পর্ব- ৪
নীলের সাথে ইমলির সম্পর্কটা কেন এমন ছাড়া ছাড়া বিভা ঠিক বোঝে না। যতবারই কথা হয়েছে নীলের সাথে বিভার মনে হয়েছে নীল কেমন যেন জোর করে বয়ে বেড়াচ্ছে সম্পর্কটা । নীলের পেড়াপেড়িতে বেশ কয়েকবার ইমলির সাথে কথাও হয়েছিল বিভার , কিন্তু ইমলি সেটা ভালো চোখে নেয় নি বোধহয়। যদিও ইমলির বয়সটা বেশ কম তাও , ইমলিকে বড়ো হিসেবি ঠেকেছিল বিভার। তবুও যখনই ইমলি নীলের ফোন ধরত না , নীল বিভাকে ইমলির সাথে কথা বলতে জোর করত। প্রথম প্রথম বিভার বেশ অস্বস্তি হত , কি বলবে ভেবে পেত না । তার ওপর ইমলি যখন জিগ্যেস করত ‘আচ্ছা বিভাদি বলোতো, তোমার সাথে ওর কি এত কথা হয় …আমি তো ওর সাথে বলার মতো কথাই খুঁজে পাই না’। … বিভা হাসত , মুখে কিছু না বললেও মনে মনে কেমন একটা মায়া লাগত নীলের ওপর। আসলে সেও জানে না নীলের সাথে সে কি এত কথা বলে। সত্যি বলতে নীলের সাথে তার বেশ কয়েক মাস টুকটাক ফোনেই যা কথা হত। কিন্তু যে বার অতীন অফিসের কাজে শিলিগুড়ি গিয়েছিল, সেই বার বিভা একা থাকতে পারবে না বলে আভাকে থাকতে বলেছিল… কিন্তু অসুস্থ শাশুরিকে ছেড়ে আভা কেমন করেই বা থাকে? … অগত্যা দুষ্টুকে রেখেছিল বিভার কাছে কদিনের জন্য। অতীন বার বার বিভাকে বলেছিল, ‘একা একটা বাচ্চাকে নিয়ে থাকতে পারবে না ’ বিভা কথা কানেই তোলে নি। দুষ্টুকে নিয়ে তার বেশ কাটছিল।সকালে ঘুম থেকে উঠে দুষ্টুকে নিয়ে কাছাকাছি একটু বাজার করা, দুপুরে ভাত খাওয়ানো , ঘুম পাড়ানো , তারপর বিকেলবেলা দুস্টুকে নিয়ে পার্কে যাওয়া । সেখানে আর পাঁচটা বাচ্চার সাথে দুষ্টুর খেলা দেখতে বিভার বেশ লাগত। সন্ধ্যেবেলা দুজনে মিলে গল্পের বই পড়ত, টিভি দেখত, তারপর অল্প কিছু রান্না করে খেয়ে খাইয়ে , অতীনের সাথে ফোনে সব কিছুর বিস্তারিত গল্প করে , তারপর শুতে যাওয়া । এক সপ্তাহের মধ্যে এইভাবে বেশ কটা দিন তো কেটেই গেছিল । কিন্তু একদিন বিকেলে দুষ্টুকে নিয়ে খেলতে গিয়ে হঠাৎ মাঠে কি একটা কামড়াতে দুষ্টুর পায়ে রক্ত জমাট হয়ে নীল হয়ে গেছিল…কি বিচ্ছিরিভাবে ফুলে উঠেছিল পা টা, … সে কি কান্না দুষ্টুর, কাঁদতে কাঁদতে ছেলেও যেন কেমন ঝিমিয়ে পড়েছিল। বিভা ভয় পেয়ে অতীনকে ফোন করল , অতীন তখন মিটিং-এ । ফোন সাইলেন্ট… । দিদিকে ফোন করল বিভা , দিদির ফোনও বেজে বেজে কেটে গেল। শেষমেষ বিভা একটা ট্যাক্সিতে উঠে পড়ল দেশপ্রিয় পার্কের দিকে এক ডাক্তারের কাছে যাবে বলে । এমন সময় হঠাৎই নীলের ফোন , বেশ কয়েবার ফোনটা বাজার পর , বিভা ফোন ধরেই খুব বিরক্তি নিয়ে বলেছিল… পরে কথা বলব, আমি এখন খুব বিপদে আছি।
-বিপদ …আরে কি হয়েছে বলোই না?
-একটু ইতস্ততঃ করে বিভা পুরো ঘটনাটা বলতেই, নীল বলেছিল, ‘কোথাও না , তুমি সোজা হরিশ মুখার্জ্জী রোডে, শম্ভুনাথ পন্ডিত হসপিটালে এসো। আমি ওখানে এমারজেন্সিতে আছি, তুমি কাউন্টারে এসো, ভয়ের কিছু নেই , সব ঠিক হয়ে যাবে’।
বিভার আজো মনে পড়ে সে কিভাবে দুষ্টুকে নিয়ে গিয়েছিল, দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে। কাউন্টারের বাইরে দুষ্টুকে কোলে নিয়ে এগিয়ে আসতে দেখেই , সুঠাম চেহেরার বেশ লম্বা একটি ছেলে কাউন্টার ছেড়ে বেরিয়ে এসে জিগ্যেস করেছিল,
-তুমি বিভা???
-হ্যাঁ…
-আমি নীল , এসো আমার সাথে এসো…ডাক্তার আছেন ভেতরে।
শম্ভুনাথ পন্ডিত হস্পিটালের আউট ডোরে ডাক্তার দেখেছিলেন দুষ্টুকে , বলেছিলেন ‘হয়ত কোনও বিষাক্ত কীটের দংশন’। …তারপর দুষ্টুর পায়ের ওই জায়গাটা একটু চিড়ে জমে থাকা রক্ত বের করে দেওয়ার পর, ওষুধ লাগিয়ে ব্যান্ডেজ করে, ইঞ্জেকশান দিয়ে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে বলছিলেন। প্রায় ঘন্টাখানেক বাদে দুষ্টু একটু স্বাভাবিক হওয়ার পর বিভার খেয়াল হয়েছিল নীলের কথা, কাউন্টারের দিকে তাকাতেই চোখাচোখি হয়েছিল নীলের সাথে। ইতিমধ্যে সে বেশ কয়েকবার এসে দেখে গেছে বিভাকে, নীলের প্রতি অসীম কৃতজ্ঞতায় বিভার মনটা ভরে গেছিল। সেদিন অল্প কিছু কথার পর, ফাইনাল চেক আপ করিয়ে, নীল ট্যাক্সিতে পৌঁছে দিয়েছিল বিভা আর দুষ্টুকে । কিন্তু বাড়ি আসে নি । কারণ ট্যাক্সিতে ওঠার পরই অতীনের ফোন … সব শুনে খুব বকেছিল বিভাকে দুষ্টুর প্রতি অবহেলার জন্য। চুপচাপ সব বকুনি শুনে বিভার তখন কাঁদো কাঁদো অবস্থা । তাও কিছুটা স্বাভাবিক হতে চেয়ে বিভা বলেছিল, ‘তুমি কি নীলের সাথে কথা বলবে, ও পাশেই আছে’ । কথা হয়েছিল অতীন আর নীলের। নীলের প্রতি কৃতজ্ঞতা দেখিয়ে অতীন তাকে বলেছিল, ‘অনেক অনেক ধন্যবাদ নীল, আমি কলকাতা ফিরলে একদিন আসুন আমার বাড়ি , তখন কথা হবে, খাওয়া-দাওয়া হবে।’ নীল বোধহয় এক মুহূর্ত কিছু ভেবেছিল। তারপর বলেছিল, …সে হবে ক্ষন, আগে আপনি ফিরুন তো দাদা।’
……এই ঘটনার পর থেকেই নীলের সাথে বিভার একটা সুন্দর বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। কলকাতায় ফিরে আসার পর অতীন একটা রবিবার নিমন্ত্রণও করেছিল, নীলকে । সেদিন খুব সুন্দর করে সেজেছিল বিভা। অনেক রাত পর্যন্ত গল্প হয়েছিল… খাওয়া দাওয়া…একটু আধটু লাল জলও চলেছিল অতীন আর নীলের । তারপর নীল বেড়িয়ে পড়েছিল বাড়ির উদ্দেশ্যে, বিভার খুব ভালো লেগেছিল, অনেকদিন পর কলকাতায় চেনা পরিচিত কাউকে পেয়ে…। বেশ আনন্দের সাথে অতীনকে জিগ্যেস করেছিল,
-কেমন লাগলো তোমার নীলকে? …
অতীন গম্ভীর হয়ে জড়ানো শব্দে বলেছিল,
-ঠিকই আছে …কিন্তু তোমার নজরটা ঠিক ছিল না , হাভ ভাব বদলে গেছিল?
-মানে?
-লড়বে নাকি আমার সাথে এই টপিকে, ..লেটস স্টার্ট বেবি …আমি রেডি।
-এ আবার কি কথা… রাত দুপুরে যত্তসব উল্টোপাল্টা ।
-তোমার তাই মনে হচ্ছে বুঝি ? কিন্তু একটা কথা বলো তুমি সেদিন ওর সাথে দেখাই করতে গিয়েছিলে, কি তাই তো?
-তুমি কি পাগল হয়ে গেছ?
– তুমি আগে তো কোনওদিন এমন করে সাজোনি বিভা, আজ কেন সেজেছিলে? ওকে ইম্প্রেসড করার জন্য? কি এমন দেখতে ছেলেটাকে?
…এরকমই কিছু কথার জ্বালায় বিভাকে এফোঁড় ওফোঁড় করে, সেই রাতে অতীন বিভার অঙ্গরাজ্যের ওপর আধিপত্য বিস্তার করেছিল। সেদিন অতীনের সোহাগের পরিভাষাটা এতটাই অন্যরকম ছিল যে, বিভা গোটারাত দুচোখের পাতা এক করতে পারে নি। অতীন যখন বেঘোরে ঘুমোচ্ছিল, বিভা তখন জলভরা চোখে ভেবেছে, একবার নীলকে ফোন করে বলবে নাকি, যে সে যেন আর তার সাথে যোগাযোগ না রাখে… । আর কোনোদিন যেন ফোন না করে, অতীন পছন্দ করছে না ব্যাপারটা…। নাকি আর ফোন ধরবেই না নীলের। বুঝিয়ে দেবে ব্যস অনেক হয়েছে আর নয়। অবশেষে ভোর রাতে মনের সাথে বেশ যুদ্ধ করে মোবাইলটা হাতে নিয়ে অন করতেই , একটা এসএমএস … !!! একরাশ মন খারাপ নিয়ে চোখের জল মুছে বিভা একদৃষ্টে চেয়েছিল স্ক্রীনের দিকে…। ভেবেছিল, এ হেঁয়ালীর মানে কি??? এসএমএস টা নীলের। গত রাতে বাড়ি পৌঁছে নীল কেন জানিনা নেশার ঘোরে বিভাকে লিখেছিল,
‘তোমাকে আজ না দেখলে বুঝতেই পারতাম না মেমসাহেব তোমার মধ্যে ,এত মেঘ… এত জল আছে, … মেম…, তুমি সবসময় খুব হাসি খুশি থেকো, হাসলে তোমায় ভারি সুন্দর দেখায়…
শুভ রাত্রি। নীল।
……………………..