পর্ব – ২।
____________________________________________________________________________________________________________________________
কলকাতার ঝাঁ চকচকে নার্সিংহোমে, জানলার কাচের মধ্যে দিয়ে রাতের শহরটাকে দেখতে বেশ লাগছিল মোহনার …দূরে রাস্তার স্ট্রীট লাইটের আলোগুলো জোনাকির মতো জ্বলছে …ফ্লাইওভারের রেলিংএর ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে চলমান গাড়ি …বেশ কয়েকটা নিয়ন সাইনের হোর্ডিংও চোখে পড়ছে …এ যেন শিল্পীর ইজেলে আঁকা রাতের কলকাতার নিস্তব্ধ তিলোত্তমা রূপ …পাশে সাদা পোশাকে সিস্টার একগাল হেসে জিগ্যেস করলেন … ‘হাউ আর ইউ ফীলিং ম্যাম?’
মোহানার চোখের ভাষাই বুঝিয়ে দিল সে এখন অনেকটা ভালো বোধ করছে…যদিও বুকের বাঁদিকে একটা চিনচিনে ব্যথা আছে তখনও।
-একটু জল দেবেন ?
-সরি , আজ নয় ম্যাম …কাল অবশ্যই দেব , আজ শধুই স্যালাইন চলবে…জল দিলে অ্যনাস্থেসিয়ার কারনে একটু ভমিটিং হতে পারে …প্লিজ ম্যাম …প্লিজ কো-অপারেট উইথ আস।
-ডঃ গুপ্ত এসেছিলেন?
-হ্যাঁ … ওনার নির্দেশেই তো আপনাকে কেবিনে শিফট করা হল। যাবার আগে আরেকবার আসবেন নিশ্চয় ।
……এরপর আর কিছু বলার ইচ্ছে করছিল না মোহনার। খুব ইচ্ছে করছিল আবীরের একটু ছোঁয়া পেতে… ঠিক আয়ান হওয়ার পর, যেমন মাথায় হাত রেখেছিল আবীর …মুখটা নামিয়ে ঝুঁকে জিগ্যেস করেছিল … ‘ খুব কষ্ট হচ্ছে মন,…কি করি বলো তো, এই কষ্টটা যে আমি চাইলেও নিতে পারব না…নইলে তোমার জায়গায় আমিই …।’ মোহনা হেসে ফেলেছিল। ওই যন্ত্রনার মধ্যেও আবীরের অসহায় মুখটা দেখে মোহনা বলেছিল ‘ এইটুকু সহ্য না করতে পারলে, মা হয়ে উঠব কি করে!!!’ আবীর মোহনাকে মন বলে ডাকত …কতদিন কেউ তাকে আর মন বলে ডাকে না ।
পরেশ গুপ্ত ঘরে আসলেন…কলকাতার নাম করা হার্ট স্পেশালিস্ট। মোহনার সাথে যদিও আগে থেকেই পরিচয় । ওনার মিসেস স্কুল কমিটিতে আছেন, সেই সূত্রে বেশ কয়েকবার গেছেও মোহনা ওঁদের বাড়ি। সিস্টারকে কি যেন জিগ্যেস করলেন… মনিটারিং দেখলেন, মোহনার পাল্স চেক করলেন, ‘কি , অসুবিধে হচ্ছে কিছু!!!… কিছু বুঝতে পারছেন?……আপনার কিন্তু নবজন্ম হল মোহনা!!… এখন চাইলেও আর আপনার হৃদস্পন্দন বন্ধ হবে না… মোহনা হাসলো একটু , ভাবলো সত্ত্যি , তার আর হৃদয় বলে কিছু রইল না……কিন্তু কই কষ্ট তো কিছু কমে নি… আবেগ তো সেই একি রকম আছে… আসলে মন বস্তুটা আর যেখানেই থাক হৃদযন্ত্রে থাকে না যে , তবু কেন যে মনের কষ্টে বুকে ব্যথা হয় কে জানে ? … দেখতে গেলে সে এখন এক হৃদয়হীন মানুষ… কিম্বা বলা যায় যান্ত্রিক হৃদয় সম্বলিত নারী। আ লেডি উইথ মেটালিক হার্ট। নিজের মনেই হাসলো মোহানা …অথচ তার যে একটা জীবন্ত হৃদয় ছিল সে ভাবতেই ভুলে গেছিল… ওই বলে না, দাঁত থাকতে দাঁতের মর্যাদা দেয় না মানুষ…অনেকটা সেইরকম ই … তার পারিপার্শ্বিক মানুষ জনের কথায়, সে তো কবে থেকে শুনে আসছে , সে নাকি হৃদয়হীনা এক মহিলা । তার স্কুলের সহকর্মীদের কাছ থেকে শুনেছে স্টুডেন্টরা আড়ালে আবডালে তাকে ‘জল্লাদ’ বলে ডাকে, …তার মধ্যে নাকি মায়া মমতার লেশ মাত্র নেই …সে অবলীলায় ছাত্রছাত্রীদের খাতার নম্বর কেটে উড়িয়ে দেয়… তাদের পাস ফেল নিয়ে নাকি তার কোনও মাথা ব্যথাই নেই…তার মা’ও মাঝে মাঝে বলত আয়ানকে শাসন করা নিয়ে … ‘তুই দিনে দিনে এমন কঠিন কেন হয়ে যাচ্ছিস মৌ। ছেলেটাকে অত বকা ঝকা কি না করলেই নয়?’ …এমনকি আয়ান তো মাঝে মাঝে বলেই ফেলত… ‘তুমি এত হার্টলেস কেন মা? কেন বোঝোনা আমার বাবার মত ইঞ্জিনিয়ার হতে ইচ্ছে করে না…অঙ্কে ভালো হলেই বুঝি ইঞ্জিনিয়ার হতে হবে …আমাকে কেন তুমি ইংলিশ লিটারেচার নিয়ে পড়তে দিতে চাও না ? …কেন তুমি এত ঘড়ি ধরে নিয়ম মেনে সব কাজ করতে বলো…কেন বুঝতে চাওনা আমার নিয়মে চলতে ভাল লাগে না মা…!!!! কথাগুলো কানে বাজছিল মোহনার …সত্যিই জীবনটাকে সে বড়ো বেশি নিয়মে বেঁধে ফেলেছে …স্কুল ,বাড়ি , আয়ান , আর তার পড়াশোনা…এর মধ্যেই জীবনটা তার সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে।
পরেশ গুপ্ত চার্ট দেখে বেরিয়ে গেলেন…যাবার আগে বলে গেলেন… ‘তাহলে মোহনা আমি এখন আসছি, কোনও চাপ নেই… আমি আছি তো, ওকে, টেক রেস্ট…যত রেস্ট করবে তত তাড়াতাড়ি কষ্টের অবসান!!!!
……কষ্টের অবসান ?…এত সহজে সব কষ্টের অবসান? শরীরের কষ্ট একরকম কিন্তু মনের কষ্ট যে আরও বেশি ! … হঠাৎ করে তার জীবনটা অমন দুর্বিপাকে না পড়লে আজ মোহনার জীবনটা হয়ত এমন চাপের হত না। আজ খুব মনে পড়ছিল তার পুরোনো সেই সব কথা। তখন মোহানারা টাটানগরে থাকত। সুখী পরিবার। আবীর মোহনা আর আয়ান … যেন একটা সম্পুর্ণ সামতলিক ক্ষেত্র…সমবাহু ত্রিভুজ। সেপ্টেম্বর মাস …ভাদ্রমাস …কদিন পরেই পুজো…কলকাতায় আসার সব ঠিকঠাক, শুধু পুজোতে নয়, একেবারে টাটানগরের পাত্তারি গুটিয়ে কলকাতা অফিসে ট্রান্সফার নিয়ে নতুন সংসার শুরু করার কথা…সন্তোষপুরের ফ্ল্যাটের পজেশান পর্যন্ত হাতে এসে গেছে…। সাথে সাথে মোহনারও নতুন জীবন , সেন্ট্রাল স্কুলে চাকরীর কনফার্মেশান …কিন্তু বাধ সাধল আবীরের অফিস…কলকাতায় যাবার আগে শেষ ট্যুর মুম্বাই…এক সপ্তাহের জন্য…। আয়ানের ক্লাস টেস্ট চলছে ,নইলে সবাই মিলেই একটু বেড়ানো হয়ে যেত…অগত্যা আবীরকে একাই যেতে হবে। মুম্বাই যাবার দিন সকালবেলা আবীরের ব্রেকফাস্ট হয়ে গেছে…ব্যাগ অ্যান্ড ব্যাগেজ সব গুছনো…একটা ফোন এল…কথা বলতে বলতে আবীর সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠছিল একটা ফাইল আনতে …দুটো করে সিঁড়ি টপকে উঠতে গিয়ে দোতলার কয়েকটা সিঁড়ি আগেই পা ফস্কে পড়ল হাফ ল্যান্ডিঙে …আর জ্ঞান হারাল…আশপাশের কয়েকজন মিলে সঙ্গে সঙ্গে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল হসপিটালে… কিন্তু সে জ্ঞান আর ফেরেনি…সব শেষ!!!!! আয়ান তখন সবে ক্লাস ফোর… কোথা থেকে কি যে হয়ে গেল !! মোহনার চোখটা ভিজে যাচ্ছিল …কাঁদতে ইচ্ছে করছিল চিৎকার করে…কিন্তু পারল কই কাঁদতে !সেদিনের পর থেকে সেই কান্না বুকে চেপে চেপেই হয়ত আজ তার এই হৃদয়ঘটিত অসুখ…সবাই বলে মেয়েদের নাকি কই মাছের জান , কিন্তু তার কি এমন বয়স ? সবে তো এই চল্লিশে পা রেখেছে… এর মধ্যেই পেসমেকার!!! …ভাবতে ভাবতে মোহনা কেমন যেন উদাস হয়ে গেল।
……………………………………………………………………………………………………………………………….ক্রমশ
© Copyright 2014 @indrila, All rights Reserved. Written For: Oimookh