This entry is part 1 of 8 in the series কিছু সংলাপ কিছু প্রলাপ

 

কিছু সংলাপ কিছু প্রলাপ

 মুখবন্ধঃ

কোলকাতার বুকে রোজ রোজ জন্ম নেয় কত স্বপ্ন , কত রং , কত কথা । দিনে রাতে চুরি যায় কত শত মন , বয়ে যায় কত লাজুক সময়, গড়ে ওঠে কত গোপন ভালোবাসা । সেই ভালোবাসার কিছু পরিণতি পায় আবার কিছু পায় না……তাই বলে তো ভালবাসাবাসিটা আর মিথ্যে হয়ে যায় না…। সেইসব ভালোবাসারই কিছু নাটকীয় সংলাপ আর প্রলাপে জন্ম হয় একটি গল্প কবিতার। যার মূল ভাবনা…..

“পায়ে পায়ে দু এক কদম
সঙ্গে চলি তোর
মনে মনে আসঙ্গ
করব জীবন ভর।”

মহুল আর রাংতার মাঝে ঠিক কতটা প্রেম ছিল জানা নেই…তবে সমান দূরত্বের একটা তরঙ্গ দৈর্ঘ্য ছিল।…..মহুল যদি হয় বুনো ওল , রাংতা তবে বাঘা তেঁতুল।

 

পর্ব – ১.


 রাংতা আর মহুল অবসর যাপনে এসেছে ভিক্টরিয়ায়…সেখানে কত শত জুটি ঘুরে বেড়াচ্ছে হাত ধরা ধরি করে…ককটেল কালচারে ভরে গেছে এখনকার যুব সমাজ…আজ নাকি প্রমিস ডে…।

-মহুল, আজ কথা দেওয়ার দিন।
-কথা রাখা হয় না বলেই এমন দিন ।
-কে বলেছে?
-আমি বলছি ,মহুল বৈরাগী । প্রেম নক্ষত্র জাত , হাসি রাশি , তুঙ্গ লগ্ন, গোলমেলে গণ।
-আমি ঠাট্টা করছি না।
-ঠাট্টা নয় রাংতা! নারী স্বাধীনতা এখনো আসেনি বলেই, নারী দিবস পালিত হয় !
-ঠিক ,তাই বলে কথা দিয়ে কথা না রাখা হলে সে কথার মূল্য কোথায় ?
-তাই তো ,কথা শুধু আজকের জন্যই , কাল যে তা মূল্যহীন।
-আচ্ছা….আজকে তাহলে সময় কাটানোর কথা আমিও ফিরিয়ে নেব।
-কথা ফিরিয়ে নিলে আমি নিশ্চিত এজন্মেই তুমি ডাকিনী বা যোগিনী হবে কন্যা।
-আমার ভাল্লাগছে না মহুল।
-আমার কথায় রাগ হল ?
-তুই তো আমায় কোনো কথাই দিস নি ,যদি আমায় ভুলে যাস?
-কে বলতে পারে রাংতা, তুইই হয়ত আমায় ভুলতে চাইলি কোনোদিন….
-হতেই পারে না।…আমি তোর মত ভেসে বেড়াই না।
আমি কি বানভাসি?
-হ্যাঁ তো, জল দেখেছিস কি ডুবেছিস।
-ঠিক করে বল সব্বনাশী, ডুবেছি না ভেসেছি?
-কি বললি, আমি তোর কি সর্বনাশ করেছি শুনি ???
-আচ্ছা বাবা …ভুল হয়েছে ! কথা দিলাম রাংতা, থাকব , যতদিন তুই থাকতে দিবি।
-না না মহুল , কথা দিস না।….কথা দিলেই যদি কথা হারিয়ে যায়॥

………………………………………………………………..………………………….……ক্রমশ

 


 

 

  
This entry is part 2 of 8 in the series কিছু সংলাপ কিছু প্রলাপ

 

 

 পর্ব – ২

___________________________________________________________________________________________________________________

তার কদিন পরের কথা। রাংতা গান শুনছে… ‘তোমায় নতুন করে পাব বলে হারাই ক্ষণেক্ষণে’ ……আজ ভ্যালেন্টাইনস ডে…সেইভাবে দেখতে গেলে রাংতার ভ্যালেন্টাইন যে কে বলা মুশকিল…… যদিও রাংতা কিন্তু এতটুকুও কনফিউসড নয় …হঠাৎ রাংতার মুঠোফোন সরব হয়ে উঠলো…

-হ্যালো
-বল
-কখন আসছিস?
-কোথায়?
-রাংতা, আর নিতে পারছিনা।
-বুঝলাম না।
-ভুলে গেছিস ,আজ যে ভালোবাসা উদযাপনের দিন?
-কেন তুই তো বললি, সচেতনাতা বাড়াতেই নাকি এই বিশেষ দিনগুলোর বিজ্ঞাপন হয়!
-হুম তাই তো।আর আমি তো বেশ বুঝছি, ভালোবাসা বাসি ব্যাপারটায় তুই একদম সচেতন নস।
-নই বুঝি?তা কি করতে হবে শুনি? ভালোবাসা জাহির করতে হবে?
-না …তা কেন? ভালোবাসা ভালোবাসে ভালোবাসাকে। -প্লিজ আয় না ঝিলের ধারে? আজ একটু পড়তে ইচ্ছা করছে?
-পড়তে? কি ? কবিতা ?
-না তোকে?
-আমি কি কবিতা ?
-হ্যাঁ তো , যত পড়ি ডুবতে থাকি, সব্বনাশী।
-মহুল!!! আজকে তোকে ঝিলের জলে ডুবিয়েই ছাড়ব! দাঁড়া !
-আরে বোকা মেয়ে …ডোবাতে গেলে, আসতে হবে তো রাংতা…মুঠোফোনে কি সব হয় ??
-ডুবেই যদি যাস ‘তাহলে আমি নদী।
-বেশ, আমি তবে নৌকা হব… তোর জলে ভাসব।
-না , তুই নদীর পাড়…আছড়ে পড়া নদীর জল সামলাবি।
-যদি না পারি?
-তাহলে তুই আকাশ হয়ে থাক…দিগন্তরেখায় মিলবো তোর সাথে।
-না না ,আমি তবে আকাশের মেঘ হব আর দুচোখ ভরে দেখবো তোর বয়ে চলা।
-মেঘ?….বর্ষার ?
-হ্যাঁ …ভরা শাওনে আকাশের কোল খালি করে তোর বুকে ঝরে পড়ব।
-তুই আমায় এতটা বুঝিস মহুল?
-হুম বুঝি তো, তাহলে বাসবি তো ভালো ,রাংতা? আসবি তো আজ বা কাল কিংবা রোজ রোজ?
-আমি অকবি মহুল…অত কবিতা বুঝিনা। ভাবছি যদি না পারি যেতে আজ বা কাল কিংবা আর কোনোদিনই…।

 

…………………………………………………………………………………………………………….ক্রমশ
 

  
This entry is part 3 of 8 in the series কিছু সংলাপ কিছু প্রলাপ

 

 

 

পর্ব-৩ ।


 

সরস্বতী পুজোর রেশ তখনও কাটে নি……রাংতা আর মহুল বেড়িয়েছে …মাঝপথে টিপ টিপ বৃষ্টি…মাথা বাঁচাতে দুজনেই বিড়লা পিচে গাছের নিচে…… এমন এক পরিবেশে তাদের বন্ধুত্বের মাঝে শোনা যায় অভিযোগের সুর………

 

-কি ব্যাপার বলতো মহুল?
-কেন কি হয়েছে?
-কোথায় হারিয়ে গেছিস বৃষ্টির টুপটাপ শব্দে? দেখ মহুল , গাছের পাতার ডগায় জলের ফোঁটাগুলো কেমন চিকচিক করছে!
-আর ওই দেখ ভিজে রাস্তায় গাড়ির হেড লাইটের আলো পড়ে কেমন ঠিকরে পড়ছে চারপাশে…
-কিন্তু আরও কি যেন দেখছিস তুই? কি এত দেখছিস?
দেখছি তো। দেখার কি শেষ আছে রাংতা?
-এবার কি দেখলি বল না?
-শ’য়ে শ’য়ে প্রজাপতি…রং বেরঙের।
-প্রজাপতি? কোথায়?
-ওইতো দেখ না জোড়ায় জোড়ায় ,ঘুরে বেড়াচ্ছে এই বৃষ্টিতেও।
-জোড়া প্রজাপতি? তার চেয়ে বল না ,শুধুই রানী মৌমাছি দেখছিস?
-যাঃ আমি কি খালি মেয়েই দেখি নাকি?
-বাহ…এইতো সরস্বতী পুজোর দিন বললি,তুই নাকি প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে লাল নীল হলুদ শাড়িতে ঠাকুরের চিন্ময়ী রূপ দেখে বেড়াচ্ছিলি!!!
-আমি অন্য মেয়েদের দিকে তাকালে তোর বুঝি হিংসে হয়
-হ্যাঁ হয় তো…আমি কেমন সেজেছি তাকিয়ে দেখিস কখনও?
-হুম দেখি তো।
-কই আমায় কোনোদিন বলেছিস দেখতে কেমন লাগে ?
-তোর ওই মনভোলানো নকলরূপে আমার তোকে অচেনা লাগে রাংতা।
-অচেনা? মানেটা কি?
-মানে……রাংতার চাকচিক্য তার কথায়, চোখে, তার মনের রঙে। শরীরের ঐ মেকী রঙ আমার মনে ধরে না।
-এসব তোর শব্দের কারসাজী…কথার নেশা।
-মহুলের কথায় নেশা তো হবেই?
-জানি তো, আর তোর ঐ মিষ্টি কথার নেশাতেই যে আমি মরেছি।
-আহ থাক না রাংতা, ভালবাসার মধ্যে আবার মৃত্যুর কথা কেন?
-“মরন রে তুঁহু মম শ্যাম সমান”……এ মরন যে সুখের , মহুল।
-এমন করে আমায় আঁকড়ে ধরিস না রাংতা…আমার বড়ো ভয় করে, দমবন্ধ হয়ে আসে।
-আচ্ছা যাঃ, তোকে ছেড়ে দিলাম…তুই যে বোনের পাখি, তোকে ধরে রাখা যায় কি?
-বাহ রে, আমি কি তাই বললাম? নাই বা রাখলি খাঁচায়…নাই বা মানালি পোষ! তবু দেখবি , পাখি ঠিক থাকবে তোর কাছে। শুধু তার উড়ানে বাধ সাধিস না।
-বেশ, বুঝলাম।
-কি বুঝলি শুনি?
-এই যে ,তুই না থেকেও আছিস , আবার থেকেও নেই।
-বেশ বলেছিস… কি করব…আমি তো এরকম ই।
-কেন তুই এরকম মহুল? আমি তো এরকম নই, তাই আমার মাঝে মাঝে কষ্ট হয়…ভারি একলা লাগে ।
-জানি তো ,তুই যে একেবারে অন্যরকম রাংতা। আর তাই তো, এবারে আমিও ….
-‘আমিও’ কি বল?
-কিছু না। গল্প হলেও সত্যি।

………………………………………………………………………………………………………………………ক্রমশ

  
This entry is part 4 of 8 in the series কিছু সংলাপ কিছু প্রলাপ

 

 

পর্ব – ৪


 

মহুলের মাঝে আছে এক বাউলিয়া সুর ……দুরন্ত বোহেমিয়ানিজম……সে বাঁধা পড়তে চায় না কোনোরকম আকুতিতে…তাই তো সে মাঝে মাঝে হয়ে ওঠে অধরা … কি এক অদৃশ্য বেড়াজাল যেন মহুলকে রাংতার থেকে দূরে সরিয়ে রাখে……যদিও সে জানে ,তার একটি মাত্র সম্মতিতে রাংতাকে সে জয় করে নিতে পারে।

 

-তোর পায়ে কি ঘোড়ার ক্ষুর লাগানো আছে ,যে ছুটে বেড়াস? জীবনে কি কি স্বপ্ন আছে মহুল…..যা তোকে এমন করে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়!
-আমি বাউন্ডুলে , ছন্নছাড়া ….আমার আবার স্বপ্ন কি?
-কেন? স্বপ্ন দেখা কি বৈরাগ্যের অন্তরায়?
-আমার স্বপ্ন দেখতে ভয় করে, রাংতা।…স্বপ্ন গুলো যে ইচ্ছের সমুদ্র তৈরি করে। আর মন যে সেই ইচ্ছে পূরণের পথ খোঁজে ।
যদি তা হয় সর্বগ্রাসী….
যদি হয় ঢেউ এর ওপর ফসফরাস!
-তবে উঠুক জ্বলে সেই ফসফরাস…
আমিও কলম্বাস হব মহুল
উজানের পথে ঐ ঢেউয়ে,
আমার নাও ভাসিয়ে
তোকে নিয়ে যাব এক নতুন দ্বীপে ।
বানিয়ে তুলব এক চিলতে
ইচ্ছের বসতবাড়ি।
-তুই কিন্তু আবার আমায় স্বপ্ন দেখাচ্ছিস , রাংতা!!!
-ভয় কি মহুল ,আছি তো আমি।
আমার ইচ্ছেবাড়ির অলিন্দ থেকে
দেখব আমি তোকে।
দেখব আমি মহুল বৈরাগী
সাগরপাড়ে চুপটি করে বসে,
বালির চরে লিখছে আমার নাম।
-কি হবে রাংতা?
যদি ঢেউয়ের রাশি ঝাঁপিয়ে পড়ে
মুছে দেয় সে নাম!
-দিলে দেবে,তাতে কি হবে?
মনের পটে যে নাম লেখা,
তা কি মুছে যাবে?
-কিন্তু তোর ইচ্ছে বাড়ির চারপাশ যে
পাঁচিলে ঘেরা।
বন্ধ দরজার কপাটে লেখা
‘প্রবেশ নিষেধ’।
তাই তো ভাবি রাংতা ,
কি হবে, স্বপ্ন দেখে?
তার চেয়ে ভালো ….
চৌকাঠে দাঁড়িয়ে বৈরাগ্য সাধন।
-‘বৈরাগ্য সাধনে মুক্তি , সে আমার নয়!’
সে তোরও নয়।
পাঁচিলে ঘেরা কোঠাবাড়ির
খোলা দালানে দাঁড়িয়েও
মানুষ খোঁজে ,
চিরন্তন নিশ্চিন্ত আশ্রয় ।
তাই, নাইবা চিনলি অন্দরমহল
নাই বা খুঁজলি খিড়কি দুয়ার
যখন জানিস,
বারমহলে যতই থাকুক ছুৎমার্গ
সেই মহলের প্রতিটি ইটে
লেখা আছে শুধু তোরই নাম।

…………………………………………………………………………………ক্রমশ

  
This entry is part 5 of 8 in the series কিছু সংলাপ কিছু প্রলাপ

 

 

পর্ব – ৫


মহুলের অবাধ্য মনের কারনে আজ রাংতার এক অসীম যন্ত্রনা মনের মাঝে সারাক্ষণ জুড়ে থাকে…কি এক অপরিসীম মোহ তাকে ছেঁটে ফেলতে দেয় না এই আগাছার মতো সম্পর্কটাকে……রাগ হয় অভিমান হয়…তবু সরে থাকতে পারে না এই খ্যাপা ছেলেটার পাশ থেকে…

-আজ তোর সাথে কোনও কথা হবে না, মহুল।
-কেন? এমন শাস্তি কেন?
-যা খুশি বল, আমি কথা বলবই না।
– অপরাধী জানলোই না কি বা তার অপরাধ!…অথচ মৃত্যুদন্ড হয়ে গেল। আরে বাবা, কারনটা তো বল…
-কত করে বলেছিলাম মহুল…আমার বাড়ি আসতে , সে যে আসবি না জানতাম। কিন্তু নিদেনপক্ষে একটা ফোন!…না তাও না…বুড়ো শিবঠাকুর হয়ে পুজো নিচ্ছিলি বুঝি কদিন ধরে?নন্দী ভৃঙ্গীর সাথে কোথায় ছিলি ধ্যানে মগ্ন? ফোনের ওপারে শুধু নিরাসক্ত একই বুলি “ দুঃখিত ,ডায়াল করা নম্বরটি এই মুহূর্তে পরিসেবা সীমার বাইরে…”। তোর মনে ছিল কি আমার জন্মদিনের কথা?কিছুই তো চাইনা মহুল…শুধু একটু কথা…তাও কি ভারী ঠেকেছিল সেদিন তোর?
-কি বলি বলতো রাংতা? মনে তো ছিল…ভেবেছিলামও অনেক কিছু, কিন্তু তোর চারপাশে যাদের উজ্জ্বল উপস্থিতি, তাদের ভিড়ে যদি হারিয়ে যাই… সেই ভয়ে সরিয়ে রেখেছিলাম নিজেকে।
-হা কপাল আমার! কোনদিনই বা কে ছিল আমার আশেপাশে…যে সেদিন থাকবে?
আমি তো একা থেকেও একা…আবার সবার মাঝেও একা।
-আমি এক মনমর্জি বাউন্ডুলে রাংতা…এইসব সামাজিকতার আশা নাই বা রাখলি আমার কাছে!!
-সামাজিকতা? বেশ যদি তাই হয়… …তুই না সমাজবদ্ধ জীব? তুই চাইলেও যেতে পারিস না সমাজের বাইরে , সে তুই যতই বিপ্লব কর।
-বিপ্লব কিসের রাংতা?…আমি একজন নিতান্তই সাধারন মানুষ , যার সাধ আছে সাধ্য নেই?
-আচ্ছা… তুই কে এমন সৃষ্টিছাড়া মনফকিরা?তোর কি খিদে তেষ্টা ঘুম কিছু নেই…চাওয়া পাওয়া ইচ্ছে অনিচ্ছে জয় করেছিস অচীন পাখির সাধনায়?
-আমি যে কে, তাই তো হাঁতড়ে চলেছি রাংতা? দিনের শুরু থেকে দিনের শেষ পর্যন্ত একটাই খোঁজ , জারজ সমাজের কোলে আমি কোন সত্যকাম?কি আমার পরিচয়?
-আমি বলব মহুল……কেতাদুরস্ত সমাজের মুখ আর মুখোশের মাঝে তুই নিজেই তো এক জেহাদ!!
-এসব কথা থাক রাংতা…তার চেয়ে বল, তোর সাত সমুদ্দর দূরে থাকা স্বপ্নের সেই রাজপুত্তুরের কথা…আমি নাই বা ফোন করলাম, সে তো করেছিল?
-আহ মহুল… কতবার বলেছি সেই রাজপুত্তুর আমার পরিবারের পছন্দের মানুষ। আমার পছন্দের যদি কেউ থাকে তো সে কেবল তুই ।
– আচ্ছা …তোকে যদি দুজনের মধ্যে দাঁড়িপাল্লায় মেপে নম্বর দিতে বলি …কাকে কত নম্বরে পাশ করাবি শুনি?
– বোকা ছেলে… প্রতিটা মানুষ সারাজীবনে তার মনের মানুষ খুঁজে বেড়ায়…আর যার সাথে মনের মিল সবচেয়ে বেশি হয়, তাকেই বেছে নেয়…এই খোঁজ কখনও কখনও চলে আমৃত্যু …কিন্তু তুই তো আমার একশ’য় একশ। আমার আবার দাঁড়িপাল্লার কি প্রয়োজন?
-বুঝলাম…আচ্ছা বল কি চাস জন্মদিনের উপহার?
-তুই কি দিতে চাস শুনি?
-হুম… একটু ভাবতে দে।
-ভাবছিস আমায় কি দিবি?
পারিস যদি চাঁদ হতে
জ্যোৎস্না পাঠিয়ে দিস…
পারিস যদি ফাগুন হতে
দখিনা বাতাস এনে দিস…
পারিস যদি সাগর হতে
মুঠোখানেক ঢেউ দিলেই হবে…
কিছুই যদি না পারিস
নিদেনপক্ষে ছুঁয়ে দিস তবে!!
-তোর জন্যে সারাজীবন
ইচ্ছে ঘুড়ি
উড়িয়ে যেতে পারি
একটা গোটা আস্ত জীবন
কথায় কথায়
ফুরিয়ে দিতে পারি।

…………………………………………………………………………………………..ক্রমশ

  
This entry is part 6 of 8 in the series কিছু সংলাপ কিছু প্রলাপ

 

পর্ব – ৬


জৈষ্ঠ্যের দুপুরে ঠা ঠা রোদে সবাই যখন ঘর বন্দী, রাংতা তখন একাডেমীর সামনে মহুলের অপেক্ষায় অপেক্ষায় অস্থির বিষুবরেখা । “ দুপুর দুটোয় একাডেমীর সামনে থাকব, চলে আসিস দেখা হবে ।”…মুঠোফোনের এই কটা শব্দে এখন পুড়ছে তার শরীর মন……

 

কিরে কি দেখছিস অমন করে? মিনিট পনেরো দেরি হয়ে গেল রে…

-হুম তাই তো দেখছি…গ্রীষ্মের এই তীব্র দহনে গোটা কোলকাতা শহর যেখানে পুড়ছে, তুই সেখানে কত নিরুত্তাপ!

-কি যে বলিস…দেখা না করলেও তো বলবি কোনও তাপ উত্তাপ নেই আমার মধ্যে…
-তুই যেন দিনকে দিন কেমন হয়ে যাচ্ছিস মহুল!…দুপুর রোদে বাড়ি থেকে বেরোতে কত মিথ্যে বলতে হয় জানিস কি? কত কত অগ্নিপরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয়…সবই সয়ে যায় শধু তোকে ভালবাসি বলে…অথচ আমার কপালটা দেখ…সব অর্থহীন…তোর চোখে এর মূল্য এক কানাকড়িও না।
-কি করি বলতো রাংতা , তোর কারনে ভাবার জন্য একটা গোটা আস্ত পরিবার আছে …আমার তো কেবল তুই-ই আছিস!!! তাই তো তোকে আমার ভালোবাসার ভাবনায় ডুবিয়ে রাখতে ইচ্ছে করে।
-এই বুঝি তোর ভালোবাসার নমুনা? তা এইভাবে কি শুধু হেঁটেই যাব?
-না না চল…নন্দনের পাশটায় গিয়ে বসি।সময়টাকে একটু আটকে রাখার চেষ্টা করি!!
-আচ্ছা মহুল সত্যি বল …ভালোবাসা কথাটার কতটুকুই বা ওজন?আছে তো ভারি চারটে ব্যাঞ্জনবর্ণ …আর তার আগে পিছে খান তিনেক আকার আর একটা ওকার…তবু যেন একমণ ভার করে রাখে মনটাকে……এক চিলতে খুশির ফাঁকে অনেকটা মনখারাপ জুড়ে খালি অপেক্ষাই অপেক্ষা!!!
-এই তো বেশ বুঝেছিস…ভালবাসলেই সব জিনিস হাতের মুঠোবন্দী করা যায় কি? পারি কি সময়ের হাত টেনে ধরে রাখতে?
-তুই আর কি বুঝবি মহুল…আজ বাদে কাল হয়ত আমার বিয়ের সানাই বেজে যাবে…সব ছেড়ে চলে যেতে হবে …অথচ এর অন্যথা হবে এমন কোনও আশ্বাসও তো পাই না তোর কাছ থেকে।
-নিশ্চিত আজ কোথাও ঝড় উঠবে রাংতা…চারপাশটা কি থম থম করছে …আর তাই বুঝি মেঘেদের ঘেরাও চলছে তোর মনে…ওরে পাগলী , আমি তো ছিলাম, আছি , থাকবও…ঠিক তোর মনের মাঝে…তোর পাশটাতে ছায়ার মত…সে তুই যতদূরেই যা…আর যার সাথেই যা…
-বাহ … কি অবলীলায় বলে দিলি কথাগুলো …খালি খালি মন পড়ানো মিষ্টি মিষ্টি কথা!!
-ওরে আমি যে ছন্নছাড়া এক বাউল …আমার নিজের কোনও কিছুর স্থিরতা আছে কি বল? তোকে সঙ্গে নি কেমন করে…
-কিন্তু আগে যে বলতিস আমিই নাকি তোর স্বপ্নের রাজকন্যে, হন্যে হয়ে ঘুরিস যার জন্যে? রাখ না আমাকে তোর মাঝে কোথাও লুকিয়ে !!
-হ্যাঁ রে হ্যাঁ , তুই-ই তো আমার সেই অহঙ্কারী চাঁদ, কিন্তু আমি যে রাজ ভিখারী রাংতা… তোর জ্যোৎস্নাটাকে লুকিয়ে রাখব কোথায় ?
-উফফফ মহুল …আচ্ছা থাক, নিতে হবে না আমায়… আমি সাত সমুদ্র দূরে চলে গেলে তখন খুঁজে পাবি না কিন্তু আমায় …এই বলে রাখলুম…যতই তখন আদরের জন্য হাত পেতে বসে থাকিস না কেন…কেউ দেবে না এসে চাতকের গলায় একবিন্দু জল…
-সে দেখা যাবে ক্ষনি…। তবে আমি ভেবে রেখেছি তুই বিয়েটা কর… তারপর আমি তোরই সাথে পরকীয়া করব…।
-যাহ তুই একেবারে যা তা…
-কেন রে যে দেশে যাবি সেখানে তো সবই আইনসিদ্ধ…
-তুই সত্যিই যেতে দিবি আমায় ?
-কি জানি…তোর বাবার সামনে কবে গিয়ে দাঁড়াতে পারব তা জানি না…কবে যে কুরুক্ষেত্রের প্রস্তুতি নেব তাও বুঝি না…দেখা যাক সময় কি বলে…তুই আমি তো নিমিত্ত মাত্র…সবই তো মহাকাল…
-আচ্ছা?? বেশ তবে তাই হোক …আমাদের প্রেমটাকে তবে উৎসর্গ করলাম মহাকালের জন্য। কাল থেকে শুধুই দুরত্ব আর দুরত্ব…আর কোনও ছোঁয়াছুঁয়ি খেলা নয় কিন্তু…?
-তুই থাকতে পারবি তো…ভেবে দেখ এখনও সময় আছে!!
-আমি তো পারব… মহুল…দেখি তুই কতবড়ো সাধক বাউল!!
……………………………………………………………………………………………………………………ক্রমশ

  
This entry is part 7 of 8 in the series কিছু সংলাপ কিছু প্রলাপ

পর্ব – ৭


রাংতার চোখে আজ একরাশ বিষাদ…তবু সে অনড় তার প্রতিজ্ঞায় …জানলার বাইরের নিগ্রো আকাশটা যেন বিরহের অজুহাতে সমস্ত মেঘকে জাপটে ধরে রেখেছে তার বাহুবন্ধনে…।এ যেন এক বন্য ভালোবাসায় মেতে ওঠার পূর্বপ্রস্তুতি ।…এমন সময় বিছানার পাশে রাখা ফোনটা বেজে উঠল …


-হ্যালো……কে বলছেন?……হ্যালো…আরে বাবা কথা বলবেন তো? ফোনটা শুধু শুধু ধরে রেখেছেন কেন? হ্যালো…কে?
-কে বলতে হবে?…আমার শ্বাস-প্রশ্বাসে চেনা যায়না বুঝি এখনও? …হ্যালো তুই আবার চুপ কেন? কি ভাবছিস, কথা বলবি কিনা?
-হুম ভাবছি তোর ‘ভীষ্মের পণ’ গেল কোথায়?
-ধ্যুর…আমি আবার পণ করলাম কোথায়? তুইই তো বললি…‘যোগাযোগ বন্ধ । ভেঙ্গে দাও সান্নিধ্যের সাঁকো ’
– কিন্তু শেষ কথাটা বলেছিলাম ,… ‘দেখব তুইও কত বড় সাধক বাউল?’
-ছাড় না রাংতা এসব মন কষাকষি …ভালোবাসা-বাসিতে আবার জেদাজেদী কিসের??…আমার মন কেমন করছে!
-কেন? আবার কি হল?
-রবি ঠাকুরের ওই গানটা মনে পড়ছে… “ মেঘ বলেছে যাব যাব/ রাত বলেছে যাই/ সাগর বলে কূল মিলেছে / আমি তো আর নাই…/ দুঃখ বলে রইনু ছুপে /তোমার পায়ের চিহ্ন রূপে …
-তোর দুঃখ হয় মহুল??
-হয় তো…এই এখন যেমন তোর জন্য হচ্ছে…তোকে ভীষণ দেখতে ইচ্ছে করছে রাংতা …বিশ্বাস কর ,আমার ঘরের জানলা দিয়ে দূরে দেখা যাচ্ছে কাঁসাই…মন বলছে তোর হাত ধরে টেনে নিয়ে যাই ওই কংসাবতীর চরে, আর এই পাগল করা বৃষ্টিতে উদ্দাম ভিজে চলি দুজনে…আমি জানি রাংতা আমি তোকে যন্ত্রণা দি…অবহেলা করি…তুই কি ভাবিস আমি না বুঝে এমন করি…নারে আমি বুঝি…স-ব বুঝি…তোর রাগ অভিমান ছটফটানি…তোর নিস্তব্ধতা…সব… স-ব বুঝি।
-তাই বুঝি…তবে সরে থাকিস কেন অমন করে? দিনের পর দিন ইচ্ছে করে আমাকে সরিয়ে রাখতে পারিস কি করে মহুল?
-কি করব বল ?…মন যে বলে তুই আমারই বন্ধুর বাগদত্তা…তোকে চাইতে নেই…পেতে নেই …ছুঁতেও নেই। ঝিলাম যে তোকে রেখে গেছে গচ্ছিত!!
-ভুল.. গচ্ছিত না….অরক্ষনীয়া ? মনে পড়ে মহুল…কলেজের সেই দিনগুলোর কথা?… জানিস তুই যেদিন প্রথম ঝিলাম আর আমার মাঝে ঝগড়ার বোঝাপড়া করতে এসেছিলি … সেদিনই তোর চোখে হারিয়েছিলাম আমি… দেখেছিলাম বারবাগ্নি!!
-হ্যাঁ হ্যাঁ …আর তাই পরে কোনও একসময় বলেছিলি…আমার চোখেই নাকি তোর মরণ লুকিয়ে আছে? যদিও সেদিন চৈত্রমাস ছিল না তবু তুই বসেছিলি সর্বনাশের আশায়!!
-বৃষ্টি শুরু হব হব মহুল, …কিন্তু আমি তো ভিজে চলেছি সেই কবে থেকে… আমি স্বৈরিণী হতেও রাজি আছি মহুল ,যদি তুই পাশে থাকিস…যদি দিস এক টুকরো ছেঁড়া পালের ভরসা আমি আমার সম্পান ভাসাব তোর ওই কাঁসাই-এর ভরা জলে …ফিরিয়ে দেব অহঙ্কারী ঝিলামকে…
-আমার মনের মধ্যে অদ্ভুত একটা যুদ্ধ চলছে রাংতা…তোর বাবার সামনে দাঁড়ানোর আগে আমাকে যে ঝিলামের মুখোমুখি হতেই হবে? জানতে হবে ও কি বলছে?
-থাক মহুল থাক…স্বপ্ন দেখলে কেউ নষ্ট হয় না…তাই তোর স্বপ্নে আমি ভিজে গেলেও নষ্ট হয়ে যাব না…তোর এই সমর্পণটুকুতেই আমার শান্তি… আমি তো জানি তুই ভাঙবি তবু মচকাবি না।
-হা হা হা…একদম ঠিক চিনেছিস আমায়…আর আমারও এইটাই শান্তি আমার ভাঙনটা তুই দেখতেই চাস না…সামলে দিস আমায়…কিন্তু এবার যে কাঁসাই-এর জল বাড়ছে রাংতা… ফুলে ফেঁপে উঠছে কাঁসাই…
-উফফফ সাধে কি বলি …তুই বানভাসি!!!!
-হ্যাঁরে …আর তুই কি কম বড়ো সব্বনাশী…বারেবারে পাড় ভাঙ্গার শব্দে ভাসিয়ে দিস নিজেকে?
-তুই কবে আসবি কোলকাতা?
-আসব রাংতা আসব , খুব শিগগিরী …। আসতে যে আমাকে হবেই…কিন্তু তোর কাছে গেলেই যে আমি মহুল পাগলা …হ্যাংলা ভিখিরী।
-বেশ …আমি কথা দিলাম তুই কাছে আসলেও আমি এবার বৈরাগী হয়ে যাব। মন প্রাণ সব সঁপে দেব অচীন পাখির সাধনায়…।
……………………..……………………..……………………..……………………..……ক্রমশ


  
This entry is part 8 of 8 in the series কিছু সংলাপ কিছু প্রলাপ

 

 পর্ব – ৮
________________________________________________________________________________________________

দিনকে দিন আকাশটা হয়ে উঠছে বড্ড খামখেয়ালী … বখাটে ছেলের মত ঝাঁকড়া চুল উড়িয়ে দমকা হাওয়া ,মেঘের ঝাঁপিতে রাখছে হাত…পরিণাম একটাই…জল। কিছুদিন আগেও রোদের তাপে পুড়ছিল যে শহর , উঠোন , মন … আজ তা বৃষ্টি জলে ভিজে থই থই। গতকাল মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গিয়েছিল রাংতার…চারপাশের জমাট অন্ধকারে, কানে আসছিল বৃষ্টির একঘেয়ে ঝরে পড়ার শব্দ। অদ্ভুত একটা একাকিত্বে  অস্থির রাংতা মুঠোফোনে হাঁৎড়ে বেড়াচ্ছিল মহুলকে…একবার !দুবার !তিন তিনবার!!! …কিন্তু ওপারে তখন এক অধরা নৈশব্দ…ফোন বেজে উঠল…ফোন বেজে চলল…বেজে বেজে থেমেই গেল। নিঃসীম ঘন অন্ধকারে রাঙতার মনে তখন মেঘের পাহাড়। সেই মেঘ ছুঁয়েছিল আকাশ ,আর আজ তাই বুঝি বা মেঘের পাহাড় ভেঙে ভিজে যাচ্ছে গোটা শহর। মাঝ রাতের নিকষ কালো অন্ধকারকে সাক্ষী রেখে আরও একবার ফোনের বোতামে হাত রেখেছিল রাংতা । ঈশ্বরের অপার করুনায় মহুলের ঘুম ঘুম কণ্ঠস্বর শোনা গেল সেই মাহেন্দ্রক্ষণে…

 

-হ্যালো!

-হ্যালো মহুল…।

-হুম ঘুমচ্ছি , একটু পরে কথা হবে ।

-না না …এখনি হবে।

-না পরে।

-বলব তো আমি মহুল,  তুই শধু শুনবি।  

-পরে শুনব …এখন শুধু ঘুম …দুচোখ জুড়ে ঘুম…প্লিজ রাংতা একটু বোঝ। 

-না আমি বুঝব না…সব বোঝার দায় কি আমার? সারাদিনে কত কথা জমা হয় বলত, শুধু বলতে না পারার জন্য আমার সব কথা হারিয়ে যায়… এমন কেন তুই …কেন মহুল?

-আচ্ছা বলে যা…ঘুমিয়ে পড়লে জাগিয়ে দিস কিন্তু।

-তোর ভালবাসায় অদ্ভুত একটা নিষ্ঠুরতা আছে মহুল…আছে একটা বিষের জ্বালা…অদ্ভুত পুরাতনী ব্যথা…আর …আর আছে একটা আভিজাত্যের দেমাক ।

-হুম…বুঝলাম।  আমার দেমাক তো তোর ভালবাসা রে, পাগলী ? কিন্তু আজ এত উতলা কেন তুই ?    

-মহুল আমার সমস্ত বাঁধন আজ ভেঙে পড়তে চাইছে যে……তোকে দেখতে চাওয়ার বাসনায়..তোকে ছুঁতে চাওয়ার বাহানায়।

-সেকি? ঝিলাম বুঝি ফোন করেছিল গতরাতে…? খুব শিগগীরি উড়িয়ে নিয়ে যাবে বলেছে তোকে ?

-না রে ঠাট্টা নয় …আমার কিচ্ছু ভাল্লাগছে না মহুল…আমি যেন দিনের পর দিন তোর কাঁসাই আর ঝিলামের মাঝে আষ্টেপৃষ্ঠে  বাঁধা পড়ে যাচ্ছি…ক্রমশঃ আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। আমার দুচোখে আজ শুধু এক মনপোড়ানো চাতকের অপেক্ষা …তুই কবে আসবি মহুল?? কিরে বল না…ঘুমোলি নাকি আবার?

-আমি আসলে কি করবি শুনি ? আমার বাড়বাড়ন্ত কাঁসাই-এর জলে ঝাঁপ দিবি? …কিরে,  চুপ কেন? কি ভাবছিস? দিবি ঝাঁপ?… কিছু বলবি তো?

-ঝাঁপ দিতেই  তো চাই মহুল… ডুবতে চাই তোর গভীরে। তাই তো আজ দুপুরে আকাশ ঘনিয়ে যখন কালো মেঘ গর্জে উঠেছিল  , আমি আমার সমস্ত কাজ ফেলে পাগলের মত ছুটে গিয়েছিলাম ছাদে , পাশের বাড়ির ঝুমু কাকিমা যখন ছাদের পাঁচিলে শুকোতে দেওয়া জামা কাপড়  তুলছিল …আমি তখন দেখছিলাম, আকাশ জুড়ে শুধু পরতে পরতে  ঘন মেঘের আনাগোনা…চারিদিকের ঠান্ডা ঝোড়ো হাওয়ায় গাছের পাতার অশান্ত হয়ে ওঠা…আমার যে তখন ভীষণ ইচ্ছে করছিল মহুল, তোর  হাত ধরে খোলা মাঠের সবুজ গালিচায় ছুটে বেড়াতে…মুঠোভরে আকাশ থেকে মেঘ তুলে নিয়ে দুহাতে করে তোকে মাখাতে…।  

– হুমমম ……তবে সেই অশান্ত ঝড়ই বুঝি বৃষ্টি এনেছে আমার রাংতার চোখে?  ফোঁটায় ফোঁটায় ভিজেয়ে দিয়েছে তোর নিকানো উঠোন , উষ্ণ শরীর ,মন…আর  তোর সেই মনখারাপিয়া সুরে এবার যে আমি পুড়ে যাব রাংতা । 

-আমি যদি বৃষ্টি হতাম মহুল?…মেঘের সাথে উড়ে যেতাম তোর কাঁসাইয়ের পাড়ে…খুঁজে খুঁজে ঠিক বার করে নিতাম তোর ঘর…তোর খোলা উঠোন জুড়ে উড়নচণ্ডী হাওয়ায়  জানান দিতাম আমার আসার খবর…শুধু দুচোখের ইশারায় নিশ্চুপে  টেনে  আনতাম তোকে কাঁসাই পাড়ে…ভিজিয়ে দিতাম উদ্দাম।

-আচ্ছা? …আর আমি বুঝি বাধ্য ছেলের মত শুধু তোর দাপাদাপি সহ্য করতাম ? ঝোপের আড়ালে তোকে নিয়ে গিয়ে আষ্টে পৃষ্ঠে বেঁধে ফেলতাম সাপের মত…তখন আমার সারা গায়ে থাকতো চাঁদের নক্সা… নিশ্বাসে বিষ!! জানিস রাংতা, সাপের ছোবলে কেমন যেন একটা নেশা হয়!!! 

-আমাকে একটা বৃষ্টি ভেজা একলা দুপুর দিবি মহুল? কোনও এক ডাকাতিয়া মুহুর্তে ,শুধু একটি বারের জন্য আমার সমস্ত মনখারাপ ,  চুঁইয়ে পড়া জলের ফোঁটার মত নিঃশেষে উজার করে দেব তোকে ভালোবেসে।  

-আমার কাঁসাই পাড়ে এবার আবার ঝড় উঠবে রাংতা…উছলে উঠবে নদীর জল… বাইরের চাঁপা ফুলের গাছটা ঝোড়ো হাওয়ায় দুলেছে…জানিস, অসময়ে একটা কোকিল ডেকে ওঠে থেকে থেকে গাছটা থেকে। এখন আবার একজোড়া কাক দম্পতি পরম মমতায় বুনেছে তাদের বাসা ওই গাছেই ? রাংতা…আমাদের কি আদৌ কোনও বাসা হবে ? তবে কেন এমন করে ডুবতে চাইছিস আমার গভীরে ? কেন চাইছিস এমন বৃষ্টি ভেজা একলা দুপুর? পোড়ারমুখী কেন চাইছিস মরতে?

– জানি না মহুল , জানি না…। ভালবাসা মানে কি মহুল? রূপোলী চাঁদ আর ঘুমহীন একা রাতের প্রতীক্ষা ? বেরঙীন স্বপ্ন আর অনুশাসনের চোখ রাঙানিতে বুক ভাঙা আকুলতা?

-না রাংতা না… ভালোবাসা ঈশ্বরের দান… ভালোবাসা যে পবিত্র এক উত্তরণ !!!ভালোবাসা আর যাই হোক কোনও পাপ নয় রাংতা।

-ভালোবাসা পাপ না পুণ্য আমি জানতে চাই না মহুল … শুধু জানতে চাই ভালোই যদি বেসেছিস তবে মাথা তুলে বলতে বাধা কোথায়? ভালোবাসা যদি ঈশ্বরই হয় তবে সেই ঈশ্বরের জন্যই তো মহম্মদ ধরেছিল তরবারি … সিদ্ধার্থ ছেড়েছিল সংসার সুখ, রাজ্যপাট …রাধা ভেঙেছিল কূলশীল … ভালবাসার সেই মন্দিরে তুই যদি মহর্ষি হোস তবে আমার দেবদাসী হতে বাধা কোথায় ?

-আমি এত যুক্তি বুঝিনা রাংতা…শুধু জানি আমি মহুল বৈরাগী ।… ভবিষ্যৎ বলে আমার কিছু নেই …যতটুকু আছে সবই বর্তমান …তোর স্বপ্ন যেখানে এসে থেমে যায়…আমার স্বপ্ন সেখান থেকেই শুরু হয়…কি লাভ আছে এত জটিলতায় গিয়ে…বেশ তো আছিস ,  ভালো করে তাকিয়ে দেখ রাংতা !!!রাতের অমা নিশা পেরিয়ে আজ এক নতুন ভোরের সূচনা … এমনি করেই ঝড় আসে , প্লাবন আসে …তবু ধ্বংসের আড়ালে থাকে সৃষ্টির মূর্ছনা … প্রতিবারই  জল বাড়বে…বন্যায় ভাসবে মানুষ ,তবু বানভাসিরা বাধ সাধবে সব্বনেশে চাওয়ায় …

-আহা মহুল ,তুই কি আবার আমাকে সব্বনাশী বলছিস?

-হুম হুম…বলছি তো …আমার ঘুমটা যে দিলি নষ্ট করে…

-তুই কবে আসবি মহুল?

-যবে তুই শান্ত হবি……আজকাল তোকে যে আমার বড় ভয় করে রাংতা।

-দূর পাগল…

আমার অস্থিরতার পায়ে বেড়ি দিয়ে

আমি যে বোষ্টমী হয়েছি গোঁসাই!!!!

আমাকে আবার তোর কিসের ভয় ?  

জানিয়েছি , আরোপিত ইচ্ছায় সম্মতি 

কারণ, চৌকাঠ পেরোলাই যে নিঃসঙ্গতা

চুপচাপ তাই খেয়েছি  প্রমাণ সিদ্ধ ফল..

আর লাল সুতোয় বেঁধেছি কবচকুণ্ডল।   

………তুই ফিরে আয় মহুল…আমি যে তোর অপেক্ষায় ক্যালেন্ডারের পাতায় দাগ কেটে মরছি!!!

 

………………………………………………………………ক্রমশ।

 

  
PAGE TOP
HTML Snippets Powered By : XYZScripts.com
Copy Protected by Chetans WP-Copyprotect.
Skip to toolbar