এক্সাইডের মোড়ে যাদবপুরের মিনিবাস থেকে নামতে নামতে …বাসটা টেনে এগিয়ে নিয়ে গেল বেশ কিছুটা । 

-উফ কি বিরক্তিকর! দূর বাবা!

একরাশ বিরক্তি নিয়ে নিজের মনেই স্বগোতোক্তি করল মোহর ।একে তো বেশ রাত হয়ে গেছে তার ওপর আবার রাস্তার মাঝে ডিভাইডার….এমন একটা জায়গায় বাসটা দাঁড়ালো …নয় ওদিকে থিয়েটার রোডের ক্রসিং এ যাও নয়ত ফ্লাইওভারের নিচে দিয়ে নন্দনের দিকে যাও …কন্ডাক্টারের ওপর রাগে গা জ্বলে যাচ্ছিল মোহরের …অগত্যা সামনের দিকে এগিয়ে থিয়েটার রোডের ক্রসিং পেরিয়ে বিড়লা প্ল্যানাটোরিয়ামের পাশ দিয়ে হেঁটে এসে বিড়লা বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়ালো মোহর । ঝোড়ো হাওয়া দিচ্ছে …কেমন যেন আকাশটা ঘোলাটে হয়ে আছে …বাসস্ট্যান্ডটা বেশ ফাঁকা ফাঁকা …এখন কতক্ষন দাঁড়াতে হবে পরের বাসের জন্য কে জানে? …বাড়ি ফেরাটা এত ঝক্কি হয় বলেই মোহর চাই নি কলেজের ফাংশানে পারফর্ম করতে ।কারন রিহার্শাল দিতে তো সেই সর্বানী ম্যামের বাড়ি যেতে হবে , কিন্তু কি করবে …মোহর যে আবার কলেজের কালচারাল সেক্রেটারী, নাও বলা যায় না… মাথাটা যন্ত্রনায় ছিঁড়ে যাচ্ছে…। এমন সময় ব্যাগে মোবাইলটা ভাইব্রেট করছে…ফোনের স্ক্রীনে শো করছে মা কলিং…

-হুম্‌ বলো…

-কিরে কোথায় , রাত্তির দশটা বেজে গেল তো!

-এই তো বিড়লার সামনে দাঁড়িয়ে …না বাস না ট্যাক্সি!!!

-সেকি রে !!!

-অত ভাবার কিছু হয়নি । পৌঁছে যাব ।

-এত দেরি… এরপর তোর ম্যামকে না বলে দিবি আর করতে হবে না ফাংশান। খাওয়া নেই দাওয়া নেই…

-একটা বাস আসছে বোধহয়, দেখতে পাচ্ছি না ঠিকমতো নাম্বারটা… রাখছি বাড়ি গিয়ে কথা হবে…চার্জ নেই … এখুনি ফোন কেটে যাবে।

ফোনটা কেটে মোহর একটু এগিয়ে গেল স্টপেজ ছেড়ে …নাহ অন্য রুটের বাস।

এলোমেলো হাওয়ায় চোখে ধুলো ঢুকে যাচ্ছে…আশেপাশেও তেমন আলো নেই শুধু বিড়লার সামনের স্ট্রীট লাইটটা জ্বলছে। মোহর একটু এগিয়ে লাইট পোস্টের নিচে এসে দাঁড়ালো। সামনের ক্রসিং-এ একটা বাইকে তিনটে ছেলে , হাত পা ছুঁড়ছে , দাঁত বার করে হাসছে চালকের মাথায় যদি বা হেলমেট আছে , বাকি দুটোর তাও নেই, দিব্যি কলকাতা শহরে ঘুরে বেড়াচ্ছে …এর বেলা কারোর চোখেও পড়ে না …মোহর হাতের মোবাইলে কটা বাজে দেখতে গিয়ে দেখল মোবাইলটা নীরব, চার্জ শেষ…। ক্রসিং-এর লালাবাতির নিষেধ উঠে যেতেই গাঁক গাঁক করে বাইকটা প্রায় ওর গায়ের ওপর দিয়ে বেরিয়ে গেল, মোহর যেন আঁতকে উঠল …।

-বুলশীট… কি রাশ ড্রাইভিং…

ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল মোহর … বাইকটা থেমে গেছে ।পিছনের ছেলে দুটো ফিরে দেখছে মোহরকে …এবার ধীরে ধীরে আরোহীদের সাথে সাথে পা ঘষে ঘষে বাইক চালক ব্যাকে আনছে বাইকটাকে …ক্রমশঃ যেন তারই দিকে …… তার খুব কাছে এসে থেমে গেল বাইকটা । মোহরের নিজেকে কেমন যেন একটু দুর্বল লাগছিল…। গলার কাছটা কেমন শুকনো শুকনো….মোহর প্রমাদ গুণলো…মনে মনে বলল,

-কি রে বাবা …এত রাতে এ আবার কি বিপদ!

…সামনের ছেলেটা হেলমেটটা খুলে কিছু একটা চিবোতে চিবোতে মোহরের দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে বলল …

-যাবে নাকি? রেট কত?…

কথাটা শোনা মাত্রই মোহরের কান দিয়ে গরম কিছু একটা তার সারা শরীরে ছড়িয়ে যেতে লাগলো , পিছনের ছেলেটা মোহরের গেরুয়া কুর্তি, কালো জিনস , কাঁধ ব্যাগ থেকে শুরু করে আপাদ মস্তক জরীপ করল, তারপর তার মুখের কাছে দুটো হাজার টাকার নোট ধরে বলল, 

-এই চেসিসে এর চেয়ে বেশি দেওয়া যায় না জানু।   

-হোয়াট রাবিশ? ইউ বাস্টার্ড …

বলে চেঁচিয়ে উঠতেই একটা ছেলে বাইকে বসেই মোহরের হাতটা ধরে টান মারল…মোহর এক হ্যাঁচকা টানে হাত ছাড়িয়ে উর্ধশ্বাসে কিছুটা দৌড় দিয়ে জোরে জোরে হাঁটা লাগালো সামনের দিকে , আর বুঝলো কি ভুলটাই না করল সে…সামনের সেন্ট পল’স ক্যাথিড্রাল চার্চের রাস্তাটা আরও ফাঁকা …আর বেশ অন্ধকারও । রাস্তার ফ্লোরটালিতে তার জুতোর হীলটাও কেমন স্লিপ করে যাচ্ছে । পিছনে তাকিয়ে দেখল মোহর…ছেলেগুলোর মুখে তখন কেমন যেন একটা যুদ্ধ জয়ের হাসি …ভাবটা হল- ‘যতই ছোটো আমার গাড়ির সাথে পারবে থোড়ি!!’  তাই বোধহয় একটু খেলিয়ে খেলিয়েই শিকার ধরার ইচ্ছেতে তারা মোহরকে এগোতে দিল ফাঁকা রাস্তাটার দিকে।  বাইকের ইন্ডিকেটরের লাল আলোটা জ্বলছে নিভছে ….. মোহর ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল ছেলেগুলো বাইকটা স্টার্ট দিচ্ছে …মোহরের কেমন যেন ভয় ভয় করতে লাগলো এবার…হঠাৎ আধো আলো আধো ছায়ায় মুখোমুখি একটি ছেলেকে আসতে দেখল মোহর …ছেলেটা বেশ লম্বা…পরনে সাদা টিশার্ট আর নীল জিন্‌স ,পিঠে ব্যাগ , মুখে সিগারেট , এক হাতে মোবাইল নিয়ে কি করছে যেন…কানে ব্লুটুথ…যত কাছে আসছে ছেলেটাকে তার কেমন চেনা চেনা মনে হচ্ছে …হ্যাঁ হ্যাঁ তার চেনাই তো …  স্কুল লাইফে একসাথে লাইফ সায়েন্স পড়ত বি. কে ম্যামের কোচিং-এ …উত্তেজনায় নামটা মনে পড়ছে না …কি যেন? কি যেন …… দুত্তোর নামে কি যায় আসে …হ্যাঁ হ্যাঁ মনে পড়েছে প্রতি…, না প্রমি… প্রমিত হ্যাঁ… প্রমিতই তো … ডাকবে নাকি জোরে …বলবে ছেলেগুলো জ্বালাচ্ছে …কিন্তু আগে তো কোনওদিন তেমন কথাই বলে নি… অত ভাবার সময় নেই… ছেলেগুলো এদিকেই আসছে …মোহর আর একটু জোরে হেঁটে সামনের দিকে এগিয়ে নিজে থেকেই বলল,

-আরে প্রমিত না…কিরে কেমন আছিস ? কি করছিস এখন?

প্রমিত হাতের মোবাইলটা পকেটে পুরে মুখের সিগারেটটা লুকিয়ে নিয়ে কেমন যেন লাজুক হেসে বলল,

-তুই মোহর না? …বি. কে মিসের কোচিং…তাইতো? ভালো আছিস।

-হ্যাঁ তো… চিনতে পেরেছিস তাহলে ? কোথায় গেছিলি? বাড়ি ফিরবি তো চল , তাহলে একসাথেই যাব।

-হুম…বাড়ি তো যাবই । ঐ এক বন্ধুর বাড়ি গেছিলাম ভবানীপুরে , ও নামিয়ে দিয়ে গেল বাইকে , কিন্তু রবীন্দ্রসদন থেকে কোনও ট্যাক্সি যেতে চাইছে না , তাই এদিকে আসছিলাম …কথার ফাঁকে মোহর দেখল ছেলেগুলো দাঁড়িয়ে গেছে কিছুটা দূরে, দেখছে ওদের দিকে চেয়ে …মোহরের কেমন যেন ইচ্ছে করছিল প্রমিতের হাতটা ধরে ওদের সামনে দিয়ে দেখাতে দেখাতে হেঁটে যায়… আর বলে ‘দেখ এই আমার মাসিহা ‘  ..কিন্তু ব্যাপারটা একটু বেশিই বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে । কিছুটা এগোতেই প্রমিত বলল ,

-তুই কোথায় গেছিলে …আর এত রাতে একা একা এদিকে হেঁটে আসছিস কেন? 

-গেছিলাম যাদবপুরে, … ওইদিকে বাস শেয়ারট্যাক্সি কিছুই নেই …তাই এদিকে এগিয়ে দেখছিলাম…

হঠাৎ একটা শেয়ার ট্যাক্সি পাশ থেকে হেঁকে উঠল ‘মন্দিরতলা,মন্দিরতলা’ …মোহর বলল ‘যাব যাব’…নিজে ট্যাক্সির দরজায় হাত রেখে পিছনে তাকিয়ে বলল…

– কিরে যাবি তো?

– হুম ওঠ।

প্রমিত দরজাটা খুলে দিল… তারপর দুজনেই পিছনের সিটে উঠে বসলো পাশাপাশি …রবীন্দ্রসদন থেকে আরও কয়েকজন উঠল …গাড়ি ভরে গেল… ফাঁকা রাস্তা ,  বিনা সিগন্যালে এক নিমেষে গাড়ি সেকেন্ড হুগলী ব্রিজে উঠে পড়ল…মোহরের মনে পড়ছিল …প্রমিত ছেলেটা কেমন যেন ছিল…পড়াশোনা করত না… ক্যাবলা ক্যাবলা …সবাই হাসতো ওর বোকা বোকা কথায় ওকে নিয়ে…তারপর ক্লাস টেনে উঠে তো কেমন একটা বাজে হয়ে গেছিল, আজেবাজে ছেলেদের সাথে মিশতো, সবাই বলত গাঁজা খায় , মদ খায় , ব্লুফিল্ম দেখে …সাথে সাথে লুকটাও কেমন একটা চোয়াড়ে চোয়াড়ে হয়ে গেছিল … কোনো অবস্থাতেই প্রমিতের সাথে কথা বলার কোনো প্রবৃত্তি হত না …হয়ও নি এতদিন….কেমন যেন লো গ্রেডেড মনে হত… কোচিং থেকে ফেরার পথে একা থাকলে , রাস্তার মোড়ে ওর মত ছেলে দেখলে তখন ভয় ভয়ই লাগত…এড়িয়েই যেত…..সেইজন্যই রাস্তা ঘাটে বাজারে দোকানে ওকে চোখেও পড়লেও কোনদিন চেনা দিতে ইচ্ছেই করে নি …মনেও হয় নি এই ছেলেটার কি যেন নাম ?…অথচ আজ এমন একটা অবস্থায় মোহর যেন কিছুটা সময়ের জন্য ওর কাছেই নিজেকে নিরাপদ মনে করছিল …সত্যি মানুষ কেন যে এত সহজে ভালো আর মন্দের বিচার করতে চায় কে জানে? আসলে ভালোমন্দ ব্যাপারটা খুব রিলেটিভ , আজ আমার কাছে যা ভালো তা অন্যের কাছে খারাপ…আবার হয়ত অন্যের কাছে যা ভালো তা আমার কাছে খারাপ। এটা নির্ভর করে মানুষের অ্যাক্সেপ্টিবিলিটির ওপর । … টোল প্লাজার কাছে আসতেই ড্রাইভার বলল ‘খুচরো আছে কারো কাছে ?’ প্রমিত পকেট থেকে একটা পঞ্চাশ টাকার নোট এগিয়ে দিয়ে বলল,

– এই নিন দাদা…আমাদের দুজনেরটা …

-আরে একি তুই দিচ্ছিস কেন?

-কেন কি হয়েছে? দিতে পারি না? বন্ধু বললি তো…

-না … মানে হ্যাঁ… বন্ধু তো কিন্তু …তবে।

-আরে ছাড় না…আসলে তুই এত ভালো মেয়ে , আমার মত ছেলে তোর বন্ধু হতেই পারে না…আমি জানি…এনি ওয়ে… যাদবপুরে কি পড়তে যাস নাকি?

– কলেজ তো ওখানেই ,কিন্তু এখন কলেজে ফাংশানের জন্য রিহার্শালে গিয়েছিলাম একজন ম্যাডামের বাড়িতে ।

-ওহ…হ্যাঁ তুই তো খুব ভাল গান করতিস …তবে এত রাত করিস না ফিরতে , …জানিস ই তো দিনকাল খারাপ …ঐ ফাঁকা বাস স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে ছিলি… দেখেছিলি কতকগুলো ছেলে বাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল…চারিদিকে কত কি ঘটছে শুনতে তো পাস, কাগজেও তো পড়িস…

-তুই কি করছিস এখন?

-এই তো বি.কম কমপ্লিট করলাম কোনোক্রমে …এবার একটু কাজের খোঁজ খবর করতে হবে…তুই?

– বি.টেক ফাইনাল ইয়ার…

……ট্যাক্সিটা মন্দিরতলার কাছে এসে পাঁচটা পাঁচটা দশটা স্পিড ব্রেকারে লাফাতা লাফাতে  নামলো…। তারপর স্লোপিং-এ গড়িয়ে এসে থামলো সমতলে…গাড়ির দরজা খুলে একে একে  সবাই নেমে  টাকা দিতে ব্যস্ত …প্রমিত আর মোহরের তো ভাড়া আগেই দেওয়া হয়ে গেছে.. তাই ওরা বাসস্ট্যান্ডের শেডের দিকে এগিয়ে গেল… প্রমিত বলল,

– কিরে এগিয়ে দিতে হবে নাকি…

-না না যাহ…

-নাহ রাত হয়ে গেছে তো?

-তো কি হয়েছে?..এই রাস্তায় আবার ভয় কি। বাই দ্য ওয়ে থ্যাঙ্কস আ লট প্রমিত…ইউ আর রিয়ালি আ ভেরি গুড পার্সন…

-বলছিস।

-একদিন আসিস না …আমাদের বাড়ি ।

-যদি বন্ধু ভাবিস নিশ্চয়ই যাব। আমার বাড়ির রাস্তা কিন্তু তোর বাড়ির উল্টোদিকে..। ওকে এগোলাম তবে টাটা…বাই দ্য ওয়ে এবার রাস্তায় দেখলে চিনতে পারবি তো …তবে একটু ভুল করে ফেলেছিস …আমার নাম প্রমিত নয় , প্রতীম …… আসলে কোনওদিন কথা বলিস নি তো… চল এগো এবার… ঝড় উঠবে মনে হয় …দমকা হাওয়া দিচ্ছে …ওকে বাই, টেক কেয়ার… গুড নাইট।

-ওহ সরি সরি…

-ইট্‌স ওকে , বাই।

-ইয়া বাই, গুড নাইট। …এইবলে মোহর একরাশ অস্বস্তি নিয়ে অবাক চোখে ওর দিকে তাকিয়ে রইল…

আর প্রমিত থুরি প্রতীম মন্দিরতলা বাসস্ট্যান্ড ছাড়িয়ে এগিয়ে গেল সামনের একটা পানের দোকানের দিকে …বলল,

-মামা আজ একটা কিং সাইজ দাও দেখি…

তারপর দড়ির আগুনে সিগারেট জ্বালিয়ে নিয়ে, দু-দুবার ঘাড়টা ওপর নিচ ডানদিক বাঁদিক করে ঘুরিয়ে অন্ধকার গলিতে মিলিয়ে গেল।  

  

খুব সাবধানে শ্বাস প্রশ্বাসের ওঠাপড়া সামলে টেবিলে রাখা কেকের ওপর ঝুঁকে পড়ে আম্রপালী লিখছিল…“ জীর্ণ পুরাতন যাক ভেসে যাক” । এক হাতে ক্রিম কোন …আর অন্য হাতটা পিছনে রেখে…দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁটটা কামড়ে ধরে খুব মনযোগে তাকিয়ে ছিল লেখাটার দিকে…। পাশ থেকে আদৃতা বলে উঠল…”ফ্যাবুলাস মাম্মা…এক্সেলেন্ট হয়েছে ” …….লেখাটা লিখতে পেরে আম্রপালীর একটা পরিতৃপ্তি হল । আজ বছরের শেষ দিন । আদৃতার কিছু বন্ধুবান্ধব আসবে থার্টিফার্ষ্ট নাইট সেলেব্রেশনে । আর তারই প্রস্তুতিতে এই কেক বানানো । কে বলবে আম্রপালী আর আদৃতা , মা ও মেয়ে… দুজনেই হুল্লোরবাজ । আম্রপালী একটি কাগজের অফিসে সহসম্পাদক আর প্রাচী ওর অফিস কলিগ । প্রাচী আজ ওদের সাথে সহযোগিতায় আছে । কেক সাজানো শেষ হতেই আদৃতা এবার মেতে গেল ঘর সাজানোয় ।

প্রাচী বলল “আদৃতা কত বড়ো হয়ে গেল !”
পালিঃ হুম , তো ?
প্রাচীঃ তা ওর কোনও বয়ফ্রেন্ড হয়েছে নাকি রে?
পালিঃ দাঁড়া আগে আমার বয়ফ্রেন্ড হওয়া শেষ হোক তারপর তো!
প্রাচীঃ যাঃ …ইটস টু মাচ…ও শুনলে কি ভাববে?
পালিঃ ও জানে …মাঝে মাঝে আমাকে রাগায় তো ? বলে প্লিজ মাম্মা তুমি আর আমার আঙ্কেলের সংখ্যা বাড়িও না…আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি নাম মনে রাখতে রাখতে ।
আমি বলি “তোর নাম মনে রাখার দরকার কি ? আমার মনে থাকলেই হবে ।”
দুজনেই হেসে ওঠে ……দুপুরে লাঞ্চ করে বিকালে প্রাচী বেরিয়ে যায় ।
সন্ধ্যেবেলা সারা ঘরটা , লাইট মিউজিক …স্টারস, স্ট্রিমারস , ল্যানটার্ন , লাল নীল আলোয় যেন বদলে গেল । আদৃতার বন্ধুরা সব আসতে শুরু করে দিয়েছে…। হাই আন্টি …হ্যালো আন্টি……পালী ওদেরকে একটু স্পেস দিয়ে উঠে আসে দোতলায় নিজের ঘরে…টিভি চলছে বটে ……কিন্তু পালীর মন কোথায় ?……..ফোনটা নিয়ে একটু নাড়াঘাঁটা করে ভাবে “ দীপ্রকে একটা ফোন করলে হত”……দীপ্রর ফোনটা বেশ কিছুক্ষন রিং হয়ে কেটে যায় । পালীর মনটাও কেমন যেন একটু ভারী ভারী লাগে।
……ছোটোবেলায় বাইরে বাইরে মানুষ হয়েছে পালী , একটা সময় ছিল জামাকাপড়ের মত বয়ফ্রেন্ড বদলাতো …খালি খালি প্রেমে পড়ে যেত…কারোর কথা বলার ধরনে …কারোর হাতের লেখায়…কারোর হাসিতে…কারোর তাকানোয়……কিন্তু কিছুদিন ঘোরাফেরা , খাওয়া-দাওয়ার পর দমটা বন্ধ হয়ে যেত শাসনের ঘনঘটায় । ভাবত কেন এত অধিকারবোধ মানুষের ? দীপ্রর সাথে বিয়ের পর , এমনকি আদৃতা হওয়ার পরও , তার মনটা পালাই পালাই করত । …দীপ্রদের উত্তর কোলকাতার বনেদীয়ানা , অযাচিত শাসন , চোরা চোখের চাউনি, সর্বোপরি আচার বিচার , না-এর বেড়াজালে প্রতিনিয়ত হাঁফিয়ে উঠেছিল আম্রপালী । দীপ্র জানতো তার পক্ষে এইসব আভিজাত্য কাটিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভবই নয়……তাই আর আটকায়নি আম্রপালীকে……আদৃতাকে নিয়ে পালী এসে উঠেছিল তার বাবার বাড়িতে……শেষমেশ দুই পরিবারের চাপে ডাইভোর্সটা হয়েও গিয়েছিল…। কিন্তু দীপ্র আদৃতার সব দায়িত্ব নিয়েছিল। পালীর কোনো ওজোর আপত্তি শোনেনি। ছোটোবেলা থেকেই আদৃতা দেখেছে বাবা মা দুটো ভিন্ন পরিবেশে থাকে…। কিন্তু পরম আস্থায় দুজনে দুজনের পাশে থাকে । …দুজনেই দুভাবে ভালবাসায় তার মনোভাবে স্বাধীনতা এনে দিয়েছিল তাই…বন্ধন আর মুক্তির সংজ্ঞাটা তার কাছে একটু অন্যরকম ।
এই একবছর হল দীপ্র নিউজার্সি গেছে অফিসের কাজে……আগে দুজনে দুবাড়িতে থেকেছে ……দুই শহরে থেকেছে……কিন্তু এতদূরে…এতদিন একে অপরকে না দেখে থাকেনি কখনও । তাই পালী কিন্তু এত বন্ধুর মাঝেও , বন্ধনের টানটা অনুভব করে দীপ্রর সাথেই…..একেবারে মন থেকে …মাঝে মাঝে শরীর থেকেও । এইসব ভাবতে ভাবতে কখন যে তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছিল পালী!……দীপ্রর ফোনে রেশটা কেটে গেল । ফোন ধরে পালী বলল………
হ্যালো
হ্যালো…ফোন করেছিলে…? আমি ড্রাইভ করছিলাম …এই অফিসে ঢুকলাম …বলো কি খবর ? আদৃতা কি করছে ?
ও বন্ধুদের সাথে পার্টিতে নিচের ঘরে…আমি টিভি দেখছি ।
কেন …তোমার ভক্তরা আজ কেউ তোমাকে সঙ্গ দিল না?
যাঃ কি যে বলো…ওরা তো টাইম পাস ……
কি বলছো…এলেবেলে ? এমন সীতাভক্ত হনুমান সব…
তোমার পার্টি সার্টি নেই?
আছে তো ……সবেতো সকাল……সন্ধ্যেটা হতে দাও!!
তুমি কবে আসবে দীপ্র ?…এক বছরে বেশ ক্লান্ত লাগছে আমার…
সে কি…আজ এতো বছর পরে ? তুমি তো এটাই চেয়েছিলে পালী?
তুমিও তো আটকাওনি?
আটকালে কি মানতে তখন ?
চেষ্টাতো করে দেখতে পারতে?
তাই বুঝি ? আচ্ছা এবার ফিরে গিয়ে দেখব ? বাই দ্য ওয়ে আগাম শুভ নববর্ষ
হুম, সেম টু ইউ…তুমি ফিরে এসো দীপ্র…আই উইল ওয়েট ফর ইউ…
ফোনটা কেটে নিজের মনে একটু হেসে এক দু ফোঁটা চোখের জল মুছতে না মুছতেই , দমকা হাওয়ার মত ঘরে ঢুকল আদৃতা…। ঘড়িটা দেখিয়ে পালীর গলা জড়িয়ে ধরে বলল………
“মাম্মা স্টার্টস কাউন্ট ডাউন…….লেটস কাউন্ট …নাইন , এইট , সেভেন , সিক্স , ফাইভ , ফোর , থ্রী , টু , ওয়ান……জিরো …হ্যাপি নিউ ইয়ার টু ইউ !!!!!!!”


  

বারোতলার ওপর থেকে নিচে ব্যস্ত কলকাতা দেখতে বিতানের বেশ লাগে। কাচের জানলা ভেদ করেও কেমন যেন দুপুরের মিঠেকড়া রোদ্দুরটায় গা গরম হয়ে ওঠে। কেবিনে বিতানের সাথে থাকে তার প্রাইভেট সেক্রেটারি রাজু পট্টনায়ক…। ওড়িশার ছেলে, বাংলা কথায় বেশ টান। ইন্টারকাম এ ফোনটা ধরে রাজু বলে ” জাস্ট ওয়েট ম্যাম”……তারপর বিতান কে বলে, “স্যার ম্যাডাম লাইনে আছেন,” বিতান বলে …”ওহো মিটিং-এ ছিলাম মোবাইল সাইলেন্ট ছিল…। মোবাইলে রিং করতে বলো।”

পকেট থেকে বিতান ফোন বার করা মাত্রই রিং হতে থাকে…। রুচিরার ফোন ……
হ্যালো
কি হ্যালো…কটা মিসড্ কল আছে দেখেছ?
আমি মিটিং-এ ছিলাম রুচি। …ফোন সাইলেন্ট ছিল…সরি বলো।
রুচিরা আদুরে গলায় বলে…ভাইব্রেট করে রাখতে কি হয় …। জানোই তো কখন কি দরকার পড়বে ফোন করতে হবে!
কেন আবার কি হল?
এই জানো…তোজো আজ বাঁ দিকে পাশ ফিরে গেছে ঘুমের ঘোরে…। তারপর হাতটা টেনে বার করতে না পেরে কি কান্না …আমার এত আনন্দ হচ্ছিল তোমায় না জানিয়ে পারলাম না……বাব্বা এখন উলটে গিয়ে কি ফোঁপানো……যেমন বাবা তার তেমন ছেলে! একটুতেই আহা উহু…
বিতান একটু হাসল…বললো…তাই বুঝি ? ভালোই তো এইভাবে ধীরে ধীরে বসতে দাঁড়াতে শিখবে আর তোমার সময় কেটে যাবে ।
ও তাই বুঝি …তা আমাকে খেলনা দিয়ে ভুলিয়ে রেখে তুমি কি করবে শুনি? নতুন করে প্রেম??
যাহ , তাই বললাম নাকি? যাক লাঞ্চ করেছ…ঠিক সময়ে খাওয়া দাওয়াটা কর …এখন কটা মাস একটু সময় মেনে চলো রুচি!
হুম আমি খেয়েছি …তুমি??
হ্যাঁ …আচ্ছা এখন রাখছি আবার একটু পর মিটিং আছে…বাই…

কথোপকথন শেষে ফোন রেখে বিতান একটা লম্বা শ্বাস নিল। মাথার পিছনে হাত দুটো রেখে আড়মোরা ভেঙ্গে চেয়ারটা ঘুরিয়ে সটান পিছনে ফিরে দেখল ……ঝকঝকে শীতের আকাশ…আশেপাশে ছোটবড়ো অফিস বাড়ি …বিজ্ঞাপনের হোর্ডিং …এইসব টপকেও দূরে দেখা যাচ্ছে শহীদ মিনার …একদল পরিযায়ী পাখির দল উড়ে যাচ্ছে আকাশের অনেকটা উঁচু দিয়ে……কত দূর থেকে ওরা আসে ভাবতে ভাবতে বিতান হারিয়ে গেল শীতকালের অজানা এক দুপুরে …কমলা লেবুর গন্ধে আর হানি বানির হই হই শব্দে……
এই দাদা দে না আমার ব্যাট টা…
আমি আঙ্কেলের সাথে খেলব…
“বানি…. হানিকে ব্যাটটা একটু দাও না”..বেশ জোরের সঙ্গে বলল দময়ন্তী ।
না না ,হানি তুমি আমার টা নিয়ে দাদার সাথে খেল আমি হাঁফিয়ে গেছি…এই বলে দময়ন্তীর পাশে এসে ঝুপ করে খোলা মাঠে শুয়ে পড়ল বিতান। দময়ন্তীকে বলল … “ আজকের আউটিংটা তোমার কেমন লাগল ম্যাডাম?”
দময়ন্তী বিতানের চশমাটা নাকের ডগা থেকে একটু ভেতরের দিকে ঠেলে দিয়ে বলল …… “ হুম তা বেশ লাগল। কিন্তু তুমি ওদের অভ্যেস খারাপ করে দিচ্ছো বিতান।”

একথা কেন বলছ?

এই যে উইকেন্ডে খালি বেড়ানো ঘোরা…হই চই মজা…। আমিও নিয়ে বেরোই… কিন্তু এত হুল্লোড় তো হয় না …তুমি ওদের অভ্যেস হয়ে উঠছো ধীরে ধীরে।

ক্ষতি কি দময়ন্তী ? আমি কি পারি না তোমাদের এই অসম্পূর্ণ সামতলিক ক্ষেত্রটা পরিপূর্ণ করতে?

না বিতান…সেটা হয় না…দেখ, তুমি আমার চেয়ে পাঁচ-ছ বছরের ছোট …যদিও জানি ভালবাসায় বয়সটা বাধা হতে পারে না……তাও তোমরা যৌথ পরিবারে থাক……এখনও তোমার দাদু আছেন , জ্যাঠামশাই আছেন …এমন একটা মেয়েকে বিয়ে করে ঘরে তুলবে যে তোমার চেয়ে বড়ো? …যার দুটো বাচ্ছা আছে?……বাড়িতে সবাই আপত্তি করবেন।

আমরা আলাদা থাকব দময়ন্তী। চারজনের সুন্দর একটা সংসার হবে । আমি মাকে বুঝিয়ে নিতে পারব …বাকিরা হয়তো মানবেন না।

না না , বিতান কারোর মনে কষ্ট দিয়ে ভালো থাকা যায় না…। তোমার সামনে গোটা জীবন পড়ে আছে। আজ ভাবতে ভাল লাগছে কিন্তু কিছুদিন পর বুঝবে সমাজ মানে তো কোনো বাক্সবন্দি ঘর নয়, যার বাইরে তুমি স্বচ্ছন্দ…বরং তোমার ওই ঘরটার বাইরেটাই সমাজ…তোমার চারপাশের সবাই … বন্ধুবান্ধব , অফিস , ক্লাব সর্বত্র যখন এই নিয়ে আলোচনা হবে তুমি ধীরে ধীরে ক্লান্ত হয়ে পড়বে……কি দরকার আছে বলো…তার চেয়ে পাশে থেকো , তাহলেই হবে।

কিন্তু দময়ন্তী সত্যি বলতে হানি বানি বড়ো হচ্ছে … আজ আঙ্কেল বলে মেনে নিচ্ছে কিন্তু কাল যদি প্রশ্ন করে , তুমি তার কি উত্তর দেবে ভেবেছ?

কিছক্ষন চুপ করে থাকে দময়ন্তী…তারপর বলে…”সেই জন্যই তো বলছি, তুমি একটা বিয়ে করো বিতান…আমি তো কোথাও পালাচ্ছি না… আর সত্যি বলতে তোমার এই নিঃসঙ্গ জীবনে কাউকে তো প্রয়োজন …আমি তো হানি বানিতেই আবদ্ধ হয়ে যাব……কিন্তু তোমার একাকীত্ব তোমাকে আরও বেশি কষ্ট দেবে…দেখবে একটা সময় পরে আমার এই নেশাটা তোমার কেটে যাবে।”

নেশা ? কি বলছো তুমি …ভালবাসি না বলতে চাও?

ডেফিনেটলি বাসো…কিন্তু দেখো, আমিই তো হানি বানির মা আবার বাবাও …যতদিন অনীশ আরেকটা বিয়ে করে নি আমি পাঠিয়েছি ওদের বাবার কাছে, কিন্তু এখন আর হানি যেতে চায় না…আর বানি যতই তোমাকে আঁকড়ে ধরুক আমি জানি ওর বাবার জায়গায় ও কোনোদিন তোমাকে মানতে পারবে না… আর তোমার কিই বা বয়স বিতান…এখনও তিরিশের ঘরে পা রাখোনি…।

……কিন্তু আজ বিতান তিরিশ ছাড়িয়ে তেত্রিশে পৌঁছেছে…। কতোগুলো বছর কেটে গেল…রুচিরার সাথে বিয়ে হয়েছে…. আড়াই মাস হল তোজো হয়েছে, তবুও মনের কোনে হানি বানি রয়েই গেছে…শুরুর সেই দিনগুলো আজও তাকে এক অদ্ভুত অনুভুতি দেয়…পারাদ্বীপে পোস্টিং এর সময় অনীশদা আর দময়ন্তীর ছোট্ট পরিবারটার সাথে তার খুব পরিচিতি হয়েছিল । তারপর যত গভীরে গেছে, দেখেছে ততই অন্তঃসারশূন্য…অনীশদা থাকে তার মত আর দময়ন্তী যেন হানি বানিকে সামলাতেই ব্যস্ত। তাদের সব কিছুতে সে একাই থাকে । বেশ কয়েকমাস পরে এক রাত্রে দময়ন্তী হানি বানিকে নিয়ে এসেছিল তার কোয়ার্টারে । সেদিন অনীশদা সম্পর্কের শেষ সুতোটুকুও ছিঁড়ে ফেলেছিল। সেইথেকে দময়ন্তীকে যেন একা ছেড়েও ছাড়তে পারে নি বিতান ……তাকে পৌঁছে দিয়েছিল তার দাদার বাড়ি। মাঝে মাঝে দেখা করতেও গেছে……ধীরে ধীরে ঘনিষ্ঠতা বেড়ে যায় …একা দময়ন্তী…আর তার একাকীত্ব……সাথে সাথে দুই ছেলে মেয়ের দায়িত্ব…। তার ওপর অনীশের দ্বিতীয়বার বিয়ে ,দময়ন্তীকে কিছুটা সময়ের জন্য বড়ো এলোমেলো করে দিয়েছিল…আঁকড়ে ধরেছিল বিতানকে……কিন্তু যত দিন গেছে ততই তার নিজেকে অপরাধী মনে হয়েছে। অবশেষে অনেক কষ্টে নিজের চাওয়া পাওয়াগুলোকে সামলেছে দময়ন্তী। বিতানেরও খুব কষ্ট হয়েছিল তার থেকে দূরে সরে থাকতে …। অপমানে আর অভিমানে পুড়ে গিয়েছিল বিতান। তার জীবনে সত্যি বলতে দময়ন্তী এমন একজন নারী ছিল ,যে সমস্ত সম্পর্কের ধারক ও বাহক হয়ে উঠেছিল…সেদিন ঘোর অভিমান হলেও আজ সে বুঝেছে, দময়ন্তী তার ভালই চেয়েছিল…সত্যি আজ সে ভালোই আছে রুচিরা আর তোজোকে নিয়ে কিন্তু যখনই অফিসের কাজে পারাদ্বীপ যেতে হয় তার ভীষণ মন কেমন করে …মনটা ছটফট করে দময়ন্তীকে একবার দেখার জন্যে। যদিও বিতান বিয়েতে কার্ড পাঠিয়েছিল, কিন্তু দময়ন্তী আসে নি ।……বিতান জানে আসতে পারে নি…পারা যায় না বোধহয় , তবে খুব সুন্দর একজোড়া কানের দুল পাঠিয়েছিলো ভিপি করে…এখনও রুচিরা ওই কানের দুল দুটো পরে। আর যখনই পড়ে , তার লাল পাথর থেকে আলো ঠিকরে , যেন শেষবার দেখা দময়ন্তীর সেই আরক্ত মুখটার কথা বিতান কে মনে করিয়ে দেয়। বিতানের মনটা ভাগাভাগি হয়ে যায় রুচিরা আর দময়ন্তীর মাঝে ।
………কেবিনের দরজা ঠেলে রাজু ফাইল হাতে এসে দাঁড়ালো টেবিলের সামনে… “ স্যার জি.কে. ব্রাদার্সের নিউ প্রজেক্টটা পাশ হয়ে গেছে …আমি কি ফোন করে জানিয়ে দেব মিস্টার রাউতকে?”
……বিতান ঘুরতে একটু সময় নিল …তারপর চশমার ঝাপসা কাচটা মুছে বলল… “আমি ফোন করে নেব…তুমি একবার টেন্ডার রিপোর্টটা নিয়ে এস তো” … রাজু হাতের ফাইলটা টেবিলে রেখে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল টেন্ডার রিপোর্ট আনতে…আর বিতান টেবিলে রাখা ফাইলটা খুলল ………। তার মুখের মানচিত্রটা একটু হলেও কি বদলে যাবে না…… যখন দেখবে নিউ প্রজেক্ট শুরু হচ্ছে পারাদ্বীপে…???

  

অনিকেতকে বুঝতে সবারই বেশ ভুল হয় ।ওর ধাঁচটা অনেকটা নারকেলের মত। ওপর থেকে যতই শক্ত হোক ভেতরটা কিন্তু নরম সাদাই।আজকাল সারাদিন লোহা পট্টিতে বসে থেকে থেকে অনিকেতের মনে হয় তার আর মন বলে কিছুই নেই, সবই কেমন যেন মেটালিক হয়ে গেছে…যেটুকু রাগ অনুরাগ ছিল তাতেও বোধহয় মরচে ধরে গেছে। বাপ ঠাকুরদার ব্যবসা , ভাল না লাগলেও ছেড়ে তো আর দিতে পারে না……সর্বোপরি সে ব্যবসায় যখন লাভজনক একটা অঙ্ক মাসের শেষে আয় হয়…তাই সারাদিন এই কালিকা হার্ডওয়ার্সের ঝাঁপ খুলে রাখতেই হয়… তারপর কয়েকজন কর্মচারীও তো সেই বাবার আমল থেকেই রয়ে গেছে।
সে আগে একটা সময় ছিল যখন বন্ধুমহলে অনিকেত লাহার একটা দরের জায়গা ছিল।আর দেখতে শুনতে তো বেশ ভালই ছিল তাই তার প্রেমিকার অভাব কোনোদিনই ছিল না।কিন্তু কোন প্রেমটাই বেশি দিন টিকতো না তার ওই খামখেয়ালী হাভভাব আর সাবেকি দেমাকটার জন্য। সবচেয়ে বড়ো কথা খুব সহজে মহিলামহলে তার কথার নেশা জমাতে পারলেও প্রেম টিকিয়ে রাখার বশীকরন মন্ত্রটা তার অজানাই ছিল।
অনিকেতের বন্ধু মৈনাক ছিল তার হরিহর আত্মা। মৈনাকের বোন ছুটকী … ভাল নাম ময়ুরাক্ষী। ময়ুরাক্ষীকে তার বেশ লাগত। আসলে ময়ুরাক্ষীর মধ্যে ওই ন্যাকা ন্যাকা প্রেম প্রেম ভাবটা কোনোদিনই ছিল না। ময়ুরাক্ষী ডানাকাটা পরী না হলেও বেশ সুন্দরীই ছিল। কিন্তু তার অনিকেত কে তেমন আহামরি কোনদিনই লাগে নি। তবু মেয়েরা যেহেতু ছেলেদের চোখের ভাষা খুব ভালই বোঝে, তাই ছুটকীরও বুঝতে অসুবিধে হত না কতটা প্রশ্রয় সে অনিকে দেবে আর কতটা তার কাকিমার ভাইপো সৌরভকে দেবে! ময়ুরাক্ষীর এই অবজ্ঞাটাই অনিকেতকে ভেতর থেকে যেমন জ্বালিয়ে দিয়েছিল তেমনি দক্ষিণ চব্বিশ-পরগনার ছেলে সৌরভকে তার প্রতিদ্বন্দী করে তুলেছিল। কলকাতার বুকে চার চারটে বাড়ি আর তিন তিনটে গাড়ির মালিকানা থাকা সত্ত্বেও অনিকেত লাহা যে, ময়ুরাক্ষীর চোখে সামান্য এক সরকারি ডাক্তার সৌরভের সমকক্ষও নয় … একথা ভাবলেই নিজেকে ভীষণ অসহায় লাগত অনির।এই অভিমানটাই ময়ুরাক্ষীর থেকে তাকে অনেকটা সরিয়ে নিয়েছিল ধীরে ধীরে। মৈনাক চাকরী পেয়ে শিলিগুড়ি চলে যাবার পর থেকে যোগাযোগটাই কমিয়েই দিয়েছিল অনি ওই বাড়ির সাথে। তবু অনিকেতের ইমশানটাকে নিয়ে ময়ুরাক্ষী কম ছেলেখেলা করেনি।
…..ছুটির দিন অনি বাড়ি বসে বেগম আখতারের গান শুনছে বাবুর মত মন নিয়ে , বেশ ফুরফুরে মেজাজ..এমন সময় ফোন বেজে উঠল দালানের । উত্তর কলকাতার বনেদী বাড়ি। বাড়িময় দাসদাসী … একজন ফোন ধরে জিগ্যেস করলেন …… “কাকে চাইছেন”
অনিকেত দা আছেন?
ধরুন ডেকে দিচ্ছি,
পাশের ঘর থেকে অনি এসে ফোন ধরল … “হ্যালো”
“আমি ছুটকী”…যেন কান দিয়ে এক সুরেলা ঝরনার রিনিঝিনি মাধুরী অনির সারা শরীরে বয়ে গেল ।
কি ব্যস্ত আছো অনি দা?
অদ্ভুত একটা ভাল লাগায় আচ্ছন্ন হয়ে অনি বলল …না ওই একটু গান শুনছিলাম আর কি। তা হঠাৎ কি মনে করে…?
না আজ সন্ধ্যায় আমাদের বাড়িতে একটা জলসা আছে মায়ের তরফ থেকে আমি নিমন্ত্রণ করলাম, দাদা তো নেই এখানে তাই…এসো কিন্তু অবশ্যই ।
কিসের জলসা?
এলেই বুঝতে পারবে।
আচ্ছা ঠিক আছে , যাব ক্ষনি।
অনির মনটা যেন এখন থেকেই ঘরের চৌকাঠ পেরিয়ে ময়ুরাক্ষীর বাড়ির গেটের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইল ।যাবে না ,যাবে না করেও সন্ধ্যেবেলা গাড়ি নিয়ে গেল অনি ময়ুরাক্ষীর বাড়ি….. আর গিয়েই বুঝল ময়ুরাক্ষী কি রসিকতাটাই না তার সাথে করেছে…মাসিমা খুব আপ্যায়ন করলেন যদিও…কিন্তু মৈনাকের দায়িত্বটাও চাপিয়ে দিলেন অনির ওপর…আর জলসা বলেতো কিছুই ছিল না যেটা ছিল সেটা হল সৌরভ আর ছুটকীর পাটিপত্র…মানে বিবাহের পুর্বে আশীর্বাদ…অনির খুব, খুব খারাপ লেগেছিল ছুটকীর এই ব্যবহার… বলতে গেলে মনটা ভেঙ্গেই গিয়েছিল…..শুধুমাত্র মাসিমার কথা ভেবে বেরিয়ে আসতে পারেনি… তার চোখের সামনেই ওদের আশীর্বাদ হয়ে গেল …অপমানে আহত অনি কেমন হিমশীতল হয়ে গিয়েছিল…… অনির সেই মুখে কি দেখেছিল ময়ুরাক্ষী কে জানে……তবে তার যে এমন মজা করাটা উচিত হয় নি সেটা খুব বুঝেছিল সে।কিন্তু সেদিন সবার মাঝে আর কিছু বলে উঠতে পারে নি অনিকে।তারপর যতবার ফোন করেছে, অনি ফোন ধরে নি…এমন কি বিয়ের দিন যায়ও নি… কিন্তু তারপর থেকে ময়ূরাক্ষীও যেন একটু সমঝে গেছিল…আর বিয়েরদিন সন্ধ্যে বেলা থেকে বারে বারে খোঁজ নিয়েছিল অনিকেত দা এসেছে কিনা…বিয়ের আসরেও তার কেমন যেন অস্থির লেগেছে নিজেকে…যাহোক অবশেষে বিয়েটা হয়েই গেল।অনিও আর ওদের বাড়িমুখো হয়নি বছর খানেক…এত বড়ো অপমান সে জীবনে ভুলতে পারবে না …এই অভিমানে মৈনাকের সাথে যোগাযোগটাও বিছিন্ন করে দিয়েছিল…তার নিজের একমাত্র লক্ষ বলতে ছিল ব্যবসা আর মনোরঞ্জন বলতে নাটক দেখা…ব্যস…জীবন থমকে গিয়েছিল …প্রেম বিষয়টা তার কাছে বিষ হয়ে উঠেছিল…যত নারীসঙ্গ সব কেমন যেন পানসে লাগতে শুরু করেছিল তার …তার পৌরুষে এমন ঘা মেরেছিল ময়ূরাক্ষী…যার জন্য সে ঠিক করেছিল কোনোদিন তাকে ক্ষমা করবে না…।
নিজের সীমাবদ্ধ গন্ডীর মধ্যে প্রতি শুক্রবার কি শনিবার অ্যাকাডেমী তে নাটক দেখা…সেদিনও ঠিক নিয়ম করে দুপুর বেলা গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে অ্যাকাডেমী চত্বরে এসে টিকিট কেটে পরের শো এর জন্য অপেক্ষা করছিল অনি …হঠাৎ কোন এক নারী কন্ঠ পিছন থেকে ডেকে উঠল “ আরে অনিকেত দা না”…ঘুরে তাকিয়ে অনিকেত চমকে উঠল …এত ময়ুরাক্ষী! এতদিনের পুষে রাখা অভিমান কিন্তু তাকে দেখে তুঁসের আগুনের মত জ্বলে উঠল না ……খুব ভালো করে ময়ুরাক্ষীর মুখের দিকে তাকিয়ে বলল একা নাকি…? ময়ুরাক্ষী মুখ নিচু করে বলল “হুম…”
সেকি সৌরভ কোথায়?
না আমি একাই এসেছি …ও থাকে কোথায়?
ময়ুরাক্ষীর কিছু যেন বদল হয়েছে সেটা যে কি যদিও তা চোখেমুখে ধরা যাচ্ছে না কিন্তু আচরনে তা স্পষ্ট….. হাতে কিছুক্ষন সময় থাকায় টুকরো টাকরা কিছু কথা হল ……অনির বেশ লাগলেও পুরোনো ব্যাথাটা একটু একটু খোঁচা দিচ্ছিল বইকি…… তবুও সে তা প্রকাশ করতে পারল আর কোথায় ! ময়ুরাক্ষী ফোন নম্বর চেয়ে নিল নিজে থেকেই … তার অন্তত আর একবার অনির সাথে দেখা করার সাধটা পূর্ণ হল… কিন্তু সত্যিই পুরন হল কি ?…তার অপেক্ষাটা যেন আবার তৈরি হল …ইচ্ছেটাও যেন বেশ বেড়ে গেল। কদিন পর প্রথম ফোনটা ময়ুরাক্ষীই অনিকে করল…ঠাঠা রোদে দোকানে বসে অনির মনে হল কোনো শীতল জলধারা বয়ে গেল মনের ওপর দিয়ে…জুড়িয়ে গেল ভেতরটা ……আচ্ছা তার তো এমন ঠান্ডা ব্যবহার করার কথা নয় …তবুও কেন সে কঠিন হতে পারছে না সে নিজেও বুঝে উঠতে পারল না। শেষমেশ ময়ুরাক্ষী বলেই ফেলল “আমার কিছু কথা আছে অনি দা …তুমি একদিন আমার সাথে দেখা করতে পারো?” প্রথমে অনি এড়িয়ে গেল…কিন্তু ময়ুরাক্ষী নাছোড়বান্দা …ঠিক হল সপ্তাহ দুয়েক পর একটা শুক্রবার ওরা দেখা করবে অ্যাকাডেমী চত্বরে…অনি মনে মনে ভাবল, সেদিন সে জিগ্যেস করবেই কেন এমনটি করেছিল ময়ুরাক্ষী ?….নির্ধারিত শুক্রবারে দেখা হল দুজনের …একটু আগেই পৌঁছেছিলো দুজনে… অনি টিকিট কেটে গাছের নিচে বসলো… চিরকালের ঠোঁটকাটা অনি শেষে জিগ্যেস করেই বসলো ময়ুরাক্ষীকে। যদিও ময়ুরাক্ষী একটু অস্বস্তিতে পরে গেল প্রথমে, তবুও সরল সত্যটা ধীরে ধীরে স্বীকার করল …হ্যাঁ সে অনিকে অপদস্থ করার বাসনাতেই এমন করেছিল কিন্তু তারপর থেকেই তো সে মরমে মরেছে শুধু নয়…… কেমন ভাবে যেন অনির প্রতি দুর্বলও হয়ে পড়েছে……বিয়ের পর থেকে একটা দিনের জন্যও সে নিজেকে ক্ষমা করতে পারে নি, আর তার সমস্ত মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়িয়েছে এই অনিই। সব শুনে অনি মনে মনে হাসে আর ভাবে সত্যি প্রেম কি বিষম বস্তু !এতদিন ধরে যে অনি শুধুমাত্র একটু গুরুত্ব পেতে চেয়েছিল ময়ুরাক্ষীর চোখে আজ সেই ময়ুরাক্ষী তার সামনে দাঁড়িয়ে তাকে ভালোবেসে ফেলার কথা শোনাচ্ছে আর সে ভেবেই পাচ্ছে না কি উত্তর দেবে! অনিও বোধহয় এই একটা বছরে অনেক বদলে গেছে তার নিজের অগোচরে… আলগোছে খানিকটা সময় পেরিয়ে যাওয়ার পর অনিকেত বলল….“তকে কয়েকটা কথা বলি ছুটকী , একথা ঠিক যে আমি তোকে ভালবাসতাম …আর তাই বিয়ে করে একটা সম্মানজনক জায়গাও দিতে চেয়েছিলাম …কিন্তু তখন হয়তো তোর সৌরভকে আমার চেয়ে অনেক বেশি যোগ্য মনে হয়েছিল……সেটা হতেই পারে কিন্তু তাই বলে আমার ইমোশনটাকে নিয়ে তোর অমন করা উচিত হয়নি সেটা তুই নিজেও বুঝেছিস…যাক সে কথা…এবার আসি আজকের কথায় …আজও হয়ত আমি তোকে ভালবাসি… কিন্তু নিজের চাওয়াটাকে বাস্তবায়িত করব বলে আমি কিন্তু তোর সাথে কোনো পরকীয়া করতে পারব না…কারন সৌরভের না থাকার সুযোগ নিয়ে আজ তুই বলবি আমাকে অ্যাকাডেমীতে দেখা করতে …কাল বলবি নলবোন …পরশু মন্দারমনি বা দীঘার কোনো হোটেলে …ধীরে ধীরে মনের টানটা শুধুমাত্র শরীরের টান হয়ে উঠবে ……আর ভালোবাসাটা অপমানিত হবে লুকোচুরি খেলে…না …আমি ভালবাসাটাকে কোনোদিন এত নিচু করে দেখেনি …আর দেখতেও পারব না…”
ময়ুরাক্ষীঃ কিন্তু আমি তো আরও কিছু বলতে চেয়েছিলাম অনিদা…
অনিকেতঃ আমার কথা এখনও শেষ হয়নি ছুটকী…যদি কোনোদিন তোর মনে হয় সৌরভ তোর যোগ্য নয় এবং তুই ওই সম্পর্কটা থেকে পুরোপুরি বেরিয়ে আসতে চাস তবেই আমায় বলিস……ডেফিনেটলি আমি তোকে আপন করে নেব…আর সত্যি বলতে জীবনে নারীসঙ্গ আমি কম করি নি…তাই তোর কাছে আমি এমন আসঙ্গ চাই না…
ময়ুরাক্ষীঃ কিন্তু অনি দা আমি তো এত তাড়াতাড়ি এই সম্পর্ক থেকে বেরোতে পারবো না !
অনিকেতঃ সেটা তুই ভাব…বেরোতে চাইলে কোন কিছুই অসম্ভব নয়…কিন্তু কি চাস আগে বুঝে নে কারন আমি তোকে শ্যাম আর কূল দুই রাখতে কখনও বলব না…আর গোপন আভিসারিকা বলে তোকে মেনেও নিতে পারবো না…এবার তুই ভেবে দেখ…টেক ইওর টাইম… আমার আর কিছু বলার নেই…।……এই বলে ঘড়ির সময় দেখল অনি।কথায় কথায় নাটকের সময় কখন পেরিয়ে গেছে…… পাঞ্জাবির পকেটে রাখা টিকিট দুটো ছিঁড়ে ফেলে, অনি তার নতুন কেনা লাল ইনোভার দরজা খুলে ভেতরে গিয়ে বসলো।একবারের জন্যও সে পিছন ফিরে ময়ূরাক্ষীকে দেখল না।যদিও তার খুব ইচ্ছে করছিল ময়ুরাক্ষীর বাড়ানো হাতটা একবার ধরে,কিন্তু নিছক সময় কাটানোর সময় যে আর নেই অনির…গাড়ি ছাড়তে যতক্ষণ সময় নিল ততক্ষণ ময়ুরাক্ষী অপলক চেয়ে রইল অনিকেতের লাল গাড়িটার দিকে।অন্তঃদহনে পুড়ে যাচ্ছিল ময়ুরাক্ষী।ভেবে পাচ্ছিল না সত্যি অনিকেত তাকে ফিরিয়ে দিয়ে, তার অপমানের প্রতিশোধ নি্‌ল, নাকি তাকে দ্বিচারিতা থেকে সাবধান করল।কিছুটা গিয়ে গাড়িটা লালবাতির নিষেধে দাঁড়ালো, গাড়ির আয়নার মধ্যে দিয়ে অনি দেখল… বিবশ ময়ুরাক্ষী দাঁড়িয়ে আছে স্থবির হয়ে…আর গাড়ির কাচের বাইরে একটা বাচ্ছা ছেলে এক গোছা গোলাপ নিয়ে জিগ্যেস করছে “বাবু গোলাপ নেবেন…টাটকা লাল গোলাপ”!!…রাস্তার লাল আলো সবুজ হল…গাড়ি স্টার্ট নিয়ে রেড রোডের দিকে বেঁকে গেল..ক্রমশ সন্ধ্যের অন্ধকারে কাচের মধ্যে দিয়ে ময়ুরাক্ষী দূর থেকে দূরে সরে যেতে যেতে ঝাপসা হয়ে গেল…।

  
PAGE TOP
HTML Snippets Powered By : XYZScripts.com
Copy Protected by Chetans WP-Copyprotect.
Skip to toolbar