নাম রঞ্জাবতী বর্মণ….বাকি সবাইকে নাম ধরে ডাকলেও চাঁদ তাকে দিদি সম্বোধন করত….রঞ্জার একটা আলাদা ব্যক্তিত্ব ছিল….দেখতে সুন্দর না হলেও একটা আলগা শ্রী ছিল….মাঝে মাঝে শাড়ি পরত…একমাথা কোঁকরানো চুলে একটা বিনুনি….চাঁদের ক্লাস অফ থাকলে রঞ্জার রুমে সময় কাটাত দুজনে…গড়িয়াহাটের কেনাকাটায় যেত….অদ্ভুত একটা কেমিস্ট্রি ছিল চাঁদ আর রঞ্জার মাঝে …. রঞ্জার প্রকাশটা যদিও কম ছিল….কিন্তু চাঁদ ওকে ভালোই পড়তে পারত…..
……সেই রঞ্জাদির ই মামাতো দিদির শ্বশুরবাড়ীতে নিমন্ত্রণে এসেছিল এই রাস্তায় ….কিন্তু বাড়িটা মনে নেই…..কত বদলে গেছে জায়গাটা…কত ফ্ল্যাট …অ্যাপার্টমেন্ট….এখন আশেপাশে…. ।

…..বৃন্দার বাড়িতে সময়টা বেশ কেটে যাচ্ছিল ….লিভিং রুমে…ভারী ভারী সোফা, মোটা কার্পেট, হ্যান্ডলুমের ঘন পর্দায় ঢাকা আলো আঁধারী পরিবেশটাকে আরও মায়াবী করে তুলেছিল শিল্পী হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়ার বাঁশির সুরেলা আবেশ….বৃন্দার সাথে কথা বলতে বলতে চাঁদ লক্ষ্য করছিল বারে বারে বৃন্দার মোবাইলটা বেজে উঠছে….আর বৃন্দা ফোনটা কেটে দিচ্ছে …চাঁদ থাকতে না পেরে বলেই ফেললো……
-তুমি ফোনটা ধরেই নাও না…কেউ হয়তো দরকারে ফোন করছে
– হুম ….ফোনটা সুরম্যর….কাল আমাদের মধ্যে একটু হট এক্সচেঞ্জ হয়েছে আজ তাই ওর ফোনটা ধরতে চাইছিলাম না…
-না না ছেলেমানুষি কর না….এগুলো খুব সেনসিটিভ ব্যাপার ….কথা বলেই নাও….
-এখন ধরলে সময় লাগবে কথা বলতে ….তুমি বিরক্ত হয়ে যাবে ।
-হব না …তুমি কথা বল…আমি তোমার ম্যাগাজিন গুলো একটু দেখি

….সেন্টার টেবিলের নীচে রাখা ‘ইনসাইড আউট সাইড’ এর একটা সংখ্যা বার করে পত্রিকাটা দেখতে দেখতে চাঁদ বুঝতে পারল অতীতের সেই পুরনো ছবিগুলো তাকে সেই দিনগুলোয় টেনে নিয়ে যাচ্ছে ………….যেখানে ফোনটা দুবার করে রিং হয়ে কেটে যাচ্ছে …..ক্রলুর ক্রুলুর….ক্রুলুর ক্রুলুর…. মা বলছে ‘চাঁদ ‘কি ব্যাপার বলতো?….লাইনের গন্ডগোল নাকি? মাঝে মাঝেই এরকম রিং হয়ে যায় ফোনটায়…কখনও দিনে , কখনও দুপুরে ,কখনও সন্ধ্যেয় ,কখনও রাতে!!!!’…..চাঁদ বইয়ের মধ্যে মুখ লুকিয়ে হাসছে….চাঁদ জানে এটা সোহমের কাজ….যখনই ও ফ্রী থাকে তখনই এরকম মিসড কল করে ল্যান্ডলাইনে সিগন্যাল দেয়…অবশ্য চাঁদও এই দুষ্টুমিটা করে….মাঝে মধ্যে ।

…..সোহমের দাদা সৌনক থাকে গুজরাটে ।মা চাকরী করেন ।বাবা মারা গেছেন সেই আট বছর বয়সে ।ছেলেবেলায় বাবার সাথে সোহমের সখ্যতা ছিল সবচাইতে বেশি….কিন্তু হঠাৎ করে হার্ট অ্যাটাকে বাবা মারা যাওয়ার পর মায়ের একাকিত্ব ….দাদার গাম্ভীর্য সোহমকে খুব তাড়াতাড়ি বড়ো করে দিয়েছিলো ….সে ছিল মা আর দাদার মাঝে একমাত্র সেতুবন্ধ…সৌনক এল এন্ড টি তে চাকরি করে …সোহমকে বলে …’তুই ভালো স্কোর কর ভাইয়া ,আমি এখানে টেনে নেব’….কিন্তু সোহম কলকাতা ছেড়ে যেতে নারাজ ।…..মা অফিসে বেড়িয়ে যান…ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যে….এর মাঝে সোহম বাড়ীতে থাকলেই মাঝে মধ্যেই চাঁদকে ফোন করে….চাঁদের সাথে কথা বলতে থাকলে সময়টা কোথা দিয়ে কেটে যায় টের পাওয়া যায় না ।
…..চাঁদ মা বাবার একমাত্র মেয়ে….যতটা আদুরে সবাই ভাবে ততটা কিন্তু নয়….বাবা একটু রাশভারী প্রকৃতির ….আর মায়ের শাসন বেশ কড়া….তাই ছোটবেলা থেকেই চাঁদ নীতি , দায়িত্ব , কর্তব্য ,ঔচিত্য…..এইসব ভারী ভারী শব্দেই বেড়ে উঠেছে । কিন্তু বয়স তো সবে উনিশ….তার ধর্ম যাবে কোথায় ?…তাই তার এখন একটু আধটু মজা, প্রগলভতা, অনিয়ম ভালোই লাগে….বেশ লাগে, চুরি চুপি দুঃসাহসিক কোনো ভাবনাকে মনের সঙ্গোপনে বাড়তে দিতে ।
বেশ কয়েকদিন হল চাঁদ কলেজে যাচ্ছে না, ভাইরাল ফিবারের জন্যে ….তাই বলে কি যোগাযোগ নেই নাকি….খুব আছে….সোহমের সাথে যোগাযোগটা তার ফোনে বেশ বেড়েই চলেছে …..
মা মুখের দিকে তাকিয়ে বলল….
-ওই দ্যাখ…আবার হবে শোন!!
-কই?
বলতে বলতে আবার দুবার রিং…..চাঁদ এবার হেসে বলল ‘মা,তুমি কি রাগ করবে?’
-কি জন্যে ?
-না…একটা কথা বলতাম!!
-কি ব্যাপারে ?
চাঁদ একটু চুপ করে থেকে ফোনের ব্যাপারে ….
-কে করে ফোনটা? তুই জানিস?…তোকে খোঁজে নাকি?….আমি যতবার ধরতে যাই কেটে দেয়!!!…কিছু করছিস নাকি চাঁদ?
-উফফ মা…এই এক তোমার সমস্যা । কিছু বলা নয়ত….
ওটা সোহমের ফোন….ও ফাঁকা থাকলে জানায়….
আমিই বলেছি ওকে …বেশি ফোন করবি না…মা রাগ করে কোনদিন কি বলে দেবে….তাই…
-ও….কিন্তু সত্যিই এটা এই পর্যন্ত না আরও বেশি কিছু
-দূর….তুমি বেশি ভাবো….ওকে কতটুকু চিনি আমি ?
-দিনকাল খারাপ চাঁদ….যা খুশি করলে পরে কাঁদতে হবে….তাছাড়া সমবয়সী প্রেমের স্থায়িত্ব কম….যা করবে বুঝে শুনে কোরো….আর মানুষের মন হল পদ্ম পাতায় জল….
-কিসব বলছো? প্রেম ???….এর মধ্যে তুমি প্রেম পেলে কোথায় ?…দেখাই হয় না….আর হলেও কথা কোথায় হয়??(চাঁদের গলাটা কেমন যেন ভারী হয়ে এল…সে চুপ করে গেল)
দোতলায় ঘরে উঠে এল চাঁদ….সোহমকে ফোনটা করেই ফেললো …..
-হ্যালো
-আজ দুপুরে চলে এসেছিস কেন? ক্লাস ছিল না?
-না…ভালো লাগছিল না । তোর শরীর কেমন?
-ঠিক আছে এখন…কিন্তু বৃষ্টির জন্যে মা বেরোতে দিচ্ছে না….
-কাল বেরো না প্লিজ …পরশু থেকে এগারো দিন আমি থাকব না ।
-কোথায় যাবি?
সোহম: এন.সি.সি ক্যাম্প…
-ও বাব্বা….কোথায় হবে??
-হেস্টিংসের মাঠে
-এর মাঝে বাড়িতে আসবি না?
-না
-সামনের বুধবার ভাবলাম তোর ফেভারিট রোল খাওয়াবো বেদুইনে ….কিন্তু…
-হঠাৎ কেন?
-এমনি।
-আচ্ছা এমনি এমনি?…তা আর কি করা যাবে…আমার যেমনি তেমনি কিছুই খাওয়া হবে না তোরাই খাস….ও সব সেন্টিমেন্টে কোনো কাজ হবে না ম্যাডাম …
-তাহলে বলছিস কেন কাল বেরোতে …তুই ঘুরে আয় …তারপর দেখা হবে…রাখছি বাই ।
হঠাৎ করে ফোনটা কেটে দিল চাঁদ ।ভাবলো …কদিন আর কথাও হবে না…সামনের বুধবার চাঁদের জন্মদিন ….ভেবেছিল সারাদিন সবাই মিলে হইচই করবে…সে আর হওয়ার নয় । কি যে হয়েছে তার কে জানে…আগে চাঁদের কলেজের এই এতদূর যাতায়াতটা অসহ্য লাগতো …আর এখন এই যাওয়া আসাটা তার বেশ লাগে ।কেমন যেন একটা মোহ ….একটা আবেশ দিনকে দিন বেড়ে যাচ্ছে …চাঁদ ভাবলো সে কি প্রেমে পড়েছে সোহমের….দূর কি সব ভুলভাল ভাবছে !!!!!
……ওদিকে ফোনটা হঠাৎ কেটে যাওয়ায় সোহম একটু চুপ হয়ে যায়….’ক্যাম্পের জন্যে ব্যাগ গুছোতে হবে’ …এই ভেবে জামাকাপড় সব বার করেও….ভালো লাগলো না ব্যাগ গুছোতে…মা বাড়ি নেই…থাকার কথাও নয়….অন্য দিন হলে পাড়ার মাঠে একটু ফুটবলে লাথি মেরে আসতো…কিন্তু আজ কিছুই সোহমের ভাল্লাগছে না…বাড়ি থেকে বেড়িয়ে মাঠে বাচ্চাদের খেলতে দেখে মাঠের পাশে গাছের নীচে ,রাধাকৃষ্ণের মন্দিরের বেদীতে বসল সোহম….মনে পড়ছিল তার ছোটবেলার সেই ঘুম না আসা রাতগুলোর কথা ।

মা : টুকুন ,চুপ করে শুয়ে পড়োতো সোনা…
টুকুন জানলা দিয়ে চাঁদের দিকে তাকিয়ে বলত…’মা , চাঁদ এত দুষ্টু কেন…ডাকলেও আসে না…’
মা : আসবে সোনা তুমি দুষ্টুমি না করলে চাঁদ একদিন সত্যিই ধরা দেবে…..

….চোখ বুজে একটা লম্বা শ্বাস নিল সোহম…মাথাটা ব্যথা করছে…খিদেও পাচ্ছে …বাড়ি এসে কিছুই খাওয়া হয়নি….ভেবেছিল ফোন করে খাবে…কিন্তু ….আচ্ছা চাঁদ তাকে এমন আকর্ষণ করছে কেন?…কি একটা টান যেন তাকে চাঁদের প্রতি আসক্ত করে তুলছে….অথচ গত দেড় বছর ধরে সোহম একটা সম্পর্কে আবদ্ধ ….তার একটা কমিটমেন্ট আছে সেখানে…কই চাঁদের সাথে পরিচয়ের আগে কোনও দিন তার নিজের এমন না পাওয়া আছে মনে হয়নি….তাহলে আজ কেন সে চাঁদকে এড়িয়ে চলতে পারছে না…না এটা ঠিক হচ্ছে না ….চাঁদকে জানাতে হবে…আর যাতায়াতটা কমাতে হবে…দরকার পড়লে আরও একটু দেরী করে যাবে….সোহম ।
…..পরদিন সোহম স্ট্যান্ডে এসে দেখে চাঁদ দাঁড়িয়ে আছে….যথারীতি তার সময়ের বাসটা ছেড়ে ।সোহম ভাবল….আজ একসঙ্গে যাবেই যখন সব বলেই দেবে তাতে চাঁদ যাই ভাবুক…নিজে তো সৎ থাকবে নিজের কাছে ।
সোহম বলল…’কিরে আজ আসবি না বললি তো’
চাঁদ : না একটু কাজ আছে…কতদিন আর ক্লাস অফ করব!
যদিও চাঁদ জানে আজ ও শুধুমাত্র সোহমের সাথেই দেখা করতে এসেছে ….আজ যেভাবেই হোক সোহমকে বলতেই হবে ….সামনের এগারোটা দিন ওর কি ভীষণ একা লাগবে….এর মানে যদিও এটা নয় যে সে সোহমের প্রেমে পড়েছে….কিন্তু হ্যাঁ অবশ্যই একটা ফিলিঙস তো তৈরি হয়েছে ….
একটু চুপ করে থেকে চাঁদ বলল…’তোর গোছগাছ হয়ে গেছে?,
সোহম ‘হ্যাঁ ‘ বলে বাস দেখে চাঁদকে এগিয়ে যেতে বলল….
বাসে উঠে চাঁদ বলল…’আজ বেরোতে বলছিলি কেন?’
-কথা আছে…
-তাই , বল শুনি কি তোর কথা…
-তাই, তা তুই কি আমার কথা শুনবি বলে বেরোলি…..নাকি কদিন দেখা হবে না …আমাকে মিস করবি তাই বেরোলি ।
চাঁদের খুব ইচ্ছে করছিল যে জোর গলায় এই সত্যিটাই বলে…কিন্তু তার বদলে একটু চুপ করে বাসের জানলায় চোখ রেখে বলল ‘ আমি কেন?…তোকে মিস করার অনেক লোক আছে..’
-একটু হেসে…’হুম অনেকে আছে কিনা জানিনা…কিন্তু , ডেফিনেটলি একজন তো আছেই…মুখে বলুক আর নাই বলুক!!!…আমিও তাকে মিস করব….
….চাঁদের কি যেন একটা অস্বস্তি হচ্ছিলো …যেন ওর নিজের নামটাই সোহমের মুখে শুনতে চাইছিল ।তবুও বলল ‘একজন কে?’
সোহম চাঁদের চোখের দিকে সোজাসুজি তাকিয়ে বলল…’কে আবার?…রঞ্জা ।
হঠাৎ চাঁদের স্থির দৃষ্টি টা একটু যেন টলে গেল…সমস্ত উত্তেজনার অবসান ঘটিয়ে অসম্ভব রকম শান্ত গলায় অথচ একরাশ জিজ্ঞাসায় বলল….মানে? রঞ্জাদি!!!!
সোহম একভাবে বেশ কিছুক্ষণ চাঁদের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে ….চাঁদের মুখের অভিব্যক্তির কোনো পরিবর্তন হয় কিনা ….তাই দেখার অপেক্ষা । কেন জানি না তার নিজেকে একটু অপরাধী লাগছিলো ।
তবু চাঁদের চোখে একরাশ প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্যে সে বলল…’হুম….রঞ্জার সাথে আমার প্রায় বছর দেড়েকের সম্পর্ক যদিও ও আমার থেকে দু-আড়াই বছরের বড়…তবু ওর ম্যাচিউরিটিটা আমাকে একটা স্বস্তির আশ্রয় দেয়….আসলে রঞ্জার আগের একটা সম্পর্ক ছিল…আমাদেরই এক বন্ধুর দাদার সাথে…ইন্দ্রদা! ইন্দ্রদা বোস্টনে স্কলারশিপ নিয়ে পড়তে গেল….প্রথমে যোগাযোগ রাখত …তারপর কমিয়ে দিল….ধীরে ধীরে রঞ্জা একা হয়ে গেল …একটা মেয়ে বাইরে থেকে পড়তে এসে কতটা অসহায় ছিল আমি ওকে দেখে বুঝেছি…তারপর একদিন দেখলাম কেমন ভাবে যেন আমি ওর সাহারা হয়ে গেছি আর ওর নির্ভরশীলতা আমাকে আর অন্য কিছু ভাবতেই দেয়নি….তবে ওর একটা কমপ্লেক্স আছে যে ,ওকে দেখতে ভালো না ।
-কিন্তু রঞ্জাদিকে আমার ভীষন ভালো লাগে ….দেখতে সুন্দর না হলেও একটা আলাদা চটক আছে….তোর বাড়িতে জানে?
-না…ওর বাড়িতে জানে….ও আমাকে ভীষন রেসপেক্ট করে….এই যে তুই আমি একসাথে যাতায়াত করি …ও জানে কিন্তু কোনোদিন কিছু প্রশ্ন করে নি এই নিয়ে….আমি বা ও চাইলে সব সময় ফোনে কথা বলতে পারি না বা ঘুরতে পারি না…কিন্তু ওর কোনো অভিযোগ নেই এই নিয়ে….ও আমাকে পুরোপুরি ছেড়ে রেখেছে আর এই কারনেই আমি খুব স্বস্তি পাই ওর কাছে….আমি দায়বদ্ধ ওর কাছে….সত্যি বলতে ওকে কোনোদিন কষ্ট দিতে পারব না….একটা কথা বলব চাঁদ….?
চাঁদ খুব মনোযোগ দিয়ে কথাগুলো শুনছিল…বলল’হুম বল ।’
-তোর কি খারাপ লাগল….আমি মানে….না মানে আমার কেমন যেন মনে হচ্ছিলো …তুই ইনভলভ হয়ে পড়ছিস ….আমার কেমন একটা অপরাধবোধ কাজ করছিল মনে মনে….
-আমার আবার খারাপ কেন লাগবে…দূর…পাগলা আছিস..আমি ওতো ইমোশনাল নই ওম্….আর আমি প্রেমে পড়তেও চাইনা….বন্ধন অধিকার বোধ …এইসবে আমার দমবন্ধ হয়ে যায়…আমি হাঁফিয়ে উঠি….
সোহম কিছুক্ষণ চাঁদের মুখের দিকে চেয়ে থেকে বলল’ আমি তোকে কোনো ভাবেই হারাতে চাই না’
কথাটায় বাধা দিয়ে চাঁদ বলল’হারাবি কেন?….আমি আছি তো…তুই সরিয়ে না দিলে আমি থাকবও…আর রঞ্জাদিও আমার খুব ভালো বন্ধু …. ।
…..পরের বাসটায় এত ভিড় দুজনে বাসে উঠে কেমন যেন ছড়িয়ে গেল…..চাঁদ একটু ভিতরের দিকে একটা জানলার সামনে দাঁড়িয়েছিল…একটা ভাবলেশহীন চোখে রাস্তা দেখতে দেখতে ভাবছিল…সোহমের তো তাকে কৈফিয়ত দেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই….ও তো কোনোভাবেই চাঁদের কাছে কমিটেড নয়…তাহলে ও কেন দোষী ভাবছে নিজেকে …হ্যাঁ এটা ঠিক যে সোহমের প্রতি তার একটা দুর্বলতা তৈরি হয়ে যাচ্ছিল যেটা হয়ত ঠিক নয়….কিন্তু এতে বন্ধুত্ব কেন নষ্ট হবে…তার চেয়ে এই বেশ ভালো হয়েছে ….
বাস থেকে নেমে দুজনেই ক্যাম্পাসের দিকে এগিয়ে যেতে লাগল….আজ কেমন যেন গতিটা শ্লথ দুজনেরই….কোনো তাড়া নেই…কোনো শব্দ নেই ..অথচ পরম বিশ্বস্ততায় পাশাপাশি হেঁটে চলার অঙ্গীকারে ….সোহম বলল….’কিছু বলবি না….’
চাঁদ একটু হেসে বলল
-ভাবছি …কি আর বলব…তবে এটুকু বলি…আমার তো এখানেই থাকার কথা ছিল….কারণ পৃথিবী যদি গ্রহ হয়, চাঁদ তার উপগ্রহ… চাঁদের সাথে পৃথিবীর সম্পর্কটা তো শুধুমাত্র বিশ্বাসী এক পড়শির ….যাদের সম্পর্কের শুরু থেকেই স্থির হয়ে আছে তারা আন্তরিক প্রতিবেশীই থাকবে…আর মাঝখানে ছোট একফালি আকাশের দূরত্ব থাকবে মহাশূন্য … অনন্তকাল এ ওর চারপাশে ঘুরে বেড়াবে……. অনর্গল কথা বলবে পরস্পর ….মুখোমুখি চেয়ে থাকবে আজীবন …কিন্তু কোনো অবস্থাতেই তারা মিলবে না….কারণ এটাই বিজ্ঞান ….দুজনে দুজনকে সমস্ত চুম্বকশক্তি দিয়ে টানতে থাকবে মহাকর্ষজ টানে…কিন্তু কোনও অভিলেপন হবে না….একে অন্যকে ছুঁয়ে বিস্ফোরণ ঘটাবে না….কারণ এটাই বিজ্ঞান ….তাই তোর আমার সম্পর্কে তো কোনো মিথ্যে আড়ম্বরের জায়গাই নেই….’এই কথা গুলো বলে চাঁদ এগিয়ে গেল তার গন্তব্যের দিকে আর অদ্ভুত একটা দৃষ্টিতে ওম্ চেয়ে রইল তার চলার পথে…. ।

…………………………………………………………………………………………………..ক্রমশ

  
This entry is part 6 of 8 in the series চাঁদের পরিক্রমণ

পর্ব-৬


 

সকাল থেকে চাঁদ বইগুলো খুঁজে চলেছে , পাচ্ছে না…অথচ এন.ডি.ভাটের ড্রয়িং আর এম.কুরির স্ট্রাকচারের বই দুটো কোথায় যে রেখেছিল মনেই পড়ছে না…..বুক শেল্ফ গুলো সবই প্রায় দেখা হয়ে গেল….বাকি আছে পুরোনো বইয়ের তাকটা….ঐ তাক থেকে বইগুলো একটু নামিয়ে দেখতে পারলে ভালো হত…।
…….তাকের পুরনো বই ঘাঁটতে ঘাঁটতে চাঁদের চোখ এড়ালো না অবন ঠাকুরের হাতে আঁকা বইটা….আর তার পাশের পুর্ণেন্দু পত্রীর’ একশো প্রেমের কবিতা’র বইটা । অবন ঠাকুরের বইটা খুলতেই চোখে পড়ল লেখাটা….”আমার জন্মদিনে আমি…..9.9.1999″….লেখাটা দেখে চাঁদ একটু হাসল….কবিতার বইটা খুলে একটু পাতাগুলো নাড়াচাড়া করতেই সব ওলোট পালোট হয়ে গেল… ।… মনে পড়ে গেল সেই চরম অধ্যায় … ।
….সেই সেদিনের কথা…যেদিন সোহম তাকে রঞ্জার কথা বলেছিল…..সেদিন ড্রয়িং ক্লাসে ভুল সায়োগ্রাফি করায়…নবনীতা ম্যাম খুব বকেছিল চাঁদকে ….টিফিনের পর ক্লাস করতে আর ভালোই লাগছিল না…কেমন যেন মনটা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিল….তার কেটে যাচ্ছিল ….চাঁদ বেরিয়ে এল ক্যাম্পাস থেকে…. । রঞ্জা খুঁজতে এলো যখন জুন বলল….’ওর শরীর খারাপ লাগছিল তাই বেরিয়ে গেছে , রঞ্জাদি ।’ রঞ্জা সোহমকে জানালো …..কথাটা শোনামাত্রই কেমন যেন অস্বস্তিটা বেড়ে গেল সোহমের….একে তো আসার পথে রঞ্জার সাথে সম্পর্কের কথাটা বলেছিল চাঁদকে….তার ওপর আগামী এগারোটা দিন দেখা হবে না ….কারণ সোহমের এন. সি.সি ট্রেনিং ফোর্ট উইলিয়ামে…. তাই চাঁদ কিছু ভুল বুঝে থাকলে ,সেটা ভাঙাবে কেমন করে!
……ওদিকে চাঁদ কলেজ থেকে একাই ফিরে এসেছিল দুপুরবেলা । মেঘলা আকাশ….ঝোড়ো হাওয়া….বিকেলের ম্লান আলোয় চুরি গিয়েছে রোদের দাপট….ভরা ভাদ্রমাস…..কিন্তু বৃষ্টি সঙ্গ ছাড়ে নি ।সন্ধ্যের মুখে আকাশ ভেঙে ভীষণ বৃষ্টি….প্রকৃতির আচরণে যেন এক তীব্র প্রতিবাদ….কি যেন এক অস্হিরতার পরিসমাপ্তি….অধীর আগ্রহে সোহম একটা ফোনের অপেক্ষা করছিল….ফোনটা নিজে থেকে করতে একটু ইতস্ততই করছিল…..ঠিক এমন সময় চাঁদের ফোনটাই এলো…..
হ্যালো….
ফোনের ওপারে নিস্তব্ধ চাঁদ আর রবীন্দ্র সংগীত ….’আজি ঝরঝর মুখর বাদল দিনে/জানি নে ,জানি নে/কিছুতে কেন যে মন লাগে না…..’….সোহম জিজ্ঞেস করল ‘কিরে গান শুনছিস….আজ হঠাৎ চলে এলি কেন ক্লাস ছেড়ে ?’
চাঁদ: মাথা যন্ত্রণা করছিল ।
সোহম: সত্যি???
চাঁদ: হুম
সোহম: ফিরে এসে কি করলি…ঘুমোলি?
চাঁদ: না, কবিতা পড়ছিলাম ।
সোহম: কার লেখা ?
চাঁদ: পুর্ণেন্দু পত্রী ।
সোহম: একটা কবিতা বল শুনি..
চাঁদ: থাক না আজ….পরে কোনোদিন বলব…
সোহম: আজ এত মেপে কথা বলছিস কেন !….আগে তো কত লেখা আমরা দুজনেই পড়ে শুনিয়েছি….বল না প্লিজ… ।
চাঁদ: (একটু চুপ করে থেকে) ….
সেই ভালো , শুধু শব্দে থাকো ।
সম্বোধনে, শুধু উচ্চারণে 
তোরঙ্গে যেমন থাকে
তোলা শাড়ী পরিপাটি ভাঁজে,
সর্বাঙ্গের ভাঁজে সে থাকে না ।
খাম ও চিঠির মধ্যে 
যেরকম অঙ্গাঙ্গি ও স্পষ্ট আলিঙ্গন
সেরকম তোমাকে পাব না ।
গমনাগমন বন্ধ 
ভেঙে দাও সান্নিধ্যের সাঁকো ।
সেই ভালো ,শুধু শব্দে থাকো ।

চাঁদের এই কবিতায় সোহমের আর বুঝতে বাকি রইলনা কিছুই ….অদ্ভুত একটা অজানা দমবন্ধ করা অনুভুতি নতুন করে ঘিরে ধরলো সোহমকে….বেশ কয়েকটা মুহূর্ত দুজনেই চুপ থাকার পর ….সোহম বলল ‘আমাদের একসাথে যাতায়াতটা বন্ধ করতে হবে চাঁদ….সত্যি বলতে আমিও বোধহয় তরল হয়ে যাচ্ছি …..রঞ্জাও আমার প্রতি কেমন যেন শীতল হয়ে যাচ্ছে ….তুই পারবি না চাঁদ সব ঠিক করে দিতে….তোর কাছে তো সব কিছুর জবাব তৈরি….?’

চাঁদ: নিজের সম্পর্কে খুব উচ্চ ধারণা পোষণ না করাই ভালো…….ও ভাবে ভাবাটা বন্ধ কর ।
কয়েকটা কথা বলি ওম্…রঞ্জাদিকে যথেষ্টই আকর্ষক লাগে …আর তুই ওকে উদ্ধার করার মানসিকতায় সম্পর্ক তৈরি করেছিস ….এটা বোঝাতে যাস না প্লিজ….ভালোবাসায় সুন্দর অসুন্দর বলে কিছু হয়না ….আর আমি …মোটেই তোর প্রেমে পড়িনি….হ্যাঁ যেটা হয়েছিলো …..সেটা ইনফ্যাচুয়েশনস…..তার জন্যে কেউ কেঁদে ভাসায় না বা বন্ধুকে এড়িয়ে চলে না…একসাথে যেতে না চাইলে যাবি না….কিন্তু নিজের কাছে নিজে কি চাস সেটা যদি পরিষ্কার থাকে , তাহলে আমার মনে হয় সম্পর্কের রূপরেখাগুলোর কোনো পরিবর্তন হয় না ।
সোহম চুপ করে কথা গুলো শোনে….তারপর বলে…’ যাক অনেক বকেছিস….আর নয়…তোকে একটা দায়িত্ব দিলাম…আমার আর রঞ্জার মাঝে যদি কেউ বোঝাপড়া করার অধিকার রাখে তো সে কেবল তুই….পারলে ওর কমপ্লেক্সটা কাটাতে চেষ্টা করিস….আর সামনের এগারোটা দিন কোনো কথা তো হবে না…ভালো থাকিস….নিজের আর রঞ্জার দুজনেরই খেয়াল রাখিস…আমি ফিরে জানাব ।
চাঁদ: নিশ্চয়ই ….তুই সাবধানে থাকিস…রাখছি বাই ।

….ফোনটা কাটার পর চাঁদ চুপচাপ খাটে শুয়ে সিলিং ফ্যানের দিকে তাকিয়ে রইল বেশ কিছুক্ষণ । ….ভাবতে থাকল…..সময় বড়ো অদ্ভুত …সময় বয়ে যায়…সাথে সাথে সম্পর্কও …যে মানুষটা একদিন সবচেয়ে কাছের থাকে ,সময়ের ঘাত প্রতিঘাত তাকে কেমন ভাবে যেন দূরে ঠেলে দেয়…চাঁদ আর ওমের মাঝে একটা নদী বয়ে যাবে অথচ মধ্যবর্তী কোনো সাঁকো নেই যে হাতটা বাড়িয়ে ধরবে….কেন যে জীবনের সব অঙ্ক মেলে না?….তার কোনো উত্তর নেই!…এরপরও পরস্পর মুখোমুখি হবে কিন্তু চাঁদ কিছুতেই তার অভিব্যক্তির আঁচ বুঝতে দেবেনা….যে চাঁদ অভিনয় এড়িয়ে চলতে চায় সারাজীবন …..সময় তাকে বারবার সেই অভিনয়ের সাথেই অভ্যস্ত হতে বাধ্য করে….হঠাৎ করে তার নিজেকে ভীষণ একা লাগল….সে এই কথাগুলো কোনওদিন কাউকে বলে হালকা হতে পারবে না…বৃষ্টি থেমে গেছে বেশ কিছুক্ষণ ….কিন্তু চাঁদের ভিজে চলা তো আজ থেকে শুরু….খুব রাগ হল তার বেয়াদপ মনটার জন্যে …কোন অসতর্ক মুহুর্তে সে এমন কাঠিন্যের বেড়া টপকে ফেললো কে জানে? যার মাসুল আজ তাকে এমনভাবে দিতে হচ্ছে …..আর কেউ না জানুক, জানলার বাইরে উজিয়ে থাকা, একফালি রম্বসের মত শিফন আকাশটাই কেবলমাত্র তার সাক্ষী হয়ে রইল ।
…….পরদিন কলেজে রঞ্জাদিকে দেখে একরাশ অভিমান জোড়ো হচ্ছিলো ….তারপর চাঁদ নিজেকে একটু শাসন করল…রঞ্জার ওপর তার বিরক্তি বা রাগের কোনো কারণ থাকা উচিত নয়…তবে কি হিংসে …না সেটাও উচিত না…যার যেটা ডেস্টিনি……॥
রঞ্জা: কিরে আজ এত চুপচাপ …? মনখারাপ?
চাঁদ: আমি তো জানি , মন তোমার খারাপ !
রঞ্জা: মানেটা কি??
চাঁদ: (একটু হেসে)…মানেটা তুমি জানো না বলতে চাও…কিন্তু আমি তো জেনেই বলছি ।
রঞ্জা: ও বাব্বা!!!!….তোকেও বলা হয়ে গেছে!!
চাঁদ: হুম…শুধু তাই নয় তোমার দেখভাল করতে বলেছে…বুঝলে…আপাতত আমি তোমার লোকাল গার্জেন ।
রঞ্জা: বুঝলাম ….আর কি বলেছে শুনি?
চাঁদ: বলেছে অনেককিছু….বলব কেন ,সব কথা…?
রঞ্জা: বল না প্লিজ….আমার মতো এরকম একটা মেয়ের সাথে কিভাবে সম্পর্ক হল …বলে নি তোকে….?
চাঁদ: একদম চুপ….’তোমার মত মেয়ে ‘….কথাটার মানে কি?…তোমার কিসের এত কমপ্লেক্স আমি বুঝি না…ইউ আর টু ব্রাইট ইন অল রেসপেক্ট…..
রঞ্জা: বুঝেছি তোকে এটাও বলেছে….তুই বুঝবি না চন্দ্রিমা…আমার সাথে আগে যার সম্পর্ক ছিল…আমি তাকে সবরকম ভাবে সাপোর্ট দিয়েছি …বোথ মেনটালি এ্যান্ড ……
চাঁদ: (রঞ্জাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই )….তো কি হয়েছে?…তুমি ভালোবেসেছিলে বলেই তো…..সে যদি তোমায় ছেড়ে যায় তোমার অপরাধটা কোথায়?
রঞ্জা: ….না…তা নয় ….কিন্তু তুই জানিস কিনা আমি জানি না….আমি ওকে সবটা বলেই উঠতে পারি নি….তার আগেই ওকে আঁকড়ে ধরেছি….এক ভীষণ বিপর্যস্ত অবস্থায় ওকে জাপটে ধরে থেকেছিলাম বেশ কিছু সময়….তখন ও আমার কে আমি ভাবতে চাইনি….কিন্তু তারপর থেকে ও আমার ওপর যথেষ্ট দায়িত্ববান…কিন্তু আমার মনে হয় তোর মত কারোর সাথে ওর সম্পর্ক হলে বোধহয় ভালো হত…..॥
চাঁদ ভেতরে ভেতরে ক্ষয়ে যাচ্ছিল ….হয়ত বা পুড়েও যাচ্ছিল ….তবুও জোর করে বলল’ না…এইসব বাজে কথা তুমি আর ভাববেও না….বলবেও না…তুমি যা তুমি তাই….ও তোমার সব অবস্থা বুঝেই তোমাকে ভালোবাসে ….সব কথা বলে বোঝাতে হয় না , রঞ্জাদি….তোমার এমন সুন্দর একটা মন ….সেটা কে কেন অপমান কর বারবারে….প্রতিটা মুহূর্তকে বাঁচার মত করে বাঁচো…. ।
রঞ্জা চাঁদকে কেমন যেন এক নির্ভরতার আশ্রয়ে জড়িয়ে ফেলল….তারপর বলল…’আচ্ছা কথা দিলাম তোকে….তোর কথা শুনব….তা তুই বেদুইনে খাওয়াবি কেন?…জন্মদিন?
চাঁদ: তোমাকে , যে বলল তাকে জিজ্ঞেস করলে না কেন?
রঞ্জা: সোহম তো জানে না বলল…আমি বলি কি…ও আসলেই খাওয়াস…
চাঁদ: হুম….তাই ভেবে রেখেছি…ও আসুক আগে….তারপরই হবে ।
……..এইভাবেবেশ কটাদিন কাটল…রঞ্জা আর চাঁদের গল্পগাছাও বাড়ল….ধীরে ধীরে সোহমের দোষ গুণ আলোচনায় ওর অনুপস্থিতিটা দুজনেই মানিয়ে নিয়েছিল ওদের নিজের মত করে ।
……আজ চাঁদের জন্মদিন….চাঁদের বাড়িতে জন্মদিনের উৎসব বারণ….তাই মা দিনের দিন কিছুই করেন না….শুধু ওর একটু পছন্দ মত রান্না হয় বাড়িতে….গত দুবছর ধরে চাঁদ বন্ধুদের সাথে একটু ঘোরাফেরা করে….বাবা আপত্তি করে না ।…সকালে চাঁদ কলেজে যাবে বলে বেরিয়েও গেল না…গগনেন্দ্র শিল্প প্রদর্শনী তে ঘুরে ঘুরে ছবি দেখল……একটা অবন ঠাকুরের আঁকার বই কিনল….দুপুরে কিছু খাবে বলে একাডেমীর সামনে এসে ‘নাথবতী অনাথবত’…এর টিকিট কেটে থিয়েটার দেখল একা একা….তারপর ওখান থেকে বেরিয়ে সেন্ট পলস্ ক্যাথিড্রাল চার্চের ভিতরে বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইল….চার্চের শান্ত সমাহিত পরিবেশে আত্মস্থ হওয়ার চেষ্টা করল চাঁদ….এইভাবে সময় কাটিয়ে সন্ধ্যে সাড়ে সাতটার পর বাড়ি এল চাঁদ…..সারাদিন কিছু খাওয়া হয়নি….বাড়ি ফিরতেই মায়ের হুকুম ….দিদা….বড়পিসি….ভাইয়া ফোন করে পায়নি চাঁদকে ….তাই ওদেরকে পাল্টা ফোন করতে হবে….চাঁদ জানে এখন খাবারের কথা বললেই মায়ের হাজার প্রশ্ন কেন খাইনি….কোথায় ছিলাম…তাই সে কিছু না বলেই নিজের ঘরে গেল….ফ্রেশ হয়ে সবার আগে ব্যাগ থেকে বইটা বার করে লিখল….’আমার জন্মদিনে আমি’….তারপর একে একে ফোন করে কথা বলল সবার সাথে….তারপর চুপচাপ শুয়ে রইল ….ভাবল কত মজা হতে পারত…কিন্তু হল না….কি অবহেলায় একটা দিন কাটাল….উফ যেন একটা মাস …কি দীর্ঘ !!!
…..এমন সময় রঞ্জাদির ফোন…
কিরে তোর ব্যাপার কি…আজ তো এলিই না কলেজে ….কার সাথে ঘুরে বেড়ানো হল ,বল?…আমরা সবাই বাদ…দাঁড়া সোহম আসুক….বলব…হচ্ছে তোর ।
চাঁদ : আরে না গো বেরোইনি আজ….
রঞ্জা : যাক গে….ছাড় পড়ে শুনব আজ কি করলি….বাই দ্য ওয়ে…আজ তোর জন্মদিনই তো….শুভেচ্ছাটা তো জানাতে দে…
চাঁদ হেসে বলল…’ তোমাকে অতো ফর্মাল হতে হবে না….আমি জানি তোমার ওয়েল উইশ আমার সাথে সবসময় আছে….
রঞ্জা: তুই একটা পাগলী….কাল আয় কথা হবে….হ্যাপি বার্থ ডে….বাই 
চাঁদ: থ্যান্ক ইউ…বাই…টাটা

….তখন প্রায় ন’টা বাজে…একটু ঘুম এসে গেছিলো চাঁদের…ঘুম ভেঙে গেল মায়ের ডাকে…’চাঁদ আমি চিলিচিকেন আর ফ্রায়েড রাইস বানিয়েছি….একটু পরে নেমে আয়….নীচে’
….চাঁদ বিছানায় উঠে বসল….নীচে নামতে যাবে….ফোনটা বেজে উঠল….
চাঁদ: হ্যালো
-মেনি হ্যাপি রিটার্নস অফ দ্য ডে…কিরে আজ খাওয়ালি সবাইকে?
একঝলক খুশি সোহমের কন্ঠস্বরে…..
চাঁদের চোখটা চিকচিক করে উঠল….ভীষণ একটা ভালোলাগায় তার কথাগুলো হারিয়ে যাচ্ছিল …বলল ‘তুই ? কোথায় ? বাড়ি চলে এসেছিস ?
সোহম:নারে বাবা….ক্যাম্পেই ।
সকালেই করতাম কিন্তু….কখন ফোন করব এটা ভাবতে গিয়েই একটু অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিলাম মার্চ পাস্টে….ব্যস কোর্ট মার্শাল হয়ে গেল….এই একটু আগে ছাড়া পেয়েছি । 
চাঁদ: এ বাবা….অত ছটফটানির কি আছে? আমি কি পালিয়ে যাচ্ছি ?
সোহম: না…তবে কেন জানিনা মনে হল তোর ভালো লাগবে । 
চাঁদ: হুম…ভালো তো লাগলো…কারণ আশাতীত….আমি ভাবিই নি ….
বাই দ্য ওয়ে আমি খাওয়াই নি..তুই এলেই হবে ।
সোহম: ওহ গড….কেন?..তুই একটা পাগলী…আচ্ছা রাখছি…কমান্ডার অফিসার এদিকে আসছেন..বাই
চাঁদ: বাই বাই…টেক কেয়ার 
…..অদ্ভুত একটা ভালো লাগা তার সারাদিনের কৃচ্ছসাধনের যন্ত্রণাকে এক লহমায় ভুলিয়ে দিল……এবার তার ভীষণ ক্ষিদে পেতে লাগল….নীচে গিয়ে মায়ের গলাটা জড়িয়ে চাঁদ বলল…কই কি বানিয়েছো….দাও আমায়!!!!মা বলল…. ‘ বস,  বাবা অপেক্ষা করছে কখন থেকে’….চাঁদ বাবার দিকে তাকিয়ে বলল….এই তোমার আসার সময় হল ….অফিস থেকে….আজকেও এত দেরী ?’….বাবা বলল ‘এবার খেতে বস… পরে ঝগড়া করবি’…. ।

…………………………………………………………………………………………………………………………………………………ক্রমশ

 

  
This entry is part 7 of 8 in the series চাঁদের পরিক্রমণ

পর্ব -৭


লাঞ্চ আওয়ারে ক্যান্টিনে চাঁদ আর বৃন্দা । কফি আর স্যান্ডউইচ নিয়ে সবেমাত্র বসেছে, বৃন্দার মোবাইলটা বেজে উঠল ।

বৃন্দা বলল: জাস্ট আ মিনিট…চন্দ্রিমা….সুরম্যর ফোন…
চাঁদ: ..ইটস ও কে….ক্যারি অন….টেক ইওর টাইম….
চাঁদ আশপাশটা লক্ষ্য করছিল….সব পড়ুয়ারা নিজেদের মধ্যে হৈ হৈ করছে …..তার মাঝে মাঝে সুরম্য আর বৃন্দার প্রেমালাপের টুকরো টুকরো কথা । চাঁদ চলে যাচ্ছে তার অতীতে । মনে পড়ে যাচ্ছে কলেজ ক্যান্টিনের কথা ।……জন্মদিনের খাওয়াটা সোহম আসার পরই হয়েছিল , তবে ওরা কেউ বেদুইনে রোল খেতে যায়নি…..ক্যান্টিনে চিকেন মোমো খেয়েছিল । সেদিন বেশ হৈ হৈ করেছিল বন্ধুরা । সোহম বলল “আচ্ছা তোকে আমরা কি উপহার দি বলতো, চাঁদ ?”
চাঁদ : উপহারের প্রয়োজনটা কি আছে? আমি তোদের কাছে এই যে হাসি মজা ভালোলাগাটুকু পেলাম…..তাই তো আমার সেরা উপহার ।
সোহম: দেখ, সত্যি বলতে আমি টিউশানে যা হাত খরচা পাই ….তার সবটাই প্রায় ফোনের এক্সট্রা বিল পেমেন্ট করতে চলে যায়….মা বলে দিয়েছে, মাসে নর্মালই যা ওঠে তাই দেবে….এর বেশিটা আমায় দিতে হবে, যেহেতু ফোন ছাড়া আমার চলে না….তাই হাত আমার সবসময় খালি ।
সৈকত: হাত খরচে আমারও কুলিয়ে ওঠে না….. কিন্তু না…….. তাও তোকে আমাদের কিছু দেওয়াই উচিত ।

…..এতসব আলোচনার মাঝে দীপা আর রঞ্জা চাঁদকে একটা মনিপুরি ওয়ালম্যাট দিল উপহারে ।
রুদ্র : দেখেছিস মেয়েরা কতটা গোছানো হয়….বাঁচালি বটে আমাদের ।
সবাই খুব হাসল । চাঁদ খুব খুশি হয়েছিল ওদের অকপট সারল্যে।
মনে মনে ভেবেছিল সোহমের উপস্থিতিটাই তো তার সবচেয়ে বড়ো পাওয়া । যদিও চাঁদ এখন সোহমকে কিছুটা এড়িয়েই চলে । ফোনে কথা হয় না…একসাথে ফেরার জায়গাটাই রাখতে চায় না ….আগে আসে আর আগে আগেই কলেজ থেকে বেরিয়ে যায় …..সোহম বুঝতে পারে সবই কিন্তু কিছুই প্রশ্ন করে নি কখনও । এরই মাঝে ওদের ক্যাম্পাস ইন্টারভিউ হয়েছে …..রুদ্র আর সোহম এল. এন. টি তে চান্স পেয়েছে…আর সৈকত গ্রুপ থেকে ছিটকে গেল ই.আই.এল এ।
এইভাবে কেটে গেল বেশ কিছু সময় । হঠাৎ একদিন বাসে মুখোমুখি সোহম আর চাঁদ ।….চাঁদ গড়িয়াহাট গিয়েছিল দীপার সাথে টিফিনের সময় ….আর ভালো লাগছিল না ক্লাস করতে….দীপাকে অটোতে তুলে , ধর্মতলার বাসে উঠেই দেখে সোহম ….ব্যস আর যায় কোথায় ? 
সোহম: কিরে আমার পাশের সিটটা তো ফাঁকা ….তাও পরেরটায় বসলি?
চাঁদ: না….গরম লাগছে …তাই জানলার ধারটা খুঁজছিলাম….বাস তো ফাঁকা !
সোহম উঠে গিয়ে পিছনে চাঁদের পাশে বসল ।
সোহম: আমায় এড়িয়ে চলছিস চাঁদ !!!
চাঁদ: (একটু ইতস্তত করে ) না, সেরকম কিছু না….তবে….
সোহম: কি তবে?
চাঁদ: তুই তো চেয়েছিলি যাতায়াতটা বন্ধ হোক ।
সোহম: হুম ….মুখে অবশ্যই বলেছিলাম কিন্তু মন থেকে চাই নি ।
চাঁদ : ও ….(চুপ করে রইল বেশ কিছুক্ষণ )
সোহমকে চুপ থাকতে দেখে চাঁদ বলল…” যা হোক , সব ঠিকঠাক আছে তো ? “
সোহম: হুম….তবে রঞ্জার সাথে একটু সমস্যা হয়েছে ।
চাঁদ: রঞ্জাদিকে নিয়ে আবার কি হল?
সোহম: তুই ওর সাথে একটু কথা বলবি?
চাঁদ: কি হয়েছেটা কি?
সোহম: রঞ্জার পুজোর ছুটিতে বাড়ি যাবার কথা…কিন্তু এর মাঝে শুনলাম ইন্দ্রদা ওর সাথে যোগাযোগ করেছিল ।
চাঁদ: তো!!
সোহম: না….আমার ধারণা ছিল ও ইন্দ্রদাকে এন্টারটেইন করবে না….কিন্তু এখন মনে হচ্ছে আমি ভুল….ও এখনও মনে মনে ওই জায়গাটায় বেশ দুর্বল ।
চাঁদ: এমন মনে হল কেন তোর? রঞ্জাদি কিছু বলেছে? কারণ আমি ওকে যতটুকু বুঝেছি তোর প্রতি ও যথেষ্ট দায়বদ্ধ….
সোহম: না আমি এ ব্যাপারে কিছুই বলি নি ….কিন্তু ও কেমন যেন ধীরে ধীরে শীতল হয়ে যাচ্ছে চাঁদ ….একটু যেন উদাসীনও ….আমি ঠিক বুঝতে পারছি না কি করব….ও যা চাইবে তাই হবে….কিন্তু ও কি চায় সেটা বলুক তো নিজের মুখে…. ।
চাঁদ: ঠিক আছে আমি কথা বলব রঞ্জাদির সাথে ।
সোহমকে চুপ করে থাকতে দেখে চাঁদ একটু সহজ হওয়ার চেষ্টা করে বলে….” ইন্টারভিউ তো হল, ট্রেনিং কোথায় পড়বে ?
সোহম: জানি না…ফার্স্ট লিস্টে নাম আছে…ওরা একশো পঁচিশ জনের মধ্যে দশ জনকে একেবারে কনফার্মেশন লেটার দেবে…দেখি কোথায় হয়…দূরে হলে মাকে নিয়ে চিন্তা !

চাঁদ বুঝতে পারছিল , যে কঠিন বর্মটা সে তৈরি করে রেখেছিল সেটা ধীরে ধীরে ভেঙে যাচ্ছে ….তার খুব ইচ্ছে করছিল তার নিজের ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞেস করুক সোহম। সোহমের আনত মুখের দিকে তাকিয়ে তার মনে হচ্ছিল ,সোহম যেন একটু ক্লান্ত ….একটু অসহায় ….চাঁদের মন চাইছিল তার মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দিতে ….একদৃষ্টে চাঁদ চেয়েছিল সোহমের দিকে…দেখছিল তার চওড়া কপাল , টিকালো নাক, চশমার ফাঁকে আনত চোখ, বলিষ্ঠ চোয়াল….পাতলা ঠোঁট ….জলে ভরে যাচ্ছিল চাঁদের চোখদুটো….জোড় করে চাঁদ মুখটা ফিরিয়ে জানলার দিকে চাইল চোখের জল লুকোতে…..কিছুটা সময় চুপচাপ….কলকাতার বুকে যানজট এড়িয়ে বাস ছুটে চলেছে….সেই চলন্ত পথের দিকে চেয়ে রইল চাঁদ….হঠাৎ সোহম বলল, “আমি যাতায়াতটা বন্ধ করতে বলেছিলাম ….তার একটাই কারণ ছিল…আমার প্রথম আকর্ষণ আমার মা….দ্বিতীয় আকর্ষণ সিগারেট …তৃতীয় আকর্ষণ রঞ্জা…আমি আর কোনো আকর্ষণে নিজেকে বাঁধতে চাইনি ।
চাঁদ: মানে….?
সোহম: মানে, ধীরে ধীরে তুইও আমার নেশা হয়ে যাচ্ছিস….রোজকার যাতায়াতে …কথায় ,লেখায়, হাসি ঠাট্টায় তুই আমাকে আকর্ষণ করছিলি….আমি রঞ্জাকে মনে করতে চাইলেও তুই আমার ভাবনায় চলে আসছিস…আমার অদ্ভুত একটা যণ্ত্রণা হচ্ছে চাঁদ …তাই তোকে ফোন করাটা কমিয়েছি…চোখের বাইরে তবু ঠিক আছে কিন্তু রোজ চোখের সামনে হলে….আমি নিজের কাছে নিজে অপরাধী হয়ে যাচ্ছি।

চাঁদ চুপ করে রইল অপরাধীর মত….কিন্তু তার মনে হতে লাগল একবার সোহমকে আঁকড়ে ধরে সে যদি বলতে পারত…তারও এখন আর কিছুই ভালো লাগেনা…জীবনের সব আনন্দ কেমন যেন হারিয়ে গেছে…সব কিছু বেরঙিন হয়ে গেছে….কিন্তু এসব কিছুই সে বলতে পারল না! শুধু মুখ নিচু করে রইল ।

সোহম : কিছু বলবি না?
চাঁদ: নাহ! আমার কিছুই বলার নেই । তোর চাওয়াটাকে সম্মান করি । তুই চেয়েছিস ফোন কমাতে…যাতায়াত বন্ধ করতে …করেছি তো ।আর এখন বলেছিস রঞ্জাদির সাথে কথা বলতে…বলব । 
সোহম: তোর নিজের কোনো চাওয়া নেই?
চাঁদ: না…
সোহম: কেন ?
চাঁদ ক্ষয়ে যাচ্ছিল ভেতরে ভেতরে ….তবুও অসম্ভব কাঠিন্য বজায় রেখে বলল…” আমি আগেও বলেছি এখনও বলছি ,আমি তোর প্রেমে পড়িনি…তাই তোর আমার ব্যাপারে কি কি হল তাই নিয়ে আমার আর কি বলার থাকতে পারে ।এসব সিলি ইমোশনের কোনো মূল্য নেই ।তুই রঞ্জাদিকে নিয়ে ছেলেখেলা করতে পারিস না ।”
সোহম: তুই নিজেকে আড়াল করতে চাইছিস কেন চাঁদ ? আজ যদি সত্যিটাকে অস্বীকার করিস তাহলে সারাজীবন পালাতে হবে জেনে রাখ!!
চাঁদ: এত সত্যি মিথ্যে বুঝিনা ওম….আমার জন্যে তোদের সম্পর্কে চিড় ধরুক আমি চাই না…এটা হতে দেব না…আমি বলেছি তো আমি রঞ্জাদির সাথে কথা বলব….আপাতত আমার আর কিছু বলার নেই ।
….চাঁদের এই আপাত কঠিন চেহারাটার পিছনে যে আবেগ …যে যন্ত্রণা লুকিয়ে ছিল তা বোধকরি সোহম বুঝে উঠতে পারল না ।
সোহম: তোকে আমার আজ বড়ো অচেনা লাগছে । আমি তো ভেবেছিলাম যদি রঞ্জা চায় ইন্দ্রদার কথা ভাবতে আমি সরে আসব….বাধা দেব না…কিন্তু তখন তুই আমার পাশে থাকবি তো চাঁদ?
চাঁদ: ইউ জাস্ট স্টপ অল দিজ ননসেন্স….আমি আমার মত..আমি কারও বিকল্প হতে চাই না । আমার অ্যাটাচমেন্টে বড় ভয় ওম…সম্পর্কের বোঝাপড়ায় যে কষ্ট , আমি তার একধাপ আগেই কষ্টটা বইতে পারি তাতে কষ্টের বোঝাটা একটু কম হয় । আর তাছাড়া আজ রঞ্জাদির পরিবর্তে আমি…কাল আমার পরিবর্তে যদি অন্য কেউ …….
সোহম চাঁদকে কথা শেষ করতে না দিয়েই অদ্ভুত একটা রাগে চাঁদকে থামিয়ে দিয়ে বলল “ব্যস অনেক বলেছিস…আর নয়…আর একটা কথা বলি, তুই ভুলেও আর রঞ্জার সাথে কথা বলবি না….ওটা অ্যাবসলিউটলি আমাদের ব্যাপার ….আমাদের মাঝে তোর তো কোনো জায়গাই নেই…..আমার ই ভুল ….রাস্তার সম্পর্ক রাস্তায় রাখাই ভাল….তাকে বেশি প্রাধান্য দেওয়া বোকামি…. ।
চাঁদ: রাস্তার সম্পর্ক ? হোয়াট ডু ইউ মিন ?
সোহম: ইয়েস আই মিন ইট । তুই ভুলেও আমাকে আর ফোন করবি না…ভুলেও আমার সামনে এসে দাঁড়াবি না…কলেজে দেখা হলে আর পাঁচটা জুনিয়ারের সাথে যতটুকু কথা হয় তোর সাথেও তাই হবে….দ্যাটস এনাফ ফর ইউ।
…..এই কথা বলে সিট ছেড়ে উঠে পড়ল ওম….বাসটা থামতেই রাসবিহারীতে নেমে পড়ল সোহম । অপমানে চাঁদের চোখ জলে ভরে গেল । তবু স্হির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল ….সোহম ভিড়ে মিশে গেল….বাস ছেড়ে দেওয়ার মুখে চাঁদ ভাবল , একবার কি নেমে যাবে সে? ছুটে গিয়ে ওমের হাতটা ধরে বলবে কিভাবে রাতের পর রাত সে নির্ঘুম কাটায়….তারপর ভাবল ভালোই হয়েছে যা হয়েছে….কি অবলীলায় সোহম বলল….রঞ্জা না হলে চাঁদ…স্বার্থপরের মত শুধু নিজের কথাই ভাবল ওম…রঞ্জাদির সাথে সব মিটে গেলে তখন ভুলেও চাঁদকে মনে পড়বে না হয়ত তার….চাঁদ যে একা সেই একাই থাকবে…..। ভীষণ অস্হির লাগছিল চাঁদের ….রাগ হচ্ছিল নিজের ওপর ।
বাড়ি এসে তার কিছুই ভালো লাগলো না ।…মা কিছু বলার আগে নিজেই বলল ….”আমার শরীরটা ভালো লাগছে না মা ..আমি একটু রেস্ট নিয়ে নি …পরে খাব …””
……ওপরে উঠে নিজের ঘরে চুপচাপ শুয়ে রইল চাঁদ…..তা প্রায় অনেক্ষণ….তারপর সন্ধ্যেবেলা কিছুটা ইতস্তত করে সোহমকে একটা ফোন করল….
বেশ কয়েকবার রিং হওয়ার পর ফোনটা ধরল সোহম….গম্ভীর ভাবে বলল…” হ্যালো ফোন করেছিস কেন ?”
চাঁদ চুপ করে রইল ।
সোহম: কি বলবি বল….
চাঁদের ইচ্ছে করছিল নিজেকে একটু ভাঙতে তবু কেন যে ভাঙতে পারল না কে জানে ! বলল…” না ….আসলে তুই হঠাৎ নেমে গিয়েছিলি তো….তাই….আর হ্যাঁ আজকের পর তোকে ফোন না করতেই চেষ্টা করব….বিশাল থেকে তো একধাপে শূন্যে আসা যায় না…একটু সময় লাগে…সেই টুকুর অপেক্ষা মাত্র …তারপর সব ঠিক হয়ে যাবে…ভালো থাকিস ।”
সোহমও বেশ কঠিন ভাবে বলল…” হ্যাঁ আমি ভালোই থাকব….কারণ ভালো থাকতে জানাটাও শেখার আছে জীবনে….তুইও ভালো থাকিস ।”
এই বলে সোহম ফোনটা কেটে দিল । চাঁদের গলার কাছে কিছু একটা উঠে আসছিল যেটা বেরোনোর পথ পাচ্ছিল না….একটা দম বন্ধ করা পরিবেশ ….চাঁদ চেষ্টা করেও নিজেকে সংবরণ করতে পারল না…..বালিশে মুখ লুকোলো ।

…………………………………….(ক্রমশঃ)

 

  
This entry is part 8 of 8 in the series চাঁদের পরিক্রমণ

 

 

পর্ব – ৮

————————————————————————————–

দেখতে দেখতে দুর্গাপুজোর চারটে দিন কেটেই গেল…। আজ দশমী। বিসর্জনের সুর বেজে উঠেছে । চারিদিকে ঢাকের আওয়াজ …। ঘটের সুতো কাটা হয়ে গেছে…।
…চাঁদ ঘর থেকে দক্ষিনের বারান্দায় এসে দাঁড়াল । মোবাইলে একের পর এক শুভ বিজয়ার এসএমএস আসছে । চাঁদ দেখছে বটে কিন্তু কোনও উৎসাহ নেই পাল্টা উত্তর দেওয়ার । এমন সময় ফোনটা বেজে উঠল…স্ক্রীনে দেখা যাচ্ছে “ সৈকত কলিং”…ফোনটা বেজেই যাচ্ছিল । আর চাঁদ অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল ফোনের দিকে । অবশেষে ফোনটা থেমে গেল । তার একটু পরেই একটা এস.এম.এস।
……… ” শুভ বিজয়া…রঞ্জা আর ইন্দ্রদা অনেক বছর বাদে টেক্সাস থেকে কলকাতায় আসছে কালিপুজোয় । আমাদের সাথে দেখা করতে চায় …দীপাবলীর সন্ধ্যেয় আমার বাড়ি সবার নিমণ্ত্রন রইল …আমরা তোর অপেক্ষা করব… তুই আসিস কিন্তু …প্লিজ ।”
চাঁদ মেসেজটা দেখল…তারপর ফোনটা বন্ধ করে রাখল …। কোনো কিছুর বহমানতা চাঁদকে তার স্থবির অবস্থাটা কাটাতে যেমন সাহায্য করে তেমনই ডুবে যেতেও করে । দক্ষিনের এই বারান্দাটা তার খুব প্রিয় ।এখানে বসে থাকলে রাস্তার ধারের দৃশ্যপট অনেক কিছু দেখা যায় । চারপাশের আলোর রোশনাই …ঢাকের আওয়াজ ……মানুষের যাতায়াত…কোলাহল , এসব কিছুর মধ্যে দিয়েই সে হারিয়ে গেল অতীতের সেই অন্ধকারে ।
……সোহমের সাথে শেষবার ফোনে কথা হওয়ার পর চাঁদ আর ফোন করেনি । তার খুব ইচ্ছা করেছে……বেশ কয়েকবার ফোনের কাছে গেছে , রিসিভার তুলেছে , তবুও নিয়ন্ত্রন করেছে নিজেকে । এর মাঝে কলেজে আর দেখাও হয়নি সোহমের সাথে। রঞ্জার সাথেও ইন্দ্রদার বিষয়ে কোনও কথা হয় নি। তিন চারদিন পর মহালয়া । কলেজে ছুটি পড়ে গেল । রঞ্জার তো বাড়ি যাবার কথাই ছিল। ছুটি পড়ার শেষ দিনটায় সবার বেশ আনন্দ…উন্মাদনা…… পুজোয় ঘুরতে যাওয়ার… ঠাকুর দেখার…কিন্তু চাঁদ এড়িয়ে গেল…। সৈকত বলল “কি ব্যাপার বলতো…। সোহম বেপাত্তা…তুই এড়িয়ে যাচ্ছিস …রঞ্জা তো বাড়ি যাবে…কি হয়েছে তোদের?” 
পুজো আসার থেকেও পুজো আসছে আসছেই ভালো । অন্যান্য বছর পুজোয় কত মজা হয় …বেড়ানো হয়…এবছর পুজোতে চাঁদের এসব কিছুই হল না…এমন কি নতুন জামাগুলো পযর্ন্ত আলমারী বন্দী হয়েই রইল…। এমনি করেই দুদিন কেটে গেল…। অবশেষে অষ্টমীর দিন সকালে চাঁদ রওনা হল কল্যানীতে তার কাকার বাড়ির উদ্দেশ্যে । খুড়তুতো বোন অরুনিমার সাথে তার বেশ ভাব । অষ্টমী আর নবমী বেশ গল্প গাছায় কেটে গেল…কাকাদের পাড়ার এ্যসোসিয়েশানের পুজো । বাড়ির মত…খাওয়া দাওয়া, নাচগান হইহট্টগোল…। এর মাঝে মাঝে চাঁদের মনটা এক আধবার যে উদাস হয়ে যায় নি তা নয়…তবুও একাকিত্বটা অতটা ভারি ঠেকে নি। কাকার সাথে চাঁদের সম্পর্কটা বেশ বন্ধুর মত। তিনি বললেন “বাব্বা চাঁদ সেই আহ্লাদী মেয়েটা কত বড়ো হয়ে গেছে…কিরে কলেজে বিশেষ কেউ বন্ধু হয়েছে নাকি?” চাঁদ হেসে এড়িয়ে যায় …বলে “কাকাই যদি হয় তুমি সবার আগে জানবে……কথা দিলাম ।” কিন্তু কাকাই লক্ষ্য করেছেন চাঁদের সেই উচ্ছ্বলতাটা আর নেই……এবার কেমন যেন একটু নিস্পৃহ লাগছে…। সেই ছটফটে মেয়েটা কেমন যেন মোহময়ী বিষাদঘন …। তবুও বড়োদের চোখে তো সেই আগের মত ছোট্টোটিই আছে সে। 
……………পুজোর দিনগুলো কেটেই গেল …দশমীর দিন বেলার দিকে স্নান করে প্যান্ডেলে বোনের সাথে…। পুজো শেষ…বিসর্জনের সানাই বেজে গেছে …ঢাকে বোল উঠেছে … “ঠাকুর থাকবে কতক্ষন…ঠাকুর যাবে বিসর্জন”……দুপুরেই বিসর্জনে যাবে সবাই ।
কাকাই জোর করলেন “ চল , বিসর্জন দেখতে যাবি ।”
চাঁদ বলল…..“না কাকাই আমার মন কেমন করে । ওই সুন্দর মুখটা কেমন 
জলের মধ্যে ডুবে যায়…আমার বড় ফাঁকা লাগে…একা লাগে…
থাক না কাকাই।”
কাকাইঃ আরে বিসর্জন না দেখলে পুজো সম্পূণর্তা আসে না । 
চাঁদঃ আমার সম্পূণর্তা ভালো লাগে না কাকাই…। কেমন যেন সব শেষ হয়ে 
যায় । থাক না কাকাই ওই সুশ্রী মুখের অসম্পূর্ণ স্মৃতিটুকুই থাক ।

কাকাই ছাড়বার পাত্র নন । অগত্যা যেতেই হল …উপায় কি?
যদিও খুব মজাই হয়েছিল বিসর্জনের যাত্রাপথটা । নাচগান বাজনা হৈহৈ … বিসর্জন সেরে ফিরতেও বেশ রাত্রি হয়ে গেল । বাড়ি এসে সবাই বেশ বিধ্বস্ত । তার ওপর পাড়ার সবাই সিঁদূর মাখিয়ে দিয়েছে । কাকিমা বললেন “ কি ভালো লাগল চাঁদ ? বাব্বা, মেয়ের মুখ দেখ একদম সিন্দুরে লাল হয়ে আছে । নাও…অনেক রাত হল যা তোরা গা হাত পা ধুয়ে …খেয়ে নে ”। আরক্ত মুখে হাসল চন্দ্রিমা…। এত হৈহৈ-এর মধ্যে কাকিমা কিন্তু বলতে ভুলে গেল যে সৈকত ফোন করেছিল । খাওয়া দাওয়া শেষ… চাঁদ মনে মনে ভাবল সোহমকে কি একটা ফোন করলে হত…বিজয়ার শুভেচ্ছা জানালে কি , ও আর রাগ করে থাকতে পারবে? ঝগড়াটা মিটিয়ে নেওয়াই ভাল…সেদিন চাঁদও তো কম কিছু বলে নি…। সোহমকে ফোনটা করেই ফেলল চাঁদ….. কিন্তু রিং হয়ে গেল …কেউ ধরল না। অরুণিমা এসে বলল “ দিদিভাই চল ঘুম পাচ্ছে খুব…… শুয়ে পড়ি”… চাঁদ একটু ইতস্তত করে চলে গেল শুতে। রাত্রে শুয়ে শুয়ে চাঁদের খুব মন খারাপ করতে লাগল সোহমের জন্য…ভাবল এত রাগ যে ফোন ধরল না । তবে এই নাম্বারটা তো ওর অজানা …ও বুঝবে কি করে……তাহলেও একটা রিং ব্যাক তো করে দেখতেই পারত…এমন কঠিন ইগো মানুষের কেন হয় কে জানে…!!কেন যে জীবনের অঙ্ক গুলো সহজে মেলে না তাও জানি না…ফোন টা যদি ধরত কার কিই বা এসে যেত । সে মনে মনে ঠিক করল এবার ক্লাশ শুরু হলে সে আবার সহজ করে নেবে বন্ধুত্বটা। এই কদিনে সে খুব বুঝেছে সোহমকে ছেড়ে থাকা কি কষ্টের…যদিও ও সোহমের সাথে থেকেও কষ্ট পাবে …কারণ সোহম কোনোদিন তার হবে না…তবুও কথার নৈকট্য তো থাকবে…। একটা এমন অস্তিত্ব যাকে ছোঁয়া না গেলেও সাড়া তো পাওয়া যাবে…। সব পাওয়ার নাম ভালোবাসা নয়…। কিছু ছাড়ার নামও ভালোবাসা…এইসব ভাবতে ভাবতে কখন যে চাঁদ ঘুমিয়ে পড়েছে সে নিজেও জানে না…। সকালে অরুনিমার ডাকে ঘুম ভাঙলো চাঁদের…..”দিদিভাই ওঠ …অনেক বেলা হয়ে গেল যে”…..কাকিমা এসে বললেন …”খুব ক্লান্ত ছিলি তাই আর ডাকি নি… এবার ওঠ দশটা বাজতে যায়…কিছু খা…বাবা মাকে ফোন করে বিজয়ার প্রনাম জানা……আর হ্যাঁ তোর বন্ধু সৈকত কাল ফোন করেছিল …বলতে ভুলে গেছি । তোকে খুঁজছিল…একবার খোঁজ নিস।” চাঁদ একটু চমকে উঠল……এমন কি দরকার যে…এখানে ফোন করেছিল…ভাবল , ঠিক আছে একটু পরে একবার রিং ব্যাক করবে।
ফ্রেশ হয়ে চায়ের টেবিলে এসে বসল চাঁদ ……কাকাই খবরের কাগজ পড়ছে । চাঁদ সবে গরম চায়ে চুমুক দিতে যাবে ফোনটা বেজে উঠল…। চাঁদ ফোন ধরে বলল “হ্যালো…
চন্দ্রিমাকে একটু ডেকে দেবেন
চন্দ্রিমাঃ বলছি …কে বলছেন?
সৈকতঃ আমি …আমি সৈকত । আমি কালও ফোন করেছিলাম, তোর বাড়ি থেকে নাম্বার 
নিয়ে…বিশেষ দরকারে ।
চন্দ্রিমাঃ হ্যাঁ কাকিমা বলতে ভুলে গেছিল…। আজ শুনলাম সকালে….বল…..ওহো…
শুভ বিজয়া…। 
সৈকতঃ একটু চুপ করে থেকে সৈকত বলল “তুই কবে ফিরবি?”
চন্দ্রিমাঃ কেন? লক্ষ্মীপুজোর পর। 
সৈকতঃ আজ ফিরে আয় চাঁদ। 
সৈকতের থমথমে কন্ঠস্বরে চাঁদ বিস্মিত……
চন্দ্রিমাঃ কি হয়েছে সৈকত? সব ঠিক আছে তো ?
সৈকতঃ কি বলব বুঝতে পারছি না।
চন্দ্রিমাঃ কেন কি হয়েছে?
সৈকত নিরুত্তর……
চন্দ্রিমাঃ বল না প্লিজ …রঞ্জাদি ঠিক আছে তো ? রুদ্র দীপা সোহম? 
সৈকতঃ আজকের কাগজের পাঁচের পাতাটা পড়ে দেখ চন্দ্রিমা ।
আমি পরে ফোন করছি …একটু পর…
রুদ্ধশ্বাসে চাঁদ বলল “একমিনিট ধর”……এই বলে কাকাই এর কাছ থেকে কাগজটা নিয়ে ঘাঁটতে লাগলো কিন্তু তাড়াতাড়িতে খুঁজে পেল না……তারপর বলল “না না …… আমি পড়তে পারছি না তুই বল প্লিজ!”
সৈকতঃ তুই শুনতে পারবি না…বাড়ি আয় তারপর বলব।
ইতিমধ্যে কাকাই ওদের কথা শুনে পিছনে এসে দাঁড়িয়েছেন।
চাঁদ উত্তেজিত হয়ে জিগ্যেস করল “কি আছে কাগজের পাঁচের পাতায় বল না সৈকত । আমি সব শুনতে পারব।”
সৈকতঃ একটা অ্যাক্সিডেন্ট……চন্দ্রিমা । 
চন্দ্রিমাঃ কার কি হয়েছে?
সৈকতঃ সোহমের। 
চন্দ্রিমাঃ সোহমের? মানে ? কি বলছিস তুই ? …… বিষ্ময়ে হতবাক চন্দ্রিমা …… ফুঁপিয়ে উঠল বাচ্চা মেয়েদের মত।
………সৈকত একটু দম নিয়ে স্থির গলায় বলে চলল…
“কাল ওদের পাড়ায় ঠাকুর ভাসানে গিয়েছিল …। বিসর্জনের সময় ধাক্কধাক্কিতে জলে পড়ে যায় ও ……জোয়ারের সময় ….গঙ্গার জেটীর নিচে চলে গিয়েছিল বোধহয় পা স্লিপ করে……লোহার স্ট্রাকচার মাথায় লেগে ব্রেন হ্যামারেজ…। গোটা রাত তন্ন তন্ন করে খোঁজা হয়েছে …। আজ ভোরে খিদিরপুর ডকে ওকে পাওয়া গেছে …। সোহম আর নেই…… চন্দ্রিমা । 
সৈকতের গলাটা ধরে আসছিল…তবু বলল “হ্যালো চাঁদ শুনছিস ?”
চাঁদ নিরুত্তর…। কি বলবে …।ও যে গতকালই রাতে ওকে ফোন করেছিল। ফোন টা বেজে গেল …একথা বলতে চেয়েও বলতে পারছিল না……সব কথা তার শেষ হয়ে গেছে …। শুধু একটা দম বন্ধ করা কষ্ট তাকে ক্রমশ গ্রাস করে ফেলছে…।
সৈকত এবার বলল “ওকে বিকেল পযর্ন্ত রাখা হবে ,তুই চলে আয় চাঁদ……সৌনক দা এসে পৌঁছবে দুপুরে……ওর শরীরটা জলে……সৈকত আর বলতে পারল না…
চাঁদ এতক্ষণ পর স্থির গলায় বলে উঠল……
‘না , আমি যাব না সৈকত । আমি দেখতে চাই না ওকে আর ওইভাবে…আর কি দেখার আছে ……ওর ওই হাসি মুখটাই আমার মনে থাক আজীবন……আমি ওকে কথা দিয়েছিলাম আর কোনোদিন আমি ওর সামনে নিজে থেকে গিয়ে দাঁড়াব না……ইনভল্ভমেন্ট নাই বা থাকলো কন্টিনিউইটি থাক……আমি ওকে দেখতে যাব না সৈকত…… থাক ওর চ্যাপ্টার অসম্পূণই থাক…। ” চাঁদ কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল……পাশে কাকাই দাঁড়িয়েছিলেন …ধরে নিলেন ওকে…।ওর হাত থেকে ফোন নিয়ে সৈকত কে কিছু বললেন ……সেটা শোনার মত অবস্থায় চাঁদ ছিল না……।

কাকাই বাড়ি পৌঁছে দিলেন চাঁদকে সেইদিনই । ট্রেনে গোটা রাস্তা সে নিথর হয়ে বসে রইল……একটু যেন অসংলগ্ন । বাড়ি এসে মা সব শুনলো…..মাথায় হাত রাখতেই চাঁদ কেঁদে ফেলল …বলল “মা যাব একবার ……ওকে দেখে আসব কাকাইকে নিয়ে …… মা বললো ” থাক না চাঁদ …যা বলেছিস ঠিকই তো বলেছিস……নাই বা দেখলি শেষ দেখা……আর দেখার কিই বা আছে …বরং কাকাই যাক একবার…। ভাবত রঞ্জার কি অবস্থা , ওর মায়ের কি অবস্থা ? ” সত্যিই তো!!! সেতো এসবের মধ্যে ভুলেই গেছিল রঞ্জার কথা……তখনই সে নিজের ঘরে গিয়ে রঞ্জাকে ফোন করল ত্রিপুরার বাড়ীতে । কিন্তু কথা হল না রঞ্জার সাথে…ওর ভাই রাতুল জানাল দিদি অসুস্থ হয়ে পড়েছে …পরে কথা বলবে..সারাটা সন্ধ্যে চাঁদ বাধ্য মেয়ের মত সবার চোখের আড়ালে চুপ করে বসে রইল বারান্দায় …অন্ধকারে । রাত্রি তখন দশটা বাজে ……মা এসে বলল সৈকত ফোন করেছে ……চাঁদ যন্ত্রচালিতের মত ঘরে গিয়ে ফোন ধরল……
চন্দ্রিমাঃ হ্যালো 
সৈকতঃ সব শেষ চন্দ্রিমা……আমি এই বাড়ী ফিরলাম । 
সৈকত আর কথা বলতে পারছিল না। তবু বলল “ কিছু হয়েছিল কি চাঁদ তোর সাথে…তুই কেন বললি ও তোকে ওর সামনে যেতে বারন করেছে……আমি কিছুটা জানতাম চাঁদ……ওর দ্বন্দ্ব , ওর ভাললাগা , খারাপলাগা…। কিন্তু কিছুদিন খুব চুপচাপ থাকছিল……। তোর সাথে শেষ কবে কথা হয়েছিল ? 
চন্দ্রিমাঃ আমি পরে কথা বলব সৈকত…। আমি ভীষণ ক্লান্ত …. ভীষণ কনফিউসডও ,ওর 
মত এত ভালো সুইমার সাঁতার কিকরে ভুলে গেল ভেবে পারছিনা ! রাখছি।

এই কদিন রোজ চাঁদ তার নিত্য দিনের কাজ সেরে গেছে রুটীন মাফিক…কাউকে বুঝতেই দেইনি তার অবস্থাটা কোন জায়গায় ……রাতে শুতে যায়…ঘুম আসে না…। চেয়ে থাকে নিমগাছের ফাঁক দিয়ে একফালি চাঁদের দিকে…রাত জাগা পাখির আওয়াজে চমকে ওঠে…..ফোনের কাছে যায় …।ডায়াল করে রেখে দেয়..। কিন্তু না কোনো উত্তর আসে না ওপার থেকে……রাত্রি বেলায় জানলার পাশে বসে থাকে যদি অশরীরী কিছু অনুভব করে……কিন্তু না কোনো ঠিকানা নেই আর সোহমকে খুঁজে পাবার।
এক সপ্তাহ বাদে ফোনটা রঞ্জাই করে…। চাঁদ ফোন ধরে। রঞ্জা খুব কান্নাকাটি করে । চাঁদকে জিগ্যেস করে “ তুই দেখেছিলি ওকে শেষবারের মত?”
চন্দ্রিমাঃ না রঞ্জাদি।
রঞ্জাঃ কেন? তোর ইচ্ছে করে নি? 
চন্দ্রিমাঃ হুম করেছিল ……কিন্তু কি দেখতে যাব বল?
রঞ্জাঃ আচ্ছা কেন এমন হল বলতো ?
চন্দ্রিমাঃ সেটাই ত ভাবছি রঞ্জা দি!!
রঞ্জাঃ জানিস এর মাঝে আমার সাথে ওর ,ইন্দ্রর ফোন করা নিয়ে একটু সমস্যা
হয়েছিল । ও ভীষন আপসেট ছিল , বলেছিল আমি চাইলে ইন্দ্রর 
সাথে সম্পর্কটা চালিয়ে যেতে পারি…। ওর কোনো আপত্তি নেই।
চন্দ্রিমাঃ তুমি কি বলেছিলে রঞ্জা দি?
রঞ্জাঃ আমি বলেছিলাম একটু ভেবে ওকে জানাব…। পুজোর পর বলব….ঘুরে
আসি বাড়ি থেকে।
চন্দ্রিমাঃ তুমি কি বলতে ওকে ?
রঞ্জাঃ আমি তো ইন্দ্রকে না-ই করে দিতে চেয়েছিলাম……যদিও বাড়ি থেকে 
(চুপ করে গেল রঞ্জা)
আর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চাঁদ বলল “ তুমি কি ওকে কিছু জানিয়েছিলে”?
রঞ্জাঃ দশমীর সকালে আমি ফোন করেছিলাম ……একথা সেকথা……অনেক
কিছু বললাম …। ও চুপ করে শুনছিল…। যেই ইন্দ্র-এর ব্যাপারে কথা
বলতে গেলাম ……আমায় বলল যে ওর তাড়া নেই ……কলকাতাই 
গেলেই এ ব্যাপারে কথা হবে……শুনতে চায়নি কথা।
রঞ্জা কাঁদতে লাগল…… কেন এমন হল বলতো?
চাঁদও কাঁদছিল নিঃশব্দে……তবু গলায় যথেষ্ট কাঠিন্য এনে বলল “ রঞ্জাদি তুমি আর অন্য কথা ভেব না……ইন্দ্রদাকে না কর না……তোমার সামনে একটা মস্ত জীবন পড়ে আছে ……আমি বলছি , সময় সব ভুলিয়ে দেবে……এভাবে নিজেকে কষ্ট দিও না……আমরা সবাই আছি তোমার সাথে।
রঞ্জা বলল……” তুই কি দিয়ে গড়া চাঁদ ……এত কিছুর পরও নিজেকে একটু ভাঙতে পারছিস না ……তোর জন্য কে থাকবে ভেবেছিস?
পুরো কান্নাটা গিলে ফেলে চাঁদ বলল “আমি ঠিক আছি রঞ্জা দি……তুমিও ভাল থেকো।” 
কলেজ খুলল পুজোর ছুটির পর । সেই বাসস্টপ…সেই বাস…সেই জানলার ধারের সিট…। শুধু পাশে অন্য মানুষ……প্রকারান্তরে পাশটা আজ ফাঁকাই… আজ আর কোনো তাড়া নেই……কোনো ঘড়ি দেখা নেই……কোনো অপেক্ষাও নেই…। সেই রাস্তা……সেই দ্বিতীয় হুগলী সেতু…সেই কন্ডাক্টর …কিন্তু ভাড়া কাটা নিয়ে ঝগড়া নেই……বিড়লা স্টপেজে নেমে পরের বাস……নেই কোন ছোটাছুটি… তার সাথে অনর্গল কথা বলার কেউ নেই আজ……বড়ো দীর্ঘ পথ। তার চেয়েও দীর্ঘ সময় । হয়ত কোন অপেক্ষাই নেই …তবু যেন কিসের এক দায়……কোনো কমিটমেন্ট ছিল না কোনোদিনই , তবু যেন চাঁদ একা থাকার জন্য , ওমের স্মৃতির মুখাপেক্ষী হয়েই রয়ে গেল। এমনি করেই কলেজের ক্যান্টিন থেকে লেকের পাশে……জানলার বাইরে থেকে ঘরের ভিতরে… চোখ খোলা থেকে রাতে চোখ বন্ধ হওয়া অবধি সর্বত্রই শুধু ওম আর ওম। ও বেঁচে থাকলে হয়ত চাঁদ সব মানিয়ে নিত কিন্তু ওমের মৃত্যুতে আজও চাঁদ বেঁচে মরে রইল……এত বছর হয়ে গেছে……সেদিনের সেই উনিশের চাঁদ আজ তিরিশ পার করে দিয়েছে তবুও আজ প্রতিটি দন্ডপল অনুপল সে ওমেরই দোসর হয়ে রয়েছে। জীবনে কত মুহুর্ত এসেছে গেছে , সুখ দুঃখ হাসি কান্নার মধ্যেও সে তার ওমের সখ্যতাই বয়ে বেড়াচ্ছে…। সেদিনের পর থেকে জীবন চলেছে তার আপন ছন্দে…আর সে সব কিছু পেরিয়ে এসেছে তবু কোন সময়ের জন্য সে ভুলে থাকতে পারে নি তার অতীতকে……সোহমকে …ওমকে…… কন্টিনিউইটি আজও আছে চাঁদের বিষন্নতার মধ্যে…তার ব্যবহারিক জীবনের মধ্যে… তার একাকিত্বের মধ্যে……শূন্যতার মধ্যে ,আজও সোহম তার একমাত্র অবলম্বন হয়েই বেঁচে আছে । সেদিনের সেই প্রতিমা নিরঞ্জনের সাথে সাথেই চাঁদের সমস্ত স্নিগ্ধতার মাধুরীও বিসর্জন হয়ে গিয়েছিল ……তবুও আজ সে তার কলঙ্কের বোঝা একাই বয়ে চলেছে……পৃথিবী ঘুরছে ঘুরবে থিওরি অফ রিলেটিভিটি , জীবন চলছে চলবে……সেদিনও চাঁদ একা ছিল… আজও চাঁদ একা……সেদিনও ওম ছিল তার নির্দিষ্ট দুরত্বে কিন্তু…… হয়ত জোয়ার ভাঁটার অমোঘ কোনো টানে ওম এসেছিল তার কাছে …। সে তো মুহুর্তেরই কোলাজ মাত্র……।
বারান্দার আলোটা জ্বেলে দিল চাঁদের বাবা……বাবা আজও তার বন্ধু……মা সঙ্গ ছেড়ে গেছেন অনেকদিন…বাবা বললেন “একা একা কি করছিস অন্ধকারে ? …ভেতরে চল ……কাকাই ফোন করেছে , বিজয়ার শুভেচ্ছা জানাতে……চাঁদ চোখের জল মুছে বলল “তুমি ভেতরে যাও বাবা …আমি আসছি।”

……………………………………………………………………………………………………
( শেষ )

 

  
PAGE TOP
HTML Snippets Powered By : XYZScripts.com
Copy Protected by Chetans WP-Copyprotect.
Skip to toolbar