পর্ব – ৮
________________________________________________________________________________________________
দিনকে দিন আকাশটা হয়ে উঠছে বড্ড খামখেয়ালী … বখাটে ছেলের মত ঝাঁকড়া চুল উড়িয়ে দমকা হাওয়া ,মেঘের ঝাঁপিতে রাখছে হাত…পরিণাম একটাই…জল। কিছুদিন আগেও রোদের তাপে পুড়ছিল যে শহর , উঠোন , মন … আজ তা বৃষ্টি জলে ভিজে থই থই। গতকাল মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গিয়েছিল রাংতার…চারপাশের জমাট অন্ধকারে, কানে আসছিল বৃষ্টির একঘেয়ে ঝরে পড়ার শব্দ। অদ্ভুত একটা একাকিত্বে অস্থির রাংতা মুঠোফোনে হাঁৎড়ে বেড়াচ্ছিল মহুলকে…একবার !দুবার !তিন তিনবার!!! …কিন্তু ওপারে তখন এক অধরা নৈশব্দ…ফোন বেজে উঠল…ফোন বেজে চলল…বেজে বেজে থেমেই গেল। নিঃসীম ঘন অন্ধকারে রাঙতার মনে তখন মেঘের পাহাড়। সেই মেঘ ছুঁয়েছিল আকাশ ,আর আজ তাই বুঝি বা মেঘের পাহাড় ভেঙে ভিজে যাচ্ছে গোটা শহর। মাঝ রাতের নিকষ কালো অন্ধকারকে সাক্ষী রেখে আরও একবার ফোনের বোতামে হাত রেখেছিল রাংতা । ঈশ্বরের অপার করুনায় মহুলের ঘুম ঘুম কণ্ঠস্বর শোনা গেল সেই মাহেন্দ্রক্ষণে…
-হ্যালো!
-হ্যালো মহুল…।
-হুম ঘুমচ্ছি , একটু পরে কথা হবে ।
-না না …এখনি হবে।
-না পরে।
-বলব তো আমি মহুল, তুই শধু শুনবি।
-পরে শুনব …এখন শুধু ঘুম …দুচোখ জুড়ে ঘুম…প্লিজ রাংতা একটু বোঝ।
-না আমি বুঝব না…সব বোঝার দায় কি আমার? সারাদিনে কত কথা জমা হয় বলত, শুধু বলতে না পারার জন্য আমার সব কথা হারিয়ে যায়… এমন কেন তুই …কেন মহুল?
-আচ্ছা বলে যা…ঘুমিয়ে পড়লে জাগিয়ে দিস কিন্তু।
-তোর ভালবাসায় অদ্ভুত একটা নিষ্ঠুরতা আছে মহুল…আছে একটা বিষের জ্বালা…অদ্ভুত পুরাতনী ব্যথা…আর …আর আছে একটা আভিজাত্যের দেমাক ।
-হুম…বুঝলাম। আমার দেমাক তো তোর ভালবাসা রে, পাগলী ? কিন্তু আজ এত উতলা কেন তুই ?
-মহুল আমার সমস্ত বাঁধন আজ ভেঙে পড়তে চাইছে যে……তোকে দেখতে চাওয়ার বাসনায়..তোকে ছুঁতে চাওয়ার বাহানায়।
-সেকি? ঝিলাম বুঝি ফোন করেছিল গতরাতে…? খুব শিগগীরি উড়িয়ে নিয়ে যাবে বলেছে তোকে ?
-না রে ঠাট্টা নয় …আমার কিচ্ছু ভাল্লাগছে না মহুল…আমি যেন দিনের পর দিন তোর কাঁসাই আর ঝিলামের মাঝে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা পড়ে যাচ্ছি…ক্রমশঃ আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। আমার দুচোখে আজ শুধু এক মনপোড়ানো চাতকের অপেক্ষা …তুই কবে আসবি মহুল?? কিরে বল না…ঘুমোলি নাকি আবার?
-আমি আসলে কি করবি শুনি ? আমার বাড়বাড়ন্ত কাঁসাই-এর জলে ঝাঁপ দিবি? …কিরে, চুপ কেন? কি ভাবছিস? দিবি ঝাঁপ?… কিছু বলবি তো?
-ঝাঁপ দিতেই তো চাই মহুল… ডুবতে চাই তোর গভীরে। তাই তো আজ দুপুরে আকাশ ঘনিয়ে যখন কালো মেঘ গর্জে উঠেছিল , আমি আমার সমস্ত কাজ ফেলে পাগলের মত ছুটে গিয়েছিলাম ছাদে , পাশের বাড়ির ঝুমু কাকিমা যখন ছাদের পাঁচিলে শুকোতে দেওয়া জামা কাপড় তুলছিল …আমি তখন দেখছিলাম, আকাশ জুড়ে শুধু পরতে পরতে ঘন মেঘের আনাগোনা…চারিদিকের ঠান্ডা ঝোড়ো হাওয়ায় গাছের পাতার অশান্ত হয়ে ওঠা…আমার যে তখন ভীষণ ইচ্ছে করছিল মহুল, তোর হাত ধরে খোলা মাঠের সবুজ গালিচায় ছুটে বেড়াতে…মুঠোভরে আকাশ থেকে মেঘ তুলে নিয়ে দুহাতে করে তোকে মাখাতে…।
– হুমমম ……তবে সেই অশান্ত ঝড়ই বুঝি বৃষ্টি এনেছে আমার রাংতার চোখে? ফোঁটায় ফোঁটায় ভিজেয়ে দিয়েছে তোর নিকানো উঠোন , উষ্ণ শরীর ,মন…আর তোর সেই মনখারাপিয়া সুরে এবার যে আমি পুড়ে যাব রাংতা ।
-আমি যদি বৃষ্টি হতাম মহুল?…মেঘের সাথে উড়ে যেতাম তোর কাঁসাইয়ের পাড়ে…খুঁজে খুঁজে ঠিক বার করে নিতাম তোর ঘর…তোর খোলা উঠোন জুড়ে উড়নচণ্ডী হাওয়ায় জানান দিতাম আমার আসার খবর…শুধু দুচোখের ইশারায় নিশ্চুপে টেনে আনতাম তোকে কাঁসাই পাড়ে…ভিজিয়ে দিতাম উদ্দাম।
-আচ্ছা? …আর আমি বুঝি বাধ্য ছেলের মত শুধু তোর দাপাদাপি সহ্য করতাম ? ঝোপের আড়ালে তোকে নিয়ে গিয়ে আষ্টে পৃষ্ঠে বেঁধে ফেলতাম সাপের মত…তখন আমার সারা গায়ে থাকতো চাঁদের নক্সা… নিশ্বাসে বিষ!! জানিস রাংতা, সাপের ছোবলে কেমন যেন একটা নেশা হয়!!!
-আমাকে একটা বৃষ্টি ভেজা একলা দুপুর দিবি মহুল? কোনও এক ডাকাতিয়া মুহুর্তে ,শুধু একটি বারের জন্য আমার সমস্ত মনখারাপ , চুঁইয়ে পড়া জলের ফোঁটার মত নিঃশেষে উজার করে দেব তোকে ভালোবেসে।
-আমার কাঁসাই পাড়ে এবার আবার ঝড় উঠবে রাংতা…উছলে উঠবে নদীর জল… বাইরের চাঁপা ফুলের গাছটা ঝোড়ো হাওয়ায় দুলেছে…জানিস, অসময়ে একটা কোকিল ডেকে ওঠে থেকে থেকে গাছটা থেকে। এখন আবার একজোড়া কাক দম্পতি পরম মমতায় বুনেছে তাদের বাসা ওই গাছেই ? রাংতা…আমাদের কি আদৌ কোনও বাসা হবে ? তবে কেন এমন করে ডুবতে চাইছিস আমার গভীরে ? কেন চাইছিস এমন বৃষ্টি ভেজা একলা দুপুর? পোড়ারমুখী কেন চাইছিস মরতে?
– জানি না মহুল , জানি না…। ভালবাসা মানে কি মহুল? রূপোলী চাঁদ আর ঘুমহীন একা রাতের প্রতীক্ষা ? বেরঙীন স্বপ্ন আর অনুশাসনের চোখ রাঙানিতে বুক ভাঙা আকুলতা?
-না রাংতা না… ভালোবাসা ঈশ্বরের দান… ভালোবাসা যে পবিত্র এক উত্তরণ !!!ভালোবাসা আর যাই হোক কোনও পাপ নয় রাংতা।
-ভালোবাসা পাপ না পুণ্য আমি জানতে চাই না মহুল … শুধু জানতে চাই ভালোই যদি বেসেছিস তবে মাথা তুলে বলতে বাধা কোথায়? ভালোবাসা যদি ঈশ্বরই হয় তবে সেই ঈশ্বরের জন্যই তো মহম্মদ ধরেছিল তরবারি … সিদ্ধার্থ ছেড়েছিল সংসার সুখ, রাজ্যপাট …রাধা ভেঙেছিল কূলশীল … ভালবাসার সেই মন্দিরে তুই যদি মহর্ষি হোস তবে আমার দেবদাসী হতে বাধা কোথায় ?
-আমি এত যুক্তি বুঝিনা রাংতা…শুধু জানি আমি মহুল বৈরাগী ।… ভবিষ্যৎ বলে আমার কিছু নেই …যতটুকু আছে সবই বর্তমান …তোর স্বপ্ন যেখানে এসে থেমে যায়…আমার স্বপ্ন সেখান থেকেই শুরু হয়…কি লাভ আছে এত জটিলতায় গিয়ে…বেশ তো আছিস , ভালো করে তাকিয়ে দেখ রাংতা !!!রাতের অমা নিশা পেরিয়ে আজ এক নতুন ভোরের সূচনা … এমনি করেই ঝড় আসে , প্লাবন আসে …তবু ধ্বংসের আড়ালে থাকে সৃষ্টির মূর্ছনা … প্রতিবারই জল বাড়বে…বন্যায় ভাসবে মানুষ ,তবু বানভাসিরা বাধ সাধবে সব্বনেশে চাওয়ায় …
-আহা মহুল ,তুই কি আবার আমাকে সব্বনাশী বলছিস?
-হুম হুম…বলছি তো …আমার ঘুমটা যে দিলি নষ্ট করে…
-তুই কবে আসবি মহুল?
-যবে তুই শান্ত হবি……আজকাল তোকে যে আমার বড় ভয় করে রাংতা।
-দূর পাগল…
আমার অস্থিরতার পায়ে বেড়ি দিয়ে
আমি যে বোষ্টমী হয়েছি গোঁসাই!!!!
আমাকে আবার তোর কিসের ভয় ?
জানিয়েছি , আরোপিত ইচ্ছায় সম্মতি
কারণ, চৌকাঠ পেরোলাই যে নিঃসঙ্গতা
চুপচাপ তাই খেয়েছি প্রমাণ সিদ্ধ ফল..
আর লাল সুতোয় বেঁধেছি কবচকুণ্ডল।
………তুই ফিরে আয় মহুল…আমি যে তোর অপেক্ষায় ক্যালেন্ডারের পাতায় দাগ কেটে মরছি!!!
………………………………………………………………ক্রমশ।