বারোতলার ওপর থেকে নিচে ব্যস্ত কলকাতা দেখতে বিতানের বেশ লাগে। কাচের জানলা ভেদ করেও কেমন যেন দুপুরের মিঠেকড়া রোদ্দুরটায় গা গরম হয়ে ওঠে। কেবিনে বিতানের সাথে থাকে তার প্রাইভেট সেক্রেটারি রাজু পট্টনায়ক…। ওড়িশার ছেলে, বাংলা কথায় বেশ টান। ইন্টারকাম এ ফোনটা ধরে রাজু বলে ” জাস্ট ওয়েট ম্যাম”……তারপর বিতান কে বলে, “স্যার ম্যাডাম লাইনে আছেন,” বিতান বলে …”ওহো মিটিং-এ ছিলাম মোবাইল সাইলেন্ট ছিল…। মোবাইলে রিং করতে বলো।”
হ্যালো
কি হ্যালো…কটা মিসড্ কল আছে দেখেছ?
আমি মিটিং-এ ছিলাম রুচি। …ফোন সাইলেন্ট ছিল…সরি বলো।
রুচিরা আদুরে গলায় বলে…ভাইব্রেট করে রাখতে কি হয় …। জানোই তো কখন কি দরকার পড়বে ফোন করতে হবে!
কেন আবার কি হল?
এই জানো…তোজো আজ বাঁ দিকে পাশ ফিরে গেছে ঘুমের ঘোরে…। তারপর হাতটা টেনে বার করতে না পেরে কি কান্না …আমার এত আনন্দ হচ্ছিল তোমায় না জানিয়ে পারলাম না……বাব্বা এখন উলটে গিয়ে কি ফোঁপানো……যেমন বাবা তার তেমন ছেলে! একটুতেই আহা উহু…
বিতান একটু হাসল…বললো…তাই বুঝি ? ভালোই তো এইভাবে ধীরে ধীরে বসতে দাঁড়াতে শিখবে আর তোমার সময় কেটে যাবে ।
ও তাই বুঝি …তা আমাকে খেলনা দিয়ে ভুলিয়ে রেখে তুমি কি করবে শুনি? নতুন করে প্রেম??
যাহ , তাই বললাম নাকি? যাক লাঞ্চ করেছ…ঠিক সময়ে খাওয়া দাওয়াটা কর …এখন কটা মাস একটু সময় মেনে চলো রুচি!
হুম আমি খেয়েছি …তুমি??
হ্যাঁ …আচ্ছা এখন রাখছি আবার একটু পর মিটিং আছে…বাই…
কথোপকথন শেষে ফোন রেখে বিতান একটা লম্বা শ্বাস নিল। মাথার পিছনে হাত দুটো রেখে আড়মোরা ভেঙ্গে চেয়ারটা ঘুরিয়ে সটান পিছনে ফিরে দেখল ……ঝকঝকে শীতের আকাশ…আশেপাশে ছোটবড়ো অফিস বাড়ি …বিজ্ঞাপনের হোর্ডিং …এইসব টপকেও দূরে দেখা যাচ্ছে শহীদ মিনার …একদল পরিযায়ী পাখির দল উড়ে যাচ্ছে আকাশের অনেকটা উঁচু দিয়ে……কত দূর থেকে ওরা আসে ভাবতে ভাবতে বিতান হারিয়ে গেল শীতকালের অজানা এক দুপুরে …কমলা লেবুর গন্ধে আর হানি বানির হই হই শব্দে……
এই দাদা দে না আমার ব্যাট টা…
আমি আঙ্কেলের সাথে খেলব…
“বানি…. হানিকে ব্যাটটা একটু দাও না”..বেশ জোরের সঙ্গে বলল দময়ন্তী ।
না না ,হানি তুমি আমার টা নিয়ে দাদার সাথে খেল আমি হাঁফিয়ে গেছি…এই বলে দময়ন্তীর পাশে এসে ঝুপ করে খোলা মাঠে শুয়ে পড়ল বিতান। দময়ন্তীকে বলল … “ আজকের আউটিংটা তোমার কেমন লাগল ম্যাডাম?”
দময়ন্তী বিতানের চশমাটা নাকের ডগা থেকে একটু ভেতরের দিকে ঠেলে দিয়ে বলল …… “ হুম তা বেশ লাগল। কিন্তু তুমি ওদের অভ্যেস খারাপ করে দিচ্ছো বিতান।”
একথা কেন বলছ?
এই যে উইকেন্ডে খালি বেড়ানো ঘোরা…হই চই মজা…। আমিও নিয়ে বেরোই… কিন্তু এত হুল্লোড় তো হয় না …তুমি ওদের অভ্যেস হয়ে উঠছো ধীরে ধীরে।
ক্ষতি কি দময়ন্তী ? আমি কি পারি না তোমাদের এই অসম্পূর্ণ সামতলিক ক্ষেত্রটা পরিপূর্ণ করতে?
না বিতান…সেটা হয় না…দেখ, তুমি আমার চেয়ে পাঁচ-ছ বছরের ছোট …যদিও জানি ভালবাসায় বয়সটা বাধা হতে পারে না……তাও তোমরা যৌথ পরিবারে থাক……এখনও তোমার দাদু আছেন , জ্যাঠামশাই আছেন …এমন একটা মেয়েকে বিয়ে করে ঘরে তুলবে যে তোমার চেয়ে বড়ো? …যার দুটো বাচ্ছা আছে?……বাড়িতে সবাই আপত্তি করবেন।
আমরা আলাদা থাকব দময়ন্তী। চারজনের সুন্দর একটা সংসার হবে । আমি মাকে বুঝিয়ে নিতে পারব …বাকিরা হয়তো মানবেন না।
না না , বিতান কারোর মনে কষ্ট দিয়ে ভালো থাকা যায় না…। তোমার সামনে গোটা জীবন পড়ে আছে। আজ ভাবতে ভাল লাগছে কিন্তু কিছুদিন পর বুঝবে সমাজ মানে তো কোনো বাক্সবন্দি ঘর নয়, যার বাইরে তুমি স্বচ্ছন্দ…বরং তোমার ওই ঘরটার বাইরেটাই সমাজ…তোমার চারপাশের সবাই … বন্ধুবান্ধব , অফিস , ক্লাব সর্বত্র যখন এই নিয়ে আলোচনা হবে তুমি ধীরে ধীরে ক্লান্ত হয়ে পড়বে……কি দরকার আছে বলো…তার চেয়ে পাশে থেকো , তাহলেই হবে।
কিন্তু দময়ন্তী সত্যি বলতে হানি বানি বড়ো হচ্ছে … আজ আঙ্কেল বলে মেনে নিচ্ছে কিন্তু কাল যদি প্রশ্ন করে , তুমি তার কি উত্তর দেবে ভেবেছ?
কিছক্ষন চুপ করে থাকে দময়ন্তী…তারপর বলে…”সেই জন্যই তো বলছি, তুমি একটা বিয়ে করো বিতান…আমি তো কোথাও পালাচ্ছি না… আর সত্যি বলতে তোমার এই নিঃসঙ্গ জীবনে কাউকে তো প্রয়োজন …আমি তো হানি বানিতেই আবদ্ধ হয়ে যাব……কিন্তু তোমার একাকীত্ব তোমাকে আরও বেশি কষ্ট দেবে…দেখবে একটা সময় পরে আমার এই নেশাটা তোমার কেটে যাবে।”
নেশা ? কি বলছো তুমি …ভালবাসি না বলতে চাও?
ডেফিনেটলি বাসো…কিন্তু দেখো, আমিই তো হানি বানির মা আবার বাবাও …যতদিন অনীশ আরেকটা বিয়ে করে নি আমি পাঠিয়েছি ওদের বাবার কাছে, কিন্তু এখন আর হানি যেতে চায় না…আর বানি যতই তোমাকে আঁকড়ে ধরুক আমি জানি ওর বাবার জায়গায় ও কোনোদিন তোমাকে মানতে পারবে না… আর তোমার কিই বা বয়স বিতান…এখনও তিরিশের ঘরে পা রাখোনি…।
……কিন্তু আজ বিতান তিরিশ ছাড়িয়ে তেত্রিশে পৌঁছেছে…। কতোগুলো বছর কেটে গেল…রুচিরার সাথে বিয়ে হয়েছে…. আড়াই মাস হল তোজো হয়েছে, তবুও মনের কোনে হানি বানি রয়েই গেছে…শুরুর সেই দিনগুলো আজও তাকে এক অদ্ভুত অনুভুতি দেয়…পারাদ্বীপে পোস্টিং এর সময় অনীশদা আর দময়ন্তীর ছোট্ট পরিবারটার সাথে তার খুব পরিচিতি হয়েছিল । তারপর যত গভীরে গেছে, দেখেছে ততই অন্তঃসারশূন্য…অনীশদা থাকে তার মত আর দময়ন্তী যেন হানি বানিকে সামলাতেই ব্যস্ত। তাদের সব কিছুতে সে একাই থাকে । বেশ কয়েকমাস পরে এক রাত্রে দময়ন্তী হানি বানিকে নিয়ে এসেছিল তার কোয়ার্টারে । সেদিন অনীশদা সম্পর্কের শেষ সুতোটুকুও ছিঁড়ে ফেলেছিল। সেইথেকে দময়ন্তীকে যেন একা ছেড়েও ছাড়তে পারে নি বিতান ……তাকে পৌঁছে দিয়েছিল তার দাদার বাড়ি। মাঝে মাঝে দেখা করতেও গেছে……ধীরে ধীরে ঘনিষ্ঠতা বেড়ে যায় …একা দময়ন্তী…আর তার একাকীত্ব……সাথে সাথে দুই ছেলে মেয়ের দায়িত্ব…। তার ওপর অনীশের দ্বিতীয়বার বিয়ে ,দময়ন্তীকে কিছুটা সময়ের জন্য বড়ো এলোমেলো করে দিয়েছিল…আঁকড়ে ধরেছিল বিতানকে……কিন্তু যত দিন গেছে ততই তার নিজেকে অপরাধী মনে হয়েছে। অবশেষে অনেক কষ্টে নিজের চাওয়া পাওয়াগুলোকে সামলেছে দময়ন্তী। বিতানেরও খুব কষ্ট হয়েছিল তার থেকে দূরে সরে থাকতে …। অপমানে আর অভিমানে পুড়ে গিয়েছিল বিতান। তার জীবনে সত্যি বলতে দময়ন্তী এমন একজন নারী ছিল ,যে সমস্ত সম্পর্কের ধারক ও বাহক হয়ে উঠেছিল…সেদিন ঘোর অভিমান হলেও আজ সে বুঝেছে, দময়ন্তী তার ভালই চেয়েছিল…সত্যি আজ সে ভালোই আছে রুচিরা আর তোজোকে নিয়ে কিন্তু যখনই অফিসের কাজে পারাদ্বীপ যেতে হয় তার ভীষণ মন কেমন করে …মনটা ছটফট করে দময়ন্তীকে একবার দেখার জন্যে। যদিও বিতান বিয়েতে কার্ড পাঠিয়েছিল, কিন্তু দময়ন্তী আসে নি ।……বিতান জানে আসতে পারে নি…পারা যায় না বোধহয় , তবে খুব সুন্দর একজোড়া কানের দুল পাঠিয়েছিলো ভিপি করে…এখনও রুচিরা ওই কানের দুল দুটো পরে। আর যখনই পড়ে , তার লাল পাথর থেকে আলো ঠিকরে , যেন শেষবার দেখা দময়ন্তীর সেই আরক্ত মুখটার কথা বিতান কে মনে করিয়ে দেয়। বিতানের মনটা ভাগাভাগি হয়ে যায় রুচিরা আর দময়ন্তীর মাঝে ।
………কেবিনের দরজা ঠেলে রাজু ফাইল হাতে এসে দাঁড়ালো টেবিলের সামনে… “ স্যার জি.কে. ব্রাদার্সের নিউ প্রজেক্টটা পাশ হয়ে গেছে …আমি কি ফোন করে জানিয়ে দেব মিস্টার রাউতকে?”
……বিতান ঘুরতে একটু সময় নিল …তারপর চশমার ঝাপসা কাচটা মুছে বলল… “আমি ফোন করে নেব…তুমি একবার টেন্ডার রিপোর্টটা নিয়ে এস তো” … রাজু হাতের ফাইলটা টেবিলে রেখে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল টেন্ডার রিপোর্ট আনতে…আর বিতান টেবিলে রাখা ফাইলটা খুলল ………। তার মুখের মানচিত্রটা একটু হলেও কি বদলে যাবে না…… যখন দেখবে নিউ প্রজেক্ট শুরু হচ্ছে পারাদ্বীপে…???