This entry is part 6 of 6 in the series বল মন 'সুখ' বল

পর্ব – ৬। (শেষ পর্ব )

কঙ্কার চলে যাওয়াটাকে অনুসরণ করে মিথিল মনে মনে বলে উঠল… ‘প্লিজ কঙ্কা , প্লিজ আমাকে ভুল বুঝো না। আমি তোমাকে আঘাত না করলে তুমি হয়ত আরও একবার দুর্বল হয়ে যেতে আমার ওপর । কিন্তু সত্যি বলতে, তুমি তো তোমার জায়গায় ঠিকই ছিলে কঙ্কা… আজ এতদিন পরে তোমাকে এত কাছ থেকে দেখে আমি বুঝেছি, সম্পর্ক ভেঙ্গে দিয়েছ কিন্তু আমাকে মন থেকে সরিয়ে রাখতে তুমিও পারোনি.. …চেষ্টা করেছ মাত্র…হয়ত ক্ষত বিক্ষত হয়েছ তুমিও। …সেদিন তোমার কথাগুলো না বুঝলেও তোমার চলে যাবার পর প্রতিটা মুহুর্তে , বিশেষত সৃঞ্জার চাওয়ায় ওকে সঙ্গ দেওয়ার মুহুর্তে আমি বুঝেছি দিনের পর দিন আমি ভেবে বাসবের হাতে নিজেকে ছেড়ে দিতে তোমার কি যন্ত্রণাটাই না হত! আমার সত্যি তোমার প্রতি আর কোনও অভিযোগ নেই কঙ্কা। আমি আজও চাই তোমাকে আমার পাশে পেতে কিন্তু পরিণতি তো সেই একটাই …যন্ত্রণা!!! নতুন করে কিছু যখন দিতে পারব না তোমাকে , কি লাভ তোমার জীবনটাকে আবারো এলোমেলো করে দিয়ে!!!’

…… কঙ্কার বেরিয়ে যাবার পর এসব ভাবত ভাবতে বেশ কিছুক্ষণ ফাঁকা অফিসে চুপ করে বসে রইল মিথিল । তারপর কঙ্কার প্রতি অদ্ভুত এক মমতায় জে .কে.কন্সট্রাকশনের এর ওনারকে ফোন করল মিথিল।
-হ্যালো মিঃ কুমার! একটু কথা ছিল,কনফিডেন্সিয়াল!!! বিজি নাকি?
-না না আমি ফ্রি আছি আপাতত , কি কথা বলুন ।
– আচ্ছা দেখুন তো বাসব সিনহা অ্যান্ড এন্টারপ্রাইজ থেকে যে রেট টা কোট করা হয়েছে সেটা অরিজিনাল থেকে কতটা ডিফার করছে………
-আপনি কি বাসব সিনহা অ্যান্ড এন্টারপ্রাইজকে রেফার করছেন?
-না ঠিক তা নয় , আসলে উনি আমার বিশেষ পরিচিত । যদি রেট টা লোয়েস্ট কোটের কাছাকাছি থাকে তবে কি একবার ডেকে পাঠিয়ে কথা বলে দেখবেন ? …কিন্তু প্লিজ আমার রেফারেন্স দেবেন না যেন ।
-ব্যস ব্যস… মিঃ সেনগুপ্তা আর বলতে হবে না , আমি দেখে নেব । তবে আজ তো আমার অফিস বন্ধ হয়ে গেছে, কালও ছুটি , যদি পসিবেল হয় , তবে কথা বলে কালই আপনাকে কনফার্ম করে দেব । কারন দু তারিখেই তো বেলা দুটোর পর অফিসিয়ালি কোটেশন ডিক্লিয়ার করতে হবে।
-থ্যাঙ্ক ইউ মিঃ কুমার…থ্যাঙ্ক ইউ সো মাচ। আপনি দেখলেই হবে… প্লিজ ডোন্ট টেক ইট আদারওয়াইজ।
– ইটস ওকে মিঃ সেনগুপ্তা…আই উইল ট্রাই মাই লেভেল বেস্ট। তবে আপনি যে মিটিং-এ বলেছিলেন যা হবে সব লিগালি!!!সেটা রাখা গেল নাত শেষ পর্যন্ত ? বাট সাপ্লায়ার ভালো তো?
-হোপ সো…আই অ্যাম রিয়েলি সরি মিঃ কুমার…
– সরি বলার কিছু নেই…ইটস নাথিং বাট অ্যান আন্ডারস্ট্যান্ডিং মিঃ সেনগুপ্তা । তবে মালটা ঠিকঠাক সাপ্লাই করলেই হল ।
– হ্যাঁ …সেটাই …ওকে বাই , রাখছি মিঃ কুমার, আমাকেও বেরোতে হবে, থ্যাঙ্কস আগেইন …এনজয় ইওরসেলফ।
……ফোনটা ছেড়ে দিয়ে চুপ করে বসে রইল মিথিল…মনে মনে ভাবল …যা মন থেকে মানি না তাও তোমার জন্যই করলাম কঙ্কা… এই কম্প্রমাইসটুকু হয়ত পরে ভারি ঠেকবে তবুও করলাম… শুধু তুমি একটু ভালো থেক কঙ্কা আমি আর কিছু চাই না। …নাহ আর বসে থাকলে চলবে না বেশ দেরি হয়ে গেল…এখনি সৃঞ্জা ফোন করবে।’
…গৌরদাকে অফিস বন্ধ করতে বলে বাইরে বেরিয়ে এল মিথিল। কলকাতা আজ সত্যি তিলোত্তমা সাজে সেজে উঠেছে। ইংরেজ দুশো বছর রাজত্ব করে গেছে বলে পুরোনো কলকাতার সাহেবিয়ানার গন্ধটা আজও কেমন যেন অক্ষত রয়ে গেছে। হাঁটতে হাঁটতে ফ্লুরিজের দিকে এগোতে লাগল মিথিল। মামমামের জন্য কেক আর মেয়োনিজ কিনতে হবে, সঙ্গে একটা গিফটও… যেতে যেতে চারপাশের এত ভিড়ের মাঝেও মিথিলের নিজেকে কেমন একা একা লাগছিল, একটা বুক চাপা কষ্ট তার মনের ভেতরটাকে দুমড়ে মুচড়ে পিষে ফেলছিল…ঝাঁ চকচকে শহরের কেতাদুরস্ত এই জীবনটা যেন কেমন দুর্বিষহ হয়ে উঠছিল ক্রমশ । কি করছে , কেন করছে সবই অর্থহীন । মনটা আজ আবার নতুন করে বিষন্ন লাগছিল তার । ইচ্ছে করছিল না রাতের জলসায় যেতে কিন্তু না গেলে সৃঞ্জা অশান্তি করবে…অগত্যা আর উপায় কি ? মনে মনে বলল মিথিল , ‘কেন এলে কঙ্কা ? আবার কেন এলে …আর এলেই যখন , কেন চলে গেলে !!! …হঠাৎ পিটারক্যাটের সামনের রাস্তায় একটা গাড়ির হেডলাইটের আলোয় মিথিলের চোখে পড়ল রাস্তার ফুটপাথের আধো আলো আধো ছায়ায় কতকগুলো রাস্তার কুকুরের সাথে ঠান্ডায় গুটিসুটি মেরে বসে আছে সকালের সেই বাচ্ছা ভিখারি ছেলেটা। গায়ে একটা ছোটো ছেঁড়া সোয়েটার আর নোংরা হাফ প্যান্ট । কি মনে হল মিথিলের , ছেলেটার দিকে এগিয়ে গেল সে । কাছে গিয়ে জিগ্যেস করল ,
-কিরে সকালে খুব লেগেছিল না ?
-না সাহিব, লাগে নি আমার।
-ঠিক তো ?
-হাঁ সাহিব।
মিথিল বলল ‘কি নাম তোর ? তোর সাথে কেউ থাকে না?’
-ছোটু নাম আছে সাহিব। আমার সাথে আরও কয়েকটা ছেলে থাকে , এখন ওরা হোটেলের বাসন সাফা করছে, আমি তো পারবনা তাই…
তাকিয়ে দেখল মিথিল ছেলেটার পা দুটো অকেজো …কিন্তু মুখটা কেমন মায়াবি…একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, পকেট থেকে একটা পাঁচশ টাকার নোট বার করে একটু ইতস্তত করে ছেলেটার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে মিথিল বলল,
– এই নে ধর । এটা তোর।
–এত্তো টাকা সাহিব!
-হুম …যা খুশি , কিনে খাস।
অপটু ইংরেজি শব্দে সে মিথিলকে একটা সেলাম ঠুকে বলল,
-থ্যাঙ্কু সাহিব।
ছেলেটার ফাঁকা মাথায় হাত দিয়ে মিথিল কিছু ভাবল, তারপর নিজের গলা থেকে কঙ্কার দেওয়া মাফলারটা সযত্নে খুলে ছেলেটার মাথায় জড়িয়ে দিল । খুশিতে উচ্ছ্বল হয়ে ছেলেটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে থাকল মাফলারটা । ছেলেটাকে খুশি দেখে মিথিলের মনে হল তার টাকাটার চেয়েও এই মাফলারটা বোধহয় তাকে বেশি সুখী করে তুলল…। এক্টা অদ্ভুত ভালোলাগায় চোখটা জলে চিকচিক করে উঠল মিথিলের । ততক্ষনে পকেটে ফোনটা ভাইব্রেট করছে । পকেট থেকে মোবাইলটা বার করে ফোনটা ধরল মিথিল । সৃঞ্জার ফোন…..,
-হ্যালো, কোথায়? আমি কখন থেকে রেডি হয়ে আছি, মিটিং হল তোমার?
-হ্যাঁ আমি বেরিয়ে পড়েছি , ফ্লুরিজে যাচ্ছি মামমামের জন্য কেক নিতে …তুমি ওখানেই চলে এস।
…মিথিল ফোনটা পকেটে রেখে ছেলেটার দিকে তাকাতেই সে খুশি খুশি বলে উঠল,
-গুড বাই সাহিব। হ্যাপ্পি নিউ ইয়ের …।
মিথিল বাচ্ছাটার দিকে তাকিয়ে একটু হেসে আলগোছে বলল , ‘হ্যাপি নিউ ইয়ার…ছোটু’ তারপর সামনের রাস্তা পেরিয়ে ফ্লুরিজের দিকে এগিয়ে চলল আর মনে মনে ভাবল ‘এরা কি অল্পেতেই সুখী … আসলে সুখ জিনিসটা বড় গোলমেলে’ …কিন্তু সুখ কাকে বলে ? সুখের পরিভাষাটা কি? সুখের অনুভুতিটা কেন এমন তরল? কেন এমন অস্থায়ী? তা খুঁজতে খুঁজতে মিথিল তার গন্তব্যের খুব কাছে পৌঁছে গেল …তবু কিন্তু তার প্রশ্নের কোনও সদুত্তর পেল না মিথিল… সুখ যেন মরীচিকা!!! কেমন যেন হেঁয়ালির মতই মনে হল সব …শুধু মনের কোণে অজান্তেই একটা গানের দুটো কলি বেজে ঊঠল,
‘ বল মন সুখ বল , বলে চল অবিরল , তোর সুখ নামে যদি সুখ আসে জীবনে
বল মন বলে চল, না ভেবেই ফলাফল, যদি তোর ডাকে বসন্ত আসে শ্রাবনে’।
____________________________________________________শেষ

Series Navigation<< বল মন ‘সুখ’ বল
© Copyright 2016 @indrila, All rights Reserved. Written For: Oimookh