This entry is part 1 of 6 in the series বল মন 'সুখ' বল

 পর্ব -১

______________________________________________________________________________________________________

 

‘ভেসে যায় আদরের নৌকা/ তোমাদের ঘুম ভাঙে কোলকাতায়/ হ্যালোজেন বৃষ্টিতে রঙ লিখে ঘর পাঠায় / ভিখিরীরা স্বপ্ন পায়/ তুষারের রাজধানী ধুয়ে যায় জ্যোৎস্নায় …’

-কিগো ফোনটা ধরো না…বাজছে তো।

-হুমমম…ধরছি।

শীতের কুয়াশা জড়ানো সকালে গরম কম্বলের ভেতর থেকে হাত বের করে ফোনটা ধরতে একটু দেরিই হয়ে গেল মিথিলের।

-দুররর… কেটে গেল!

-কার ফোন ছিল দেখলে?

-কি করে দেখব চশমা কই?

-ওহো দাঁড়াও দিচ্ছি। সাধে কি বলি এবার চোখটা আরেকবার দেখাও।

-আরে এ তো চালশে গো…বয়সটা কি কম হল!

চশমাটা হাত বাড়িয়ে সাইড টেবিল থেকে মিথিলের হাতে তুলে দিয়ে কম্বল সরিয়ে উঠে বসল সৃঞ্জা , আলগোছে মাথার চুলটা পাকিয়ে একটা হাতখোঁপা বানিয়ে পাশে রাখা গরম শালটা টেনে নিল।

-সেকি কথা আমার মিথিল বাবুর মুখে… বয়স বাড়ছে? ভাবা যায়…? এই যে বল শরীরের বয়স বাড়লে বাড়ুক , মনের বয়স বাড়তে দিও না।

– হ্যাঁ তো, শরীরের বয়স বাড়ার সাথে সাথে শরীরের যন্ত্রপাতির কলকব্জাগুলো তো পুরোনো হচ্ছে, নাকি?

-আচ্ছা তাই বুঝি, দেখি আমার মিথিলবাবুর শরীরের কলকব্জাগুলো কতটা পুরোনো হয়েছে… …এই বলে, সৃঞ্জা তার ঠান্ডা হাতদুটো কম্বলের ভিতর দিয়ে মিথিলের জামার মধ্যে ঢুকিয়ে দিল ।

-এই যাহ…কি হচ্ছে কি? ওরে বাবারে কি ঠাণ্ডা, প্লিজ প্লিজ ঠাণ্ডা হাতটা দিও না শীত করছে , উফফফ তোমার হাত দুটো এমন বরফের মত কেন গো? আহ সরাও না…সরাবে না তো দাঁড়াও দেখচ্ছি মজা।

…এক ঝটকায় মিথিল কম্বলটা উল্টোদিকে ছুঁড়ে সৃঞ্জাকে জড়িয়ে চেপে ধরে খাটে ফেলল। তারপর নিজের খোঁচা খোঁচা দাড়ি দিয়ে সৃঞ্জার নরম গালে গাল ঘষতে লাগলো।

-উঃ , লাগছে প্লিজ ছাড়ো না।

-না ছাড়ব না , নাও এবার তুমি কি করবে কর দেখি।

-প্লিজ মিথিল ছাড়ো না …আহা লাগছে তো আমার।

-না আমি শুনবই না । তুমি শুনেছিলে ?

…ফোনটা আবার বেজে উঠল। ‘ভেসে যায় আদরের নৌকা/ তোমাদের ঘুম ভাঙে কোলকাতায়/ হ্যালোজেন বৃষ্টিতে’ … মোবাইলের রিংটোনে অগত্যা সৃঞ্জাকে ছেড়ে মিথিলকে উঠতেই হল। মিথিলের হাত থেকে ছাড়া পেয়ে সৃঞ্জা তখন পালিয়ে বেঁচেছে । ঘোলাটে চোখে মোবাইলের স্ক্রীনে তাকালো মিথিল… ‘নাহ, ঠাওর হচ্ছে না নামটা…ফোনটা কানে তুলে মিথিল বলল,

-হ্যালো…হ্যালো কে?

-ভালো আছো মিথিলদা?

-কে ?

-মনে হচ্ছে ভুলে গেছ আমাকে?…আমি কঙ্কা!!!

মিথিলের শীতের সকালের আদরের আমেজটা কেমন গুটিয়ে গেল ! কান দিয়ে যেন একটা উষ্ণপ্রস্রবনের ধারা সোজা স্বাধিষ্ঠান চক্র হয়ে মনিপুরা চক্রে এসে ধাক্কা মারলো।

-তুমি কি বিরক্ত হলে মিথিলদা?

-তা হঠাৎ কি মনে করে?

-তোমার সাথে একটু দরকার ছিল মিথিলদা? একটু সময় দেবে আমাকে?

-বলো কি বলতে চাও?

-না মানে এভাবে কথা বলা যাবে না…একটু দেখা করলে ভালো হত ? একবার দেখা করবে আমার সাথে? কয়েক সেকেন্ড চুপ করে রইল মিথিল,

মিথিলকে চুপ দেখে কঙ্কা এবার একটু কঠিন স্বরে বলল,

-অবশ্য তুমি না চাইলে আমি জোর করব না…ইনফ্যাক্ট সে অধিকারও এখন আমার আর নেই। তাই না মিথিলদা?

-কি বলতে চাও একটু পরিস্কার করে বললে ভালো হত কঙ্কা…জানোই তো এত কমপ্লিকেশন আমার ভালো লাগে না।

-আজ কতদিন পর তোমার মুখে এই কঙ্কা ডাকটা শুনলাম!!!কেমন যেন পুরোনো সময়গুলো আমাকে ঘিরে ধরছে …সত্যি বল তোমার সেই পুরোনো কথাগুলো কিছু মনে পড়ছে না? একবার দেখা করলে কি মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে মিথিলদা? পারবে তো আমাকে অস্বীকার করতে নিজের কনসেন্সের কাছে???

-অতো কথার কিছু নেই কঙ্কা…বলো কবে আর কোথায় দেখা করতে চাও?

-তুমি বলো তোমার সুবিধা মত। তবে আজই হলে ভালো হয়।

-আজই? কিন্তু আজ তো সারাদিনে অনেকরকম কাজ আছে? তাছাড়া আজতো ৩১শে ডিসেম্বর, সন্ধ্যে থেকে বেশ ভিড় হয়ে যাবে।

-তোমার অফিসটা এখনো সেই পার্ক ষ্ট্রীটেই আছে তো?

-হুমমম… সন্ধ্যে ছটার পর হয়ত একটু ফাঁকা থাকব আমি , চাইলে আমার অফিসে আসতে পারো, যদি কোনও অসুবিধে না থাকে ।

-না না ঠিক আছে। আমি তাহলে আজ সন্ধ্যে ছটার পরই তোমার অফিসে যাব। ভুলে যেও না কিন্তু!!

-না মনে থাকবে…তুমি এসো।

-থ্যাঙ্ক ইউ স মাচ মিথিলদা।

ফোনটা ছেড়ে দিল মিথিল । গলার কাছে কি যেন ঠেলে উঠে আসার মত একটা অনুভুতি হচ্ছিল। মুখটা বড় বিস্বাদ লাগছিল।–নাহ একটা সিগারেট ধরাতে হবে। বিছানার পাশে রাখা গায়ের চাদরটা জড়িয়ে উঠে পড়ল মিথিল।

______________________________________________________________________ক্রমশ

  
This entry is part 2 of 6 in the series বল মন 'সুখ' বল

পর্ব – ২।

আজ বছরের শেষ দিন। কাল নতুন বছরে মামমামের জন্য গিফট কিনতে হবে কিছু মিথিলকে । আজ অফিসে জে.কে.কন্সট্রাকশনের সাথে ভাইটাল মিটিং আছে তার । টেন্ডার কোট নিয়ে ফাইনাল আলোচনা। রাতে আবার থার্টি ফার্স্ট ইভের জন্য সৃঞ্জার বন্ধু আর তাদের হাব্বিদের নিয়ে লেট নাইট পার্টি… তার মধ্যে কঙ্কার ফোনটা এসে যেন সব গুলিয়ে দিল মিথিলের আজকের প্ল্যানিংটাকে। সত্যি মেয়েরা অনেকটা পারে । অথচ একটা সময়ে এই কঙ্কাই তাকে দিনের পর দিন এড়িয়ে চলেছে , বহু চেষ্টা করেও সে নাগাল পায় নি কঙ্কার… অনেক বুঝিয়েও তাদের মাঝের পোড়ে পাওয়া সম্পর্কের রেশটুকুকে রক্ষা করতে পারে নি সে…শেষ পর্যন্ত কঙ্কার সাথে স্বপ্নিল সম্পর্কটার ইতি টানতে বাধ্য হয়েছিল মিথিল । তার খুব খুব অসুবিধে হয়েছিল কঙ্কাকে মন থেকে সরিয়ে রাখতে। কঙ্কার সাথে কাটানো সময়গুলো তাকে মাঝে মাঝে ভীষণ অস্থির করে তুলত। এমনকি সৃঞ্জার সাথে অতি ঘনিষ্ঠ মুহুর্তেও তার কেবলি কঙ্কার ছোঁয়াটা মনে পড়ে যেত । খুব সত্যি বললে যদিও কঙ্কার সাথে তার হয়ত একটা পরকীয়া সম্পর্কই ছিল কিন্তু সৃঞ্জার থেকেও অনেক বেশি সহজ ছিল মিথিল কঙ্কার কাছে। আসলে তাদের দুজনের মধ্যের চাওয়া পাওয়াটা যে অতটা দুর্বার ছিল না। কিন্তু সেই সব তো চুকে বুকে গেছে নয় নয় করে আজ বছর তিনেক হল। তবে সম্পর্কটা যেমন একদিনে শেষ হয়ে যায় নি তেমনি মিথিলের সব ভুলে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসাও অত সহজ হয় নি । … বেশ খানিকটা সময় পার হয়ে গেছিল নিজেকে সব কিছুর বাইরে নিয়ে যেতে, তারপর ধীরে ধীরে নিজের মনটাকে সৃঞ্জাতে সীমাবদ্ধ করতে পেরেছিল মিথিল…একটা সময় পরে সৃঞ্জাকেই জীবনের একমাত্র অবলম্বন ভাবতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল সে এই কটা বছরে। অথচ তিন বছর পর আজ হঠাত কি এমন হল যে কঙ্কা নিজে থেকে দেখা করতে চাইছে মিথিলের সাথে ? তাহলে কি কঙ্কা আবার ফিরতে চাইছে নাকি তাদের পুরনো সম্পর্কের বৃত্তে । সে কি আবার ফিরে দেখতে চাইছে পুরোনো দিনগুলোকে । কিন্তু কঙ্কা যে বলেছিল সে আর চায় না এই সম্পর্কটাকে টিকিয়ে রাখতে। একদিকে মিথিল আর একদিকে তার স্বামী বাসব …দুজনের মাঝে সে হাঁফিয়ে উঠেছিল! কঙ্কা তো আরও বলেছিল ,যে বাসব যত খারাপই হোক হাজার হলেও সে তার অগ্নিসাক্ষী করা স্বামী, তার একমাত্র সন্তান বুবুনের বাবা , তাকে অস্বীকার করবে কি করে কঙ্কা! আর মিথিলের সাথে তো পরকীয়া প্রেম…আনকন্ডিশনাল লাভ ! …সম্পর্কটা চালিয়ে যাবার আদৌ কোনও দায়বদ্ধতা ছিল কি কঙ্কার ?ছিল না বোধহয় আর তাই স্বার্থপরের মত নিঃশব্দে মিথিলের হাত ছেড়ে দিয়েছিল কঙ্কা । অবশ্য মিথিলও বলেছিল ,
-দেখ , কঙ্কা জোর করে তো সম্পর্ক রাখা যায় না …অসুবিধে থাকলে তুমি সময় নাও …কিছুদিন দুরত্ব বজায় রাখো, কিন্তু একেবারে সরে যেও না …সত্যি বলতে আমরা দুজনেই সংসারে বাঁধা পড়ে আছি চাইলেও কেউই কিন্তু নিজেদের জায়গা থেকে সরে আসতে পারব না কোনোদিনই …তবু দুজনেই দুজনের কাছে একটা উন্মুক্ত খোলা জানলা…এমন করে জানলাটা বন্ধ করে দিলে আরও গুমরে মরবে কঙ্কা!… কাছে থাকতে হবে না। কিন্তু এমন দুরত্বে কি থাকা যায় না যাতে হাত বাড়ালে ছোঁয়া যায় …একটা পরম নিশ্চিন্ত আশ্রয়!!!… কিন্তু না কঙ্কা রাজি হয়নি । কি যে হয়েছিল ? কে জানে ? শেষমেশ মিথিল বিরক্ত হয়ে বলেছিল,
– ঠিক আছে আমি তোমার কথাই মেনে নিলাম, কিন্তু মনে রেখ, আজ যেমন ভাবে তুমি এড়িয়ে যাচ্ছ , এরপর যদি কোনদিন তুমি ভুল বুঝে ফিরে আসতে চাও ,আমিও কিন্তু তোমাকে চিনতে পারব না।‘’
…কিন্তু কই সকালবেলা ফোনে কঙ্কা নামটা শোনার পর, সে ফোনটা কাটতে পারল না তো ?

……একথা সেকথা ভাবতে ভাবতে আজ মিথিলের একটু দেরিই হয়ে গেল। একবারে স্নান সেরে বেরিয়ে ড্রেসকোর্ট করার সময় আজ এতদিন পর সাদা আর ধুসর রঙের মাফলারটা কেমন যেন গলায় জড়াতে ইচ্ছে করল মিথিলের । একবছর জন্মদিনে কঙ্কা দিয়েছিল তাকে । মাফলারটা নেড়েচেড়ে দেখতে দেখতে একটা লুকোনো চেনা গন্ধ তাকে বারে বারে পুরোনো দিনগুলোতে ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল ।মনে মনে এক অমোঘ টান আজও তাকে কঙ্কার প্রতি আকৃষ্ট করে তুলছিল।

-কিগো ব্রেকফাস্ট করবে তো?
-হ্যাঁ চল, হয়ে গেছে , যাচ্ছি।
সৃঞ্জার ডাকে সাতপাঁচ ভাবা বন্ধ করে মাফলারটা গলায় ফেলে ডাইনিং-এ এসে বসল মিথিল। খাবার ততক্ষনে রেডি । মামমাম এসে গলা জড়িয়ে বলল,
– গুড মর্নিং পাপা।
– মর্নিং মামমাম।
– সন্ধ্যেবেলা ফ্লুরিজের কেক আনছো তো? দাদাইও খাবে বলেছে।
– হুম , মনে আছে আমার…আর তার সঙ্গে একটা সারপ্রাইজ গিফটও ।
– পাপা, আজ তো তোমাদের থার্টি ফার্স্টের পার্টি থাকবে , আমি তো মামার বাড়ি থাকব রাতে , আমার সাথে তো তোমার আজ আর দেখাই হবে না , কাল দেখা হবে মামার বাড়িতে। …তুমি কিন্তু প্লিজ দিদুন আর দাদাই এর কাছে কাল তাড়াতাড়ি মাকে নিয়ে পৌঁছে যাবে… একদম আমার ঘুম ভাঙ্গার আগেই …আমি যেন ঘুম থেকে উঠেই তোমাকে দেখতে পাই আর সবার প্রথম হ্যাপি নিউ ইয়ারটা তোমার মুখেই শুনতে পাই।
– ওকে মাই লিটীল অ্যাঞ্জেল। তাই হবে । তুমি কিন্তু আজ দিদুন আর দাদাইকে একদম বিরক্ত করবে না।
সৃঞ্জা বলল,
-তুমি অফিসে পৌঁছে একবার গাড়িটা পাঠিয়ে দিও, আমি মামমামকে মায়ের কাছে রাখতে যাব…মা দুপুরে খেতে বলেছে…আমরা ওখানে পৌঁছে গাড়ি ছেড়ে দেব । বিকেলে আমি একটু পার্লারে যাব। কিন্তু সন্ধ্যেবেলা তুমি কি করবে শুনি ?
-মানে? যাব তো পার্টিতে।
– না তুমি কি আমাকে নিতে আসবে নাকি ,আমি পৌঁছে যাব তোমার অফিসে।
-দেখে নিচ্ছি…মিটিং হয়ে গেলে জানিয়ে দেব । তুমি রেডি হয়ে থেকো। … আর না হয় এক কাজ কর গাড়ি ছাড়তে হবে না, তুমি গাড়িটা রেখ… আমার কাজ মিটে গেলে আমি ফোন করে দেব তুমি গাড়ি নিয়েই চলে এস অফিসে একসাথে বেরিয়ে যাব।
-হুম সেটাই ঠিক হবে…তবে প্লিজ দেরি কর না যেন।
____________________________________ক্রমশ।

  
This entry is part 3 of 6 in the series বল মন 'সুখ' বল

পর্ব – ৩।

…সারা কলকাতা শহরটাই কদিন ধরে কেমন যেন উৎসবের আমেজে মেতে আছে। সেই বড়দিনের সময় থেকেই রাস্তা ঘাটে দোকানে বাজারে আলোর রোশনাই …তার সাথে যোগ হয়েছে ল্যান্টারন্‌স , বেল্‌স , স্ট্রীমার্‌স,স্টার্‌স… আরো কত কি? গাড়ি নিয়ে বালিগঞ্জ থেকে পার্ক স্ট্রিট আসতে আসতে পুরোনো কথাগুলো আবার মিথিলকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যেতে লাগল। সত্যি বলতে মিথিল কিন্তু কঙ্কাকে কম ভালোবাসে নি । তবে মিথিল আর কঙ্কার সম্পর্কটা কোনও পূর্ব নির্ধারিত বা সুপরিকল্পিত সম্পর্ক ছিল না… এটা একটা দুর্ঘটনা কিম্বা বলা ভালো ভাগ্যের খেলা। বন্ধুমহলে যদিও মিথিল আর সৃঞ্জা ভীষণ আইডিয়াল কাপ্‌লই ছিল, তবুও যেন সৃঞ্জার বাবা মায়ের সমস্ত বিষয়ে মতামত জ্ঞাপন আর সৃঞ্জার মন-মর্জীর তোয়াক্কা করতে করতে মন থেকে কেমন যন্ত্র হয়ে উঠছিল মিথিল…একটা অদ্ভুত শূন্যতা তৈরি হচ্ছিল তার মনের মধ্যে দিনে দিনে …যার কারনটা মিথিল চেষ্টা করেও ঠিক খুঁজে পায় না। এমনি এক সময় মিথিলের নতুন অফিসের ট্যাক্স কনসালটেন্ট বরুন মিত্রের কাছ থেকে অডিটর হয়ে মিথিলের অফিসে আসে কঙ্কনা সিন্‌হা। তার দায়িত্ববোধ, ধৈর্য , যত্ন ও রুচিশীল ব্যবহারে ধীরে ধীরে একটু একটু করে মিথিলের মনের ফাঁকটা তার অজান্তেই কেমনভাবে যেন ভরে উঠছিল। সেই ভালোলাগার পরিভাষাটা দিনে দিনে বদলাতে লাগল কঙ্কানার জীবনে বাসবের দুর্বিষহ অত্যাচারের কারনে। বাসবের কন্ট্রাক্টরী ব্যবসার ঘাটা আর মাঝে মাঝে সাইকোপ্যাথের মত ভয়াবহ আচরণ দিনে দিনে কঙ্কনাকেও যেন মিথিলের দিকে এগিয়ে আনছিল…যার সর্বশেষ পরিনতি হল… কঙ্কনা ধীরে ধীরে মিথিলের কাছে কঙ্কা হয়ে উঠল আর দুজনের মাঝের অফিসিয়াল রিলেশনটা মুখ মুখোশের আড়ালে আনফিসিয়ালি মন ছেড়ে শরীরে এসে দানা বাঁধল। আর মানুষের মন তো পদ্ম পাতায় জল… যে সময় একটু একটু করে মিথিলের মন সৃঞ্জার থেকে কঙ্কার দিকে সরে যাচ্ছিল, সেই সময় মিথিল নিজের মনের সাথে লুকোচুরি খেলতে খেলতে একটাই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বেরাচ্ছিল …একসাথে কি দুজনকে ভালোবাসা যায় না ??? কঙ্কার কারণে সে তো আর সৃঞ্জাকে অবহেলা করছে না ! কই তার তো আগের মত নিজেকে আর ফাঁকা লাগে না, বেশ তো সৃঞ্জা আর কঙ্কাতে মনটা ভরেই রয়েছে তার …। কাজে কত মনযোগ দিতে পারছে ! তাছাড়া কঙ্কা অত ডিমান্ডিং ছিল না, আর সেও মিথিলের মধ্যে একটা পরম নিশ্চিন্ত আশ্রয় পেয়েছিল। ফলত দুজনার সম্পর্কের মাঝে খেয়া আর সেতু দুটোই গড়ে উঠেছিল ভাগ্যের নিপুণ চালে।মিথিলের মনে হয়েছিল, যে সম্পর্ক একে অন্যকে সমৃদ্ধ করছে সে সম্পর্ক খারাপ কেন হবে ? সৃঞ্জা যেমন তার নিজের স্পেস খুঁজে নিয়েছে তার বাবা মা ভাই বোন বন্ধু বান্ধবের মাঝে, ঠিক তেমনই মিথিলও স্পেস খুঁজেছে কঙ্কার মাঝে। এর মাঝে দোষের কি আছে? শুধু বিবেকের দংশন বলতে একটু সত্যগোপন অর্থাৎ লুকোচুরি…এটুকু মানিয়ে নিতেই হয়। … সত্যিই তো সারাজীবনে সব কথা কি সবাইকে বলার ? বলা যায় নাকি বলাটা উচিৎ। আর তাছাড়া সত্যগোপন আর মিথ্যাচার তো এক নয়?… এইভাবে বেশ কাটছিল দুজনের , দুজনের মাঝে এত সুন্দর বোঝাপড়ায় কোনো সমস্যাও ছিল না। আর মিথিল দিব্যি শ্যাম কূল বজায় রেখে জীবনটা উপভোগ করছিল। কিন্তু কোথা থেকে কি যে হল তাদের পাক্কা দু বছরের মধুর সম্পর্কটা কেমন যেন পান্‌সে হয়ে উঠতে লাগলো । ধীরে ধীরে কঙ্কা যেন কেমন বদলে যেতে লাগলো । যে ব্যালান্সটা মিথিল পাক্কা খেলোয়ারের মত করতে সক্ষম হচ্ছিল…কঙ্কা কিন্তু সত্যিই পারছিল না। তার পরিবারে মিথিলকে নিয়ে যতটা জল ঘোলা হয়েছিল তার থেকেও বেশি সে আত্মদহনে পুড়ছিল । মিথিলকে বোঝানোর চেষ্টা করলেও, মিথিল কিছুতেই বুঝতে চাইছিল না । আর খুব সত্যি বলতে ,জোর করে আর যাই হোক ভালোবাসা হয় না। তাই মিথিলের চাপাচাপিতে কঙ্কা ধীরে ধীরে শরীরে মনে স্থবির হয়ে যাচ্ছিল। এক অদ্ভুত মানসিক যন্ত্রনা হাত থেকে মুক্তি পেতে সে এড়িয়ে চলতে চাইছিল মিথিলকে। কিন্তু সে কথা মিথিলের উপলব্ধির বাইরে ছিল বোধহয় ।

……দিনের পর দিন বিভিন্ন অছিলায় কঙ্কা সরে থাকতে থাকতে শেষ পর্যন্ত একদিন মিথিলের সাথে টানাপড়েনটায় ইতি টেনেই দিয়েছিল। মিথিলের আজও বেশ মনে আছে কঙ্কার সাথে তার শেষ কথোপকথনটা । কঙ্কার মুখে তখন কেবলি একটাই কথা…
– মিথিলদা , আমার ভীষণ ক্লান্ত লাগছে ।
-কিসের ক্লান্তি কঙ্কা?
– একদিকে তুমি আর অন্যদিকে বাসব …আমি যেন ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছি। আমি অভিনয় করতে করতে হাঁফিয়ে উঠছি মিথিলদা …কোনটা আসল আর কোনটা অভিনয় আমার গুলিয়ে যাচ্ছে।
-অভিনয় বলছ কেন?
– অভিনয় নয়? বাসবের সাথে কি আমি মিথ্যে ভালোবাসার অভিনয় করছি না? আমি কি মেশিন মিথিলদা?
-আমি বুঝতে পারছি না তোমার অসুবিধেটা কোথায় হচ্ছে কঙ্কা ? আমরা সারাদিনে তো কাজের মাঝেও নিজেদের মধ্যে একটা কোয়ালিটি টাইম কাটাই কঙ্কা, তারপরও তুমি বলছ!!! আমি সারাদিন যতটা অ্যাটাচ্‌ড তোমার সাথে থাকি ফোনে , এস.এম.এস-এ ততটা আমি আমার ফ্যামিলিকেও সময় দিই না। …তুমি চাইলে আমি তোমাকে সময় দিই তো?
-কিন্তু মিথিলদা শুধু কি এইটুকুতেই শান্তি ? আমার তো একটা মন আছে বল । যখন তোমাকে কাছে পেতে ইচ্ছে করে বাসব এসে আমার অঙ্গরাজ্যের অধিকর্তা হয়ে বসে, বাসবের ছোঁয়া আর তোমার ছোঁয়া কি এক ?? তোমাকে চিন্তা করে যদি বা বাসবকে মেনেও নিয়ে বিছানায়, তবু অদ্ভুত একটা বৈসাদৃশ্য আমাকে ভীষণভাবে অতৃপ্ত করে তোলে…তখন আমার নিজের ওপরই রাগ হয়, ঘৃণা হয় … বিশ্বাস করো , কান্না পায় , একা লাগে…পাগল পাগল লাগে। মনে হয় আমি কি সাঙ্ঘাতিক ভুল করেছি তোমার সাথে নিজেকে জড়িয়ে। এভাবে আমি নিজেই নিজের কাছে ছোট হয়ে যাচ্ছি মিথিলদা । মনে প্রানে শরীরে ভালোবাসব তোমাকে আর বাসব তার স্বামীত্বের অধিকারে সহবাস করতে বাধ্য করবে আমাকে ওর সাথে। আমি এটা আর মানতে পারছি না ।
-দুররর, তুমি বড় বেশি ভাব কঙ্কা। এগুলোকে এত প্রশ্রয় দিতে নেই।
-না মিথিলদা না…আমার মনে হচ্ছে আমিও বোধহয় সাইকো হয়ে যাচ্ছি দিনে দিনে, প্রতারণা করছি সব চাইতে বেশি আমার সন্তানের সাথে। বুবুনের কি দোষ বলো ? ওকি পাচ্ছে ওর মাকে পুরোপুরি ? আমি কি নিজের সমস্যা নিয়ে ব্যস্ত থেকে ওকে অবহেলা করছি না? আমি কি পারছি ওকে একটা সুস্থ জীবন দিতে?
-কিন্তু তুমিই তো বলতে কঙ্কা বাসবের সাথে তোমার কোনোভাবেই মিলমিশ হয় না, ওর একগুয়েমি , অল্পশিক্ষা, প্রকারন্তরে অমানবিক আচরণ তোমাদের মাঝে দিনে দিনে একটা অদৃশ্য পাঁচিল তৈরি করে দিয়েছে! যে বাসবের হাত ধরে তুমি একদিন বাড়ি ছেড়েছিলে সেই বাসবকে আজ তোমার অচেনা লাগে , আর তুমি সেই বাসবকে আঁকড়ে ধরেই বা বাঁচবে কি করে? তুমি ওর থেকে সরে এসে স্বাধীনভাবে বাঁচো কঙ্কা । আমি যতটা পারব তোমাকে সাহায্য করব। আমি বলছি তুমি ভালো থাকবে।
-কিন্তু বুবুনের তো মা বাবা দুজনকেই চাই বলো…ওর তো আমাদের দুজনের হাত ধরেই বেড়ে ওঠার কথা। আর সত্যি বলো এতদিন ছিলাম তো এই অমিল নিয়েই ? তখন পারলাম কি করে? আসলে কি জানো মিথিলদা, মানুষষের কাছে বেশি অপশন থাকা উচিত নয়? তাহলেই মনের মাঝে না পাওয়াগুলো বড় বেশি খোঁচা মারে । মনে অস্থিরতা আসে , স্বার্থপরের মত নিজের ভালোটুকুই বুঝতে চায়… সত্যি বলতে তোমার সাথে সৃঞ্জার সম্পর্ক এতটা তিক্ত নয় তো , তাই তুমি আমার জ্বালাটা বুঝতে পারছো না। না , মিথিলদা , না…আমি অনেক ভেবেছি…আমি আর পারছি না…আমায় তুমি ক্ষমা কর … আমায় তুমি মুক্তি দাও!!!
ভাবনার সুতোটা তখনও ঠিকমতো কাটে নি …হঠাৎই ড্রাইভার ইকবাল গাড়িতে প্রচন্ড জোর ব্রেক কষলো । গাড়িটা থেমে গেল অফিসের একটু আগেই…ইকবাল চিৎকার করে উঠল,
-ওই শালা , শুয়ার কে পিল্লা , মরনা চাহতা হ্যায় ক্যায়া?
-কি হল ইকবাল ? গালি দিচ্ছ কেন?
-আরে সাব , আভি আভি চাক্কে কে নিচে চলা যাতা …শালা ভিখ মাঙ্গনেবালা!
… কাচের জানলার ভিতর দিয়ে মিথিল দেখল একটা বাচ্ছা ভিখারী ছেলে, যার কোমর থেকে বাকি শরীরটা একেবারেই অকেজ , দুটো হাত দিয়ে টেনে টেনে হেঁটে রাস্তাটা পেরিয়ে ফুটপাথে গিয়ে উঠল। রাস্তা পার হতে গিয়ে মিথিলে গাড়ির নীচে চলে যেত, আরেকটু হলেই। ছেলেটাকে অফিসের পাশে বেশ কয়েবার বসে থাকতে দেখেছে মিথিল আগে । মাঝে সাঝে জুলজুল করে চেয়ে থাকতে দেখে মিথিল পাঁচ দশটাকা দিয়েছেও …আজ গাড়ি থেকে মিথিল দেখল, এই প্রচন্ড ঠান্ডায় একট ছেঁড়া সোয়েটার পরে ন্যাড়া মাথায় ফুটপাথের এক পাশে মাথা নামিয়ে ইকবালের গালি খাচ্ছে। ইকবাল বলে যাচ্ছে,
– আবে বুরবক ইসতারা কই রাস্তা ক্রশ করতা হ্যায় ক্যায়া?
মিথিল বলল,
– গালি মাত দো , ছোড় দো ইকবাল, দের হো রাহা হ্যায় … গাড়ি পার্ক করনেকা জরুরত নেহি হ্যায়, মুঝে উতার জানে দো …অর তুম থোরাসা আগে যাকে গাড়ি ঘুমাকে , ঘর চলা যাও …মেমসাবকো বাহার যানা হ্যায় ।
…মিথিল গাড়ি থেকে নেমে ছেলেটার দিকে যেতে গিয়ে… একবার ঘড়িটা দেখল, তারপর আর সেদিকে না গিয়ে সোজা অফিসের দিকে হাঁটা লাগালো।
_______________________________________ক্রমশ

  
This entry is part 4 of 6 in the series বল মন 'সুখ' বল

পর্ব – ৪।

অফিসের পরিবেশটা আজ একটু হালকা হালকাই…তবুও নিউ প্রোজেক্টের এস্টিমেটটা দেখা বাকি আছে , বেলেঘাটার সাইটের ওয়ার্কিং ড্রয়িং-এর কপি, ইন্সপেকশন রিপোর্ট , ক্লায়েন্টের সাথে মিটিং সামলে লাঞ্চে গৌরদাকে দিয়ে কিছু ক্যাথলিন কেক আর চিকেন স্যান্ডুইচ আনতে দিল মিথিল সবার জন্য। তারপর কফি , কেক , স্যান্ডউইচ খেয়ে জে .কে. কন্সট্রাকশনের অফিসে বেরিয়ে গেল । যাবার আগে মিথিল কতকগুলো অ্যামোনিয়া প্রিন্ট রেডি করতে দিয়ে গেল তার পি. এ. বিপুলকে । কাল ছুটি , তাই আজই কাজটা করে রাখতে হবে । বিপুল গৌরদাকে সব বুঝিয়ে দিল।
…গৌরদা সেই প্রিন্টগুলো রেডি করে নিয়ে রিশেপ্সনে এসে দাঁড়াতেই , চোখে পড়ল কঙ্কনাকে। কঙ্কনা আগেও যেহেতু এসেছে এই অফিসে তাই গৌরদা ভালোই চিনত তাকে … বলল ‘কি ম্যাডাম , কেমন আছেন?’
– আরে গৌরদা যে, সব ভালো তো ? অফিস কেমন চলছে ?
– আমি ভালো আছি আর অফিসও ভালো চলছে , তবে আপনার কি আজ আসার কথা ছিল।
– হ্যাঁ । মিথিলদা আছেন ?
– না বেরিয়েছেন …একটু অপেক্ষা করুন এসে যাবেন।
-ঠিক আছে , আমি বসছি ভিসিটিং-এ।
… বসে থাকতে থাকতে কত পুরোনো কথা কঙ্কার মনে পড়ছিল। সত্যি বলতে তার সারাদিনে বহুবার বহুকাজের মধ্যে এমনি মনে পড়ে যায় পুরোনো সেইদিনগুলো , মনে পড়ে যায় মিথিলকে। ইচ্ছে করে মিথিলকে দেখতে। ফোনে কথা শুনতে। রাতে ঘুমের ঘোরে মিথিলকে স্বপ্ন দেখে চোখের পাতা জলে ভারী হয়ে যায় কঙ্কার। স্মৃতি তো সততই সুখের ,তাই কখনও কখনও নিজের মনেই পুরোনো কথায় হেসে ওঠে কঙ্কা , কিন্তু তারপর বাস্তবের একাকিত্বে বড়ো ফাঁকা ফাঁকা লাগে, মনটা কেমন যেন অসাঢ় হয়ে থাকে , কোনও কিছুতেই সায় দেয় না…… তার ওপর মাঝ রাতে বাসবের জোড়াজোড়িতে তার দম বন্ধ হয়ে আসে , ইচ্ছে করে মিথিলের কাছে ছুটে যায় কিন্তু…
…ভাবতে ভাবতে প্রায় পৌনে সাতটা বেজে যায়। হঠাৎ কাচের দরজা ঠেলে ঝড়ের গতিতে অফিসে ফিরে আসে মিথিল। কঙ্কাকে চোখে পড়তে হাঁটার গতি একটুও শ্লথ না করে চোখের ইশারায় কঙ্কাকে ভেতরে আসতে বলে। নিজের কেবিনের দরজা খুলে ভেতরে চলে যায় মিথিল । এক মুহুর্তের জন্য কেমন একটা জড়তায় কঙ্কা যেন স্থির হয়ে যায়… মিথিলের আসাটা এক ঝলক মনে পড়তেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে মিথিলের গলায় তার দেওয়া মাফলারটা। মনে মনে ভিজে যায় কঙ্কা। কিন্তু নাহ, তার তো দুর্বল হলে চলবে না …। সত্যি তো এইরকম সম্পর্কের কোনও পরিণতিই হয় না , তো কি লাভ আছে দুটো মানুষের মিথ্যে চাওয়ায় দুটো পরিবারকে সংকটের মুখে ফেলার!… তার চেয়ে এই ভালো…যে যার নিজের বৃত্তেই আবদ্ধ থাক। একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে কঙ্কা এগিয়ে গেল কেবিনের দিকে, তারপর দরজা খুলে ভিতরে গেল। কেবিনের দরজায় কঙ্কাকে দেখে মিথিল শান্ত স্বরে বলল ,
-ভেতরে এস কঙ্কা।
…তারপর বেল দিয়ে গৌরদাকে ডেকে দুকাপ কফি দিতে বলল মিথিল। কঙ্কা বসল মিথিলের একেবারে সোজাসুজি। মিথিল চোখ থকে চশমা খুলে এক গ্লাস জল খেয়ে মাথার পিছনে হাত রেখে চেয়ারটা একটু হেলিয়ে একদৃষ্টে তাকিয়ে দেখল কঙ্কাকে। আগের চেয়ে কঙ্কা যেন একটু ম্লান , একটু স্থুল , একটু আটপৌরে । কঙ্কাও অবশ্য এতক্ষন নীরবে তাকিয়েছিল মিথিলের দিকে, আর মনে মনে মেলাচ্ছিল মিথিলকে, নাহ্‌ কোনও পরিবর্তন হয়নি মিথিলের শুধু মাথার চুলে ঈষৎ পাক ধরেছে আর চশমার ফ্রেমটা চেঞ্জ হয়েছে । কঙ্কাকে চুপ থাকতে দেখে মিথিল নিজে থেকেই বলে ,

– কি ভালো আছো তো?
– হুম আমি ঠিক আছি । তুমি?
… একটু অর্থপূর্ণ হাসল মিথিল। … মনে মনে বলল ‘আজও কি আমায় ভাবো কঙ্কা?’
কঙ্কাও যেন মনে মনে উত্তর করল ‘ ভাবি গো ভাবি আজও তোমার কথা ভাবি আমি। কিন্তু আমার হাত পা যে বাঁধা মিথিলদা এটুকু কি তুমি বোঝো!’
কফি এল… কঙ্কা একটু চুপ থেকে ,বলল
-আমার ওপর খুব বিরক্ত হয়েছ তাই না?
-নাহ!
-সত্যি বলছ?
– জানি না…মানে ভাবি নি। কি বলবে বলছিলে?
একটু সময় নিল কঙ্কা। আনত মুখ , টেবিলের কাচে নখ দিয়ে আঁচড় কাটা, দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ানো , বুকের কাছে আঁচলের আড়ালে শ্বাস-প্রশ্বাসের ওঠাপড়া … কঙ্কার এই স্বভাবগুলো মিথিলের খুব চেনা। তার খুব ইচ্ছে করছিল সবার অলক্ষ্যে কঙ্কাকে জড়িয়ে একটা দীর্ঘ চুমু দিতে। কিন্তু সব ইচ্ছে কি সব সময় পূরণ হয়! মিথিলের ঠোঁটটা শুকিয়ে আসছিল, নাহ্‌ একটা সিগারেট ধরাতে হবে। মাথার চুলগুলো হাতে করে ঝাঁকিয়ে আপাত গম্ভীর স্বরে বলল,
-আমি আজ একটু তাড়াতাড়ি বেড়িয়ে যাব কঙ্কা। কি বলবে বল।
মিথিলের এই আপাত রাগটাও আবার কঙ্কা খুব ভালো চেনে। সে জানে এমন রাগের সময় মিথিলের খুব কাছে গিয়ে মিথিলের হাত দুটো ধরলেই তাকে উস্কে দেওয়া যায়। কিন্তু দুজনে দুজনকে এত ভালোভাবে জানার পরও কে যেন এক অদৃশ্য পাঁচিল তুলে দিয়েছে তাদের মাঝে…তাদের মাঝের সেতু আর খেয়া দুইই গেছে আজ হারিয়ে , এখন দুজন যেন নদীর দুই কুলে দাঁড়িয়ে একে অপরের দিকে দীর্ঘ শ্বাস টুকুই ছুঁড়ে দিতে পারে। অবশেষে মিথিলের দিকে সোজাসুজি চোখ রেখে কঙ্কা বলল,
– যাক, তবে কাজের কথায় আসি… মিথিলদা বাসব জে .কে.কন্সট্রাকশনের টেন্ডার কোট করেছে। ফাইনাল লিস্টিং-এর আগে তুমি যদি একটু সুপারিশ করতে, তাহলে বাসব কাজটা পেতে পারে । ওকে একটা সুযোগ করে দেবে , কাজটা পেলে ওর একটা হিল্লে হয়ে যেত। বেশ কয়েক বছর ধরে ওর ব্যাবসাটা মার খাচ্ছে ।
মিথিল যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিল না। তবুও ঘোরটা কাটিয়ে বলল,
– তুমি কি এইজন্যই আমার সাথে দেখা করতে এসছিলে? আমি তো ভাবলাম তোমার আমাকে আরো কিছু বলার আছে।
কঙ্কা চুপ করে গেল , তারপর বলল,
– নিজেদের কত রকম সুবিধে অসুবিধের কথা আগে আমরা দুজনে দুজনকে বলেছি তো মিথিলদা , আজ কি আমি এতটাই পর হয়ে গেছি যে …
কথাটা শেষ করতে পারল না কঙ্কা …গলাটা কান্নায় বুজে এল।
-এটা তুমি বলছ কঙ্কা? আমি তো সরে আসতে চাইনি তোমার কাছ থেকে? তুমি সরিয়ে দিয়েছ নিজের ঔদ্ধত্যে । দিনের পর দিন তোমাকে ফোন করেছি, মেসেজ পাঠিয়েছি, তুমি কোনো জবাব দাও নি। এরপরও তোমার মনে হয় আমি তোমার জন্য এসব করব ? কেন করব ? কি পাব আমি? একটা সময় তোমাকে আমি ধরে রাখতে চেয়েছিলাম এটা সত্যি কিন্তু আজ আমার কোনো আগ্রহই নেই তোমার ব্যাপারে । তাহলে কেন করতে যাব আমি এসব?
-আমি জানি মিথিলদা, চাইলে তুমি করতে পারো । কিন্তু করবে কেন? ইটস্‌ আ মিলিয়ন ডলার কোয়েশ্চেন! আসলে জানো সম্পর্কটা যে জায়গায় থেমে গেছে এর চেয়ে আর এগোনোর ছিল না বলেই বোধহয় সুতোটা কেটে গেছিল। কিন্তু আমি সত্যি ভাবিনি তুমি আজ এতো হিসেব কষবে ।আজ বুঝছি জীবনে তো কত ভুলি করেছি এটাও একরকমের ভুলই । এর চেয়ে ভালো ছিল তুমি যদি বলতে এই কাজটার বিনিময়ে তুমি আমাকে আগের মতই কাছে ধরে রাখতে চাও। তবু বুঝতাম আজও আমার প্রতি তোমার কিছু ভালোলাগা আছে। কিন্তু আজ তো তোমার কোনো চাওয়াই নেই আমার কাছে …তাই কেনই বা ভাববে তুমি আমার কথা? ঠিক বলেছ তুমি …..একেবারে ঠিক!!!
মিনিট খানেক চুপ করে থেকে কঙ্কা সিট ছেড়ে উঠে পড়ল । তারপর নিঃশব্দে এগিয়ে গেল সামনের দিকে ।পিছনে ফিরে মিথিলকে দেখার ইচ্ছেটা শেষবারের মত সংবরণ করল।

_____________________________________ক্রমশ

  
This entry is part 5 of 6 in the series বল মন 'সুখ' বল
পর্ব – ৫।

অফিস থেকে বেরিয়ে এল কঙ্কা। বছরের শেষদিন । ডিসেম্বর মাস। কড়া ঠান্ডা। আলোকিত পথঘাট , হোটেল , রেস্তরাঁ গাছপালা সব কিছু ঝলমল করছে নতুন বছরের অপেক্ষায়। চারিদিকে বেশ মানুষের ঢল , জনজোয়ার বইতে শুরু করেছে কলকাতার আনাচে-কানাচে…পার্ক স্ট্রীটের অলি গলি পাকস্থলিতে । সবাই কত কত খুশি। কিন্তু কঙ্কার মনটা অস্থির লাগছে , কিছুটা এই বিসদৃশ ঘটনার জন্য কিছুটা বা মিথিলের জন্য। কঙ্কা জানে মিথিল এমন নয়… আর আজকের এই কথার তেমন তাৎপর্যও নেই… হয়ত মিথিলের কিছুই করার নেই , তাই নিজের অপারগতা ঢাকতেই এমন অভিনয় করল সে। কঙ্কার বাসবকে চিনতে ভুল হলেও মিথিলকে চিনতে তার এতটুকুও ভুল হয় নি। কিন্তু বাসবকে সে কি বলবে ? এই ভাবনা ভাবতে ভাবতেই কঙ্কার ফোন বেজে উঠল… ‘আলো আলো রঙ, জমকালো চাঁদ ধুয়ে যায়/ চেনা শোনা মুখ, জানা শোনা হাত ছুঁয়ে যায়, ধীরে ধীরে ঘুম ঘিরে ঘিরে গান রেখে যায়/ কিছু মিছু রাত পিছু পিছু টান ডেকে যায়’ …..বাসবের ফোন। …স্ক্রীনের দিকে তাকিয়ে প্রবল অনীহায় ফোনটা ধরতে বাধ্য হল কঙ্কা। বাসবকে এড়িয়ে তো যাওয়া যাবে না, পেরিয়ে যেতে হবে কিম্বা বলা ভালো মাড়িয়েই যেতে হবে।
-হ্যালো
-কি কথা হল তোমার বুড়ো বয়ফ্রেন্ডের সাথে?
-ওভাবে বলছো কেন?
-আচ্ছা, বুড়ো বললাম বলে বুঝি রাগ হল?
-নাহ , বয়ফ্রেন্ড বলছ বলে গায়ে লাগছে।
– সরি সরি…এক্স বয়ফ্রেন্ড…এবার ঠিক আছে তো।
-চুপ কর ভালো লাগছে না আমার।
-কেন পুরোনো প্রেম উথলে উঠেছে বুঝি। কি মুখে উত্তর নেই কেন?
-ভাল্লাগছে না কথা বলতে।
-তা লাগবে কেন? আমি যে বর তা ওই বর্বরটা কি বলল। আমার ব্যাপারটা একটু সেট করে দেবে কি? তোমার সাথে এতো যে সময় কাটালো তা কি এমনি এমনি? ইন্টারেস্ট দিতে হবে তো!
-কিসের ইন্টারেস্ট? কি সব বলছ?
-ও তুমি বুঝবে না …ছাড়ো। তা বলছেটা কি শুনি ? তুমি আদৌ বলেছ নাকি শুধু নাকে কেঁদে এলে?
– বাজে কথা কেন বলছ ? বলেছিলাম … কিন্তু দেরি হয়ে গেছে…আগে হলে হয়ত হত কিন্তু এখন আর সম্ভব নয়। ফাইনাল লিস্টিং হয়ে গেছে।
-আচ্ছা তাই নাকি …তা বলতে পারতে তোমার প্রানসখাকে এটা সেটিং করে দিলে আমি না হয় অ্যালাও করতাম কদিনের জন্য কলকাতার বাইরে কোনো রিসোর্টে ।
-প্লিজ বাসব স্টপ দিস ননসেন্স । তোমার কার্যোদ্ধারের জন্য তুমি কতটা নিচে নামতে পারো তা আমার অজানা নয়।
-আহা চটছ কেন ? নীচে তো তোমরা নিজেরাই নেমেছ সবার আড়ালে , আমি তো সেই আড়াল তুলে দিয়েছি……তবে আড়ালে আবডালে থাকা কেন? তার চাইতে খুললাম খুল্লাই তো ভালো। তাই না…আমারও কাজ হত তোমারও সুখ হত ।
-সুখ?? সুখ কাকে বলে তুমি জানো নাকি বাসব ? যবে থেকে তোমার হাত ধরে পথে নেমেছি সুখের ঠিকানা আমি পথেই হারিয়েছি। …আর সুখ খুঁজিনা আমি তোমার মাঝে , বুঝেছ। সুখ দিতে হবে না আমায় পারলে একটু শান্তি দাও ।
প্রচন্ড একটা ঘৃণায় ফোনটা কেটে দিল কঙ্কা। একটা ট্যাক্সি আসছিল সামনে …হাত দেখিয়ে তাতে উঠে পড়ল । চোখটা কেমন জ্বালা জ্বালা করছে …কঙ্কার মন বলছে যেদিকে দুচোখ যায় চলে যাবে …কিন্তু বুবুন ? তার কি হবে ? …ছেলেটা যে এখনও ছোটো। গায়ের চাদরটা মুখের কাছে টেনে কান্না চাপতে চাপতে ,মিথিলকে বলতে না পারা কথাগুলো কঙকা নিজের মনেই আওড়ে গেলো , ‘ মিথিলদা, সত্যি আমার কিছুই চাওয়ার ছিল না তোমার কাছে । আমি জানি, তুমি আমায় আজও ভালোবাসো …আর বাসো বলেই বোধহয় আজ তুমি আমায় এমন কঠিন কথায় ফিরিয়ে দিলে …আমি জানি, তুমি আমার থেকে সরে থাকতে চাও নি , কিন্তু বাসব যে আমাকে দিনের পর দিন ইচ্ছে করে তোমার দিকে ঠেলে দিচ্ছিল কিছু সুবিধে পাবার লোভে,আর এটা জানতে পারার পরই আমি সরে যেতে চেয়েছি তোমার জীবন থেকে। তার জন্য আমাকে অনেক কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে মিথিলদা … ।তবু বাসবের অভিসন্ধি আমি কিছুতেই সত্যি হয়ে উঠতে দিই নি ,আর দেবও না। …বারে বারে মনে হয়েছে তোমার কাছে ছুটে যাই …, খোলা হাওয়ায় বুক ভরে শ্বাস নিই কিন্তু পরক্ষনেই মনে হয়েছে এর সুযোগ বাসব নেবে। নাহ কিছুতেই না …তোমার থেকে দূরে থাকতে হবে আমাকে । নিজের সাজানো পরিকল্পনা ভেস্তে যেতে দেখে রাগে অন্ধ হয়ে গেছে বাসব । তোমার ক্ষতি করার ভয় দেখিয়েছে…তোমার অফিসে পরিবারে বদনাম করার হুমকি দিয়েছে । ভেবেছিলাম , জানো তোমাকে সব বলব , কিন্তু যেদিন তুমি অভিমান করে আমার ফোন ধরবে না বলেছিলে, সেদিন ভেবেছিলাম এই বেশ হয়েছে …ধীরে ধীরে আমি তোমার চোখের আড়াল হতে হতে তোমার মনের আড়ালও হয়ে যাব ।শুধু একটাই কষ্ট মনের মধ্যে তোলপার করত…তুমি ভুল বুঝলে আমাকে। …… তাই বিশ্বাস করো একবার শুধু তোমার সাথে দেখা করে সব জানাব বলেই , বাসবকে মিথ্যে বলে কাজের অছিলায় তোমার দ্বারস্থ হয়েছিলাম। কিন্তু এসে মনে হল …কি আর বলব তোমায়? … তোমার ওই চোখ, তোমার ওই না বলা কথা , কফি কাপ হাত তুলে দেওয়ার অজুহাতে আঙ্গুলে আঙ্গুল ছোঁয়ানো, আপাত গাম্ভীর্যয় মনে হল আবার বুঝি তোমাকে দুর্বল করে ফেললাম !!! সত্যি কথাগুলো সব বললে , হয়ত আবার তোমাকে ঘেঁটে ফেলব…!!! অগত্যা প্রসঙ্গটা বদলাতে বাসবের কথা তুললাম, ভাবলাম বলেই ফেলি বাসবের কথা তোমাকে , সত্যি যদি বাসবের কাজটা তুমি করে দিতে পার…যদি ব্যাবসাটা একটু ঠিক হয়,তাহলে বাসবের অমানবিকতাটা কিছুটা কমলে হয়ত দুর্বিষহ জীবনটা একটু একটু করে নতুন বছরে আলোর মুখ দেখবে নয়ত নিজেকে তোমার চোখে খারাপ করে সারাজীবনের মত অন্ধকারে মুখ লুকিয়ে রাখব । নাহ আর তোমায় আমি কোনোভাবেই বিরক্ত করব না মিথিলদা , আজ থেকে আমি তোমায় আমায় ভালোবাসার সমস্ত দায় থেকে মুক্তি দিলাম…’।
মোবাইলে বাসবের ফোন নম্বরের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে থাকতে জলে ঝাপসা হয়ে উঠল তার চোখ দুটো। অবশেষে কঙ্কা মোবাইলের কন্ট্যাক্টসে গিয়ে মিথিলের ফোন নম্বরটা ডিলিট করে দিল তার ফোন থেকে । যেন চিরকালের মত সমস্ত পিছুটানকে অস্বীকার করে কঙ্কা তার অতীতের পাতা উলটে ফেলতে চাইল বর্ষশেষের শেষবেলায়। যেন তার আগামী জীবনের সমস্ত টানাপোড়েনে মিথিলের স্মৃতির বোঝাকে সমাধিস্থ করে ফেলতে চাইল । কিন্তু চাইলেই কি সব পারা যায়???? …অগত্যা পড়ে রইল শুধু একরাশ আত্মখননের দীর্ঘশ্বাস আর তার নতুন বছরের নতুন যুদ্ধ শুরুর ভাবনা। …আর এইভাবনার দীর্ঘসূত্রতা কে সঙ্গে করেই কঙ্কার গাড়ি এগিয়ে চলল কলকাতা শহরের মধ্যে দিয়ে তার নিজের বৃত্তের কেন্দ্রবিন্দুর দিকে, আলো আলো রাত আর জমকালো চাঁদকে পিছনে ফেলে ।

__________________________________________ক্রমশ

 

  
This entry is part 6 of 6 in the series বল মন 'সুখ' বল

পর্ব – ৬। (শেষ পর্ব )

কঙ্কার চলে যাওয়াটাকে অনুসরণ করে মিথিল মনে মনে বলে উঠল… ‘প্লিজ কঙ্কা , প্লিজ আমাকে ভুল বুঝো না। আমি তোমাকে আঘাত না করলে তুমি হয়ত আরও একবার দুর্বল হয়ে যেতে আমার ওপর । কিন্তু সত্যি বলতে, তুমি তো তোমার জায়গায় ঠিকই ছিলে কঙ্কা… আজ এতদিন পরে তোমাকে এত কাছ থেকে দেখে আমি বুঝেছি, সম্পর্ক ভেঙ্গে দিয়েছ কিন্তু আমাকে মন থেকে সরিয়ে রাখতে তুমিও পারোনি.. …চেষ্টা করেছ মাত্র…হয়ত ক্ষত বিক্ষত হয়েছ তুমিও। …সেদিন তোমার কথাগুলো না বুঝলেও তোমার চলে যাবার পর প্রতিটা মুহুর্তে , বিশেষত সৃঞ্জার চাওয়ায় ওকে সঙ্গ দেওয়ার মুহুর্তে আমি বুঝেছি দিনের পর দিন আমি ভেবে বাসবের হাতে নিজেকে ছেড়ে দিতে তোমার কি যন্ত্রণাটাই না হত! আমার সত্যি তোমার প্রতি আর কোনও অভিযোগ নেই কঙ্কা। আমি আজও চাই তোমাকে আমার পাশে পেতে কিন্তু পরিণতি তো সেই একটাই …যন্ত্রণা!!! নতুন করে কিছু যখন দিতে পারব না তোমাকে , কি লাভ তোমার জীবনটাকে আবারো এলোমেলো করে দিয়ে!!!’

…… কঙ্কার বেরিয়ে যাবার পর এসব ভাবত ভাবতে বেশ কিছুক্ষণ ফাঁকা অফিসে চুপ করে বসে রইল মিথিল । তারপর কঙ্কার প্রতি অদ্ভুত এক মমতায় জে .কে.কন্সট্রাকশনের এর ওনারকে ফোন করল মিথিল।
-হ্যালো মিঃ কুমার! একটু কথা ছিল,কনফিডেন্সিয়াল!!! বিজি নাকি?
-না না আমি ফ্রি আছি আপাতত , কি কথা বলুন ।
– আচ্ছা দেখুন তো বাসব সিনহা অ্যান্ড এন্টারপ্রাইজ থেকে যে রেট টা কোট করা হয়েছে সেটা অরিজিনাল থেকে কতটা ডিফার করছে………
-আপনি কি বাসব সিনহা অ্যান্ড এন্টারপ্রাইজকে রেফার করছেন?
-না ঠিক তা নয় , আসলে উনি আমার বিশেষ পরিচিত । যদি রেট টা লোয়েস্ট কোটের কাছাকাছি থাকে তবে কি একবার ডেকে পাঠিয়ে কথা বলে দেখবেন ? …কিন্তু প্লিজ আমার রেফারেন্স দেবেন না যেন ।
-ব্যস ব্যস… মিঃ সেনগুপ্তা আর বলতে হবে না , আমি দেখে নেব । তবে আজ তো আমার অফিস বন্ধ হয়ে গেছে, কালও ছুটি , যদি পসিবেল হয় , তবে কথা বলে কালই আপনাকে কনফার্ম করে দেব । কারন দু তারিখেই তো বেলা দুটোর পর অফিসিয়ালি কোটেশন ডিক্লিয়ার করতে হবে।
-থ্যাঙ্ক ইউ মিঃ কুমার…থ্যাঙ্ক ইউ সো মাচ। আপনি দেখলেই হবে… প্লিজ ডোন্ট টেক ইট আদারওয়াইজ।
– ইটস ওকে মিঃ সেনগুপ্তা…আই উইল ট্রাই মাই লেভেল বেস্ট। তবে আপনি যে মিটিং-এ বলেছিলেন যা হবে সব লিগালি!!!সেটা রাখা গেল নাত শেষ পর্যন্ত ? বাট সাপ্লায়ার ভালো তো?
-হোপ সো…আই অ্যাম রিয়েলি সরি মিঃ কুমার…
– সরি বলার কিছু নেই…ইটস নাথিং বাট অ্যান আন্ডারস্ট্যান্ডিং মিঃ সেনগুপ্তা । তবে মালটা ঠিকঠাক সাপ্লাই করলেই হল ।
– হ্যাঁ …সেটাই …ওকে বাই , রাখছি মিঃ কুমার, আমাকেও বেরোতে হবে, থ্যাঙ্কস আগেইন …এনজয় ইওরসেলফ।
……ফোনটা ছেড়ে দিয়ে চুপ করে বসে রইল মিথিল…মনে মনে ভাবল …যা মন থেকে মানি না তাও তোমার জন্যই করলাম কঙ্কা… এই কম্প্রমাইসটুকু হয়ত পরে ভারি ঠেকবে তবুও করলাম… শুধু তুমি একটু ভালো থেক কঙ্কা আমি আর কিছু চাই না। …নাহ আর বসে থাকলে চলবে না বেশ দেরি হয়ে গেল…এখনি সৃঞ্জা ফোন করবে।’
…গৌরদাকে অফিস বন্ধ করতে বলে বাইরে বেরিয়ে এল মিথিল। কলকাতা আজ সত্যি তিলোত্তমা সাজে সেজে উঠেছে। ইংরেজ দুশো বছর রাজত্ব করে গেছে বলে পুরোনো কলকাতার সাহেবিয়ানার গন্ধটা আজও কেমন যেন অক্ষত রয়ে গেছে। হাঁটতে হাঁটতে ফ্লুরিজের দিকে এগোতে লাগল মিথিল। মামমামের জন্য কেক আর মেয়োনিজ কিনতে হবে, সঙ্গে একটা গিফটও… যেতে যেতে চারপাশের এত ভিড়ের মাঝেও মিথিলের নিজেকে কেমন একা একা লাগছিল, একটা বুক চাপা কষ্ট তার মনের ভেতরটাকে দুমড়ে মুচড়ে পিষে ফেলছিল…ঝাঁ চকচকে শহরের কেতাদুরস্ত এই জীবনটা যেন কেমন দুর্বিষহ হয়ে উঠছিল ক্রমশ । কি করছে , কেন করছে সবই অর্থহীন । মনটা আজ আবার নতুন করে বিষন্ন লাগছিল তার । ইচ্ছে করছিল না রাতের জলসায় যেতে কিন্তু না গেলে সৃঞ্জা অশান্তি করবে…অগত্যা আর উপায় কি ? মনে মনে বলল মিথিল , ‘কেন এলে কঙ্কা ? আবার কেন এলে …আর এলেই যখন , কেন চলে গেলে !!! …হঠাৎ পিটারক্যাটের সামনের রাস্তায় একটা গাড়ির হেডলাইটের আলোয় মিথিলের চোখে পড়ল রাস্তার ফুটপাথের আধো আলো আধো ছায়ায় কতকগুলো রাস্তার কুকুরের সাথে ঠান্ডায় গুটিসুটি মেরে বসে আছে সকালের সেই বাচ্ছা ভিখারি ছেলেটা। গায়ে একটা ছোটো ছেঁড়া সোয়েটার আর নোংরা হাফ প্যান্ট । কি মনে হল মিথিলের , ছেলেটার দিকে এগিয়ে গেল সে । কাছে গিয়ে জিগ্যেস করল ,
-কিরে সকালে খুব লেগেছিল না ?
-না সাহিব, লাগে নি আমার।
-ঠিক তো ?
-হাঁ সাহিব।
মিথিল বলল ‘কি নাম তোর ? তোর সাথে কেউ থাকে না?’
-ছোটু নাম আছে সাহিব। আমার সাথে আরও কয়েকটা ছেলে থাকে , এখন ওরা হোটেলের বাসন সাফা করছে, আমি তো পারবনা তাই…
তাকিয়ে দেখল মিথিল ছেলেটার পা দুটো অকেজো …কিন্তু মুখটা কেমন মায়াবি…একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, পকেট থেকে একটা পাঁচশ টাকার নোট বার করে একটু ইতস্তত করে ছেলেটার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে মিথিল বলল,
– এই নে ধর । এটা তোর।
–এত্তো টাকা সাহিব!
-হুম …যা খুশি , কিনে খাস।
অপটু ইংরেজি শব্দে সে মিথিলকে একটা সেলাম ঠুকে বলল,
-থ্যাঙ্কু সাহিব।
ছেলেটার ফাঁকা মাথায় হাত দিয়ে মিথিল কিছু ভাবল, তারপর নিজের গলা থেকে কঙ্কার দেওয়া মাফলারটা সযত্নে খুলে ছেলেটার মাথায় জড়িয়ে দিল । খুশিতে উচ্ছ্বল হয়ে ছেলেটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে থাকল মাফলারটা । ছেলেটাকে খুশি দেখে মিথিলের মনে হল তার টাকাটার চেয়েও এই মাফলারটা বোধহয় তাকে বেশি সুখী করে তুলল…। এক্টা অদ্ভুত ভালোলাগায় চোখটা জলে চিকচিক করে উঠল মিথিলের । ততক্ষনে পকেটে ফোনটা ভাইব্রেট করছে । পকেট থেকে মোবাইলটা বার করে ফোনটা ধরল মিথিল । সৃঞ্জার ফোন…..,
-হ্যালো, কোথায়? আমি কখন থেকে রেডি হয়ে আছি, মিটিং হল তোমার?
-হ্যাঁ আমি বেরিয়ে পড়েছি , ফ্লুরিজে যাচ্ছি মামমামের জন্য কেক নিতে …তুমি ওখানেই চলে এস।
…মিথিল ফোনটা পকেটে রেখে ছেলেটার দিকে তাকাতেই সে খুশি খুশি বলে উঠল,
-গুড বাই সাহিব। হ্যাপ্পি নিউ ইয়ের …।
মিথিল বাচ্ছাটার দিকে তাকিয়ে একটু হেসে আলগোছে বলল , ‘হ্যাপি নিউ ইয়ার…ছোটু’ তারপর সামনের রাস্তা পেরিয়ে ফ্লুরিজের দিকে এগিয়ে চলল আর মনে মনে ভাবল ‘এরা কি অল্পেতেই সুখী … আসলে সুখ জিনিসটা বড় গোলমেলে’ …কিন্তু সুখ কাকে বলে ? সুখের পরিভাষাটা কি? সুখের অনুভুতিটা কেন এমন তরল? কেন এমন অস্থায়ী? তা খুঁজতে খুঁজতে মিথিল তার গন্তব্যের খুব কাছে পৌঁছে গেল …তবু কিন্তু তার প্রশ্নের কোনও সদুত্তর পেল না মিথিল… সুখ যেন মরীচিকা!!! কেমন যেন হেঁয়ালির মতই মনে হল সব …শুধু মনের কোণে অজান্তেই একটা গানের দুটো কলি বেজে ঊঠল,
‘ বল মন সুখ বল , বলে চল অবিরল , তোর সুখ নামে যদি সুখ আসে জীবনে
বল মন বলে চল, না ভেবেই ফলাফল, যদি তোর ডাকে বসন্ত আসে শ্রাবনে’।
____________________________________________________শেষ

  
PAGE TOP
HTML Snippets Powered By : XYZScripts.com
Copy Protected by Chetans WP-Copyprotect.
Skip to toolbar