এক্সাইডের মোড়ে যাদবপুরের মিনিবাস থেকে নামতে নামতে …বাসটা টেনে এগিয়ে নিয়ে গেল বেশ কিছুটা ।
-উফ কি বিরক্তিকর! দূর বাবা!
একরাশ বিরক্তি নিয়ে নিজের মনেই স্বগোতোক্তি করল মোহর ।একে তো বেশ রাত হয়ে গেছে তার ওপর আবার রাস্তার মাঝে ডিভাইডার….এমন একটা জায়গায় বাসটা দাঁড়ালো …নয় ওদিকে থিয়েটার রোডের ক্রসিং এ যাও নয়ত ফ্লাইওভারের নিচে দিয়ে নন্দনের দিকে যাও …কন্ডাক্টারের ওপর রাগে গা জ্বলে যাচ্ছিল মোহরের …অগত্যা সামনের দিকে এগিয়ে থিয়েটার রোডের ক্রসিং পেরিয়ে বিড়লা প্ল্যানাটোরিয়ামের পাশ দিয়ে হেঁটে এসে বিড়লা বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়ালো মোহর । ঝোড়ো হাওয়া দিচ্ছে …কেমন যেন আকাশটা ঘোলাটে হয়ে আছে …বাসস্ট্যান্ডটা বেশ ফাঁকা ফাঁকা …এখন কতক্ষন দাঁড়াতে হবে পরের বাসের জন্য কে জানে? …বাড়ি ফেরাটা এত ঝক্কি হয় বলেই মোহর চাই নি কলেজের ফাংশানে পারফর্ম করতে ।কারন রিহার্শাল দিতে তো সেই সর্বানী ম্যামের বাড়ি যেতে হবে , কিন্তু কি করবে …মোহর যে আবার কলেজের কালচারাল সেক্রেটারী, নাও বলা যায় না… মাথাটা যন্ত্রনায় ছিঁড়ে যাচ্ছে…। এমন সময় ব্যাগে মোবাইলটা ভাইব্রেট করছে…ফোনের স্ক্রীনে শো করছে মা কলিং…
-হুম্ বলো…
-কিরে কোথায় , রাত্তির দশটা বেজে গেল তো!
-এই তো বিড়লার সামনে দাঁড়িয়ে …না বাস না ট্যাক্সি!!!
-সেকি রে !!!
-অত ভাবার কিছু হয়নি । পৌঁছে যাব ।
-এত দেরি… এরপর তোর ম্যামকে না বলে দিবি আর করতে হবে না ফাংশান। খাওয়া নেই দাওয়া নেই…
-একটা বাস আসছে বোধহয়, দেখতে পাচ্ছি না ঠিকমতো নাম্বারটা… রাখছি বাড়ি গিয়ে কথা হবে…চার্জ নেই … এখুনি ফোন কেটে যাবে।
ফোনটা কেটে মোহর একটু এগিয়ে গেল স্টপেজ ছেড়ে …নাহ অন্য রুটের বাস।
এলোমেলো হাওয়ায় চোখে ধুলো ঢুকে যাচ্ছে…আশেপাশেও তেমন আলো নেই শুধু বিড়লার সামনের স্ট্রীট লাইটটা জ্বলছে। মোহর একটু এগিয়ে লাইট পোস্টের নিচে এসে দাঁড়ালো। সামনের ক্রসিং-এ একটা বাইকে তিনটে ছেলে , হাত পা ছুঁড়ছে , দাঁত বার করে হাসছে চালকের মাথায় যদি বা হেলমেট আছে , বাকি দুটোর তাও নেই, দিব্যি কলকাতা শহরে ঘুরে বেড়াচ্ছে …এর বেলা কারোর চোখেও পড়ে না …মোহর হাতের মোবাইলে কটা বাজে দেখতে গিয়ে দেখল মোবাইলটা নীরব, চার্জ শেষ…। ক্রসিং-এর লালাবাতির নিষেধ উঠে যেতেই গাঁক গাঁক করে বাইকটা প্রায় ওর গায়ের ওপর দিয়ে বেরিয়ে গেল, মোহর যেন আঁতকে উঠল …।
-বুলশীট… কি রাশ ড্রাইভিং…
ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল মোহর … বাইকটা থেমে গেছে ।পিছনের ছেলে দুটো ফিরে দেখছে মোহরকে …এবার ধীরে ধীরে আরোহীদের সাথে সাথে পা ঘষে ঘষে বাইক চালক ব্যাকে আনছে বাইকটাকে …ক্রমশঃ যেন তারই দিকে …… তার খুব কাছে এসে থেমে গেল বাইকটা । মোহরের নিজেকে কেমন যেন একটু দুর্বল লাগছিল…। গলার কাছটা কেমন শুকনো শুকনো….মোহর প্রমাদ গুণলো…মনে মনে বলল,
-কি রে বাবা …এত রাতে এ আবার কি বিপদ!
…সামনের ছেলেটা হেলমেটটা খুলে কিছু একটা চিবোতে চিবোতে মোহরের দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে বলল …
-যাবে নাকি? রেট কত?…
কথাটা শোনা মাত্রই মোহরের কান দিয়ে গরম কিছু একটা তার সারা শরীরে ছড়িয়ে যেতে লাগলো , পিছনের ছেলেটা মোহরের গেরুয়া কুর্তি, কালো জিনস , কাঁধ ব্যাগ থেকে শুরু করে আপাদ মস্তক জরীপ করল, তারপর তার মুখের কাছে দুটো হাজার টাকার নোট ধরে বলল,
-এই চেসিসে এর চেয়ে বেশি দেওয়া যায় না জানু।
-হোয়াট রাবিশ? ইউ বাস্টার্ড …
বলে চেঁচিয়ে উঠতেই একটা ছেলে বাইকে বসেই মোহরের হাতটা ধরে টান মারল…মোহর এক হ্যাঁচকা টানে হাত ছাড়িয়ে উর্ধশ্বাসে কিছুটা দৌড় দিয়ে জোরে জোরে হাঁটা লাগালো সামনের দিকে , আর বুঝলো কি ভুলটাই না করল সে…সামনের সেন্ট পল’স ক্যাথিড্রাল চার্চের রাস্তাটা আরও ফাঁকা …আর বেশ অন্ধকারও । রাস্তার ফ্লোরটালিতে তার জুতোর হীলটাও কেমন স্লিপ করে যাচ্ছে । পিছনে তাকিয়ে দেখল মোহর…ছেলেগুলোর মুখে তখন কেমন যেন একটা যুদ্ধ জয়ের হাসি …ভাবটা হল- ‘যতই ছোটো আমার গাড়ির সাথে পারবে থোড়ি!!’ তাই বোধহয় একটু খেলিয়ে খেলিয়েই শিকার ধরার ইচ্ছেতে তারা মোহরকে এগোতে দিল ফাঁকা রাস্তাটার দিকে। বাইকের ইন্ডিকেটরের লাল আলোটা জ্বলছে নিভছে ….. মোহর ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল ছেলেগুলো বাইকটা স্টার্ট দিচ্ছে …মোহরের কেমন যেন ভয় ভয় করতে লাগলো এবার…হঠাৎ আধো আলো আধো ছায়ায় মুখোমুখি একটি ছেলেকে আসতে দেখল মোহর …ছেলেটা বেশ লম্বা…পরনে সাদা টিশার্ট আর নীল জিন্স ,পিঠে ব্যাগ , মুখে সিগারেট , এক হাতে মোবাইল নিয়ে কি করছে যেন…কানে ব্লুটুথ…যত কাছে আসছে ছেলেটাকে তার কেমন চেনা চেনা মনে হচ্ছে …হ্যাঁ হ্যাঁ তার চেনাই তো … স্কুল লাইফে একসাথে লাইফ সায়েন্স পড়ত বি. কে ম্যামের কোচিং-এ …উত্তেজনায় নামটা মনে পড়ছে না …কি যেন? কি যেন …… দুত্তোর নামে কি যায় আসে …হ্যাঁ হ্যাঁ মনে পড়েছে প্রতি…, না প্রমি… প্রমিত হ্যাঁ… প্রমিতই তো … ডাকবে নাকি জোরে …বলবে ছেলেগুলো জ্বালাচ্ছে …কিন্তু আগে তো কোনওদিন তেমন কথাই বলে নি… অত ভাবার সময় নেই… ছেলেগুলো এদিকেই আসছে …মোহর আর একটু জোরে হেঁটে সামনের দিকে এগিয়ে নিজে থেকেই বলল,
-আরে প্রমিত না…কিরে কেমন আছিস ? কি করছিস এখন?
প্রমিত হাতের মোবাইলটা পকেটে পুরে মুখের সিগারেটটা লুকিয়ে নিয়ে কেমন যেন লাজুক হেসে বলল,
-তুই মোহর না? …বি. কে মিসের কোচিং…তাইতো? ভালো আছিস।
-হ্যাঁ তো… চিনতে পেরেছিস তাহলে ? কোথায় গেছিলি? বাড়ি ফিরবি তো চল , তাহলে একসাথেই যাব।
-হুম…বাড়ি তো যাবই । ঐ এক বন্ধুর বাড়ি গেছিলাম ভবানীপুরে , ও নামিয়ে দিয়ে গেল বাইকে , কিন্তু রবীন্দ্রসদন থেকে কোনও ট্যাক্সি যেতে চাইছে না , তাই এদিকে আসছিলাম …কথার ফাঁকে মোহর দেখল ছেলেগুলো দাঁড়িয়ে গেছে কিছুটা দূরে, দেখছে ওদের দিকে চেয়ে …মোহরের কেমন যেন ইচ্ছে করছিল প্রমিতের হাতটা ধরে ওদের সামনে দিয়ে দেখাতে দেখাতে হেঁটে যায়… আর বলে ‘দেখ এই আমার মাসিহা ‘ ..কিন্তু ব্যাপারটা একটু বেশিই বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে । কিছুটা এগোতেই প্রমিত বলল ,
-তুই কোথায় গেছিলে …আর এত রাতে একা একা এদিকে হেঁটে আসছিস কেন?
-গেছিলাম যাদবপুরে, … ওইদিকে বাস শেয়ারট্যাক্সি কিছুই নেই …তাই এদিকে এগিয়ে দেখছিলাম…
হঠাৎ একটা শেয়ার ট্যাক্সি পাশ থেকে হেঁকে উঠল ‘মন্দিরতলা,মন্দিরতলা’ …মোহর বলল ‘যাব যাব’…নিজে ট্যাক্সির দরজায় হাত রেখে পিছনে তাকিয়ে বলল…
– কিরে যাবি তো?
– হুম ওঠ।
প্রমিত দরজাটা খুলে দিল… তারপর দুজনেই পিছনের সিটে উঠে বসলো পাশাপাশি …রবীন্দ্রসদন থেকে আরও কয়েকজন উঠল …গাড়ি ভরে গেল… ফাঁকা রাস্তা , বিনা সিগন্যালে এক নিমেষে গাড়ি সেকেন্ড হুগলী ব্রিজে উঠে পড়ল…মোহরের মনে পড়ছিল …প্রমিত ছেলেটা কেমন যেন ছিল…পড়াশোনা করত না… ক্যাবলা ক্যাবলা …সবাই হাসতো ওর বোকা বোকা কথায় ওকে নিয়ে…তারপর ক্লাস টেনে উঠে তো কেমন একটা বাজে হয়ে গেছিল, আজেবাজে ছেলেদের সাথে মিশতো, সবাই বলত গাঁজা খায় , মদ খায় , ব্লুফিল্ম দেখে …সাথে সাথে লুকটাও কেমন একটা চোয়াড়ে চোয়াড়ে হয়ে গেছিল … কোনো অবস্থাতেই প্রমিতের সাথে কথা বলার কোনো প্রবৃত্তি হত না …হয়ও নি এতদিন….কেমন যেন লো গ্রেডেড মনে হত… কোচিং থেকে ফেরার পথে একা থাকলে , রাস্তার মোড়ে ওর মত ছেলে দেখলে তখন ভয় ভয়ই লাগত…এড়িয়েই যেত…..সেইজন্যই রাস্তা ঘাটে বাজারে দোকানে ওকে চোখেও পড়লেও কোনদিন চেনা দিতে ইচ্ছেই করে নি …মনেও হয় নি এই ছেলেটার কি যেন নাম ?…অথচ আজ এমন একটা অবস্থায় মোহর যেন কিছুটা সময়ের জন্য ওর কাছেই নিজেকে নিরাপদ মনে করছিল …সত্যি মানুষ কেন যে এত সহজে ভালো আর মন্দের বিচার করতে চায় কে জানে? আসলে ভালোমন্দ ব্যাপারটা খুব রিলেটিভ , আজ আমার কাছে যা ভালো তা অন্যের কাছে খারাপ…আবার হয়ত অন্যের কাছে যা ভালো তা আমার কাছে খারাপ। এটা নির্ভর করে মানুষের অ্যাক্সেপ্টিবিলিটির ওপর । … টোল প্লাজার কাছে আসতেই ড্রাইভার বলল ‘খুচরো আছে কারো কাছে ?’ প্রমিত পকেট থেকে একটা পঞ্চাশ টাকার নোট এগিয়ে দিয়ে বলল,
– এই নিন দাদা…আমাদের দুজনেরটা …
-আরে একি তুই দিচ্ছিস কেন?
-কেন কি হয়েছে? দিতে পারি না? বন্ধু বললি তো…
-না … মানে হ্যাঁ… বন্ধু তো কিন্তু …তবে।
-আরে ছাড় না…আসলে তুই এত ভালো মেয়ে , আমার মত ছেলে তোর বন্ধু হতেই পারে না…আমি জানি…এনি ওয়ে… যাদবপুরে কি পড়তে যাস নাকি?
– কলেজ তো ওখানেই ,কিন্তু এখন কলেজে ফাংশানের জন্য রিহার্শালে গিয়েছিলাম একজন ম্যাডামের বাড়িতে ।
-ওহ…হ্যাঁ তুই তো খুব ভাল গান করতিস …তবে এত রাত করিস না ফিরতে , …জানিস ই তো দিনকাল খারাপ …ঐ ফাঁকা বাস স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে ছিলি… দেখেছিলি কতকগুলো ছেলে বাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল…চারিদিকে কত কি ঘটছে শুনতে তো পাস, কাগজেও তো পড়িস…
-তুই কি করছিস এখন?
-এই তো বি.কম কমপ্লিট করলাম কোনোক্রমে …এবার একটু কাজের খোঁজ খবর করতে হবে…তুই?
– বি.টেক ফাইনাল ইয়ার…
……ট্যাক্সিটা মন্দিরতলার কাছে এসে পাঁচটা পাঁচটা দশটা স্পিড ব্রেকারে লাফাতা লাফাতে নামলো…। তারপর স্লোপিং-এ গড়িয়ে এসে থামলো সমতলে…গাড়ির দরজা খুলে একে একে সবাই নেমে টাকা দিতে ব্যস্ত …প্রমিত আর মোহরের তো ভাড়া আগেই দেওয়া হয়ে গেছে.. তাই ওরা বাসস্ট্যান্ডের শেডের দিকে এগিয়ে গেল… প্রমিত বলল,
– কিরে এগিয়ে দিতে হবে নাকি…
-না না যাহ…
-নাহ রাত হয়ে গেছে তো?
-তো কি হয়েছে?..এই রাস্তায় আবার ভয় কি। বাই দ্য ওয়ে থ্যাঙ্কস আ লট প্রমিত…ইউ আর রিয়ালি আ ভেরি গুড পার্সন…
-বলছিস।
-একদিন আসিস না …আমাদের বাড়ি ।
-যদি বন্ধু ভাবিস নিশ্চয়ই যাব। আমার বাড়ির রাস্তা কিন্তু তোর বাড়ির উল্টোদিকে..। ওকে এগোলাম তবে টাটা…বাই দ্য ওয়ে এবার রাস্তায় দেখলে চিনতে পারবি তো …তবে একটু ভুল করে ফেলেছিস …আমার নাম প্রমিত নয় , প্রতীম …… আসলে কোনওদিন কথা বলিস নি তো… চল এগো এবার… ঝড় উঠবে মনে হয় …দমকা হাওয়া দিচ্ছে …ওকে বাই, টেক কেয়ার… গুড নাইট।
-ওহ সরি সরি…
-ইট্স ওকে , বাই।
-ইয়া বাই, গুড নাইট। …এইবলে মোহর একরাশ অস্বস্তি নিয়ে অবাক চোখে ওর দিকে তাকিয়ে রইল…
আর প্রমিত থুরি প্রতীম মন্দিরতলা বাসস্ট্যান্ড ছাড়িয়ে এগিয়ে গেল সামনের একটা পানের দোকানের দিকে …বলল,
-মামা আজ একটা কিং সাইজ দাও দেখি…
তারপর দড়ির আগুনে সিগারেট জ্বালিয়ে নিয়ে, দু-দুবার ঘাড়টা ওপর নিচ ডানদিক বাঁদিক করে ঘুরিয়ে অন্ধকার গলিতে মিলিয়ে গেল।