পর্ব – ৭


 

অনীশের গাড়িটা বেড়িয়ে যাওয়ার সাথে সাথে ভারী লোহার গেটটা বন্ধ হওয়ার আওয়াজ কানে এলো কুরচির । দোতলার কোণের ঘরে জানালার পাশ থেকে সরে এসে খাটের একধারে ঝিম মেরে বসে পড়ল সে । অপলকে চেয়ে রইল উল্টোদিকে রাখা আলমারির আয়নাটায়। আয়নার ওইপারে এ কোন কুরচি? আজকের এই কুরচিকে কেন এত ভীষণ অচেনা লাগছে তার ! যেন তার বর্তমান আর তার অতীত মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে একে অন্যের মুখ চেয়ে …চোখের সামনে ভেসে উঠল মাথার দুপাশে বেণী দোলানো ঈষৎ ছটফটে কুরচির সেই ছ’ বছর আগেকার লাজুক মুখটা। কাকীমার গঞ্জনায় যার প্রতিদিনের বিস্বাদ সকালটা অনীশের ভালোবাসার মায়াঞ্জনে রাতের অন্ধকারে হয়ে উঠত স্বপ্নিল। গেল বছর অনীশ কুরচির জন্মদিনে একটা মোবাইল ফোন কিনে দিয়েছিল কুরচিকে, তার সাথে যোগাযোগের সহজ মাধ্যম হিসাবে , আর সেই ফোনটা ছিল কুরচির একমাত্র অক্সিজেন। সেই ফোন মারফত তার সারাদিনের সমস্ত মনখারাপ রাতের আঁধারে গলে গলে পড়ত অনীশের বুকে আর কুরচির কথার আবেশে অনীশের কান দিয়ে যেন সারা শরীরে বয়ে যেত এক সুরেলা ঝরনার রিণরিণে শীতল জলধারা । যদিও কুরচির কাকা তখন হন্যে হয়ে উঠেছেন তার দায় থেকে নিজেকে মুক্ত করার জন্য…জগৎ সংসারে যাকে পাচ্ছেন তাকেই ধরে আনছেন কুরচির সাথে বিয়ে দিয়ে দেবেন বলে…দিনের পর দিন কুরচি যেন কেমন আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে উঠছে, এই বুঝি বাড়ি ফিরে শুনবে, আজকেই বোধহয় তার কাকার হোটেলের শেষ ভাত, মায়ের সাথে কাটানো শেষ রাত, কালই বুঝি কাকা তাকে ঠেলে দেবেন অন্য এক জীবনে । এমনি একদিন, কলেজ থেকে বাড়ি ফিরে কুরচি দেখেছিল সুশান্ত বাবু , কাকাবাবু আর আরও একজন অপরিচিত ভদ্রলোক তাদের ঘরে বসে আছেন । তার বেশ মনে পড়ে সেই দিনকার কথা… সেদিন কাকিমার আতিথেয়তার ঘনঘটা কিছু কম ছিল না …অতিথিদের সামনে থালা ভরতি সিঙ্গারা মিষ্টি , কাপে কাপে চা…… মা দাঁড়িয়ে ছিল পর্দার আড়ালে… নিস্তব্ধ। ঘরে পা রাখতেই কাকা যেন হাতে চাঁদ পেয়ে গেলেন… কুরচিকে দেখে আদিখ্যেতাই চুড় চুড় হয়ে বললেন,
-এই আমার ভাইঝি সুমৌলী।
কুরচি ঈষৎ তীক্ষ্ণ চোখে তাকাতেই কাকা বলে উঠলেন,
-যা যা প্রণাম কর। আর কদিন পরই ওনারা আমাদের সম্বন্ধী হবেন…।
কুরচিকে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে, কেউ যেন বলেছিলেন,
-থাক থাক , লজ্জা পাচ্ছে , তুমি এখন ভেতরে যাও মা…
কুরচি এক ছুটে ভেতরে চলে গিয়েছিল …তার যে তখন মাথায় বাজ ভেঙ্গে পড়েছে। সন্ধ্যেবেলা সবাই চলে যেতে মায়ের সাথে কথা বলল কুরচি । মা বললেন ,
-শোন কুরচি ছেলের পরিবারটা কিন্তু বেশ ভালো । হ্যাঁ, মানছি ছেলের বয়সটা একটু বেশি কিন্তু অবস্থাটা ভালো…কিচ্ছু নেবে না ওরা , শাঁখা সিঁদুরে তোকে নিয়ে যাবে বলেছে। তুই আর অমত করিস না মা।… মাথা থেকে অনীশের চিন্তাটা ছাড় ।
-কি বলছ তুমি মা?
-হ্যাঁ ঠিকই বলছি, ও ছেলে কোনওদিনই বাবার ইচ্ছের বাইরে যেতে পারবে না , আর কি দরকার আছে কুরচি …ওরা অনেক বড়ো মানুষ , আমাদের সামর্থ কই যে ওদের সাথে আত্মীয়তা করব!… আর ওর বাবা কক্ষনও তোকে মেনে নেবেন না…মাঝখান থেকে ওর মায়ের চোখের জল কোনোদিন তোদের সুখী হতে দেবে না। … তোর অনেক ভাগ্য কুরচি তাই এমন একটা যোগাযোগ এসেছে। …ঠাকুরপো যা ব্যবস্থা করেছে তা তোর ভালোরই জন্য…তুই আজই অনীশকে ফোন করে না করে দিস।
… পলকে কুরচির চোখের সামনেটা কেমন ঝাপ্সা হয়ে গেল …চোখ জলে ভরে গেল…গুম হয়ে বসে রইল। …রাতে কিচ্ছু খেল না সে। তারপর ঘরের দরজা বন্ধ করে চুপি চুপি ফোন করলে অনীশকে,
-হ্যালো অনি …
-বল…কিরে চুপ কেন?
-কথা ছিল রে ?
-তোর গলাটা অমন লাগছে কেন রে?
-কাল কলেজ থেকে ফেরার পথে হাজরা বাসস্ট্যান্ডে থাকিস, বিকেল চারটেই, কথা আছে।
-আরে কি হয়েছে ? এখনই বল না।
-না , এখন বলা যাবে না কাল আসিস বলব ।
-ঠিক আছে যাব …কিন্তু একটু কিছু তো বল।
-ভালো লাগছে না অনি। কিছু ভালো লাগছে না।
-কি হয়েছে বল না …প্লিজ বল।
-কাকা আমার বিয়ে ঠিক করে ফেলেছে ।
-সেকি কোথায়? কার সাথে?
-জানি না…
-মানে?
-মানে বেশি কিছুই জানি না শুধু জানি ,ছেলের বয়স বছর চল্লিশ.. আর তার কাকার লোহার কারখানা।
-সেকি আয়রন ম্যান!!
-মজা ভাল্লাগছে না অনি। প্লিজ কিছু একটা কর । আমি এই বিয়েটা করতে পারব না , মরে যাব অনি।
-দুর , পাগলী মরার কথা উঠছে কেন?…আমাকে একটু ভাবতে দে।
-তুই আর কি ভাববি? এতকাল তো তোর সব ভাবনা আমিই ভেবে এলাম। তোর ভাবতে ভাবতে ঐ আয়রন ম্যানের সাথে আমার বিয়েটাই হয়ে যাবে , দেখিস।
-আমি মজা করছি না কুরচি । তোর মায়ের সাথে কথা বলেছিস?
-বলেছি, মা বলেছেন কাকার সিদ্ধান্তই শেষ কথা…। প্লিজ অনি এবার কিছু একটা কর। ভাবছি ভাবছি বলে সময় কাটানোর মত সত্যি সময় নেই।
-শোন আমি একটা কথা বলি, তোকে বিয়ে করে বাড়ি নিয়ে এলে বাবা মানবেন না ঠিকই কিন্তু আমার মা তো আর ফেলে দেবে না আর সময়ের সাথে সাথে তুই পারবি না কুরচি আমার বাবাকে মানিয়ে নিতে।…তার মনটা জয় করে নিতে…তুই তো সব অঙ্কের সমাধান জানিস।
-সব বিষয়টা এত সোজা নয় অনি ।আমি তোর বাবার চোখে আমার প্রতি যে ঘৃণা দেখেছি উনি হয়ত আমাদের একসাথে হতেই দেবেন না।
-তাহলে কি করতে বলছিস আমায়?
-চল না অনি আমরা কোথাও পালিয়ে যাই …তুই তো বলতিস দূরে কোথাও চলে যাবি আমায় নিয়ে …সবার আড়ালে…সেখানে শুধু তুই আর আমি।
-বলতাম তো , কিন্তু যাব কোথায়?
-আমি জানি না অনি…প্লিজ কিছু একটা কর…আমি আর থাকতে পারব না এখানে।
কুরচির গলাটা কান্নায় বুজে এলো…-
-প্লিজ সোনা, কাঁদিস না…দেখছি আমি কি করতে পারি আমাকে দুটো দিন সময় দে ,এর মাঝে তুই আর বাড়িতে কোনও ঝামেলা করিস না…একটু চুপচাপ থাক …আমি কিছু একটা ব্যবস্থা করে তোকে জানাব…জাস্ট আমার ফোনের অপেক্ষায় থাক আর প্লিজ স্বাভাবিক থাক। কাল কোনও দেখা-সাক্ষাতের দরকার নেই । আমি একটু গুছিয়ে নিয়ে তোকে জানাব কোথায় দেখা করতে হবে।কেমন?
-যা করবি একটু তাড়াতাড়ি কর অনি । মা বলছিল ছেলেদের কোনও ডিমান্ড নেই, ওরা এক কাপড়ে আমাকে নিয়ে যেতে চায়। তাই কাকা হয়ত কালীঘাটেই আমাদের বিয়েটা দিয়ে দিতে চাইবেন।
-তুই অত ঘাবড়াচ্ছিস কেন? আমি আছি তো …
-ঠিক আছে । এখন রাখছি তাহলে।
-আজ কিছু দিবি না আমায়…!!!
-আহ অনি …তুই একটা যাচ্ছেতাই …আমি মরছি চিন্তায়…আর… তোর খালি ধান্দা। এখন কিছু পাবি না আগে আমাকে নিয়ে যা তোর কাছে , তারপর সব হবে।
-আচ্ছা ?? …দাঁড়া তোকে কাছে পাই একবার…কড়ায় গণ্ডায় সব সুদ মিটিয়ে নেবো আমি।
-দেখা যাবে…রাখছি…এখন বাই ।
-হুম রাখ, বাই গুড নাইট।
……ফোনটা ছেড়ে দিয়ে অনীশ ভাবল, কি ব্যবস্থাই বা করবে সে এত চট জলদি…এখান থেকে পালিয়ে যাবেটা কোথায়? থাকবেই বা কোথায়? একটা কাজও তো খোঁজ করতে হবে। মনে পড়ল পাবলোর কথা। তার এককালের স্কুলের বন্ধু…এখন সে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে শিবপুরে। ছোটবেলায় একবার পাবলোর পিসির বাড়ি গিয়েছিল মেচেদায় ,তখন অনীশ নাইনে পড়তো…পিসিমশাই আগেই মারা গেছিলেন ।পাবলোর কাছে পড়ে শুনেছিলো, পিসি মারা যাওয়ার পর তার পিসতুতো দাদা অভয়দা একাই থাকত মেচেদায়, অভয়দার একটা প্রেস ছিল, অভয়দা অনির লেখালিখির জন্য তাকে বেশ পছন্দও করতো… কিন্তু বেশ কয়েক বছর তো কোনও যোগাযোগই নেই ।পাবলোকে একটা ফোন করতে হবে, জানতে হবে ওখানে কিছু সময়ের জন্য থাকা যাবে কিনা…কাজটাও যদি পাওয়া যায়…তাহলে কুরচিকে নিয়ে একেবারে শহর ছেড়ে শহরতলী।
……সত্যিই তো এইরকম সময় সে একা তো সব গুছিয়ে উঠতে পারবে না…বন্ধুরা কেউ পাশে থাকলে সুবিধেই হয় …ভাবা মাত্রই অনি ফোন লাগালো পাবলোকে । বেশ অনেকক্ষণ কথা হল পাবলোর সাথে……একটা আশ্বাসের সুরও পেল পাবলোর কাছ থেকে। ঠিক হল অভয়দার সাথে কথা বলে, পাবলো ফোন করে অনীশকে জানাবে।
……রাতে খেতে বসে কিছু খেতে পারল না অনি , মনটা খারাপ হয়ে রইল কুরচির জন্য। একটা লেখা নিয়ে বসবে ভেবেছিল তাও হল না……পড়াশোনা তো এমনিতেই তথইবচ…ক্লাস করতে ভালোও লাগে না…দেখতে দেখতে ফাইনাল ইয়ার শেষ হতে চলল…কোনওক্রমে পাসটা তো করতে হত…কিন্তু আর কি হবে?…জীবন বুঝি এবার অন্য খাতে বইবে কুরচিকে নিয়ে। আর নয় অনেক হয়েছে ছেলেমানুষি… এবার তাকে দায়িত্ববান হয়ে উঠতে হবে কুরচির জন্য। …আর কদিন পরে তাদের একটা ছোট্ট সংসার গড়ে উঠবে…যেখানে শুধু সে, কুরচি আর তাদের বুক ভরা একরাশ স্বপ্ন। তার বাবার অহংকার আর কুরচির কাকার অত্যাচার সব কিছুকে অগ্রাহ্য করে তাদের স্বপ্নের উড়ান শুরু হয়ে যাবে আর কদিনের মধ্যেই। ……এইসব ভাবতে ভাবতে অদ্ভুত একটা প্রশান্তিতে তার দুচোখ জুড়ে নেমে এল গভীর ঘুমের ঝাঁপি।
…পড়ন্ত বিকেলের ফিকে হয়ে আসা আলোতে কুরচির আজও মনে পড়ে পরদিন বিকালে অনীশ তাকে ফোন করে সাঙ্গুভিলা রেস্টোরেন্টে দেখা করতে বলেছিল…।একটা দমচাপা উত্তেজনায় বসুশ্রী সিনেমা হলের সামনে বাস থেকে নামতেই চোখে পড়েছিল অনিকে ,পরনে তার সাদা পাঞ্জাবি আর নীল জিনস ,একমাথা উষ্কখুষ্ক চুল , চোখে কালো ফ্রেমের চশমা, গাল ভরতি দাড়িতে কেমন যেন উদ্বিঘ্ন , দুজনে মিলে রেস্টোরেন্টের একদম শেষ কেবিনটায় বসে তাদের পরবর্তী পদক্ষেপের কথা আলোচনা করেছিল বেশ কিছুক্ষণ। তারপর লোকচক্ষুর আড়ালে দুজনে দুজনকে পরম বিশ্বস্ততায় আঁকড়ে ধরে অজানা ভবিষ্যতের স্বপ্নের বীজ বুনেছিল । সেদিন কি এক পরম মমতায় অনি যেন আগলে রেখেছিল তার কুরচিকে… কিন্তু কুরচির মধ্যে তখন কাজ করছিল এক অদ্ভুত অস্থিরতা। তার অমন ছটফটানি না থাকলে হয়ত আরও কিছুক্ষণ অনি নিজের করে কাছে টেনে রাখত কুরচিকে। কিন্তু পরদিন ভোরে যে তাদের নতুন গন্তব্যের উদ্দেশ্যে পাড়ি দিতে হবে…আর তাই সেই শপথেই দুজনে হাতে হাত রেখে বেরিয়ে পড়েছিল সাঙ্গুভিলা থেকে। আলগোছে হেঁটে চলেছিল পাশাপাশি ,নীরবে …কারন সময় তাদের মধ্যে এনে দিয়েছিল এক অজানা আশঙ্কা আর দায়িত্ব বোধের যুগপথ দ্বন্দ্বের আস্বাদ। কালীঘাট পর্যন্ত হেঁটে কুরচিকে বাড়ির পথে এগিয়ে দিয়ে, অনীশ নাকতলার মিনি বাসে উঠে বসেছিল।
… দেখতে দেখতে কতদিন হয়ে গেল কুরচি তার নিজের স্বামী পুত্র নিয়ে বেশ গুছিয়ে ঘর সংসার করছে , ঘুণাক্ষরেও সে ভাবতে চায়না তার সেই ফেলে আসা অতীতের কথা। তবে বিধাতার কোন সে অঙ্গুলি হেলনে আজ কুরচি এতদিন পর অনিকে দেখতে পেল আর একলাফে পিছিয়ে গেল ছ’ছটা বছর , ফিরে চাইল কালো কফিনে ঢাকা তার স্মৃতির চোরকুঠুরিতে …তা বোধকরি সে নিজেও বুঝে উঠতে পারছিল না। সে জানে না আর জানতে চায়ও না এখানে সত্যি কোনও প্রোজেক্ট অম্বরীশ মিত্র করবেন কিনা, কিন্তু সত্যি বলতে মনের মাঝে অনিকে একবার চোখের দেখা দেখবার যে সাধ তার অপূর্ণ ছিল তা বোধহয় এই জমি দেখতে আশার সূত্র ধরে সার্থক হয়ে উঠল।
……………………………………………………… ক্রমশ

Series Navigation<< প্ল্যাটফর্ম নম্বর তেরো/৬প্ল্যাটফর্ম নম্বর তেরো /৮ >>
© Copyright 2014 @indrila, All rights Reserved. Written For: Oimookh