পর্ব – ৩
বিভার সব আপনজনেরা বহরমপুরে থাকে । শ্বশুরবাড়ির বাপেরবাড়ির সবাই সেখানে । বিয়ের পর একটা বছর বিভা অতীনও বহরমপুরেই ছিল। হঠাৎ করে অতীনের বদলির চিঠি । ব্যস , তারপরেই অতীনের কর্মসূত্রে বিভার বহরমপুরের স্বজন পরিজন ছেড়ে কলকাতায় আসা, আর চেতলার কাছাকাছি একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে থাকা । যদিও প্রথম কিছুদিন অতীন কলকাতায় একাই অফিসের গেস্টহাউসে থেকে অফিস করেছিল , তারপর একটা মাথা গোঁজার উপযুক্ত ঠাঁই ঠিক করে বিভাকে নিয়ে এসেছিল কলকাতায়। সত্যি বলতে কলকাতার এই জটিল জীবনযাত্রায়, মাপা কথা মাপা হাসি, বিভা যেন ভেতর থেকে নিজেকে গুটিয়ে ফেলেছিল। সর্বোপরি এই শহরে তাদের নিজের কেউ না থাকা …আর তার ওপর অতীনের সকাল থেকে বেড়িয়ে যাওয়ায় বিভা ক্রমশই একা হয়ে পড়েছিল।
বিয়ের পর থেকেই বিভা দেখেছে অতীন একটু গোঁয়ার স্বভাবের। ভালো তো ভালো… কিন্তু রাগলে মাত্রাজ্ঞান থাকে না। একটু যেন চোখেও হারায় বিভাকে। যে কারনে বিভা বহরমপুরে শ্বশুর ভাসুর সবাইকে নিয়ে থাকতে রাজি থাকলেও অতীন প্রায় একপ্রকার জেদ করেই বিভাকে কলকাতায় এনে তুলল । না হলে অতীনের মা বাবা দাদা বউদি সবাই চেয়েছিল বিভা ওখানেই থাক , অতীন না হয় সপ্তাহে সপ্তাহে আসবে। কিন্তু না অতীন বিভাকে একা ছাড়বেই না। প্রথম প্রথম বিভার এই চোখে হারানোটা বেশ লাগত কিন্তু দিনে দিনে কেমন পাহারাদারীর মতো ঠেকছিল। অথচ অতীন মানুষটা বেশ সোজা সাপটা , বিভার আক্ষরিক অভিভাবকও বটে। কিন্তু কেন জানি না বন্ধুত্বটা কম , শাসনটা একটু বেশি লাগে বিভার। সাথে সাথে ফ্যামিলি এক্সপ্যানসনের কথা শুনলেই অতীনের এড়িয়ে যাওয়াটাও ভালো লাগে না বিভার। তাই মাঝে মাঝে বিভার দমবন্ধ হয়ে আসত কলকাতার এই অজানা পরিবেশে। একমাত্র অক্সিজেন বলতে তার দিদিভাই আভা আর দুষ্টুর মাঝে মধ্যে চন্দননগর থেকে আসা যাওয়াটা । আভার স্বামী সুকান্ত মারা যাওয়ার পর এখনও আভা তার শ্বশুরবাড়ি চন্দননগরেই থাকে । এখন তার বাড়িতে অসুস্থ শাশুড়ি ছাড়া আর সেরকম কেউ নেই । বছর তিনেক আগে বারুইপুর মিউনিসিপ্যালিটিতে সুকান্তর চাকরীটা কমপ্যাশনেট গ্রাউন্ডে পেয়েছিল আভা। সেই কারনে বিভা কলকাতায় আসার পর ছুটিছাটায় মাঝে মধ্যে দুষ্টুকে বিভার কাছে রেখে যায় আভা। বিভা আর দুষ্টু মিলে তখন খুব হৈ-হৈ হয় । কিন্তু অতীন সেটাতেও মাঝে মাঝে আপত্তি করত। তাই নিয়ে আভা যদিও কিছু মনে করে নি কখনো, শুধু বিভাকে বোঝাত অতীনের সাথে এ ব্যাপারে যেন ঝগড়াঝাটি না করে। কিন্তু তা বললে কি হবে… বিভার একমাত্র ভালোলাগার জায়গা তো ওই দুষ্টুই …তাই অতীন দুষ্টুকে রাখার ব্যাপারে বিরক্তি দেখালেই বিভার সাথে অতীনের এক চোট ঝামেলা হয়েই যেত । বিভার বেশ মনে আছে, এমনি একদিন , দুষ্টুকে নিয়ে দুজনের তর্কাতর্কির পর অতীন অফিসে বেড়িয়ে গিয়েছিল কিছু না খেয়েই । বেশ অনেকক্ষণ একা একা বাচ্ছা মেয়ের মত বালিশে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেছিল বিভা , কোনও কাজ করে নি, তারপর দুপুরের দিকে ফ্ল্যাটের পশ্চিমের একচিলতে বারান্দাটায় এসে দাঁড়িয়েছিল বিভা। শীতকাল , দুপুরের ঝলমলে রোদে চারিদিক বেশ ঝকঝক করছিল , কিন্তু তার ছটফটে চড়াই চড়াই মনটায় সেদিন কেমন যেন পড়ন্ত রোদের আঁচ। দুপুরে সে কিছু খায়ও নি, মনে মনে ভেবেছিল অতীন বোধহয় ফোন করবে, তাড়াতাড়ি চলে আসবে …তারপর দুজনে মিলে একসাথে খাবে । কিন্তু কোথায় কি? অতীন তো ফোন করেই নি উপরন্তু বিভা মোবাইলে রিং করলেও সে সমানে ফোন কেটে দিচ্ছিল। বিভা কেমন যেন অস্থির হয়ে উঠছিল ।… আসলে বিভা অতীনের সাথে পারতপক্ষে ঝামেলা করেই না…কিন্তু ঝামেলা হলে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে থাকে । বিভার এই দুর্বলতাটা আর কেউ বুঝুক না বুঝুক অতীন কিন্তু ভালোই বুঝত। তাই বিভার ফোনটা না ধরায় অতীন যতটা স্বস্তি বোধ করছিল… বিভা ততটাই অধৈর্য হয়ে উঠছিল। বিভার একটুও ভাল লাগছিল না। মনটা হালকা করার জন্য সে দিদিভাইকে ফোন করল…কিন্তু ফোন নট রিচেবেল । ‘দূররর’… রাগ করে বিভা ফোনটা সুইচ অফ করে বিছানায় ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে চুপ করে বসে রইল কিছুক্ষন …এমন সময় হঠাৎ ল্যান্ডলাইনটা বেজে উঠতেই বিভা ছুটে গেল …অতীনের ফোন ভেবে…কিন্তু ফোনটা ধরতেই অপরপ্রান্তের মানুষটি বলল…
– কি ব্যাপার মেমসাহেব… আজ দুপুরে ঘুমোওনি মনে হচ্ছে?
বিভা চুপ …
-হ্যালো …হ্যালো, তোমার এত রাগ কিসের মেমসাহেব? জানো তো বেশি রাগ করলে শরীর খারাপ হয়… মনও খারাপ হয়।
নীলের ফোনটা তার কাছে তখন অসহ্য মনে হচ্ছিল। সেই প্রথম দিনের পর দুপুরের দিকে নীল এর আগেও বেশ কয়েকবার বিভাকে ফোন করেছিল। প্রতিবার না হলেও এক আধবার নীলের সাথে বিভার কথা হয়েছিল। বিভা প্রথম দিকে একটু আধটু কথা বললেও পরের দিকে এড়িয়েই চলত.. । যদিও বিভার ছেলেটাকে খারাপ মনে হয়নি …তবে কেমন যেন পাগলাটে লেগেছিল। বেশি কথা বলে । বিভার বিষয়ে বেশি কিছু না জানতে চাইলেও , নিজের ভালোলাগা মন্দলাগার খবর বিভাকে কিছুটা দিয়েছিল। কথায় কথায় বিভা জেনেছিল, নীল তার চেয়ে নয় নয় করে তিন চার বছরের ছোটোই হবে । সে যাই হোক অচেনা কারোর বিষয় তার অত জেনেই বা লাভ কি ? অকারন গল্প করে কিই বা হবে, এই সব ভেবে ইদানীং আর কথা বলতে ভালো লাগত না বিভার । ঠিক এই কারনে প্রথমে কোনো কথা বলেনি বিভা , ফোনটা কেটেই দিয়েছিল। তারপর চুপ করে কিছুক্ষন খাটে শুয়ে রইল সে … ভাবল আচ্ছা সে যে রাগ করেছে , ঘুমোয়নি একথা ওই নীল জানলো কি করে ???? ব্যস ভাবামাত্রই মোবাইলটা তুলে নিয়ে সুইচ অন করে একটু মনে করে করে নম্বরটা ডায়াল করল বিভা। ওপ্রান্তে হ্যালো বলার সাথে সাথেই বিভা বলে উঠল ,
-আচ্ছা আপনি হঠাৎ বললেন কেন, আমার রাগ হয়েছে … আমি আজ ঘুমোই নি ?
-আরেব্বাস এটা তোমার মোবাইল নম্বর মেমসাহেব ?
-হুম… তো? আগে বলুন আপনি একথা বললেন কেন?
-হুম বলব তো…বলতে তো হবেই। কারন শুধু এই প্রশ্নটা জানতেই তুমি আমাকে আজ নিজে থেকে ফোন করলে মেমসাহেব …কিন্তু মাঝের এই আপনি আপনি ডাকটা কি বদলে তুমি করা যায় না?
-সেটা যায়, কিন্তু আগে বলুন…
-বলব… প্লিজ আপনি ডাকাটা বন্ধ করো মেমসাহেব।
-আচ্ছা বেশ… এবার বলো দেখি।
– এটা তো ভারী সোজা। অন্যদিন আমি ফোন করলে তুমি অনেকক্ষন পর ফোন ধরো আর ঘুম জড়ানো গলায় হ্যালো বলো। কিন্তু আজ তোমার গলায় সেই আলসেমীটা ছিল না।
-আচ্ছা তাই থেকেই তুমি বুঝলে আমি ঘুমোই নি? কিন্তু রেগে গেছি সেটা বুঝলে কি করে…
-এটা তো আরো সোজা …তুমি তো কথাই বলো নি…মানে হ্যালো টুকুও না…তার মানে আমার ফোনটা একেবারেই তোমার কাছে এক্সপেক্টেড নয়…
-বাব্বা তুমি এত স্টাডি করো নাকি মানুষকে ?
-নাহ , সবাইকে না… ।
-তাহলে কি আমাকে? কিন্তু কেন?
-ঠিক তোমাকেও না… তোমার ভয়েসটাকে ।
– আচ্ছা তাই বুঝি…? কিন্তু সবাই যদি এমন করে বুঝত, তাহলে তো…
-কি ব্যাপার মেমসাহেব আজ এমন মনমরা হয়ে আছো কেন?
-আমার কণ্ঠস্বরে এটাও বুঝি বোঝা যাচ্ছে ?
-হুম যাচ্ছে তো? আসলে কি জানো তোমার অস্তিত্বটা আমার কাছে শুধু কন্ঠস্বরে তো তাই বোধহয় …
– বুঝলাম…তা কি করা হচ্ছে এখন অফিসে?
– সেরকম কিছুই না… আচ্ছা তোমার মন খারাপ কেন ?
-নাহ মন খারাপ নয় তো? আচ্ছা তুমি যে এতো বোঝো , তোমার বাড়ীর লোকেদের সবাইকে বুঝতে পারো…
-বাড়ির লোক মানে কার কথা বলছো… বউ ?..তাহলে জানিয়ে রাখি… আমার বিয়ে হয় নি এখনো। এখনও আমি স্বাধীন…বশ্যতা স্বীকার করি নি।
– বিয়ে মানেই পরাধীন নাকি ?
-হ্যাঁ তো …সবার ক্ষেত্রেই, তবে মেয়েদের ক্ষেত্রে বেশি…
-আচ্ছা তোমার কোনো বান্ধবী নেই?
-বান্ধবী মানে গার্ল ফ্রেন্ড বলছো কি? …তাহলে বলি, ছিল…হয়ত আছেও!
-এ আবার কিরকম উত্তর!!!!
-না মানে তার যখন আমাকে দরকার তখন আছে …যখন দরকার পড়ে না তখন ডাকলেও সাড়া পাই না।
-কেন?
-কি কেন? অনেকদিনের সম্পর্ক মেমসাহেব । আছি ওই পর্যন্ত । একসময় এত কথা বলেছি …এখন কথা ফুরিয়ে গেছে …সারাদিনে একবার শুধু থাকাটা জেনে নেওয়া।
-এমন কেন? এখনো তো বিয়ে করনি।
-কেন তোমাদের বিবাহিত জীবনে সম্পর্কগুলো বুঝি ফুরিয়ে যায় না?
-না… বুড়িয়ে যেতে পারে … ফুরিয়ে যাবে কেন?
-যায় মেমসাহেব যায়… কিন্তু বিয়ে হয়ে গেছে বলে সহজে কেটে বেরোনো যায় না।
-কি জানি …ভাবিনি কোনোদিন এমনভাবে।
– তোমার গার্ল ফ্রেন্ডের নাম কি?
– ইমলি…
– ওমা কি মিষ্টি নাম!!!!
– মিষ্টি ??? তেঁতুল আবার মিষ্টি হয় নাকি?
– খাট্টা মিঠা তো হয় …
– তাতে কি বোঝা গেল শুনি?
– অনেক কিছু ।
– কি আবার বুঝলে?
– বুঝলাম এই যে, তুমি যেমন বুনো ওল সেও তেমন বাঘা তেঁতুল । কি তাই তো????
– তোমার এই হাসিটা আমার বেশ লাগে মেমসাহেব …
-তোমার এই মেমসাহেব ডাকটাও আমার বেশ লাগে । যাক অনেক হয়েছে…এখন রাখি …কাজ আছে অনেক …বাই।
– এবার ফোন করলে বিরক্ত হবে নাতো …মে-ম সাহেব?
– তা বলতে পারছি না… সব আমার মুডের ওপর নির্ভর করছে…এখন রাখছি। বাই
– হুম রাখ। আই উইল ওয়েট ।
অতীনের কড়া কড়া কথা আর উপেক্ষায় বিভার মনটা এতটাই বিপর্যস্ত ছিল , যে নীলের সাথে সামান্য কটা কথা সেদিন তার বেশ লেগেছিল। মনটা বেশ হালকা হয়ে গিয়েছিল। তার যে মনটা তাকে ইদানীং কোন কিছুতেই সঙ্গ দিচ্ছিল না, সেই মনটা কিন্তু নীলের সাথে কথা বলার ছাড়পত্র দিয়েছিল খুব সহজেই।
……………………..