পর্ব – ৮
————————————————————————————–
দেখতে দেখতে দুর্গাপুজোর চারটে দিন কেটেই গেল…। আজ দশমী। বিসর্জনের সুর বেজে উঠেছে । চারিদিকে ঢাকের আওয়াজ …। ঘটের সুতো কাটা হয়ে গেছে…।
…চাঁদ ঘর থেকে দক্ষিনের বারান্দায় এসে দাঁড়াল । মোবাইলে একের পর এক শুভ বিজয়ার এসএমএস আসছে । চাঁদ দেখছে বটে কিন্তু কোনও উৎসাহ নেই পাল্টা উত্তর দেওয়ার । এমন সময় ফোনটা বেজে উঠল…স্ক্রীনে দেখা যাচ্ছে “ সৈকত কলিং”…ফোনটা বেজেই যাচ্ছিল । আর চাঁদ অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল ফোনের দিকে । অবশেষে ফোনটা থেমে গেল । তার একটু পরেই একটা এস.এম.এস।
……… ” শুভ বিজয়া…রঞ্জা আর ইন্দ্রদা অনেক বছর বাদে টেক্সাস থেকে কলকাতায় আসছে কালিপুজোয় । আমাদের সাথে দেখা করতে চায় …দীপাবলীর সন্ধ্যেয় আমার বাড়ি সবার নিমণ্ত্রন রইল …আমরা তোর অপেক্ষা করব… তুই আসিস কিন্তু …প্লিজ ।”
চাঁদ মেসেজটা দেখল…তারপর ফোনটা বন্ধ করে রাখল …। কোনো কিছুর বহমানতা চাঁদকে তার স্থবির অবস্থাটা কাটাতে যেমন সাহায্য করে তেমনই ডুবে যেতেও করে । দক্ষিনের এই বারান্দাটা তার খুব প্রিয় ।এখানে বসে থাকলে রাস্তার ধারের দৃশ্যপট অনেক কিছু দেখা যায় । চারপাশের আলোর রোশনাই …ঢাকের আওয়াজ ……মানুষের যাতায়াত…কোলাহল , এসব কিছুর মধ্যে দিয়েই সে হারিয়ে গেল অতীতের সেই অন্ধকারে ।
……সোহমের সাথে শেষবার ফোনে কথা হওয়ার পর চাঁদ আর ফোন করেনি । তার খুব ইচ্ছা করেছে……বেশ কয়েকবার ফোনের কাছে গেছে , রিসিভার তুলেছে , তবুও নিয়ন্ত্রন করেছে নিজেকে । এর মাঝে কলেজে আর দেখাও হয়নি সোহমের সাথে। রঞ্জার সাথেও ইন্দ্রদার বিষয়ে কোনও কথা হয় নি। তিন চারদিন পর মহালয়া । কলেজে ছুটি পড়ে গেল । রঞ্জার তো বাড়ি যাবার কথাই ছিল। ছুটি পড়ার শেষ দিনটায় সবার বেশ আনন্দ…উন্মাদনা…… পুজোয় ঘুরতে যাওয়ার… ঠাকুর দেখার…কিন্তু চাঁদ এড়িয়ে গেল…। সৈকত বলল “কি ব্যাপার বলতো…। সোহম বেপাত্তা…তুই এড়িয়ে যাচ্ছিস …রঞ্জা তো বাড়ি যাবে…কি হয়েছে তোদের?”
পুজো আসার থেকেও পুজো আসছে আসছেই ভালো । অন্যান্য বছর পুজোয় কত মজা হয় …বেড়ানো হয়…এবছর পুজোতে চাঁদের এসব কিছুই হল না…এমন কি নতুন জামাগুলো পযর্ন্ত আলমারী বন্দী হয়েই রইল…। এমনি করেই দুদিন কেটে গেল…। অবশেষে অষ্টমীর দিন সকালে চাঁদ রওনা হল কল্যানীতে তার কাকার বাড়ির উদ্দেশ্যে । খুড়তুতো বোন অরুনিমার সাথে তার বেশ ভাব । অষ্টমী আর নবমী বেশ গল্প গাছায় কেটে গেল…কাকাদের পাড়ার এ্যসোসিয়েশানের পুজো । বাড়ির মত…খাওয়া দাওয়া, নাচগান হইহট্টগোল…। এর মাঝে মাঝে চাঁদের মনটা এক আধবার যে উদাস হয়ে যায় নি তা নয়…তবুও একাকিত্বটা অতটা ভারি ঠেকে নি। কাকার সাথে চাঁদের সম্পর্কটা বেশ বন্ধুর মত। তিনি বললেন “বাব্বা চাঁদ সেই আহ্লাদী মেয়েটা কত বড়ো হয়ে গেছে…কিরে কলেজে বিশেষ কেউ বন্ধু হয়েছে নাকি?” চাঁদ হেসে এড়িয়ে যায় …বলে “কাকাই যদি হয় তুমি সবার আগে জানবে……কথা দিলাম ।” কিন্তু কাকাই লক্ষ্য করেছেন চাঁদের সেই উচ্ছ্বলতাটা আর নেই……এবার কেমন যেন একটু নিস্পৃহ লাগছে…। সেই ছটফটে মেয়েটা কেমন যেন মোহময়ী বিষাদঘন …। তবুও বড়োদের চোখে তো সেই আগের মত ছোট্টোটিই আছে সে।
……………পুজোর দিনগুলো কেটেই গেল …দশমীর দিন বেলার দিকে স্নান করে প্যান্ডেলে বোনের সাথে…। পুজো শেষ…বিসর্জনের সানাই বেজে গেছে …ঢাকে বোল উঠেছে … “ঠাকুর থাকবে কতক্ষন…ঠাকুর যাবে বিসর্জন”……দুপুরেই বিসর্জনে যাবে সবাই ।
কাকাই জোর করলেন “ চল , বিসর্জন দেখতে যাবি ।”
চাঁদ বলল…..“না কাকাই আমার মন কেমন করে । ওই সুন্দর মুখটা কেমন
জলের মধ্যে ডুবে যায়…আমার বড় ফাঁকা লাগে…একা লাগে…
থাক না কাকাই।”
কাকাইঃ আরে বিসর্জন না দেখলে পুজো সম্পূণর্তা আসে না ।
চাঁদঃ আমার সম্পূণর্তা ভালো লাগে না কাকাই…। কেমন যেন সব শেষ হয়ে
যায় । থাক না কাকাই ওই সুশ্রী মুখের অসম্পূর্ণ স্মৃতিটুকুই থাক ।
কাকাই ছাড়বার পাত্র নন । অগত্যা যেতেই হল …উপায় কি?
যদিও খুব মজাই হয়েছিল বিসর্জনের যাত্রাপথটা । নাচগান বাজনা হৈহৈ … বিসর্জন সেরে ফিরতেও বেশ রাত্রি হয়ে গেল । বাড়ি এসে সবাই বেশ বিধ্বস্ত । তার ওপর পাড়ার সবাই সিঁদূর মাখিয়ে দিয়েছে । কাকিমা বললেন “ কি ভালো লাগল চাঁদ ? বাব্বা, মেয়ের মুখ দেখ একদম সিন্দুরে লাল হয়ে আছে । নাও…অনেক রাত হল যা তোরা গা হাত পা ধুয়ে …খেয়ে নে ”। আরক্ত মুখে হাসল চন্দ্রিমা…। এত হৈহৈ-এর মধ্যে কাকিমা কিন্তু বলতে ভুলে গেল যে সৈকত ফোন করেছিল । খাওয়া দাওয়া শেষ… চাঁদ মনে মনে ভাবল সোহমকে কি একটা ফোন করলে হত…বিজয়ার শুভেচ্ছা জানালে কি , ও আর রাগ করে থাকতে পারবে? ঝগড়াটা মিটিয়ে নেওয়াই ভাল…সেদিন চাঁদও তো কম কিছু বলে নি…। সোহমকে ফোনটা করেই ফেলল চাঁদ….. কিন্তু রিং হয়ে গেল …কেউ ধরল না। অরুণিমা এসে বলল “ দিদিভাই চল ঘুম পাচ্ছে খুব…… শুয়ে পড়ি”… চাঁদ একটু ইতস্তত করে চলে গেল শুতে। রাত্রে শুয়ে শুয়ে চাঁদের খুব মন খারাপ করতে লাগল সোহমের জন্য…ভাবল এত রাগ যে ফোন ধরল না । তবে এই নাম্বারটা তো ওর অজানা …ও বুঝবে কি করে……তাহলেও একটা রিং ব্যাক তো করে দেখতেই পারত…এমন কঠিন ইগো মানুষের কেন হয় কে জানে…!!কেন যে জীবনের অঙ্ক গুলো সহজে মেলে না তাও জানি না…ফোন টা যদি ধরত কার কিই বা এসে যেত । সে মনে মনে ঠিক করল এবার ক্লাশ শুরু হলে সে আবার সহজ করে নেবে বন্ধুত্বটা। এই কদিনে সে খুব বুঝেছে সোহমকে ছেড়ে থাকা কি কষ্টের…যদিও ও সোহমের সাথে থেকেও কষ্ট পাবে …কারণ সোহম কোনোদিন তার হবে না…তবুও কথার নৈকট্য তো থাকবে…। একটা এমন অস্তিত্ব যাকে ছোঁয়া না গেলেও সাড়া তো পাওয়া যাবে…। সব পাওয়ার নাম ভালোবাসা নয়…। কিছু ছাড়ার নামও ভালোবাসা…এইসব ভাবতে ভাবতে কখন যে চাঁদ ঘুমিয়ে পড়েছে সে নিজেও জানে না…। সকালে অরুনিমার ডাকে ঘুম ভাঙলো চাঁদের…..”দিদিভাই ওঠ …অনেক বেলা হয়ে গেল যে”…..কাকিমা এসে বললেন …”খুব ক্লান্ত ছিলি তাই আর ডাকি নি… এবার ওঠ দশটা বাজতে যায়…কিছু খা…বাবা মাকে ফোন করে বিজয়ার প্রনাম জানা……আর হ্যাঁ তোর বন্ধু সৈকত কাল ফোন করেছিল …বলতে ভুলে গেছি । তোকে খুঁজছিল…একবার খোঁজ নিস।” চাঁদ একটু চমকে উঠল……এমন কি দরকার যে…এখানে ফোন করেছিল…ভাবল , ঠিক আছে একটু পরে একবার রিং ব্যাক করবে।
ফ্রেশ হয়ে চায়ের টেবিলে এসে বসল চাঁদ ……কাকাই খবরের কাগজ পড়ছে । চাঁদ সবে গরম চায়ে চুমুক দিতে যাবে ফোনটা বেজে উঠল…। চাঁদ ফোন ধরে বলল “হ্যালো…
চন্দ্রিমাকে একটু ডেকে দেবেন
চন্দ্রিমাঃ বলছি …কে বলছেন?
সৈকতঃ আমি …আমি সৈকত । আমি কালও ফোন করেছিলাম, তোর বাড়ি থেকে নাম্বার
নিয়ে…বিশেষ দরকারে ।
চন্দ্রিমাঃ হ্যাঁ কাকিমা বলতে ভুলে গেছিল…। আজ শুনলাম সকালে….বল…..ওহো…
শুভ বিজয়া…।
সৈকতঃ একটু চুপ করে থেকে সৈকত বলল “তুই কবে ফিরবি?”
চন্দ্রিমাঃ কেন? লক্ষ্মীপুজোর পর।
সৈকতঃ আজ ফিরে আয় চাঁদ।
সৈকতের থমথমে কন্ঠস্বরে চাঁদ বিস্মিত……
চন্দ্রিমাঃ কি হয়েছে সৈকত? সব ঠিক আছে তো ?
সৈকতঃ কি বলব বুঝতে পারছি না।
চন্দ্রিমাঃ কেন কি হয়েছে?
সৈকত নিরুত্তর……
চন্দ্রিমাঃ বল না প্লিজ …রঞ্জাদি ঠিক আছে তো ? রুদ্র দীপা সোহম?
সৈকতঃ আজকের কাগজের পাঁচের পাতাটা পড়ে দেখ চন্দ্রিমা ।
আমি পরে ফোন করছি …একটু পর…
রুদ্ধশ্বাসে চাঁদ বলল “একমিনিট ধর”……এই বলে কাকাই এর কাছ থেকে কাগজটা নিয়ে ঘাঁটতে লাগলো কিন্তু তাড়াতাড়িতে খুঁজে পেল না……তারপর বলল “না না …… আমি পড়তে পারছি না তুই বল প্লিজ!”
সৈকতঃ তুই শুনতে পারবি না…বাড়ি আয় তারপর বলব।
ইতিমধ্যে কাকাই ওদের কথা শুনে পিছনে এসে দাঁড়িয়েছেন।
চাঁদ উত্তেজিত হয়ে জিগ্যেস করল “কি আছে কাগজের পাঁচের পাতায় বল না সৈকত । আমি সব শুনতে পারব।”
সৈকতঃ একটা অ্যাক্সিডেন্ট……চন্দ্রিমা ।
চন্দ্রিমাঃ কার কি হয়েছে?
সৈকতঃ সোহমের।
চন্দ্রিমাঃ সোহমের? মানে ? কি বলছিস তুই ? …… বিষ্ময়ে হতবাক চন্দ্রিমা …… ফুঁপিয়ে উঠল বাচ্চা মেয়েদের মত।
………সৈকত একটু দম নিয়ে স্থির গলায় বলে চলল…
“কাল ওদের পাড়ায় ঠাকুর ভাসানে গিয়েছিল …। বিসর্জনের সময় ধাক্কধাক্কিতে জলে পড়ে যায় ও ……জোয়ারের সময় ….গঙ্গার জেটীর নিচে চলে গিয়েছিল বোধহয় পা স্লিপ করে……লোহার স্ট্রাকচার মাথায় লেগে ব্রেন হ্যামারেজ…। গোটা রাত তন্ন তন্ন করে খোঁজা হয়েছে …। আজ ভোরে খিদিরপুর ডকে ওকে পাওয়া গেছে …। সোহম আর নেই…… চন্দ্রিমা ।
সৈকতের গলাটা ধরে আসছিল…তবু বলল “হ্যালো চাঁদ শুনছিস ?”
চাঁদ নিরুত্তর…। কি বলবে …।ও যে গতকালই রাতে ওকে ফোন করেছিল। ফোন টা বেজে গেল …একথা বলতে চেয়েও বলতে পারছিল না……সব কথা তার শেষ হয়ে গেছে …। শুধু একটা দম বন্ধ করা কষ্ট তাকে ক্রমশ গ্রাস করে ফেলছে…।
সৈকত এবার বলল “ওকে বিকেল পযর্ন্ত রাখা হবে ,তুই চলে আয় চাঁদ……সৌনক দা এসে পৌঁছবে দুপুরে……ওর শরীরটা জলে……সৈকত আর বলতে পারল না…
চাঁদ এতক্ষণ পর স্থির গলায় বলে উঠল……
‘না , আমি যাব না সৈকত । আমি দেখতে চাই না ওকে আর ওইভাবে…আর কি দেখার আছে ……ওর ওই হাসি মুখটাই আমার মনে থাক আজীবন……আমি ওকে কথা দিয়েছিলাম আর কোনোদিন আমি ওর সামনে নিজে থেকে গিয়ে দাঁড়াব না……ইনভল্ভমেন্ট নাই বা থাকলো কন্টিনিউইটি থাক……আমি ওকে দেখতে যাব না সৈকত…… থাক ওর চ্যাপ্টার অসম্পূণই থাক…। ” চাঁদ কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল……পাশে কাকাই দাঁড়িয়েছিলেন …ধরে নিলেন ওকে…।ওর হাত থেকে ফোন নিয়ে সৈকত কে কিছু বললেন ……সেটা শোনার মত অবস্থায় চাঁদ ছিল না……।
কাকাই বাড়ি পৌঁছে দিলেন চাঁদকে সেইদিনই । ট্রেনে গোটা রাস্তা সে নিথর হয়ে বসে রইল……একটু যেন অসংলগ্ন । বাড়ি এসে মা সব শুনলো…..মাথায় হাত রাখতেই চাঁদ কেঁদে ফেলল …বলল “মা যাব একবার ……ওকে দেখে আসব কাকাইকে নিয়ে …… মা বললো ” থাক না চাঁদ …যা বলেছিস ঠিকই তো বলেছিস……নাই বা দেখলি শেষ দেখা……আর দেখার কিই বা আছে …বরং কাকাই যাক একবার…। ভাবত রঞ্জার কি অবস্থা , ওর মায়ের কি অবস্থা ? ” সত্যিই তো!!! সেতো এসবের মধ্যে ভুলেই গেছিল রঞ্জার কথা……তখনই সে নিজের ঘরে গিয়ে রঞ্জাকে ফোন করল ত্রিপুরার বাড়ীতে । কিন্তু কথা হল না রঞ্জার সাথে…ওর ভাই রাতুল জানাল দিদি অসুস্থ হয়ে পড়েছে …পরে কথা বলবে..সারাটা সন্ধ্যে চাঁদ বাধ্য মেয়ের মত সবার চোখের আড়ালে চুপ করে বসে রইল বারান্দায় …অন্ধকারে । রাত্রি তখন দশটা বাজে ……মা এসে বলল সৈকত ফোন করেছে ……চাঁদ যন্ত্রচালিতের মত ঘরে গিয়ে ফোন ধরল……
চন্দ্রিমাঃ হ্যালো
সৈকতঃ সব শেষ চন্দ্রিমা……আমি এই বাড়ী ফিরলাম ।
সৈকত আর কথা বলতে পারছিল না। তবু বলল “ কিছু হয়েছিল কি চাঁদ তোর সাথে…তুই কেন বললি ও তোকে ওর সামনে যেতে বারন করেছে……আমি কিছুটা জানতাম চাঁদ……ওর দ্বন্দ্ব , ওর ভাললাগা , খারাপলাগা…। কিন্তু কিছুদিন খুব চুপচাপ থাকছিল……। তোর সাথে শেষ কবে কথা হয়েছিল ?
চন্দ্রিমাঃ আমি পরে কথা বলব সৈকত…। আমি ভীষণ ক্লান্ত …. ভীষণ কনফিউসডও ,ওর
মত এত ভালো সুইমার সাঁতার কিকরে ভুলে গেল ভেবে পারছিনা ! রাখছি।
এই কদিন রোজ চাঁদ তার নিত্য দিনের কাজ সেরে গেছে রুটীন মাফিক…কাউকে বুঝতেই দেইনি তার অবস্থাটা কোন জায়গায় ……রাতে শুতে যায়…ঘুম আসে না…। চেয়ে থাকে নিমগাছের ফাঁক দিয়ে একফালি চাঁদের দিকে…রাত জাগা পাখির আওয়াজে চমকে ওঠে…..ফোনের কাছে যায় …।ডায়াল করে রেখে দেয়..। কিন্তু না কোনো উত্তর আসে না ওপার থেকে……রাত্রি বেলায় জানলার পাশে বসে থাকে যদি অশরীরী কিছু অনুভব করে……কিন্তু না কোনো ঠিকানা নেই আর সোহমকে খুঁজে পাবার।
এক সপ্তাহ বাদে ফোনটা রঞ্জাই করে…। চাঁদ ফোন ধরে। রঞ্জা খুব কান্নাকাটি করে । চাঁদকে জিগ্যেস করে “ তুই দেখেছিলি ওকে শেষবারের মত?”
চন্দ্রিমাঃ না রঞ্জাদি।
রঞ্জাঃ কেন? তোর ইচ্ছে করে নি?
চন্দ্রিমাঃ হুম করেছিল ……কিন্তু কি দেখতে যাব বল?
রঞ্জাঃ আচ্ছা কেন এমন হল বলতো ?
চন্দ্রিমাঃ সেটাই ত ভাবছি রঞ্জা দি!!
রঞ্জাঃ জানিস এর মাঝে আমার সাথে ওর ,ইন্দ্রর ফোন করা নিয়ে একটু সমস্যা
হয়েছিল । ও ভীষন আপসেট ছিল , বলেছিল আমি চাইলে ইন্দ্রর
সাথে সম্পর্কটা চালিয়ে যেতে পারি…। ওর কোনো আপত্তি নেই।
চন্দ্রিমাঃ তুমি কি বলেছিলে রঞ্জা দি?
রঞ্জাঃ আমি বলেছিলাম একটু ভেবে ওকে জানাব…। পুজোর পর বলব….ঘুরে
আসি বাড়ি থেকে।
চন্দ্রিমাঃ তুমি কি বলতে ওকে ?
রঞ্জাঃ আমি তো ইন্দ্রকে না-ই করে দিতে চেয়েছিলাম……যদিও বাড়ি থেকে
(চুপ করে গেল রঞ্জা)
আর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চাঁদ বলল “ তুমি কি ওকে কিছু জানিয়েছিলে”?
রঞ্জাঃ দশমীর সকালে আমি ফোন করেছিলাম ……একথা সেকথা……অনেক
কিছু বললাম …। ও চুপ করে শুনছিল…। যেই ইন্দ্র-এর ব্যাপারে কথা
বলতে গেলাম ……আমায় বলল যে ওর তাড়া নেই ……কলকাতাই
গেলেই এ ব্যাপারে কথা হবে……শুনতে চায়নি কথা।
রঞ্জা কাঁদতে লাগল…… কেন এমন হল বলতো?
চাঁদও কাঁদছিল নিঃশব্দে……তবু গলায় যথেষ্ট কাঠিন্য এনে বলল “ রঞ্জাদি তুমি আর অন্য কথা ভেব না……ইন্দ্রদাকে না কর না……তোমার সামনে একটা মস্ত জীবন পড়ে আছে ……আমি বলছি , সময় সব ভুলিয়ে দেবে……এভাবে নিজেকে কষ্ট দিও না……আমরা সবাই আছি তোমার সাথে।
রঞ্জা বলল……” তুই কি দিয়ে গড়া চাঁদ ……এত কিছুর পরও নিজেকে একটু ভাঙতে পারছিস না ……তোর জন্য কে থাকবে ভেবেছিস?
পুরো কান্নাটা গিলে ফেলে চাঁদ বলল “আমি ঠিক আছি রঞ্জা দি……তুমিও ভাল থেকো।”
কলেজ খুলল পুজোর ছুটির পর । সেই বাসস্টপ…সেই বাস…সেই জানলার ধারের সিট…। শুধু পাশে অন্য মানুষ……প্রকারান্তরে পাশটা আজ ফাঁকাই… আজ আর কোনো তাড়া নেই……কোনো ঘড়ি দেখা নেই……কোনো অপেক্ষাও নেই…। সেই রাস্তা……সেই দ্বিতীয় হুগলী সেতু…সেই কন্ডাক্টর …কিন্তু ভাড়া কাটা নিয়ে ঝগড়া নেই……বিড়লা স্টপেজে নেমে পরের বাস……নেই কোন ছোটাছুটি… তার সাথে অনর্গল কথা বলার কেউ নেই আজ……বড়ো দীর্ঘ পথ। তার চেয়েও দীর্ঘ সময় । হয়ত কোন অপেক্ষাই নেই …তবু যেন কিসের এক দায়……কোনো কমিটমেন্ট ছিল না কোনোদিনই , তবু যেন চাঁদ একা থাকার জন্য , ওমের স্মৃতির মুখাপেক্ষী হয়েই রয়ে গেল। এমনি করেই কলেজের ক্যান্টিন থেকে লেকের পাশে……জানলার বাইরে থেকে ঘরের ভিতরে… চোখ খোলা থেকে রাতে চোখ বন্ধ হওয়া অবধি সর্বত্রই শুধু ওম আর ওম। ও বেঁচে থাকলে হয়ত চাঁদ সব মানিয়ে নিত কিন্তু ওমের মৃত্যুতে আজও চাঁদ বেঁচে মরে রইল……এত বছর হয়ে গেছে……সেদিনের সেই উনিশের চাঁদ আজ তিরিশ পার করে দিয়েছে তবুও আজ প্রতিটি দন্ডপল অনুপল সে ওমেরই দোসর হয়ে রয়েছে। জীবনে কত মুহুর্ত এসেছে গেছে , সুখ দুঃখ হাসি কান্নার মধ্যেও সে তার ওমের সখ্যতাই বয়ে বেড়াচ্ছে…। সেদিনের পর থেকে জীবন চলেছে তার আপন ছন্দে…আর সে সব কিছু পেরিয়ে এসেছে তবু কোন সময়ের জন্য সে ভুলে থাকতে পারে নি তার অতীতকে……সোহমকে …ওমকে…… কন্টিনিউইটি আজও আছে চাঁদের বিষন্নতার মধ্যে…তার ব্যবহারিক জীবনের মধ্যে… তার একাকিত্বের মধ্যে……শূন্যতার মধ্যে ,আজও সোহম তার একমাত্র অবলম্বন হয়েই বেঁচে আছে । সেদিনের সেই প্রতিমা নিরঞ্জনের সাথে সাথেই চাঁদের সমস্ত স্নিগ্ধতার মাধুরীও বিসর্জন হয়ে গিয়েছিল ……তবুও আজ সে তার কলঙ্কের বোঝা একাই বয়ে চলেছে……পৃথিবী ঘুরছে ঘুরবে থিওরি অফ রিলেটিভিটি , জীবন চলছে চলবে……সেদিনও চাঁদ একা ছিল… আজও চাঁদ একা……সেদিনও ওম ছিল তার নির্দিষ্ট দুরত্বে কিন্তু…… হয়ত জোয়ার ভাঁটার অমোঘ কোনো টানে ওম এসেছিল তার কাছে …। সে তো মুহুর্তেরই কোলাজ মাত্র……।
বারান্দার আলোটা জ্বেলে দিল চাঁদের বাবা……বাবা আজও তার বন্ধু……মা সঙ্গ ছেড়ে গেছেন অনেকদিন…বাবা বললেন “একা একা কি করছিস অন্ধকারে ? …ভেতরে চল ……কাকাই ফোন করেছে , বিজয়ার শুভেচ্ছা জানাতে……চাঁদ চোখের জল মুছে বলল “তুমি ভেতরে যাও বাবা …আমি আসছি।”
……………………………………………………………………………………………………
( শেষ )
© Copyright 2014 @indrila, All rights Reserved. Written For: Oimookh