পর্ব – ৪।
অফিসের পরিবেশটা আজ একটু হালকা হালকাই…তবুও নিউ প্রোজেক্টের এস্টিমেটটা দেখা বাকি আছে , বেলেঘাটার সাইটের ওয়ার্কিং ড্রয়িং-এর কপি, ইন্সপেকশন রিপোর্ট , ক্লায়েন্টের সাথে মিটিং সামলে লাঞ্চে গৌরদাকে দিয়ে কিছু ক্যাথলিন কেক আর চিকেন স্যান্ডুইচ আনতে দিল মিথিল সবার জন্য। তারপর কফি , কেক , স্যান্ডউইচ খেয়ে জে .কে. কন্সট্রাকশনের অফিসে বেরিয়ে গেল । যাবার আগে মিথিল কতকগুলো অ্যামোনিয়া প্রিন্ট রেডি করতে দিয়ে গেল তার পি. এ. বিপুলকে । কাল ছুটি , তাই আজই কাজটা করে রাখতে হবে । বিপুল গৌরদাকে সব বুঝিয়ে দিল।
…গৌরদা সেই প্রিন্টগুলো রেডি করে নিয়ে রিশেপ্সনে এসে দাঁড়াতেই , চোখে পড়ল কঙ্কনাকে। কঙ্কনা আগেও যেহেতু এসেছে এই অফিসে তাই গৌরদা ভালোই চিনত তাকে … বলল ‘কি ম্যাডাম , কেমন আছেন?’
– আরে গৌরদা যে, সব ভালো তো ? অফিস কেমন চলছে ?
– আমি ভালো আছি আর অফিসও ভালো চলছে , তবে আপনার কি আজ আসার কথা ছিল।
– হ্যাঁ । মিথিলদা আছেন ?
– না বেরিয়েছেন …একটু অপেক্ষা করুন এসে যাবেন।
-ঠিক আছে , আমি বসছি ভিসিটিং-এ।
… বসে থাকতে থাকতে কত পুরোনো কথা কঙ্কার মনে পড়ছিল। সত্যি বলতে তার সারাদিনে বহুবার বহুকাজের মধ্যে এমনি মনে পড়ে যায় পুরোনো সেইদিনগুলো , মনে পড়ে যায় মিথিলকে। ইচ্ছে করে মিথিলকে দেখতে। ফোনে কথা শুনতে। রাতে ঘুমের ঘোরে মিথিলকে স্বপ্ন দেখে চোখের পাতা জলে ভারী হয়ে যায় কঙ্কার। স্মৃতি তো সততই সুখের ,তাই কখনও কখনও নিজের মনেই পুরোনো কথায় হেসে ওঠে কঙ্কা , কিন্তু তারপর বাস্তবের একাকিত্বে বড়ো ফাঁকা ফাঁকা লাগে, মনটা কেমন যেন অসাঢ় হয়ে থাকে , কোনও কিছুতেই সায় দেয় না…… তার ওপর মাঝ রাতে বাসবের জোড়াজোড়িতে তার দম বন্ধ হয়ে আসে , ইচ্ছে করে মিথিলের কাছে ছুটে যায় কিন্তু…
…ভাবতে ভাবতে প্রায় পৌনে সাতটা বেজে যায়। হঠাৎ কাচের দরজা ঠেলে ঝড়ের গতিতে অফিসে ফিরে আসে মিথিল। কঙ্কাকে চোখে পড়তে হাঁটার গতি একটুও শ্লথ না করে চোখের ইশারায় কঙ্কাকে ভেতরে আসতে বলে। নিজের কেবিনের দরজা খুলে ভেতরে চলে যায় মিথিল । এক মুহুর্তের জন্য কেমন একটা জড়তায় কঙ্কা যেন স্থির হয়ে যায়… মিথিলের আসাটা এক ঝলক মনে পড়তেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে মিথিলের গলায় তার দেওয়া মাফলারটা। মনে মনে ভিজে যায় কঙ্কা। কিন্তু নাহ, তার তো দুর্বল হলে চলবে না …। সত্যি তো এইরকম সম্পর্কের কোনও পরিণতিই হয় না , তো কি লাভ আছে দুটো মানুষের মিথ্যে চাওয়ায় দুটো পরিবারকে সংকটের মুখে ফেলার!… তার চেয়ে এই ভালো…যে যার নিজের বৃত্তেই আবদ্ধ থাক। একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে কঙ্কা এগিয়ে গেল কেবিনের দিকে, তারপর দরজা খুলে ভিতরে গেল। কেবিনের দরজায় কঙ্কাকে দেখে মিথিল শান্ত স্বরে বলল ,
-ভেতরে এস কঙ্কা।
…তারপর বেল দিয়ে গৌরদাকে ডেকে দুকাপ কফি দিতে বলল মিথিল। কঙ্কা বসল মিথিলের একেবারে সোজাসুজি। মিথিল চোখ থকে চশমা খুলে এক গ্লাস জল খেয়ে মাথার পিছনে হাত রেখে চেয়ারটা একটু হেলিয়ে একদৃষ্টে তাকিয়ে দেখল কঙ্কাকে। আগের চেয়ে কঙ্কা যেন একটু ম্লান , একটু স্থুল , একটু আটপৌরে । কঙ্কাও অবশ্য এতক্ষন নীরবে তাকিয়েছিল মিথিলের দিকে, আর মনে মনে মেলাচ্ছিল মিথিলকে, নাহ্ কোনও পরিবর্তন হয়নি মিথিলের শুধু মাথার চুলে ঈষৎ পাক ধরেছে আর চশমার ফ্রেমটা চেঞ্জ হয়েছে । কঙ্কাকে চুপ থাকতে দেখে মিথিল নিজে থেকেই বলে ,
– কি ভালো আছো তো?
– হুম আমি ঠিক আছি । তুমি?
… একটু অর্থপূর্ণ হাসল মিথিল। … মনে মনে বলল ‘আজও কি আমায় ভাবো কঙ্কা?’
কঙ্কাও যেন মনে মনে উত্তর করল ‘ ভাবি গো ভাবি আজও তোমার কথা ভাবি আমি। কিন্তু আমার হাত পা যে বাঁধা মিথিলদা এটুকু কি তুমি বোঝো!’
কফি এল… কঙ্কা একটু চুপ থেকে ,বলল
-আমার ওপর খুব বিরক্ত হয়েছ তাই না?
-নাহ!
-সত্যি বলছ?
– জানি না…মানে ভাবি নি। কি বলবে বলছিলে?
একটু সময় নিল কঙ্কা। আনত মুখ , টেবিলের কাচে নখ দিয়ে আঁচড় কাটা, দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ানো , বুকের কাছে আঁচলের আড়ালে শ্বাস-প্রশ্বাসের ওঠাপড়া … কঙ্কার এই স্বভাবগুলো মিথিলের খুব চেনা। তার খুব ইচ্ছে করছিল সবার অলক্ষ্যে কঙ্কাকে জড়িয়ে একটা দীর্ঘ চুমু দিতে। কিন্তু সব ইচ্ছে কি সব সময় পূরণ হয়! মিথিলের ঠোঁটটা শুকিয়ে আসছিল, নাহ্ একটা সিগারেট ধরাতে হবে। মাথার চুলগুলো হাতে করে ঝাঁকিয়ে আপাত গম্ভীর স্বরে বলল,
-আমি আজ একটু তাড়াতাড়ি বেড়িয়ে যাব কঙ্কা। কি বলবে বল।
মিথিলের এই আপাত রাগটাও আবার কঙ্কা খুব ভালো চেনে। সে জানে এমন রাগের সময় মিথিলের খুব কাছে গিয়ে মিথিলের হাত দুটো ধরলেই তাকে উস্কে দেওয়া যায়। কিন্তু দুজনে দুজনকে এত ভালোভাবে জানার পরও কে যেন এক অদৃশ্য পাঁচিল তুলে দিয়েছে তাদের মাঝে…তাদের মাঝের সেতু আর খেয়া দুইই গেছে আজ হারিয়ে , এখন দুজন যেন নদীর দুই কুলে দাঁড়িয়ে একে অপরের দিকে দীর্ঘ শ্বাস টুকুই ছুঁড়ে দিতে পারে। অবশেষে মিথিলের দিকে সোজাসুজি চোখ রেখে কঙ্কা বলল,
– যাক, তবে কাজের কথায় আসি… মিথিলদা বাসব জে .কে.কন্সট্রাকশনের টেন্ডার কোট করেছে। ফাইনাল লিস্টিং-এর আগে তুমি যদি একটু সুপারিশ করতে, তাহলে বাসব কাজটা পেতে পারে । ওকে একটা সুযোগ করে দেবে , কাজটা পেলে ওর একটা হিল্লে হয়ে যেত। বেশ কয়েক বছর ধরে ওর ব্যাবসাটা মার খাচ্ছে ।
মিথিল যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিল না। তবুও ঘোরটা কাটিয়ে বলল,
– তুমি কি এইজন্যই আমার সাথে দেখা করতে এসছিলে? আমি তো ভাবলাম তোমার আমাকে আরো কিছু বলার আছে।
কঙ্কা চুপ করে গেল , তারপর বলল,
– নিজেদের কত রকম সুবিধে অসুবিধের কথা আগে আমরা দুজনে দুজনকে বলেছি তো মিথিলদা , আজ কি আমি এতটাই পর হয়ে গেছি যে …
কথাটা শেষ করতে পারল না কঙ্কা …গলাটা কান্নায় বুজে এল।
-এটা তুমি বলছ কঙ্কা? আমি তো সরে আসতে চাইনি তোমার কাছ থেকে? তুমি সরিয়ে দিয়েছ নিজের ঔদ্ধত্যে । দিনের পর দিন তোমাকে ফোন করেছি, মেসেজ পাঠিয়েছি, তুমি কোনো জবাব দাও নি। এরপরও তোমার মনে হয় আমি তোমার জন্য এসব করব ? কেন করব ? কি পাব আমি? একটা সময় তোমাকে আমি ধরে রাখতে চেয়েছিলাম এটা সত্যি কিন্তু আজ আমার কোনো আগ্রহই নেই তোমার ব্যাপারে । তাহলে কেন করতে যাব আমি এসব?
-আমি জানি মিথিলদা, চাইলে তুমি করতে পারো । কিন্তু করবে কেন? ইটস্ আ মিলিয়ন ডলার কোয়েশ্চেন! আসলে জানো সম্পর্কটা যে জায়গায় থেমে গেছে এর চেয়ে আর এগোনোর ছিল না বলেই বোধহয় সুতোটা কেটে গেছিল। কিন্তু আমি সত্যি ভাবিনি তুমি আজ এতো হিসেব কষবে ।আজ বুঝছি জীবনে তো কত ভুলি করেছি এটাও একরকমের ভুলই । এর চেয়ে ভালো ছিল তুমি যদি বলতে এই কাজটার বিনিময়ে তুমি আমাকে আগের মতই কাছে ধরে রাখতে চাও। তবু বুঝতাম আজও আমার প্রতি তোমার কিছু ভালোলাগা আছে। কিন্তু আজ তো তোমার কোনো চাওয়াই নেই আমার কাছে …তাই কেনই বা ভাববে তুমি আমার কথা? ঠিক বলেছ তুমি …..একেবারে ঠিক!!!
মিনিট খানেক চুপ করে থেকে কঙ্কা সিট ছেড়ে উঠে পড়ল । তারপর নিঃশব্দে এগিয়ে গেল সামনের দিকে ।পিছনে ফিরে মিথিলকে দেখার ইচ্ছেটা শেষবারের মত সংবরণ করল।
__________________________