পর্ব-৪


    সন্ধ্যের মুখে অফিসে এসে অনীশ জানতে পারলো একটা বড়ো অর্ডার এসেছে মুম্বাই থেকে…অম্বরীশ অফিসেই ছিলেন …ছেলেকে দেখে বললেন,

-নতুন ওয়ার্কশপের জন্যে একটা জায়গা দেখতে যাওয়ার ব্যাপার আছে কদিনের মধ্যে। তোমাকে নিয়েই যাবো। নিজেকে ফ্রী রেখো এই সপ্তাহটা…
-ঠিক আছে…কবে যাবে বোলো…
……কয়েকটা কোটেশান ফাইনাল করার ছিল…অনীশ কিছু পুরোনো ফাইল নিজের কেবিনে নিয়ে আসলো… অনীশের কেবিনটা বেশ ওয়েল ডেকোরেট …একটা ওভাল শেপড টেবিল উইথ রিভল্ভিং চেয়ার ……সামনে আরও তিনটে সিটিং অ্যারেঞ্জমেন্ট… ব্যাকসাইড ওয়ালে একটা এল সি ডি স্ক্রীন… একটা কর্নারে সোফাসেট, সেন্টার টেবিল……সাইডে শেলফ …ফাইল ক্যাবিনেট ……এক পাশে গোটা দেওয়াল জুড়ে ফ্লোর থেকে একটু উঁচুতে অ্যালুমিনিয়াম উইন্ডো উইথ গ্লাস পেন …কাচের ওপর লুভার্স… তার ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে রাসবিহারী মেট্রো স্টেশানটা । অনীশ বুদ্ধদাকে চা দিতে বলে ল্যাপটপে নতুন এস্টিমেটের খসরাটায় চোখ বোলাতে লাগলো …মেটেরিয়ালের নিউ প্রাইজ লিস্টটাকে মাঝে মাঝে আপডেট করে নিতে হয়… এমনসময় ইন্টারকামে অম্বরীশ বললেন
-পিসিমা এসেছে বেলেঘড়িয়া থেকে…বাড়িতে যেতে বলছে …
-ওহো …আমি তো এই এলাম…আচ্ছা চলো…
-না , আমার একটা মিটিং আছে আটটায় …তুমি বেরিয়ে যাও …আমি মিটিং সেরে যাচ্ছি। যাওয়ার সময় শ্রী হরির মালাই চমচম নিয়ে যেও …
-ঠিক আছে। আমি বেরিয়ে যাচ্ছি তাহলে…
……চা খেয়েই অনীশ বাধ্য ছেলের মত ল্যাপটপ আর ফাইল ক’খানা নিয়ে বেরিয়ে পড়লো…যাবার পথে ভাবলো ‘ পিসিমণি যে শ্রীহরির চমচম খেতে ভালবাসেন , বাবার সেটাও খেয়াল আছে!!’ …..গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়ে শ্রী হরিতে পৌঁছলো অনীশ… পাশের রাস্তাটায় গাড়ি থামিয়ে মিষ্টি কিনতে গিয়ে দেখা হল …বারীন বাবুর সাথে…অনীশের অঙ্কের স্যার…পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করল অনীশ…
-ভালো আছেন স্যার…চিনতে পারছেন ?
-কে বলো তো?
-অনীশ …স্যার…অনীশ মিত্র …মিত্র ইনস্টিটিউশন।
-হুম… খুব মনে পড়ছে… পাবলো ,মিতুল, কুরচিদের সাথে ছিলে তো?
-হ্যাঁ স্যার…এখনও পড়ান?
-না বাবা…এখন আর টিউশন করি না …শরীরও তেমন ভালো নেই…তা তুমি কি করছো এখন?
-আমি তো বাবার ব্যবসাই দেখাশনা করি …আর কিছু করতে পারলাম কই!!!
-সে কি কথা…এমন সাজানো বাগান থাকলে কে আর কি করতে চায়?
-জয়ি কেমন আছে স্যার ?
-ভালো আছে…ওর তো ব্যাঙ্গালোরে বিয়ে হয়েছে …একটা মেয়ে হয়েছে গতবছর…
-বাহ … অনেক দিন কোনও যোগাযোগ নেই তো …কারও সাথে দেখাও হয় নি তেমন…
-হ্যাঁ এখন তো সবাই ব্যস্ত… বড়ো ব্যস্ত …তুমি দুটো কথা বললে ভালো লাগলো…..চলি , সবাই ভালো থেকো কেমন !……বারীন বাবু এগিয়ে গেলেন… কেমন যেন মনটা খারাপ হয়ে গেল অনীশের…মিষ্টি নিয়ে গাড়িতে উঠল অনীশ …..পথে যেতে যেতে মনে পড়ে গেল কত পুরোনো কথা….সেই অঙ্কের ক্লাস…সেই বারীন বাবুর কোচিং…। পাবলো …তার স্কুলের জুটি … বারীনবাবুর মেয়ে জয়িতা আর সুমৌলীর জুটি।
…এই কোচিং-এই তার প্রথম দেখা সুমৌলীর সাথে… ডাক নাম কুরচি…
-কোন স্কুল?
-মিত্র ইনস্টিটিউশন।
-কোন ক্লাস?
-নাইন…
-আমারও ক্লাস নাইন …কমলা গার্লস।
বারীনবাবুর প্রথম অঙ্ক ক্লাসে পাশাপাশি বসে অঙ্ক কষতে কষতে পরিচয় পর্ব সারা হয়ে গেল দুজনের…
-তোর বাড়ি কোথায় কুরচি?
-কালীঘাটে … তোর?
-টালিগঞ্জ চারু মার্কেটে …।
ব্যাস…এরপর থেকেই দুজনের বেশ ভাব হয়ে গেল…. কোচিংএ যাওয়া আসার সময়ে বিশেষত………অনীশের তো পড়ায় মনটা কম …চিরকালই খালি স্বপ্ন আর স্বপ্ন। কিন্তু কুরচি ছিল বেশ চালাকচতুর …বুদ্ধিমতী…আর দায়িত্ববোধটাও বেশ ভালোরকমের।
বেশ কদিন হল অনীশের হোমওয়ার্ক করতে ভালো লাগছে না …বারীন বাবু বলেছেন “এরপর হোমওয়ার্ক না করলে ক্লাসে আসবি না”…..ফলে অনীশ পড়েছে মহা মুশকিলে …শেষ পর্যন্ত কুরচিই ভরসা… দেশপ্রিয় পার্কের ভিতরে বসে কুরচি অনীশের খাতায় অঙ্ক কষছে …আর অনীশ ঘাসের ওপর গঙ্গা ফড়িং-এর ওড়া দেখছে…
-কি করিস বলতো অনি? কিচ্ছু পড়াশোনা করছিস না…এইভাবে কি করে চলবে?
-কেন? তুই আছিস তো!
-দ্যুর… আমি কি সব সময় থাকব নাকি তোর সঙ্গে?
-কেন? থাকলে দোষ কি?
-মানে?
-মানে …আমি তো ভাবি তুই আছিস সবসময় আমার সাথে সাথে…আর পরেও থাকবি । …কিরে থাকবি না??
-পরে মানে?
-মানে সারাজীবন।
-তাহলেই হয়েছে…তোর মত খামখেয়ালি ছেলের সাথে সারাজীবন? …তুই আমার কোন সুরাহাটা করেছিস আজ পর্যন্ত …যে পরেও করবি?
-আচ্ছা কুরচি …একটা কথা বল …প্রেম বিয়ে দায়-দায়িত্ব এগুলো ছাড়া দুজনে একসাথে থাকা যায় না ,না??
-মানে? লিভ টুগেদার?
-না না, অত সব ভারি ভারি কথা আমি বুঝি না…অঙ্ক না পারলে যেমন তুই করে দিস…তেমন যদি জীবনের সব অঙ্ক মেলাতে না পারি…তুই মিলিয়ে দিতে পারবি না?
-ভগবান!!!!! এ কার পাল্লায় পড়েছি…না পারি ধরতে না পারি ছাড়তে…। শোন এসব ভুলভাল বকে কিছু লাভ নেই অনি…।ভালো করে পড় । জীবনে কিছু করতে হবে তো?…যতই তোর বাবার ব্যাকগ্রাউন্ড থাকুক …তোর পরিচয় তোকে নিজেকেই তৈরি করতে হবে…।……কত বড়ো কথা!!!……অথচ কত ছোট বয়সে কুরচি বলতো…সত্যি আজও সে পারে নি তার নিজের পরিচয় গড়ে তুলতে…কতদিন হয়ে গেল কুরচিকে দেখা হয় নি তার…সত্যি বলতে সে তেমন করে আর আঁকড়েও থাকে না কুরচির স্মৃতিগুলোকে এখন… এমনকি কুরচির সাথে পৃথাকে আর মেলায়ও না। প্রথম প্রথম পৃথাকে মেলাতো অনি, কুরচির সাথে…কারন তখন মনে হত কুরচি ছিল ঠিক তার মনের মত…কিন্তু এই ক’বছরে অনীশ বেশ বুঝেছে মনের মত বলে কিছু হয় না…কেউ হয় না…আসলে প্রতিটা মানুষের মাঝেই নারী পুরুষ দুটো সত্ত্বা থাকে । তাই তার কল্পনার নারী মানে একেবারে তার নিজের নারী সত্ত্বা…তা কেমন করে মিলবে কোনো জাগতিক নারীর সাথে। তাই পৃথা যতটা তার সেই কল্পলোকের নারীর থেকে অন্যরকম, ঠিক ততটাই অসম্পুর্ণ মনে হয়েছিল কুরচিকেও একসময় । তাই এখন আর পৃথার মধ্যেও সে কুরচিকে খোঁজে না … শুধু জানতে ইচ্ছে করে কেমন আছে কুরচি ?…ভালো আছে তো? হতে পারে সময় আজ তাদের আলাদা করে দিয়েছে…তাই বলে কি সব অনুভুতিগুলো মিথ্যে হয়ে গেছে?…স্মৃতিগুলো কি সব ঝাপসা হয়ে গেছে?…সত্যি কি সব ভুলে যাওয়া যায়…?…নাকি শুধু ইমপালসটা কমে যায়…রিফ্লেকশনটা ফিকে হয়ে যায় মাত্র…!!!
……গাড়ির হর্ন বেজে উঠলো বাড়ির গেটের মুখে এসে…পেলে রুদ্ধশ্বাসে ছুটে বারান্দায় এসে চেঁচাচ্ছে “বাবাই এসে গেছে, মামামাম…।বাবাই এসে গেছে…”।
……………………..……………………..…………………..ক্রমশ।


Series Navigation<< প্ল্যাটফর্ম নম্বর তেরো/৩প্ল্যাটফর্ম নম্বর তেরো /৫ >>
© Copyright 2014 @indrila, All rights Reserved. Written For: Oimookh