This entry is part 4 of 8 in the series চাঁদের পরিক্রমণ

 

পর্ব -৪।


কলেজের গেটের মুখে আসতেই…মোবাইলটা বেজে উঠল ।ব্যাগ থেকে ফোনটা বার করে ধরতে না ধরতেই…..লাইনটা কেটে গেল ….চাঁদ মাথা নামিয়ে ,কার মিসড কল দেখতে দেখতে সামনের ল’নে এগিয়ে যাচ্ছিল …..উল্টোদিক থেকে হঠাৎ একটা ধাক্কা …..ব্যস….হাতের খাতা বই সব নীচে পড়ে ছড়িয়ে গেল ।…বিরক্তি , বিষ্ময়, আর যন্ত্রনা সব মিলিয়ে ….অস্ফুটে একটাই শব্দ বেরিয়ে এল চাঁদের মুখ থেকে……..’উফফফফ’
-সরি ,সরি , এক্সট্রিমলি সরি ম্যাম…..আমি…আমি সব তুলে দিচ্ছি ….গুছিয়ে দিচ্ছি ….
নীচু হয়ে চাঁদের পায়ের কাছে ছড়িয়ে যাওয়া খাতাগুলিকে গুছিয়ে তুলে দিতে যাওয়া ছাত্রটিকে চাঁদ একটু অপ্রস্তুত হয়ে জিজ্ঞেস করল…
-নাম কি ? কোন ইয়ার ?
-পারিজাত বসু ….থার্ড ইয়ার….কম্পিউটার সায়েন্স…ম্যাম।
চাঁদ খাতা গুলো হাতে নিয়ে বলল…
-মনটা কোথায় থাকে…একটু দেখে যেতে পারো না?….
-আর এরকম ভুল হবে না ম্যাম….ওই একটা ফোন নাম্বার খুঁজতে গিয়ে ….
-ইট্’স ওকে….যাও ।

পারিজাত চলে গেল ওর সামনে থেকে….চাঁদ ভাবল …’সেই তো আমিও তো মাথা নামিয়ে ফোনই দেখছিলাম ….ভাগ্যিস ছেলেটা পাল্টা কিছু বলে নি…বললে আমিই বা কি জবাব দিতাম….’
একটু হেসেই ফেলল, চাঁদ নিজের মনে….
কলেজে চাঁদ এখনকার প্রজন্মকে এরকম যত দেখে ,ততই যেন সেই পুরোনো দিনগুলো তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে….

……মনে পড়ছিল…. সেই যেদিন চাঁদ বাসে উঠে বসেছিল একরাশ অপেক্ষা নিয়ে….শেষ পর্যন্ত বাসটা ছাড়ার মুখে হঠাৎ কি যেন ভেবে সিট ছেড়ে উঠে পড়ল…..ভিড় ঠেলে ধাক্কাধাক্কি করে….কান গরম করা কিছু মন্তব্য পেরিয়ে ….বাসের সিঁড়ির কাছে এসে দাঁড়িয়েছে… দরজা খুলে বেরোতে যাবে ….মূর্তিমান ঝড় ….এক্কেবারে মুখোমুখি …ধাক্কা খেতে খেতে বেঁচে গেল…. এতক্ষণে এসে হাজির….সোহম!!
-কিরে নামছিস কেন? চল ভেতরে চল….
চাঁদ একটু ভাবল….তারপর ইতস্তত করে…
-না…আমি একবার যখন সিট ছেড়ে উঠে এসেছি…পরের বাসেই যাব….
-আচ্ছা …ঠিক আছে নাম….তাড়াতাড়ি…এখুনি সবাই চিৎকার করবে ….

চাঁদ নেমে পড়ল বাস থেকে…বাসটা বেরিয়ে গেল…..
বাস থেকে নেমে , দূরে তাকিয়ে বাসস্ট্যান্ডের ভিড় দেখে একটু রাগ দেখিয়ে বলল…..’দূর বাসটা না ছাড়লেই হত….’
-হুমম….তাই তো বলতে চেয়েছিলাম….যাক ছাড় … আজ আমার সময়ের সাথে নিজেকে একটু মিলিয়ে দেখ না…..কিন্তু হঠাৎ যে বড় নেমে পড়লি….

প্রশ্নটা ছুড়ে দিয়ে সেই মিচকে শয়তানি হাসিটা আর চিরাচরিত চশমার ভেতর দিয়ে সেই মন পর্যন্ত ছুঁয়ে ফেলা দৃষ্টিতে তাকালো চাঁদের দিকে…..
-উফফ…চশমাটা নাকের ডগা থেকে তোল । …যেন মূর্তিমান মহাকাল… হ্যাঁ তো কি হয়েছে ?….ইচ্ছে হল তোর সাথে যাবার….তাই….
….তুই এত লম্বা না….তোর দিকে তাকিয়ে কথা বলতে আমার ঘাড়ে ব্যাথা হয়ে যায়…..(চাঁদ একটু হেসে লজ্জা পেয়ে মাথাটা নামিয়ে নিল)
-আচ্ছা ????? আর আমার বুঝি মাথা নামিয়ে কথা বলতে অসুবিধে হয় না?? সবচেয়ে বড়ো কথা ….জীবনে যে ছেলে কখনও কারোর সামনে মাথা নামায় না…. তুই কোন মালিকা-এ-সুলতানা ,যে আমায় মাথা হেঁট করে তোর সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে…..শুনি?
-বাঃ ভালো বলেছিস তো….ধরে নে না রাজিয়া সুলতান…

এই বলে দুজনেই হেসে উঠল…তারপর চাঁদ বলল… ‘ তবু তো কাউকে পেলি যার সামনে তুই অকপটে তোর মাথা নামাতে পারছিস….’

কথার মাঝখানে বাম্পার টপকে টপকে বাস চলে এল…..ঘুরে এসে স্ট্যান্ডে দাঁড়ালো ….অজগরের মত লাইনটা নড়েচড়ে উঠল….আজ আর বাসে সিট পাওয়া যাবে না….লাইন দিয়ে বাসে উঠেই, সোহম কেবিনের দিকে এগিয়ে গেল….চাঁদকে বলল…’এদিকে আয়…’ ড্রাইভারের পিছনে হেল্পারের সিটে কনডাক্টর বসেছিল….গাড়িটা ছাড়ার মুখে সে উঠে পড়তেই ….সোহম চাঁদকে বলল …’বসে যা….আর আমার কলকব্জা গুলো ধরে নে….’
চাঁদ হেসে ফেলল…’তোর কলকব্জা??? কি যে বলিস…যাঃ !!!! কনডাক্টরকে গেটের মুখ থেকে আসতে দেখেই চাঁদ ব্যাগ থেকে টাকা বার করতে করতে বলল’ আজ আমি টিকিট কাটব দাঁড়া…আগের দিন তুই কেটেছিস…..’
চাঁদ কনডাক্টরকে ডাকল….
কনডাক্টর ডাকটা উপেক্ষা করে উল্টো দিকে চলে গেল………

-দেখেছিস….আমি নিজে থেকে টিকিট কাটতে চাইছি…আর উনি ওদিকে হাত পেতে চাইতে চলে গেলেন ….
-তোর এত তাড়া কিসের বল তো টিকিট করার….দাঁড়া না…বাসে ভিড যা….এমনিতেই একবার কনডাক্টর ভেতরে গেলে ,বেরিয়ে আসতে আসতে আমরা সদন পৌঁছে যাব….তখন কে কার টিকিট কাটে ????
-যাঃ…তাই বলে বিনা টিকিটে….
চাঁদকে কথা শেষ করতে না দিয়ে …সোহম গলাটা একটু তুলেই বলল ‘আমি কি তাই বললাম?…তবে টিকিটের জন্যে স্টপেজে দাঁড়িয়ে তো আর পরের বাসটা মিস করব না!!!’
হঠাৎ বাসের সিঁড়ির মুখে দাঁড়ানো ইন্সপেক্টর বললেন ‘আপনাদের টাকাটা বাড়ান দেখি এদিকে….’
সোহম চাঁদের দিকে তাকিয়ে হেসে বলল….’দেখলি কেমন ভাবে ডাকতে হয়….’
চাঁদ হাসল…’বুঝলাম…নে টাকাটা ধর…’
সোহম নিজের বুক পকেট থেকে টাকা বার করে টিকিট করতে দিল…
-এটা কিন্তু ভীষণ বাজে হচ্ছে …রোজ রোজ তুই কাটলে…..দ্যাট’স অ্যান ওব্লিগেশান, ওম….এরকম করলে তো তোর সাথে আর যাওয়াই যাবে না….

-আচ্ছা আচ্ছা …মেরী মা….ফেরার সময় তুইই কাটিস….আর ফেরার সময় কেন এবার থেকে আমি তোর সাথে গেলে টিকিটই কাটবো না…তুই দেখ……
চাঁদের রাগ রাগ মুখটায় এবার একটু হাসির রেখা দেখে সোহম বলল…’ইউ আর সো ইমপালসিভ চাঁদ….জীবনটা এত ছোট্ট নয় , যে একদিনে ফুরিয়ে যাবে….এইভাবেই সব চলছে চলবেও……কালও হয়ত এইভাবে তোর আমার দেখা হবে….তখন কাটবি টিকিট……’

সোহমকে থামিয়ে দিয়ে চাঁদ বলে…’উঁহু….ভুল..পৃথিবী ঘুরছে …ঘুরবে …..থিওরি অফ রিলেটিভিটি…জীবন চলছে চলবে….কিন্তু কে বলতে পারে আজ আমি আছি বলেই কাল থাকব?? আমি মুহূর্তে বিশ্বাস করি ওম্ !!!! কাল কে দেখেছে???
-মানলাম … কিন্তু জীবন তো মুহূর্তেরই কোলাজ….
-এক্জ্যাক্টলি….নট নেসেসারি যে কনটিনিউইটি থাকতেই হবে…..

সোহম আর কথা বাড়ালো না…শুধু মুগ্ধ দৃষ্টিতে একবার চাঁদকে দেখল,তারপর কেমন যেন ভাবনায় ডুবে গেল….এতদিন সবার মুখের কথা সোহম কেড়ে এসেছে …আর আজ এই পাঁচ ফুট দুই-তিন ইঞ্চির মেয়েটার কথায় সে কথা হারিয়ে ফেলছে কেন?…তার খুব ইচ্ছে করছিল চাঁদের হাতটা একবার ছুঁয়ে দেখে….
এমন সময় বাস কনডাক্টর চেঁচিয়ে উঠল…’ এক্সাইড এক্সাইড’ ….চাঁদ বলল ‘বাসটা আজ নন্দনের সামনে দিয়ে এল খেয়াল করিনি …কিরে নামবি তো ….’
সোহম যেন হারিয়ে গিয়েছিল ….বাস থেকে নেমেই দুজনে ছুট লাগালো…. ক্রসিং-এ দাঁড়ানো যাদবপুরের বাস দেখে……ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে সোহম বাসের দরজায় পৌঁছোলো…ইতিমধ্যে চাঁদও এসে পড়ল….যথারীতি বাসে উঠে ,একটাও বসার জায়গা নেই…দুজনেই দাঁড়িয়ে রইল…চাঁদ সিটের সামনে…সোহম পিছনে ….সোহম নিজের মাথা বাঁচাতে ,ঘাড়টা ঈষৎ নীচু করে সামনের দিকে ঝুঁকে ,দুহাতে মাথার ওপরের রডটা ধরে দাঁড়ালো… এতে চাঁদের একটু অস্বস্তিই হচ্ছিল….কারণ দুজনেই বেশ হাঁপাচ্ছিলো,আর সোহমের গরম নিঃশ্বাসটা চাঁদের গায়ে পড়ছিল……চাঁদ একটু পিছন ফিরে তাকাতেই….সোহম বলল…’আজ তোর কি টেস্ট ?’
-মেটিরিয়াল….একটু বইটা দেখতে পারলে হত….কিন্তু আজ এত দেরি হয়ে গেল….! তোর কি সাবজেক্ট…ডিজাইন?
-হুম…মেশিন ডিজাইন ।

…এ কদিন ওদের স্টাডি লিভ ছিল…আজ থেকে ফার্স্ট সেমিস্টার শুরু ….দুজনেই যে আজ প্রথম একসাথে যাওয়ার ভালোলাগাটা একটু উপভোগ করবে তার আর উপায় কোথায় !!!
পার্ক সার্কাসের কাছে আসতেই চাঁদের সামনের মহিলা উঠে পড়লেন….চাঁদ সোহমকে বসতে বলল ।
-আমি তো আগের বাসে বসে এলাম…তুই বসে পড়…
-তুই একটা মেয়ে হয়ে দাঁড়াবি আর আমি কলেজের স্টুডেন্টস ইউনিয়নের এগজিকিউটিভ মেম্বার হয়ে তোর সামনে বসে থাকব! এটা হয় কোনোদিন? তুই বস…আর পারলে বইটা বার করে একটু চোখ বুলিয়ে নে….

একরাশ অস্বস্তি নিয়ে চাঁদ বসে পড়ল ….আর বইটা ব্যাগ থেকে বার করে দেখতে লাগল …
সোহম বলল ‘সব কিছুই ভালোলাগে…যদি রেজাল্টটা ভালো হয়….জানিস তো..!!’

চাঁদ বইটা খুলে বসল বটে…কিন্তু তিন-চারবার ওড়না ঠিক করল…চুলটা নিয়ে একটু নাড়াচাড়া করল….বইয়ের পাতাগুলো ওল্টালো….তবুও তার একটুও মন বসল না….সোহমের দিকে তাকিয়ে দেখল …সে তার বইয়ের দিকেই দেখছিল….চাঁদের সাথে চোখাচোখি হতেই সোহম জানলার দিকে তাকাল…. চাঁদ মাথা নামিয়ে চেষ্টা করছিল মনোসংযোগ করতে ….কিন্তু তার খালি মনে হতে লাগল ওর মাথার ওপর সোহমের দুজোড়া চোখ যেন খোলা বইটার অছিলায় ওকেই পড়তে চেষ্টা করছে…..
…..ওদিকে সোহম জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়েছিল ঠিকই কিন্তু ভাবছিল….চাঁদের মধ্যে কি যেন একটা আকর্ষণ আছে …সেটা কথায়…না …কন্ঠস্বরে…নাকি ব্যক্তিত্বে…কি জানি …. ।
ঢাকুরিয়া ব্রিজের কাছে এসে বাসটা বেশ ফাঁকা হল…সোহম চাঁদের পাশে বসতেই চাঁদ বলল,
-দূর আর পড়তে ভাল্লাগছে না…যা হবে …হবে…আজ একসাথে প্রথম এলাম আর কিছু গল্পই হল না…
-দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে থোড়ী কথা হত ম্যাডাম …বল কি বলবি…
-বলবো না…শুনব …তোর কথা….
-আমার কথা?…আজ থাক…পরে হবে ক্ষণ…তুই ফ্রী থাকলে বলিস…আমি ফোন করব….
…..যাদবপুরে বাস থেকে নেমেই বাসস্ট্যান্ডের সামনে সোহমের সাথে সৈকতের দেখা…
সোহম চাঁদকে বলল’…তুই এগিয়ে যা..বাই…অ্যান্ড বেস্ট অফ লাক…’
কিঞ্চিত ভুরু কুঁচকে, একটু চুপ করে থেকে বলল .. ‘থ্যাঙ্ক ইউ …সেম টু ইউ…বাই…’
…চাঁদ এগিয়ে গেল….মনে মনে ভাবল …এই এড়িয়ে যাওয়াটার কি খুব দরকার ছিল….ওর চেনা মহলে চাঁদ যেন ব্রাত্য….
…সৈকত সোহমকে বলল..’ব্যাপারটা কি?….কে মেয়েটা…আগের দিন বাসে…আজ কলেজে …একসাথে…আগে দেখিনি তো?
-এক জায়গায় থাকি তো…আগে অবশ্য আমিও জানতাম না….
-আচ্ছা আচ্ছা ….তা তুই ডান দিক বাঁদিক দুইদিকই সামলাচ্ছিস নাকি??
-আরে না না…দূর… পরীক্ষাটা দেবার ইচ্ছে আছে কি?? কটা বাজে দেখ!!!
….এই বলে দুজনে দৌড় লাগালো ইউনিভার্সিটির গেটের দিকে …

…………………………………………………………………………………………………ক্রমশ

 

Series Navigation<< চাঁদের পরিক্রমণ /৩চাঁদের পরিক্রমণ /৫ >>
© Copyright 2014 @indrila, All rights Reserved. Written For: Oimookh